Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

রাজিউল হাসান

১০ বছর আগে

পাগলির প্রলাপ অথবা বাস্তবতার আত্মকথা

সূর্যটা আজ বত্রিশপাটি দাঁত বের করে হাসছে। সে বছরের প্রতিদিনই হাসে; মেঘলা দিনেও হাসে। তবে কখনো সে হাসি কিছুটা ম্লান থাকে, কখনো স্মিত, কখনোবা মেঘের চাদর ভেদ করে তার হাসি ধরণিতে আসতেই পারে না; যা আসে তা হাসির আভা মাত্র। গ্রীষ্মকালে আজকের মতো হাসি দেয় সূর্য। শরতের মধ্যাহ্নের রোদ মাথার ঘিলু সিদ্ধ করে দিতে চাইছে। বাদল প্রায় ঘন্টাখানেক হলো নিউমার্কেটে ঘুরঘুর করছে। তার হাঁটাচলা, দৃষ্টি খেয়াল করলে যে কেউ ভেবে নিতে পারে- আজই প্রথম এখানে এসেছে সে। এক যুগের অধিক সময় ঢাকায় বসবাস করে আজ প্রথম কেউ নিউমার্কেটে এসেছে- জানলে যে কারোর চোখ কপালে উঠে যাবে। এ কথায় বাদলের নিজেরও চোখ কপালে উঠবে। এই নিউমার্কেটে সে কতশতবার এসেছে, হিসাব নেই। এখানের এক ফাস্টফুড শপের ম্যানেজার ওর গ্রামেরই এক ছোটভাই। ছেলেটার নাম খোকন। খোকন জানে, সম্ভব-অসম্ভব যেকোনো কিছু প্রত্যাখ্যান করা বাদলের কাছে অতি মামুলি ব্যাপার; কিন্তু লাচ্ছি প্রত্যাখ্যান একেবারেই অসম্ভব। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা যেকোনো ঋতুতে, সুস্থ-অসুস্থ যেকোনো অবস্থাতেই বাদলের সামনে লাচ্ছি হাজির করা হোক না কেন, সে তা গ্রহণ করবেই। নিউমার্কেটে এর আগেও একদিন আজকের মতো অবস্থা হয়েছিল। সেদিন পায়েল কিনতে এসেছিল সে। প্রথম কিছু করতে গেলেই কেমন যেন একটা বিপদ খাড়া হয়ে যায়! মনে হয়, প্রশান্ত মহাসাগরের ঠিক মাঝ বরাবর ফেলে দেওয়া হয়েছে। এবার সাঁতরে পার হও। অনেক খোঁজাখুজি শেষে পায়েল পাওয়া গিয়েছিল। এতটাই ভালো লেগেছিল, একসাথে একইরকম দুটো কিনে ফেলেছিল বাদল। কিন্তু কেনা পর্যন্তই শেষ। যার জন্য কেনা, সে কখনোই বাদলের মতো ছাপোষা মানুষের পক্ষ থেকে কোনো উপহার পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হওয়ার অপেক্ষায় ছিল না। থাকবেও না কোনোদিন। মানুষ মাত্রই আকাশের দিকেই দৃষ্টি পাতে। মর্তের পৃথিবীতে মধ্যাকর্ষণজনিত কারণে পদযুগল আটকে থাকলেও দৃষ্টি ঠিকই রয়ে যায় নীলে।

বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর নিউমার্কেটের দোতলায় পাওয়া গেল সাধ্যের ভেতর আকাক্সিক্ষত বস্তুর সন্ধান। যাচাই-বাছাইয়ের পর ছ’শ টাকায় কেনা গেল শাড়িটা। ঠকল, কি জিতল- জানা নেই। পৃথিবীর বেশিরভাগ পুরুষ দামাদামি, যাচাই-বাছাইয়ে আনাড়ী। নতুন কেনা শাড়ির প্যাকেট হাতে সন্তুষ্ট চিত্তে বাইরে এলেও মাথা এখন ভনভন করে ঘুরছে বাদলের। চারিদিকে মানুষ কিলবিল করছে। পদার্থ কণার কলয়ডিয় গতিকেও যেন হার মানাবে মানুষের ছোটাছুটি। কী আজব ব্যাপার! কোনো মানুষ কারোর দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না এক মুহূর্তের জন্য। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। সময়ের সাথে ছুটে চলা জীবন মানুষকে ভাবতে দেয় না, পৃথিবীতে সে ছাড়াও অসংখ্য মানুষের বসবাস। মানুষ যদি মানুষকে মানুষ ভাবতো, তাহলে ধরণিতে ক্ষুধার্ত মানুষ থাকত না, খুনখারাবি করার মতো মানুষ পাওয়া যেত না, যারা মানুষকে অন্যায়ের পথে ঠেলে দেয়, তাদের অস্তিত্ব থাকত না। সৃষ্টির সেরা জীবের সাথে এখানেই বুঝি অন্য প্রানির পার্থক্য। বাঘ অন্য বাঘকে বাঘই মনে করে; কোকিল আওয়াজ পেলেই বুঝতে পারে আশেপাশে তার স্বজাতি আছে। শুধুমাত্র মানুষই অন্য মানুষকে মানুষ ভাবতে পারে না। কখনো কখনো সৃষ্টিকর্তার সাথে মানুষের কর্মকা- নিয়ে আলোচনায় বসতে ইচ্ছে হয় বাদলের, দেখতে ইচ্ছে হয় এ বিষয়ে তিনি কতখানি বিব্রতবোধ করেন!

কাটাবন মোড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে এখন বাদল। পাগলিটাকে আজ দেখা যাচ্ছে না। অথচ প্রায় প্রতিদিনই কাপড়ের দোকানগুলোর পাশে ফুটপাতে বসে থাকতে দেখা যায় তাকে। প্রথম যেদিন পাগলিটাকে দেখেছিল, প্রান কেঁদে উঠেছিল তার। সেদিন সকাল দশটার দিকে শাহবাগ থেকে হেঁটে সায়েন্সল্যাবের দিকে যাচ্ছিল বাদল। কাটাবন মোড় পার হয়ে একটু সামনে বাড়তেই থমকে দাঁড়িয়েছিল। সামনে অর্ধনগ্ন পাগলি উকুন বাছায় ব্যস্ত, আর পেছনে শো-রুমগুলোর বাইরে রাখা বার্বিডলগুলোয় কাপড় চড়ানয় ব্যস্ত দোকানিরা। এ দেশে তবে মানুষের চেয়ে বার্বিডলের দাম বেশি! কতস্থানে বাদল দেখেছে, কুকুর-মানুষ একসাথে ডাস্টবিনে খাদ্যান্বেষণে ব্যস্ত। রাতে এ শহরের একটা যাত্রিছাউনিও খালি পড়ে থাকে না। সবই গৃহহীন মানুষের ঘুমের ঘরে পরিণত হয়। রাতে ঘুরে বেড়ানর একটা অসুখ আছে বাদলের। মন চাইলেই বেরিয়ে পড়ে। এমনই কোনো এক রাত যখন ভোরের কোলে ঢলে পড়ছে, বাদল বাসার দিকে ফিরছিল। সারারাত নিরুদ্দেশ হেঁটে ক্লান্ত তখন সে। আজিজ সুপার মার্কেটের পাশ দিয়ে ছুটে চলে যাওয়া বীরউত্তম সি আর দত্ত রোডে পা রাখতেই থমকে গিয়েছিল বাদল। রাস্তার আইল্যাণ্ডে পাগলিটা ঘুমাচ্ছিল তখন। কী শান্তির ঘুম! পাশেই রাস্তার উপর কিছু একটা জ্বালিয়ে ধোঁয়া সৃষ্টি করেছিল পাগলি। হয়তো মশা তাড়াতে, নতুবা উষ্ণতার নিমিত্তে অথবা উভয়ের উদ্দেশ্যে। হায়রে দেশ! এখানে দিনকে দিন সুউচ্চ চকচকে দালানের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তার সাথে একইভাবে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সহায়-সম্বলহীন মানুষের সংখ্যা। কোনো গাণিতিক সূত্রই উভয়াবস্থার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না।

সিগারেট শেষ করে বাদল বীরউত্তম সি আর দত্ত রোডের মাথায় চলে এসেছে। পাগলিকে পাওয়া গেছে। সে রাতে যেখানে ঘুমায়, সেখানেই গাছের ছায়ায় বসে আছে। পাগলিই একমাত্র আদর্শ বিশ্ব নাগরিক। আকাশ তার বাড়ির ছাদ, ধরণি তার ঘুমানোর বিছানা- একজন বিশ্বনাগরিকের আর কী শর্ত দরকার! বাদল তার দিকে অগ্রসর হল।

