Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

নাজনীন পলি

১০ বছর আগে

পাপ

                                     গল্প: পাপ

                               লেখক : নাজনীন পলি

 

এক

তুষার ভীষণ ক্লান্ত ।

প্রতিদিন এই সময়টা তার শরীর ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়তে চায় । সবার অফিস ছুটি হলেও তারই শুধু কাজ বাকি থাকে । আজ সবার প্রস্থান দেখতে দেখতে সে তার ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কথা ভাবতে থাকে । পৃথিবীতে এই একটি মাত্র চাকরিই ছিল আমার ভাগ্যে। হায়রে ! নিজের পকেটে ফুটো কড়িটা নেই অথচ সারাদিন বসে বসে লাখ লাখ টাকার হিসাব কর । ৯ টা – ৫ টা অফিস হলেও তুষার কোন দিনই অফিস থেকে ৭টার আগে বের হতে পারে না । এরপর বাসের লাইন ধর , বাসে ভিড়ে গরমে সিদ্ধ হও  তারপর কতগুলো সিগন্যাল ও জ্যাম পেরিয়ে বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে ৯টা সাড়ে ৯ টাতো  বাজবেই ।ছেলেটা ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ে । একটা মাত্র ছেলে, তার সাথেও একটু কথা বলা হয়না । আর বউয়ের সাথে আদর সোহাগের কথাতো বাদই দিলাম । কোন মেম সাহেব বউ হলে কবে আমার সংসারে লাথি মেরে অন্যের হাত ধরে চলে যেত ।

হঠাৎ তুষারের অফিসের বস পারভেজ চৌধুরির গলা শুনে তুষার একেবারে হকচকিয়ে যায় । যেন স্যার মনে মনে বলা সব কথা শুনেছেন ।

-        কি তুষার সাহেব , আপনার হিসাবের কাজ এখনও শেষ হয়নি ?

-        জী স্যার , অল্প বাকি আছে; এক দেড় ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে ।

-        আচ্ছা , আপনি বরং কাল এসে বাকি কাজটা শেষ করেন। আজ আপনার ছুটি । 

-        ঠিক আছে স্যার ।

-        আমিও বুঝি তুষার সাহেব , ঘরে বউ বাচ্চা আছে তাদেরকেও  তো একটু সময় দিতে হবে । এই বলতে বলতে পারভেজ চৌধুরির তুষারের পকেটে কতগুলো নোট ঢুকিয়ে দেন । টাকাগুলো রাখেন আপনার ছেলের জন্য মৌসুমি ফল কিনে নিবেন ।

তুষার অফিস থেকে বের হওয়ার সময় খেয়ালই করল না যে ফ্রন্ট দেক্স অফিসার মেঘলা নিরবে অশ্রু বিসর্জন করছে ।

 

 

দুই

রেমি পারভেজের স্ত্রী অনেকক্ষণ পাইচারি করছেন । মেয়েকে বার বার ফোন দিচ্ছেন আর নারী কণ্ঠের একঘেয়ে সংলাপ শুনছেন এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না .........। মেয়েটা স্কুলে গিয়েছে সেই সকাল নটায় আর এখন বাজে রাত দশটা , এখনো বাসায় ফেরেনি আবার ড্রাইভারকেও ছেড়ে দিয়েছে । খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে কোথায় যে গেলো ।

রেমি আজ তিন মাস পর বাড়ি ফিরল । স্বামীর সাথে ঝগড়া করে বাবার বাড়ি চট্টগ্রাম চলে গিয়েছিল, ঝগড়ার কারন পারভেজের ইউনিভার্সিটি লাইফের প্রেমিকা নন্দিনীকে নিয়ে । রেমি প্রমান পেয়েছে নন্দিনীর সাথে পারভেজের এখনো সম্পর্ক আছে । এ কদিনে না বাপ না মেয়ে কেউই একবার ও ফোন করেনি বরং রেমির এখন মনে হচ্ছে ও চলে যাওয়াতে পারভেজের সুবিধাই হয়েছে । এর আগে যতবার বাবার বাড়ি চলে গিয়েছে পারভেজ রাগ ভাঙ্গিয়ে নিজে গিয়ে নিয়ে এসেছে । এবারই ব্যতিক্রম হল । রেমির মনে সঙ্কা জাগে তবে কি পারভেজের কাছে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে । রেমি কিছুতেই তার সাজানো সংসার এভাবে ছেড়ে চলে যাবে না । এ তিন মাস এখানে না থেকে সে খুবই ভুল করেছে বলে তার মনে হচ্ছে ।  

