Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

পাহাড় আসলে সমুদ্রের ঢেউয়ের মত

সবুর শক্তপোক্ত পুরুষ। বয়স যখন পনের ষোল, তখন থেকে বাবার সাথে সমুদ্রে যাতায়াত। বছর চারেক সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে লড়ে শরীরে একটা শক্ত গাঁথুনি এসেছিলো তখন, সমুদ্র ছেড়ে পাহাড়ে এলে, দিনে দিনে সে গাঁথুনি শক্ত জমাট বাঁধে। রাতভর ফরেষ্টাফিসের চৌকিদারি, এই সময়টা সবুরের সবছেয়ে প্রিয় সময়। নিজের অতীত, চর সোহাগী। কি নির্মম ভাবে সমুদ্রের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে সে পাহাড়ে উঠে এলো, সেই সব সময় শুধু রাতেই জীবন্ত হয়ে উঠে সবুরের চোখে, মনে। দিনের অর্ধেক বেলাঅব্দি ঘুমিয়ে জেগে উঠে, দুপুরে খাবার খেতে খেতে, মেয়ে আর মনসুরার সাথে টুকটাক সাংসারিক কথা, কম বলে বেশী শুনতে শুনতে সূর্য্য পশ্চিমে অনেকটা নেমে এলে, নিত্যদিনের মত ফরেষ্টার আফজাল হোসেনের পিছু পিছু খিরাম বাজারে যায়। ফরাস মিয়ার হোটেলে গরম জিলাপি আর রুটি খেতে খেতে সন্ধ্যা নেমে এলে, দুই বোতল বাংলা মদ হাতে নিয়ে আবার মিয়াসাব আফজাল হোসেনের পিছু পিছু ফরেষ্টাফিসে ফিরে আসে। মিয়াসাব অর্ধেক বোতল গিলে অনেকটা নিস্তেজ হয়ে এলে, গাছ চোরদের মা মাসি তুলে গালাগাল করতে করতে নিজের কামরায় ফিরে গেলে, বাকী মদ সবুর ও কখনো বন প্রহরী কবির বক্স কখনো প্রদীপ ধর মিলে গিলে নেয়। মদটুকু গলায় পড়লেই সবুর নিশ্চিত হয়ে বাকী রাত চৌকিদারির ইন্তেজাম করে।

এশার নামাজ পড়ে, কচু অথবা কোরমা, মনসুরা যাই রাঁধুক, দু'থালা ভাত খেয়ে, প্রত্যহের মত আজও ঘর থেকে বেরিয়ে সবুরের মনে হলো, দীর্ঘদিন নির্বাসিত থাকার পর নিজ রাজ্যে ফিরে এসেছে সে। এবং এ রাজ্যের অধিপতি সবুর নিজে। পৌষের শীত থেকে বাঁচতে, হাতে পায়ে মোজা, দুইটা স্যুয়েটারের উপর ফুলতোলা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে, কানটুপি মাথায়, এক হাতে টর্চ অন্য হাতে সেগুন কাঠের লাঠি নিয়ে কুয়াশা গলে, সর্তা অথবা সরতা খালের পাড় ধরে পূর্ব দিকে এগুতে থাকে সবুর। সর্তার ওপাড়ে সারি সারি সেগুন গাছ গায়ে গেঁথে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের গায়ে, তিন ব্যাটারি টর্চের আলো ফেলে দেখে নেয় সন্দেহ জনক কিছু আছে কিনা। মাঝে মাঝে জোর গলায় হাঁক ছাড়ে- খবরদার হুশিয়ার। সবুরের হাঁক প্রায় জলশূণ্য সর্তার উপর দিয়ে বাতাসে ঢেউ খেলে খেলে পাহাড়ের গভীরে মিলিয়ে যাবার বদলে পাহাড়ে বাধা খেয়ে অনেকগুলো সবুরের কন্ঠ ফিরে আসে সবুরের কাছেই। যেনো পাহাড়ের আড়াল থেকে আরেকজন সবুর হাঁক দিয়ে বলছে- খবরদার হুশিয়ার। যেখানে সর্তা পূর্ব থেকে উত্তরে বাঁক নিয়েছে সেখানে সবুরও দিক বদলায় সর্তার সাথে। একটূ এগিয়ে শনের চাউনি দেয়া, চারপাশ খোলা, সবুর তার মসনদ- চৌকিতে উঠে বসার আগে, পা ছোঁয়া দূরত্বে, শীতের শুরু থেকে প্রতি রাতে জ্বলতে জ্বলতে প্রায়শেষ, শুকনো গামারী গাছটায় আগুন ধরিয়ে দেয়।। সর্তা এই ফাঁকে আরকটু উত্তরে গিয়ে, আর্মি ক্যাম্পটা বাঁয়ে রেখে আবার পূর্বদিকে বাঁক নিয়ে, দু'পাশে পাহাড় সংঙ্গী করে উপরে উঠে গেছে।

