জেসাস! প্লিজ, আমার বোনকে ভালো করে দাও। আমি আর কখনও ছবি আঁকব না। তুমি কেবল আমার বোনকে ভালো করে দাও। হাঁটু গেড়ে চার্চে যিশুর মূর্তির সামনে বসে ছিল ছেলেটি। বাড়িতে সবাই তার ছোট বোনকে নিয়ে ব্যস্ত। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবচাইতে আদরের ছোটবোন কনসিটা। ওরই অসুখ। কোন ডাক্তারই কিছু করতে পারছে না। তের বছরের বড়ভাই তাই ছুটে এসেছে চার্চে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। বাঁচান গেল না পরিবারের একমাত্র আদরের মেয়েটিকে। তের বছরের ছেলেটির হাত থেকে তুলির রং কেড়ে নিতে স্বয়ং ঈশ্বরও বোধহয় চাননি। ছেলের প্রার্থনা শুনে খানিকটা থমকেই গিয়েছিলেন বুঝি বাবা। হাঁপ ছাড়লেন তিনিও। তুলে দিলেন নিজের সমস্ত তুলি আর রং একরত্তি ছেলেটির হাতে। মন দিয়ে এবার আঁকতে শুরু করল সে।
শিল্পী বাবার প্রথম সন্তান। ছেলেটাকে ঘিরে সবার আনন্দটা বুঝি একটু বেশিই ছিল। নামের বাহার দেখলেই অবশ্য সেটা আন্দাজ করা যায়-- পাবলো দিয়েগো হোসে ফ্রান্সিসকো দে পাউলা হুয়ান নেপোমুচেনো মারিয়া দে লোস রেমেদিয়োস ক্রিসপিনিয়ানো দে লা সান্তিসিমা ত্রিনিদাদ রুইস পিকাসো! ঠিক যেন বার হাত কাঁকুড়ের তের হাত বিচি! ডাকনাম পাবলিয়েতো। ১৮৮১ সালের ২৫ অক্টোবর মালাগার স্প্যানিশ শহরে জন্ম হয় পাবলিয়েতোর। ওর খুব পছন্দের খাবার ছিল চারোস, লাঠির মতন দেখতে এক ধরনের মিষ্টি। তখন ও খুব ছোট। একদিন ওর চারোস খেতে খুব ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কী করবে বেচারা, ও তো তখনও কথাই বলতে পারে না! শেষমেশ অনেক কান্নাকাটি করে ছেলেটি বসে গেল খাতা-পেন্সিল নিয়ে। চারোসের ছবি এঁকে দেখাল বাবাকে। বাবা খানিকটা অবাক হলেও, মা কিন্তু একদমই চমকালেন না। অনেক বড় স্বপ্ন ছিল তার ছেলেকে ঘিরে। আর্মি হোক বা চার্চ-- যেখানেই যাক, ছেলে তার খুব বড় কিছু একটা হবেই। মায়ের মনের কথা শেষতক মিথ্যেও হয়নি।
ছোটবেলা থেকেই পাবলিয়েতোর ছবি আঁকার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল। ভালোও বাসত ছেলেটা আঁকতে। আর যতটা সে আঁকতে পছন্দ করত, তার চাইতে বেশি অপছন্দ করত স্কুলে যেতে। প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিন ছেলের সে কী কান্না! ভয় হচ্ছিল তার, বাবা যদি আর নিতে না আসে! শেষমেশ ঠিক হল, বাবার টুপি, লাঠি, তুলি-- যে কোনো একটা জিনিস রেখে যেতে হবে পাবলিয়েতোর কাছে। তবেই সে স্কুলে যাবে, ক্লাসে বসে থাকবে।
