Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের ৩৮তম মৃত্যুদিবসে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি


লোকসাহিত্যের আজীবন প্রবক্তা, মাটি ও মানুষের কবি পল্লী কবি জসীমউদ্দীন। যুগে যুগে বাংলা সাহিত্যে অনেক উজ্জ্বল প্রতিভার আবির্ভাব হয়েছেন যাঁদের প্রতিভা স্পর্শে বাংলাসাহিত্য আজ বিশ্বমানের। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ তাঁরা সবাই স্বমহিমায় ভাস্বর প্রতিভাবান। কিন্তু যে নামটি উচ্চারিত হলে আবহমান বাংলার রূপ, কাদা মাটির গন্ধে, কৃষকের হাসি ফোটা মুখচ্ছবি, গাঁয়ের সহজ সরল চাষীদের কথা, রাখাল বালকের কথা, নববধূর কলসীতে জল ভরানোর কথা, ফসল ঘেরা সবুজ মাঠ এবং প্রেমিকের ছন্দচিত্র আমাদের চেতনায় ফুটে ওঠে তিনি আমাদের প্রাণের মানুষ প্রিয় পল্লীকবি জসীমউদ্দীন। তবে পল্লীকবি বলতে যে অশিক্ষিত গেঁয়ো বয়াতিদের বোঝানো হয় তিনি তা ছিলেন না। তিনি ছিলেন যথার্থই একজন আধুনিক কবি। তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু গ্রামভিত্তিক ছিল, তাঁর কবিতায় পল্লীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং পল্লীর মানুষের সুখদুঃখের ছবি প্রতিফলিত হয়েছে বলেই তাঁকে পল্লীকবি বলা হয়। তাঁর মতো এতো সুন্দর করে আর কোনো কবি পল্লীর চিত্র অঙ্কন করতে পারেননি। ১৯৭৬ সালের ১৩মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আজ তার ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যুদিবসে পল্লী কবিকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।

তুমি যাবে ভাই - যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়,
তুমি যাবে ভাই - যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,

ছোট গাঁওখানি - ছোট নদী চলে, তারি একপাশ দিয়া,
কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া;
ঘাটের কিনারে আছে বাঁধা তরী
পারের খবর টানাটানি করি;
বিনাসুতি মালা গাথিছে নিতুই এপার ওপার দিয়া;
বাঁকা ফাঁদ পেতে টানিয়া আনিছে দুইটি তটের হিয়া।

বন্ধুকে নিন্ত্রণে এমন আন্তরিক আহ্বান যাঁর লেখায় প্রকাশ পায় তিনিই বিখ্যাত বাঙালি কবি জসীমউদ্দীন।

পল্লী কবি জসীমউদ্দীন ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এটি ছিল তাঁর নানার বাড়ি। নিজের বাড়ি ছিল গোবিন্দপুর গ্রামে। পুরো নাম জসীমউদ্দীন মোল্লা। তাঁর বাবা আনসার উদ্দীন এবং মা আমিনা খাতুন ওরফে রাঙাছুট । কবি জসিমউদ্দীনের পিতা ছিলেন ফরিদপুর হিতৈষী এমই স্কুলের শিক্ষক। নেহাজউদ্দীন নামে জসীমউদ্দীনের এক চাচাতো ভাই ছিলেন। তাঁরা দু’জন সারাদিন টোটো করে পথেঘাটে, ক্ষেত-খোলা আর নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়াতেন। এমনি দুষ্টুমি আর দস্যিপনায় মেতে থাকতে থাকতে স্কুলে যাওয়ার বয়স হলে বাবা তাঁদের দু’জনকেই শোভারামপুর গ্রামে অম্বিকা মাস্টারের পাঠশালায় ভর্তি করে দিলেন। তারপর কবি অম্বিকা বাবুর পাঠশালা থেকে আসেন বাবার স্কুলে। সেখানে পড়েন চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত। তারপর জেলা স্কুলে। এই স্কুল থেকেই তিনি ১৯২১ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর ভর্তি হন ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে। এখান থেকেই তিনি আইএ এবং বিএ পাস করেন ১৯২৯ সালে। তারপর তিনি চলে যান কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমএ পাস করে ১৯৩৩।

জসীমউদ্দীনের কবি প্রতিভা বিকশিত হয় শৈশবেই। কবিতা লেখার প্রতি তার প্রবল ঝোঁক থেকে ইচ্ছে হয় বড় কবি হওয়ার। ১৯২৭ সালে তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ (একটি রাখালি অন্যটি নকশীকাঁথার মাঠ) প্রকাশিত হলে তাঁর কবি খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের বিচিত্র বিষয় ছিল তার কবিতার বিষয়বস্তু। গ্রামের সাধারণ মানুষের কথাই তিনি তার কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। দেশের মানুষ তাই তাকে ভালোবেসে ‘পল্লীকবি’ হিসেবে ভূষিত করেছে। তবে ‘পল্লীকবি’ হিসেবে তাঁর পরিচয় বেঁধে দেয়া বোধ হয় ঠিক নয়, বরং আমাদের বাঙালি সত্তার একজন সত্যিকার মহৎ ও বড় কবি হিসেবেই তাকে শনাক্ত করা উচিত; যিনি প্রচলিত আধুনিক ধ্যান-ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে সহজ সরল ভাষায় চিরায়ত পল্লী জীবনকে তুলে ধরেছেন তাঁর কবিতায়।