‘আমি কি আপনার সাথে কথা বলতে পারি?’ সামনে দাঁড়িয়ে বাদল পাগলিকে উদ্দেশ্য করে বলল। কিন্তু পাগলির কোনো সাড়া নেই। সে আগের মতই নির্বিকার রইল। একবার ফিরে দেখলও না, সামনে মানুষ, না গরু-ছাগল দাঁড়িয়ে। বাদল আবার বলল, ‘আমি কি আপনার সাথে কথা বলতে পারি?’ এবার পাগলি ফিরল। বাদলকে মৌনদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করল। খানিকপর তার চেহারা বিকৃত হয়ে উঠল। রাজ্যের সব রাগ-ক্ষোভ-অভিমান তার চেহারায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলল, ‘রাইতে এহন আর অয় না তর। দিনেই চইলা আইছস!’

পাগলির কথায় ইলেক্ট্রিক শক লাগল যেন বাদলের। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝল না। অস্ফুট স্বরে শুধু প্রশ্ন করতে পারল, ‘মানে?’

পাগলি যেন হেঁয়ালি করেই বলে, ‘আহা! এহন কিছছু বোজ না, না? রাইতে তো ঠিহি কাম সাইরা কিছু না দিয়াই বিরি টানতে টানতে চইলা জাস জমিদারের নাহাল। তুই বুজবি কী, প্যাডে দানা না থাকলে ক্যামুন লাগে! তগর তো ক্ষিদাই নাগে না!’

যার শরীরের উৎকট গন্ধে দশহাত দূর থেকে গা গুলিয়ে আসে, সেই মানুষটাও কারো না কারো লালসার শিকার! পাগলির কথাগুলোর উত্তাপ যেন এই তপ্ত দুপুরে মধ্য গগণের সূর্যের প্রখরতার চেয়েও প্রখর। সে উত্তাপ বাদলকে ঝলসে দিতে চাইছে প্রতিমুহূর্তে। পাগলি এখন রাগে-ক্ষোভে দুলছে। আপন মনে বলে চলেছে সে, ‘তরা পোলারা একেকটা রাক্কস! আমরা হইলাম তগর খাওন। হেই ছুডকালে নিজের আফন মামায় সর্বনাশ কইরা বেইচা দিল আমারে!’ পাগলি এবার ডুকরে কেঁদে ওঠে। হয়তো অতীত জীবন্ত হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অশ্রুসিক্ত গলায় আগের মতই বলে চলেছে, ‘হের ফর কুনদিক দিয়া দিন জায়, কুন দিক দিয়া রাইত জায়, কিছছু বুজি না। একটা গরে জীবন কাইটা গেল আমার। একটা কইরা প্যান্টশাট পরা রাক্কস আহে, আমারে কুটি কুটি কইরা খায়। নিজের মামায় জেইদিন আমার সর্বনাশ করল, বাপ পর্যন্ত ডাকছি পায়ে পইড়া; হুনে নাই। আমার মুখ-হাত-পা বাইন্দা খাইল। জবাই করা মুরগীর নাহাল ছটফট করছি, একটু মায়াও অয় নাই বেজন্মাডার। নিজে খাইল, হের ফর ট্যাহার লোভে বেইচা দিল।’ পাগলি থেমে যায়। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। বাদলের কণ্ঠনালীতে কী যেন দলা পাকিয়ে আছে। উগরে দিতে না পেরে অনবরত ঢোক গিলে ভেতরে পাঠিয়ে দিতে চাইছে; কিন্তু এক্ষেত্রেও সে বিফল। ক্ষীণ গলায় শুধু একবার জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার বাবামা? পরিবার?’

পাগলি ধরা গলায় তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ‘বাপমায়েরে ওফরওয়ালা অনেক আগেই তুইলা নিয়া গেছে। মায়ে আমারে জন্ম দেওনের সময় মরছে। আর বাপ রিসকা চালাইত। একদিন গারির নিচে চাপা পইরা মরল! হের ফর থেইকাই মামার সংসারে আছিলাম।’

এই অন্নহীন-বস্ত্রহীন মানুষটাকে বাদলের মতই সবাই পাগলি ভাবে। কিন্তু আসলেই কি সে পাগলি? পোশাক-পরিচ্ছদ ঠিক না থাকলেই আমাদের দেশে মানুষকে ভিখারি-পাগল মনে করা হয়। আসলে আমরা সবসময়ই অপর মানুষকে নিজের থেকে নিচু করে দেখতে ভালোবাসি। আর তাই যারা অন্ধকারে পতীত হয়, তাদের আঁধার থেকে উদ্ধার না করে নিজের মত চলে যাই। নিজেকে প্রবোধ দেই, নিজে পড়ি নি, শুকরয়িা। পাগলি ক্রমেই ভাবিয়ে তুলছে বাদলকে। কথা বলতে কখন থেমে গেছে পাগলি খেয়াল করে নি সে। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বাদল আবার জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর?’