রেমি পারভেজের বিশ বছরের সংসার । এইতো সেদিন বিশাল জাঁকজমকপূর্ণ  পার্টি হল তাদের বিশতম বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে । তাদের দুই মেয়ে বিভা ও রুভা । বিভার সাথে রেমির সেই ছোট বেলা থেকেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক । বিভা মায়ের সাথে সব কিছু শেয়ার করে। বিভা অস্ত্রলিয়া পড়তে যাওয়াতে রেমি খুব একলা হয়ে গেছে । ছোট মেয়ে রুভা কখনই মাকে মনের কথা জানায় না, তার যত কথা বাবার সাথে এখন পারভেজ তার ব্যবসা নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকে মেয়ের সাথে সময় কাটানোর সময় কোথায় তার ।

রেমি কি করবে ভেবে পাচ্ছে না ; পারভেজকে কি ফোন দেবে ? পারভেজ কে ফোন দিতে আত্মসম্মানে লাগছে । রাগ করে চলে যেয়ে আবার ফিরে এসেছে আবার ফোনটা ও কি আগে করবে? তারচেয়ে বরং ড্রাইভারকে বলবে ফোন করতে ।

 

তিন

পারভেজের ফোন এখন বন্ধ; সে মেঘলার সাথে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ডিল করছে । মেঘলার বাবা অসুস্থ ; পারভেজ তাকে বাবার ডাক্তার দেখানো থেকে শুরু করে সুস্থ হতে যত টাকা লাগবে তার সব দেবে । মেঘলার খুশি হওয়ার কথা কিন্তু সে কাঁদছে ।

 পারভেজ মেঘলার জন্য নীল রঙের শিফনের শাড়ি কিনেছে সাথে আনুসঙ্গিক জিনিস । মেঘলাকে পারভেজ শারিটা পড়তে বলল। চোখ মুছে ওয়াস রুমের দিকে পা বাড়ালে পারভেজ বলল , আমার সামনেই পর ; আমি নয়ন ভরে দেখব তুমি শারি পরে কতটা সুন্দর আর না পরেই বা কতটা ।

১৮ বছরের মেঘলা তার জীবনটাকে বাবার চিকিৎসা ও ছোট ভাই বোনের খরচ জোগাতে মেঘে ঢেকে দিতে রাজী হয়ে গেলো । আর পারভেজের একবার ও  মনে পড়লো না ঠিক ১৮ বছর বয়সের তার ও একটা মেয়ে আছে ।

পৃথিবীতে ভ্রমর টাইপের কিছু পুরুষের পাশাপাশি মনুষ্যত্ব বিশিষ্ট পুরুষ ও আছে তেমনি একজন তুষার । সে আজ সিএনজি ভাড়া করে বাসায় এসেছে । তার ছেলে  বাবার পাশে বসে প্রিয় আম দুধ দিয়ে ভাত খেয়েছে । তুষারের বউ ময়ূরীর চুল ময়ূরের পেখমের থেকেও সুন্দর অন্তত তুষার তাই মনে করে । সেই সুন্দর চুল খুলে ময়ূরী বসে আছে , জানালা দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদের আলো এসে পড়েছে তার মুখে ; তুষারের মনে হচ্ছে এর চেয়ে অপরূপ মুহূর্ত, এরচেয়ে সুখের পৃথিবীতে আর কিছুই হতে পারে না ।

চার

রুভার মন ভীষণ খারাপ । সাগরের সাথে ছয় মাসের প্রেমের ইতি ঘটলো আজ । সাগর কিভাবে পারল ওকে এভাবে ইউজ করতে! নিজের কষ্টের কথা বলতে পারে এমন কেউই নাই ওর। এতো বড় পৃথিবীতে কেউ নেই ভাবতেই নিজেকে ধ্বংস করে দেওয়ার জেদ চাপে । ক্লাসের উচ্ছিঙ্খল কিছু ছেলে মেয়ের সাথে ভাব হয়েছে রুভার , তাদের সাথে সে আজ নাইট ক্লাবে এসেছে । রুভা বুঝতে পারছেনা এখন কয়টা বাজে , মোবাইল বন্ধ হয়ে আছে সম্ভবত চার্জ নেই । নেশার ঘোরে কাকে যেন বলল আমাকে বাসায় পৌঁছে দেবে ।

