Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

Mishu Milan ..

১০ বছর আগে

পরানপুরাণ

ভবতোষ নাভির নিচে তুলির পোঁচ দিতে দিতে খানিকটা সোজা হয়ে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেললো প্রতিমার মসৃন বুকের কাছে। তার কোমর ধরে গেছে। সাধু দু-হাতের আঙুলে চুলের পরিচর্যা খুলছে। দীঘল কালো চুল। তার মুখে সিগারেট। শেষ টান দিয়ে সিগারেটটা বাড়িয়ে দিল ভবতোষের দিকে। ভবতোষ সিগারেট হাতে নিয়ে বেশ লম্বা একটা টান দিল। পাকানো ধোঁয়া ছাড়লো প্রতিমার মুখের ওপর। নির্বিকার সরস্বতী প্রতিমা!
খুক খুক করে বার দুই কাশলো সাধু। কাল রাতে মাথার কাছের জানলাটা খোলা ছিল। ভোরবেলার হালকা শিশির ভেজা শীতল বাতাসে ঠান্ডা লেগেছে ওর। ভবতোষ সিগারেটটা সাধুর হাতে ফেরত দিতে দিতে বললো, ‘কাল তালি সখিপুর যাতেছিস?’
‘হ, আমি ছাড়া তো উদ্ধার নাই।’
ভবতোষ ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হেসে বললো, ‘গঙ্গাস্নান হবি নাকি?’
সাধু ধোঁয়া ছেড়ে চোখ টিপ দিয়ে, শুষিয়ে বললো, ‘আবার কয়! সখিপুর যাব, আর গঙ্গায় ডুব দেব না!’
হেসে উঠলো দুজনেই। ভবতোষ আবার সরস্বতী প্রতিমার নাভির নিচে তুলির পোঁচ দিতে শুরু করলো। রঙের কাজ শেষের পথে। শুধু সরস্বতীর আংশিক আর কার্তিক বাকী। কাল দুপুর থেকে শুরু হবে চুল লাগানো, কাপড় পরানো আর সাজসজ্জার কাজ। সবশেষে চোখ আঁকা।
ভবতোষের বাবা ভবেশ পাল প্রায় বছর ত্রিশেক যাবত এই শিবগঞ্জ গ্রামের প্রতিমা গড়ার কাজ করছে। ভবতোষ দশ বারো বছর বয়স থেকেই বাবার সাথে প্রতিমা গড়তে আসছে। বাবাকে এটা-সেটা এগিয়ে দিতে দিতে, যোগালিয়ার কাজ করতে করতে এক সময় সেও হয়ে উঠেছে নিপূণ প্রতিমা শিল্পী। এখন ভবতোষের বয়স পঁচিশ। বাবার পঁয়ষট্টি। এখন বাবা তার যোগালিয়া।
ভবেশের বয়স হয়েছে। তার ওপর হাঁপানীর রোগী। এই খোলা মন্দিরে রাতে কাজ করলে তার হাঁপানী বেড়ে যায়। আশ্বিনের শেষ ভাগ। মৃদুমন্দ শিশির পড়ে, হালকা শীতল বাতাস বয়। হাঁপানীর রোগীর সয় না। তাই ভবতোষ বাবাকে বলেছে,‘রাতে তোমার কাজ করবার দরকার নাই।’
সন্ধ্যার পরপরই ভবেশ শুতে চলে যায়। এ বছর তাদের থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে গিরীশ মাতব্বর। এক এক বছর, এক একজন অবস্থাপন্ন এবং মাতব্বর গোছের লোক এই দায়িত্ব নেয়।
তবে সন্ধ্যার পর একা হয় না ভবতোষ। গ্রামের ছেলে-ছোকরা, মাতব্বর গোছের লোকজন আসে-যায়। সবাই চলে যাবার পরও থাকে সাধু। ভবতোষের কাজে সাহায্য করে। সেই বাঁশ চাছা থেকে শুরু করে সাজসজ্জা পর্যন্ত সব কাজেই থাকে সাধুর হাতের ছোঁয়া। গিরীশ মাতব্বরের বাড়ি থেকে ভবতোষের জন্য মন্দিরেই খাবার আসে। কিন্তু রাতের বেলা সে শোয় সাধুর সঙ্গে। বন্ধুত্ব এমনই গাঢ় যে, মাঝে মাঝে সাধুও বেড়াতে যায় ভবতোষদের বাড়িতে।