পাগলি আবার শুরু করল, ‘একদিন সরদারনী কইল, আমার আর জৌবন নাই। কাস্টমার পামু না। থাহনের গর গেল, খাওন গেল!’ পাগলির গলা আবার ধরে এলো। ‘কতদিন প্যাট পুইরা খাই না! খাওন চাইলে মানুষ লাত্তি-ঝাডা মারে। আবার কেউ কেউ দুই-চাইর ট্যাহা দেয়। রাইতে এহনো রাক্কস আহে। চিপায় নিয়া আমারে খায়। মুন চাইলে দশ-বিশ ট্যাহা দেয়, মুন না চাইলে পরে দিব কইয়া চইলা জায়।’

বাদল তার সহ্য সীমার শেষ প্রান্তে চলে এসেছে। সে হজম করতে পারছে না আর। এরই নাম কি মানবতা! শাড়িটা পাগলির দিকে বাড়িয়ে ধরে সে বলল, ‘এটা নিন। আপনার জন্য।’ বাড়িয়ে ধরা শাড়িটা দেখে পাগলি যেন বিশ্বাস করতে পারে না। শূন্য-অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বাদল একটু তাড়া দিয়ে বলে, ‘নিন।’ পাগলি হাত বাড়িয়ে শাড়িটা ধরে।

সুখ-স্মৃতি কী জিনিস, পাগলির জানা নেই। জীবনে শুধু ঠোকরই খেয়েছে এতদিন। কখনো আধপেট, কখনো খালি পেটে দিন পার করে দিতে হয়েছে। স্বামীর সংসার, সন্তানের ভালোবাসা কী- জানা নেই তার। আজ হঠাৎ করে নাম না জানা অচেনা এই মানুষটা শাড়ির সাথে সব সুখ যেন মাখিয়ে দিয়েছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে পাগলির আবার। এবার তার চোখে আনন্দাশ্রু। শাড়িটা কোলের ওপর রেখে আলতো করে আদর করতে থাকে, যেন কোনো মোমের পুতুল আদর করছে; একটু নাড়া দিলেই ভেঙ্গে যাবে। কাপড়খানায় নাক ডুবিয়ে গভীর-দীর্ঘ শ্বাস নেয়। নতুন কাপড়ের গন্ধ কেমন, ভুলে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ গন্ধ নেওয়ার পর আস্তে আস্তে শাড়ির ভাঁজ খুলতে শুরু করল। অর্ধেক ভাঁজ খোলার পর থেমে গেল পাগলির হাত। ঝাপসা চোখে হয়তো কৃতজ্ঞতা জানাতেই দৃষ্টি ভুমির সমতলে নিক্ষেপ করল। চকিত আশেপাশে তাকাল। নেই, কোথাও নেই। হাজার মানুষের ভীড়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সামনের মানুষটা। শাড়ির ভাঁজে পড়ে থাকা একশ’ টাকার নোট দুটোর দিকে তাকাল আবার পাগলি। আজ সে পেটপুরে খাবে।

০ Likes ৬ Comments ০ Share ৬৬৯ Views

Comments (6)

  • - নীল সাধু

    সক্রিয় হোক রাষ্ট্র। সক্রিয় হোক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সক্রিয় হোক গণমাধ্যমগুলো। আর বরাবরের মত সক্রিয় থাকুক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনরত প্রতিটি সচেতন নাগরিক। 

     

    নক্ষত্র ব্লগে প্রিয় আইরিনকে দেখে ভালো লাগছে অনেক।

    শুভেচ্ছা স্বাগতম।

    আশা করছি কুশলেই আছ। শুভকামনা জেনো -

    - লুব্ধক রয়

    dhonnobad.

    amader sobar socchar hote hobe.

    - লুৎফুর রহমান পাশা

    এটা খুবই দুঃখজনক যে আজ এতদিনেও কোন মানবতা বিরোধীর উল্লেখ করার মত কোন সাজা দেওয়া গেলনা। এ লজ্জা পুরো জাতির।