রাত বাড়ার সাথে সাথে, সর্তার গা গেঁষে থাকা খিরাম ফরেষ্টাফিসের আলোগুলো একটা একটা করে নিভে যায়। গত বছর ঝড়ে ভেঙ্গে পড়া শতশত গাছ টুকরো টুকরো হয়ে, স্তুপ হয়ে আছে ফরেষ্টাফিসের আনাচে কানাচে। কুয়াশা ধীরে ধীরে টুপটাপ বৃষ্টি ফোটার মত ঝরতে থাকলে, টুকরো গাছগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে সন্দেহ হলে, সবুর কিছুটা জড়নো কন্ঠে হাঁক ছাড়ে- হুশিয়ার সাবধান, ইবা কন? তারপর একবুক শূণ্যতা নিয়ে বয়ে চলা সর্তার ওপারে চোখ ফেলে বসে থাকে সবুর। বর্ষায়, পাহাড়ী ঢলে কাল নাগিনীর মত ফোঁস ফোঁস করে বয়ে চলা, এই পৌষে, জলশূণ্য সর্তার শূণ্যতা সবুরকে ছুঁতে পারেনা। বরং ওপাড়ের পাহাড় তার দৃষ্টির পথ ধরে মনে এসে বসে থাকে। খুব ছোটবেলায় সবুর একবার বাবাকে জিগ্যেস করেছিলো- আব্বা পাআড় দেকতে কেরিন্না? সালাম মাঝি মূলত সমুদ্রের মানুষ হলেও পাহাড় দেখেছিলেন স্বচক্ষে। তিনি ছেলেকে বলেছিলেন- পাআড় দেকতে খেরের হারার মতন। হারা যেরিন্না নীচের দিকে মোডা অই আস্তে আস্তে উপরের দিকে চিউন অই গেছে, পাআড়ও এরিন্না। তয় পাআড়ের হারা গাত গাছ আর জংলায় ভরা।

 

 কিন্তু প্রথম পাহাড় দেখে সবুরের মনে হয়েছিলো, পাহাড় আসলে সমুদ্রের ঢেউয়ের মত। সত্তরের ঘুর্ণিঝড়ে পাহাড়ের মত সমুদ্রের ঢেউ মাথার উপর আঁচড়ে পড়লে, বাতাসের নিষ্ঠুর চাবুকে ঘরবাড়ি গাছপালা খড়কুটোর মত উড়ে গেলে, পরদিন চর সোহাগীতে পা ফেলার জায়গা ছিলনা। ধর্ষিতা নারীর মত লন্ডবন্ড চর সোহাগীর বুকে পড়েছিলো লাশের পর লাশ। পুরো চর খুঁজে বড় তিন ভাই সদরুল, সরাফত আর সফিকুলের লাশ পেলেও বড় আর মেজো দুই ভাবি, মা বাবা কাউকেই পায়নি সবুর। তার এক সপ্তাহ পর, খিরাম ফরেষ্টাফিসের চৌকিদার, কালাম চাচার হাত ধরে চিরদিনের মত চর সোহাগী ছেড়ে আসে সবুর। আসার পথে, সন্ধ্যা নেমে এলে নানুপুর থেকে খিরিম আসার সময় পথের দু'ধারের পাহাড়সারি দেখে সবুর নিশ্চিত হয়েছিলো, পাহাড় আসলে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতই।

সবুরের ভুল ভাঙ্গে পাহাড়ে উঠার পর। প্রথম পাহাড়ে উঠে সবুরের মনে হয়েছিলো, পাহাড় আসলে মেয়েদের স্তনের মত। সত্তরের সেই মরণঝড়ে, বিমল মাঝির মেয়ে মমতা, যার সাথে আড়ালে আবডালে চোখাচোখিতে, মাঝে মাঝে মনে মনে বিস্তর কথা হতো সবুরের, তার বস্ত্রহীন অসাড় দেহ চিৎ হয়ে পড়ে থাকলে, স্তন দুটি আকাশমুখি হয়ে গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে ভিজতে থাকলে, যাকে খুঁজে পেয়েছিলো সবুর। আরো কয়েকটা পাহাড়ে উঠে সবুর নিশ্চিত হয়- পাহাড় দেখতে আসলে মমতার স্তনের মত।