আজ থেকে ছয় সাত মাস আগের ঘটনা রুভা গিয়েছিল তার দূর সম্পর্কের খালাতো বোন নিপার বাসায় , সেদিন ছিল ছুটির দিন । নিপা প্রেগন্যান্ট বলে বাবার বাড়ি গিয়েছে রুভার জানা ছিল না । বাসায় নিপার স্বামী সাগর একা ছিল । ১৫ বছরের রুভা সেদিন সাগরের সাথে অনেক সময় কাটায় । সে বুঝতে পারে না কেন সাগরকে তার এতো ভাল লাগছে । বয়সন্ধির এই সময়টা খুবই ভয়ঙ্কর ; শরীরের পরিবর্তন ও শরীর নিয়ে একধরনের কৌতূহল যে কারো জীবনে বিপদ ডেকে আনতে পারে । এজন্য প্রয়োজন পরিবারের সহযোগিতা, আগে থেকে সতর্ক করে দেয়া । রুভাকে কেউই সতর্ক করে দেয়নি । রুভার অজ্ঞানতা, অনভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে সাগর দিনের পর দিন রুভাকে প্রেমের নামে প্রতারিত করেছে ।

নিপা সাগরের সাথে রুভাদের ফ্যামিলির সম্পর্ক খুবই ভাল । এ বাড়ির ছোট বড় সব ধরনের অনুষ্ঠানে তারা নিমন্ত্রিত থাকে । পারভেজ রেমির যখনই ঝগড়া হয়েছে রেমির মান ভাঙ্গাতে পারভেজ নিপা সাগরের সাহায্য নিয়েছে ।কারন সাগর অনেক গুছিয়ে কথা বলতে পারে । সাগরের একসময় অর্থের সমস্যা ছিল সে সময়ে পারভেজই তাকে তার অফিসে চাকরি দিয়েছে ।

পাঁচ

এখন সাড়ে দশটা বাজে ।

পারভেজ ফোন ওপেন করতেই রেমির কল । পারভেজ অবাক হয় রেমির রাগতো কমার কথা না , সে এত সহজে তাকে ক্ষমা করবে না এটা পারভেজ ভাল করেই জানে । এ তিন মাসে নিজের পক্ষে কি সাফায় গাইবে বুঝে উঠতে না পেরে রেমির সাথে যোগাযোগই করেনি । রেমি কি তবে এত রাতে  ডিভোর্স চাওয়ার জন্য ফোন করছে ? ফোনটা কেটে যেয়ে আবার বাজছে । রিছিভ করতেই রেমির কান্না জড়ানো কণ্ঠ । রেমি যা বলল তার সারমর্ম হল আজ সে বাসায় ফিরেছে , এসে দেখে রুভা বাসায় নেই এবং ড্রাইভারকে সকাল বেলায় ছেড়ে দিয়েছে ।

এখন রাত বারটা ।

ঘড়িতে ঢং ঢং আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । রেমি পারভেজের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছে আর পারভেজ রেমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে , রেমি শেষ কবে পারভেজের কাঁধে মাথা রেখেছিল এটা পারভেজ বা কেউই হয়তো মনে করতে পারবে না ।ডোরবেল বাজার শব্দে দুজনই উঠে দাঁড়াল । দরজায়  রুভাকে ধরে পারভেজের এক পুরানো বন্ধু , পারভেজ রেমিকে অনেক কথা শোনাল ।

-        কি পারভেজ , মেয়ের খোঁজ খবর কিছু রাখ ? নাইট ক্লাবে মাতাল হয়ে পড়েছিল ; আমি চিনতে পেরে নিয়ে আসলাম ।

-        অনেক ধন্যবাদ , ভিতরে আসো ।

-        না , আজ আর না অন্যদিন । তোমার মেয়েকে দেখে আমার আর নেশা করতে ইচ্ছে হল না আজ । এই বয়সি মেয়ে নেশা করে ! মেয়েকে দেখে শুনে রেখ ।

পারভেজ রেমি দুজনই মেয়ের বিছানার পাশে বসে আছে । পারভেজকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে । রুভা আর একটু দেরি করলে পারভেজের হয়তো হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত । রুভা ঘরে ফেরেনি শুনে বাসার আশেপাশে , স্কুলের আশেপাশে অনেকক্ষণ খুঁজেছে সেই সাথে ফোন দিয়েছে সব আত্মীয় বন্ধুদের বাসায় । এমনকি সাগরকেও ফোন দিয়েছে । সাগর বলেইনি রুভা তার বাসায় সকালে এসেছিল ।