কিছুদিন বাদে তাতেও আর পোষাল না পাবলিয়েতোর। কোনো ক্লাসেই যে পড়া শিখে যায় না সে! আর তার শাস্তি হিসেবে রোজ তাকে অন্য একটা ঘরে পাঠিয়ে দেন টিচার। সেখানে একা একা কী করে সময় কাটবে তার? ছবি আঁকলেই তো সময় কেটে যায়। বলা হল বাসা থেকে। পরদিন থেকে কেবল পাবলো নয়, একটা আস্ত পোষা কবুতরসহ আয়াও গেল স্কুলে, পাবলিয়েতোর পিছুপিছু। আরও বেশি ক্লাসে অমনোযোগী হয়ে গেল সে। ইচ্ছে করেই পড়া শিখত না আর, যাতে বেশি করে শাস্তি দেওয়া হয়, আর আরও বেশি করে ছবি আঁকতে পারে সে। স্কুলের পাশেই ছিল চাচার বাসা। ভালো না লাগলেই সংকেত দিত চাচাকে। চাচাও সাহায্য করত পাবলিয়েতোকে। তবে এভাবে আর বেশিদিন চলল না। বাসা বদলালেন পাবলিয়েতোর বাবা ডন রুইস। সপরিবারে চলে গেলেন করুনাতে।
নতুন স্কুলে পড়াশোনার চাপ ছিল বেশি। এমনিতেই তো পড়াশোনা পাবলিয়েতোর খুবই অপছন্দের বিষয়। বিশেষ করে গণিত। ওর একদমই ভালো লাগত না অংক কষতে। শেষে এক উপায় বের করল সে নিজেই। অংকের শব্দগুলোকে মিশিয়ে নিল নিজের ভালোবাসার বিষয় ছবি আঁকার সঙ্গে। প্রথমে একটা ০, তারপর একটা ৬, সবশেষে ৩। ব্যস, হয়ে গেল আস্ত একটা কবুতর! এভাবেই গণিতকে নিজের ভালো লাগার সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছিল ছোট্ট ছেলেটি।
বাবা এতদিন ছেলের ছবি আঁকার অভ্যাস খেয়াল করলেও, তেমন একটা গা করেননি। এবার গা করলেন। ছবি আঁকার প্রতি ছেলের আগ্রহ দেখে নিজেই শুরু করলেন শেখাতে। অবশ্য পাবলিয়েতোর আঁকাআঁকি কখনও খারাপ ছিল না। প্রথম যে ছবিটা সে এঁকেছিল, সেটিও যে সে ছবি ছিল না। তাতে সে এঁকেছিল লাইটহাউজসহ মালাগা বন্দর। আর এবার বাবা শুরু করলেন হাতে-কলমে শেখাতে। মন মতো না হওয়া পর্যন্ত ঘণ্টার পর ঘণ্টা মৃত কবুতরের পা আঁকতে হত পাবলিয়েতোকে। মেয়ে কনসিটারের মৃত্যু যেন আরও শক্ত আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞ করে তুলল বাবা-ছেলেকে। করুনা ছাড়ার আগেই রুইজ আয়োজন করলেন ছেলের ছবির প্রথম প্রদর্শনী। বিক্রিবাট্টা অবশ্য তেমন হয়নি, কিন্তু ১৪ বছরেই একটা আস্ত ছবির প্রদর্শনী করে ফেলাটাও-বা মন্দ কী!
বাকিটুকু ইতিহাস। ছবিপাগল পাবলিয়েতো শেষ পর্যন্ত হয়ে গেলেন পাবলো পিকাসো; নামের মাঝের বিশাল অংশটুকু বাদ পড়ে গেল। আর ছবি-আঁকিয়ে হিসেবে হয়ে গেলেন কিংবদন্তি। তার আঁকা সব ছবিই এখন দুর্মূল্য। তবে তার ছবিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছবিটি হচ্ছে ‘গোয়ের্নিকা’।
সাদিয়া ইসলাম বৃষ্টি
Comments (7)
কবিতায় ভাললাগা মাসুম ভাই।
ভাল থাকবেন।
শুভকামনা জানবেন !!!
হুম। পতিদেব শুধু দেহটাই ভোগ করে কিন্তু নন্দিনীর মনটা বোঝে না। যে বুঝতো, সেই তাপস চলে গেছে বহু দূরে। ভালো লাগলো কবিতা মাসুম ভাই।
অনেক অনেক শুভকামনা !!!
আহা! নন্দিনী
শুভেচ্ছা...