ফরেষ্টাফিসে ডুকার পথে আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে বিশাল চাপালিশ গাছটার তলায় পাহারারত কালা আর লালা ঘেউ ঘেউ করে উঠলে, সবুরের মন থেকে দৃষ্টি গলে পাহাড় বের হয়ে, টুপ করে সর্তার ওপাড়ে গিয়ে বসে পড়ে। সবুর হাঁক ছাড়ে- হুশিয়ার খবরদার। সত্তর থেকে বিরান্নব্বই প্রায় দুই দশকের চেষ্টার পরও ভুল উচ্চারণে বলে- ইবা কন জাদ্দে। টর্চের আলো ঘুরিয়ে পুরো অফিসটা একবার দেখে নেয়। কিন্তু কুকুর দুইটার ঘেউ ঘেউ বন্ধ হয়নি দেখে, সবুর উঠে গিয়ে এক পাক ঘুরে আসে। ফরেষ্টাফিসের কোল ঘেঁষে থাকা বাড়িতে গিয়ে মেয়ে শরীফাকে ডেকে তুলে এক খিলি পান মুখে দিয়ে, ফিরে এসে চৌকিতে বসে।  

কালাম চাচা বেঁচে থাকতে মাঝে মাঝে চাচার বদলি হিসেবে চৌকিতে বসত সবুর। চাচা মারা যাবার পর এই চৌকির চৌকিদার এখন সে। পৌষের শীতের রাতে চৌকিতে বসে সবুরের আফসুস হয়। বর্ষায় যদি ভয়ংকর সর্তার জলে গরুটা ভেসে না যেত, গরু বাঁচাতে যদি উম্মাদ সর্তার বুকে তমিজ ঝাপিয়ে না পড়ত, জোয়ান হয়ে উঠা পোলাটা সর্তায় ভেসে না যেত, তাহলে পোলাটারে এই চৌকিতে বসিয়ে মরতে পারলে সবুরের মরণটা সুখের মরণ হতো। তারও আগে একটা মেয়ে মরেছিলো ম্যালেরিয়ায়। থাকার মধ্যে এখন কেবল মেয়ে শরীফা আর স্ত্রী মনসুরা। সত্তরে চর সোহাগীর সবকিছু হঠাৎ সবুরের কাছে নাই হয়ে গেলে, বিশ বছর বয়সী সবুর খিরাম এসে বুঝেছিলো এই বিশাল পৃথিবীতে সে একা। পৌষের সর্তার শূণ্য বুকের মত শূণ্যতা যখন সবুরকে প্রায় পাহাড়চারী করে তুলছিলো, তখন কালাম চৌকিদার ভাতিজা সবুরকে বিয়ে করিয়ে দেন মনসুরার সাথে। পিতাহারা মনসুরা তখন মাত্র ফরেষ্টাফিসের রসুই ঘরের দায়িত্বটা মা'র কাছ থেকে বুঝে নিয়েছে। দিনে দিনে দুই দশক হয়ে গেলো, মেয়ে শরীফার বিয়েরও মৃদু আলাপ আলোচনা শুরু হয়েছে। সবাই যখন একে একে মরছে তখনও নিষ্ঠুর ভাবে কি করে সবুর বেঁচে থাকে, সবুর ভেবে পায়না। মেয়ে শরীফা আর মনসুরাও একদিন তাকে ছেড়ে ওপারে যাবে, এ সে অবধারিত ধরে বসে আছে।

 

 এই রকম শীতের দিনে, কি জমজমাট সন্ধ্যা নামত সবুরদের ঘরে, চর সোহাগীতে। সারাদিন খাটুনি শেষে চার ভাই আর বাবা সালাম মাঝি ঘরে ফিরে এলে, মা ওজিফা খাতুন সরষে তেলে মুড়ি মেখে দিয়ে, পাশে বসে রসুন কোষের খোসা চাড়িয়ে কখনো ছেলেদের কখনো স্বামির হাতে তুলে দিতেন। সেই সব কথা ভাবতে ভাবতে, ভাবনা গভীর হতে থাকলে, সবুরের চোখ বেয়ে জল পড়তে থাকে। পাহাড়ের দিকে শূণ্য দৃষ্টি ফেলে জল শুকোতে চাইলে বুকের ভিতর কষ্ট, সর্তার বাঁকে বর্ষার জলের মতো মোচোড় দিয়ে বইতে থাকে।সবুর আরো গভীর ভাবে নিজের ভিতর ডুবে গেলে, স্মৃতি সাঁতরাতে সাঁতরাতে ক্লান্ত হয় এলে, দুই চোখে ঘুম নেমে আসে। চৌকিতে কাত হয়ে শুয়ে, সবুর ঘুমের আরো গভীরে ডুবতে থাকলে, রাত তার অর্ধেক বয়স পেরিয়ে, শীতে কাঁপতে কাঁপতে, কুয়াশায় ভিজতে ভিজতে, কালের গর্তে ধীরে ধীরে বিলীন হতে থাকে।