রেমি পারভেজকে বলল তুমি ঘুমিয়ে পড় আমি থাকছি পাশে , পারভেজ ও রেমিকে একই কথা বলল । এবং দুজনই সারারাত রুভার পাশে বসে থাকল।  

ছয়

রাতের প্রায় শেষ । রুভার ঘুম ভেঙ্গেছে । মা বাবা দুজনই তার বিছানায় আধা শোয়া অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে । মম কখন বাসায় আসলো । পাপাইবা তার বিছানায় এভাবে ঘুমাচ্ছে কেন ? প্রথমে রুভা কিছুই মনে করতে পারে না ।

রুভার পেটে খুব ব্যথা করছে সেই সাথে সকাল থেকে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা মনে পড়ছে । আজ খুব সকালে রুভা গিয়েছিল সাগরের বাসায় ।

কিছু দিন থেকে রুভা তার শরীরে বড় ধরনের পরিবর্তন টের পাচ্ছে । তার ভয় হচ্ছে সে হয়তো প্রেগন্যান্ট । কি করবে বুঝতে না পেরে সাগরের সাথে পরামর্শ করতে গিয়েছিল । সাগর যে এ কথা শুনে এত বাজে ব্যবহার করবে রুভা ভাবতেই পারেনি । যে লোক এত সুন্দর করে কথা বলে , যার প্রতিটা কথাকেই মনে হয় এক একটি কবিতা সে কিনা এসব বলেছে ।

রুভাকে সাগর সরাসরি বলেছে তোমার সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই। কাল নিপা আসবে আশা করি তুমি আমাদের সুখের সংসারে ঝামেলা করবে না ।

-        আমাকে ইউজ করে এখন যখন আমি বিপদে তখন আমাকে ঝামেলা মনে হচ্ছে?

-        তুমিপ্রেগন্যান্টহলেআবরসনকরিয়েফেল। 

-        রুভা রাগে ও ক্ষোভে বলে আমি পাপাকে সব বলে দিব , তোমার চাকরিটা কি করে থাকে আমি দেখব ?

-        আরে যা তোর দুশ্চরিত্র বাপকে যেয়ে আগে জিজ্ঞেস করিস এ রকম কত মেয়ের সাথে করেছে ।

এই বলে সাগর রুভাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে । রুভা তখনই ভেবেছিল পাপাকে সব বলে দেবে কিন্তু ফিরে এসে রুভা পারভেজকে বাসায় পায়নি । তারপর স্কুলে গিয়েছে সেখান থেকে নাইট ক্লাব ।

 

পুরানো কথা ভাবতে ভাবতেই  রুভার প্রচণ্ড বমির বেগ আসে । বমির শব্দে পারভেজ রেমি দুজনই জেগে গিয়েছে ।

 

রুভা প্রেগন্যান্ট এ খবরে পারভেজ রেমি দুজনই আকাশ থেকে পড়েছে । প্রভা অস্ত্রলিয়া থেকে কিছুক্ষণ পর পর ফোন করছে।

রুভাহাসপাতালেরবেড এ শুয়ে আছে কিছুক্ষণ পর তার অপারেসন হবে । পেটের ভিতর ভ্রূণটা মরে আছে । বেশি সময় ভ্রুণ এ অবস্থায় থাকলে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে ।

        পরিশিষ্ট

রুভা অপারেসনের আগে তার মম পাপার সাথে কথা বলতে চায় । পারভেজ রেমি দুজনই রুভার পাশে ।

কাল থেকেই পারভেজের বিপি হাই । রুভার মুখে সাগরের সাথে রুভার সম্পর্কের কথা , প্রতারনার কথা শুনে পারভেজ আস্তে আস্তে বুকে হাত দিয়ে মাটিতে পড়ে গেলো , পড়ার মুহূর্তে শুধু বলতে পারল “ হে আল্লাহ্‌ , আমার শাস্তি আমার মেয়েকে কেন দিলে ? ”

        ডাক্তার ডাক্তার ।

        পারভেজ সাহেব মনে হয় হার্ট অ্যাটাক করেছেন ।

                                               - ০ –

০৪ জুলাই ২০১৩ 

 

 

 

 

 

 

০ Likes ১৯ Comments ০ Share ৪৬৪ Views