(ডালিম গাছের নিচে স্ত্রীর কবরের পাশে কবি)
কবি জসীমউদ্দীন কবির খ্যাতির শীর্ষে ওঠেন যখন কলেজে পড়ার সময় তিনি কবর কবিতাটি লেখেন। কবর কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে এক অবিস্মরণীয় অবদান। তিনি যখন বিএ ক্লাসের ছাত্র তখনই কবিতাটি প্রবেশিকা পরীক্ষার্থীদের পাঠ্য তালিকাভুক্ত হয়। জসীমউদ্দীনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাখালী’তে তাঁর বিখ্যাত কবিতা কবর ও পল্লীজননী স্থান পেয়েছে। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘নকশী কাঁথার মাঠ,’ এক পল্লীকিশোরীর বেদনা-মধুর প্রেম কাহিনীর অপূর্ব কাব্যিক রূপ প্রকাশ পেয়েছে এখানে। এ গ্রন্থটি মিসেস ই. এম. মিলফোর্ড ‘ফিল্ড অব দি এমব্রয়ডারড কুইল্ট’ ‘নামে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। গ্রন্থটি জসীমউদ্দীনকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কবি করে তোলে।

কবি জসীমউদ্দীন ছোটদের ভালোবাসতেন। তাই তো তিনি শিশুদের জন্য লিখেছিলেন হাসু, এক পয়সার বাঁশী, বাঙালির হাসির গল্প, ডালিম কুমার, আসমানীর কবি ভাই, হলুদ পরীর দেশে প্রভৃতি গ্রন্থ। তার অন্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে কাব্যগ্রন্থ ধানক্ষেত, মাটির কান্না, হলুদ বরণী রূপবতী, জলের লেখন, পদ্মা নদীর দেশে প্রভৃতি। কাহিনী কাব্যের মধ্যে সুজন বাদিয়ার ঘাট, নকশীকাঁথার মাঠ, সকিনা প্রভৃতি। তার অন্যতম জনপ্রিয় লোকনাট্য গ্রন্থ মধুমালা, বেদের মেয়ে, পদ্মার পার, পল্লীবধূ, গ্রামের মায়া, গাঙের পার, ওগো পুষ্প রেণু প্রভৃতি। তাঁর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থের মধ্যে অন্যতম ঠাকুর বাড়ীর আঙিনায়, স্মৃতিপট, যে দেশে মানুষ বড় ইত্যাদি। ভ্রমণ কাহিনীর মধ্যে চলে মুসাফির, জার্মানির শহরে ও বন্দরে প্রভৃতি। বোবা কাহিনী তার একটি জনপ্রিয় উপন্যাস। এছাড়াও আছে তার জারিসারি ও মুর্শিদী গানের সংগ্রহ ও সম্পাদনা।

(International Writers' Conference 1962: Henry Miller and Jasim Uddin)
১৯৩৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করার পর তিনি চাকরি জীবন শুরু করেন। জসিমউদ্দীণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের অধীনে ‘রামতনু লাহিড়ী’ গবেষণা সহকারী নিযুক্ত হন। ১৯৩৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। অধ্যাপনা ছেড়ে ১৯৪৪ সালে তত্কালীন পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগে চাকরি গ্রহণ করে ১৯৬১ সালে অবসর গ্রহণ করেন। জসিমউদ্দীন ব্যক্তি জীবনে যেমন সফল মানুষ তেমনি একজন কবি হিসেবেও সফলতার দ্বার ছোঁয়া একজন সফল কবি।

(1975 - Jasim Uddin & his wife with Prime Minister of India
Mrs. Indira Gandhi at Delhi )

জসীমউদ্দীন সাহিত্য জীবনে অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কলকাতা তাকে সম্মানসূচক ‘ডিলিট’ উপাধি দেন ১৯৬৮ সালে, বাংলা একাডেমী তাকে ১৯৭৬ সালে ‘একুশে পদক’ প্রদান করে। ১৯৬৯ সনে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মান সূচক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত করেন।

আনুষ্ঠানিক উপাধি ও সম্মাননা ছাড়াও বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা পাওয়া জনপ্রিয় এই কবি ১৯৭৬সালের ১৩ মার্চ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পরে তার ইচ্ছানুযায়ী তাকে দাফন করা হয় নিজ গ্রাম গোবিন্দপুরে। এ কথা সত্যি যে তিনি সঠিকভাবে মূল্যায়ন হননি, তাঁর কথা আমরা অনেকেই ভুলে গেছি। তাঁকে আমাদের স্মরণ করতে হবে এবং তাঁর লেখা রচনাগুলো স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সিলেবাসে সন্নিবেশিত করতে হবে। তাহলে আমরা তাঁকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারব। আমাদের আবহমান বাংলা চিরকাল টিকে থাকবে তার অমর সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যদিয়ে। আর হয়তো আগামীতে উত্তরাধুনিক চেতনায় জসীমউদ্দীন দেশে সর্বাধুনিক ও সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে নতুন যুগের পাঠকদের কাছে নতুনভাবে আবির্ভূত হবেন।

আজ মাটি ও মানুষের কবির ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। পল্লী কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে কবির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

০ Likes ৩ Comments ০ Share ৬২৩ Views

Comments (3)

  • - আলমগীর সরকার লিটন

    শুভ কামনা রইল-----

    • - নিঃশ্চুপ অর্ণব

      শুভ কামনা

    - ইকবাল মাহমুদ ইকু

    ভালো লাগলো আপনার এই লিখাটি । ভালো থাকবেন । 

    • - নিঃশ্চুপ অর্ণব

      ভালবাসা নিবেন :)

    - মেজদা

    বাহ! সুন্দর লিখেছো অর্নব। প্রীতি নিও। 

    • - নিঃশ্চুপ অর্ণব

      দাদা......... ভালবাসা নিবেন....... তবে.... আপনার বই কিন্তু এখনো হাতে পেলাম না

    Load more comments...