ফরেষ্টাফিসের শান্ত, নিশ্চুপ, তীব্র শীতে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে থাকা রাত, হঠাৎ ধেয়ে আসা বিক্ষুব্ধ ভিমরুলের মত গুলির শব্দে ধড়পড় করে উঠে বসে। সবুরেরও ভাবনাঘুম ভেঙ্গে যায়। ফরস্টাফিসের বাঁশ কাঠের ঘরগুলো থেকে চিৎকার কানে এলে, সবুর বুঝতে পারে কি ঘটে চলছে। চারদিকে গুলির মধ্যেই সবুর যতক্ষণে মিয়াসাবের ঘরের সামনে আসে, ততক্ষনে চারজন লোক মিয়াসাবের শরীরে বন্দুক তাক করে ঠেলতে ঠেলতে সবুরকে পাশ কাটিয়ে সর্তার দিকে এগিয়ে যায়। সবুর দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়ালে, একজন বন্দুক দিয়ে মাথায় আঘাত করে, সবুর কাত হয়ে পড়ে পথে। কতক্ষণ পর সবুররে হুশ ফিরলো ঠিক অনুমান করতে পারলনা সে।

উঠে ফরেষ্টাফিস ঘুরে, চারটি লাশ, পাঁচটি গুলিবিদ্ধ খাবি খাওয়া মানুষ, আর জীবিত মানুষগুলোর আহাজারী শুনে সবুরের হঠাৎ মনে হলো মনসুরা আর শরীফা কোথাও নেই। সে ভাবে, মাটির দেয়াল ভেদ করে, গুলি, চিৎকার, মনসুরা আর শরীফার কানে যায়নি। জেগে উঠলে এতক্ষণে তারা পাগলের মত ছুটে আসত সবুরের খোঁজে। সবুর ঘরের দিকে পা বাড়ায়। উঠোনে এসে দরজা খোলা দেখে, সবুর আর নড়তে পারেনা। টর্চের আলো কাঁপতে কাঁপতে দরজায় পড়লে, ঘর থেকে গড়িয়ে আসা রক্তে টর্চের আলো পড়লে, সবুরের শরীরের রক্ত জমে যায়। উঠোনে জুবুথুবু হয়ে বসে পড়ে, কিছুতেই আর উঠোন পেরিয়ে ঘরে পৌছতে পারেনা। দু'পা ফেলে ঘরে পৌছানো পথটুকু সহস্র মাইল লম্বা মনে হয় সবুরের। যতক্ষণে ক্যাম্প থেকে আর্মিরা এসে মনসুরা আর শরীফার লাশ দুটো উঠোনে বের করে আনে, ততক্ষণ সবুর উঠোনে বসে ছিলো। লাশ দেখে সে সর্তার দিকে দৌড় দিকে দেয়, যে দিকে "শান্তি বাহিনী" চলে গেছে, সে দিকে দৌড়াতে থাকে আর বলতে থাকে- ও "শান্তি বাহিনী" ভাইরা আঁরেও গুলি করি যান, আন্নেগ আল্লার দোয়াই, আঁরেও মারি থুই যান।

১ Likes ১৩ Comments ০ Share ৮৭৯ Views

Comments (13)

  • - মাহাফুজুর রহমান কনক

    বাচ্চা ভয়ংকর কাচ্ছা ভয়ংকর

     

    চাইলেই বাচ্ছা হতে পারবেন?

    - নীল সাধু

    কনক নামতো খুবই বাবু বাবু শোনায় মাহফুজ

     

    শুভেচ্ছা আনমনা

    • - নীল সাধু

      বল এই ফাঁকে শুনে ফেলি

    • Load more relies...
    - আনমনা

     

     

    এই একটা জিনিস চাইলেই হতে পারা যায় কিন্তু, শুধু ইচ্ছে লাগে  সবার ভেতরেই কিন্তু একটা বাচ্চা থাকে, শুধু থাকে জাগাতে হয় 

     

    বুড়ো হয়ে মরে যাবার থেকে থেকে বাচ্চা হয়ে ভয়ংকর হওয়া ভালো না? 

    Load more comments...