সাধু এই গ্রামেরই ছেলে। ভবতোষের সমবয়সী। ভবতোষ যখন বাবার সাথে প্রথম এসেছে এই গ্রামে, তখন থেকেই সাধুর সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। ভবতোষ বাবাকে এটা-সেটা যোগান দিত। সাধু এসে বসে থাকতো প্রথম প্রথম। তারপর সেও কাজে হাত লাগাতো। সাধুর তো আর অন্যদের মতো স্কুলে যাবার তাড়া ছিল না। স্কুলের পাট কাস ফোরেই চুকিয়েছিল সে। অন্য ছেলেরা যখন পুজার ছুটি কখন হবে সেই অপেক্ষায় মুখিয়ে থাকতো, স্কুলে যাওয়া-আসার পথে মন্দিরের খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, পিঠ ঘষতে ঘষতে ভবেশের মূর্তি গড়া দেখতো আর সাধুর দিকে তাকিয়ে ঈর্ষাবোধ করতো। তখন সাধু তাদের দিকে গর্বিত চোখে তাকাতো। দ্বিগুণ উৎসাহে ব্যস্ততার ভান করতো। সেই অন্য ছেলেরা বড় হয়ে কবেই লেখাপড়ার জন্য গ্রাম ছেড়েছে। কিন্তু সাধু এখনও আছে সাধুর মতো। এখনও মূর্তি গড়ার সময় মন্দিরের মেঝেতে পশ্চাৎদেশ ঘষতে ঘষতে তার সময় যায়।
সাধুর আসল নাম সাধন। সাধু তার ডাক নাম। এই ডাক নামের পিছনে তার একান্ত নিজস্ব এক ইতিহাস আছে। সাধুর বয়স যখন দশ-এগারো, তখন গ্রামে কোন সাধু-সন্ন্যাসী এলে তার পিছন পিছন ঘুরতো সাধু। সেই জটাধরী বা লম্বা চুলের গেরুয়া বা লাল বসন পরিহিত সন্ন্যাসীকে মুগ্ধ হয়ে দেখতো। আগন্তুক সন্ন্যাসীরাও এমন ন্যাওটা পেয়ে খুশি হতো। দিব্যদৃষ্টি সুলভ চোখে তাকিয়ে তামাটে দাঁড়ি-গোফের ফাঁকে কালচে ময়লা দাঁত বের করে মৃদু হেসে তার মাথায় হাত রাখতো। পরক্ষণেই আবার গম্ভীর হয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তো।
একবার এক সন্ন্যাসী সাধুর মাকে বলেছিল, ‘বেটিয়া, তোর ব্যাটা তো দিব্যজ্ঞানী হইবে।’
তারপর দক্ষিণা গ্রহণপূর্বক সাধু সাধু বলতে বলতে চলে গিয়েছিল সন্ন্যাসী। সেই আনন্দেই সাধুর মা দু-দিন কেঁদেছিল। আর ছেলের সাধন নাম ঘুচিয়ে ডাকতে শুরু করেছিল সাধু বলে। সেই থেকেই সাধন সাধু হলো।
সাধুর বাবা বাজারে খুচরা সবজীর ব্যবসা করে। সাধুরা দু-ভাই, এক বোন। বোনটার বিয়ে হয়েছে চৌদ্দ বছর বয়সে। বড় ভাই বিধান বাবার কাজে সাহায্য করে। খেয়ে পরে চলে যায় তাদের সংসার। সন্ন্যাসীর ভবিষ্যৎ বানী শোনার পর থেকেই সাধুর মা ডিমের বেশিটা, মাঝের বড় টুকরোটা সাধুর পাতেই দিতো। দিব্যজ্ঞানী হলে সাধু যদি আমিষ ত্যাগ করে! মায়ের মন!
ঐ সন্ন্যাসীদের পিছন পিছন ঘুরতে ঘুরতে চৌদ্দ বছরেই দিব্যজ্ঞান অর্জন করেছিল সাধু, এক সন্ন্যাসীর গাঁজার পোটলা চুরির মধ্য দিয়ে! তারপর অনিলদের পোড়ো ভিটেয় গিয়ে একটা কুড়োনো কলকে তে গাঁজা সাজিয়ে সন্ন্যাসীকে নকল করে আপন মনে গাঁজা টেনেছিল ফুরনো বিকেলে। দিব্যজ্ঞান পেয়ে বসেছিল ওকে। সূর্যদেবের দর্শন পেয়েছিল! পাশের গ্রামের মন্ডলদের নারকেল গাছের মাথায় লাল টকটকে পাঁচটা সূর্য দেখেছিল! তারপর সেই বিকেল ফুরোনো সন্ধ্যায় বাঁশঝাড়ে শালিকেরা হাজার কন্ঠে গাইলো ওদের ভাষায়, ওদের রাগ-খেয়াল। থেমেও গেলো। বকফুল গাছ থেকে ডেকে উঠলো কোকিল। সাধু হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে কোকিলের ডাকের অনুকরণ করলো, ‘কু..উ...’। তারপর উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে গেল। ঘাসের ওপর শুয়ে হাসতে লাগলো। হাসতেই লাগলো....।
পরদিন সকালে বকফুল গাছেল পাতার ফাঁক দিয়ে যখন সন্ন্যাসীর ত্রিশূলের মতো রোদ্দুর পড়লো নরম চোখের পাতায়, তখন সাধু আড়মোড়া ভাঙলো। চোখ মেলে দেখলো বকফুল গাছে তিড়িং বিড়িং করছে দুটো চড়–ই। ওদের নাড়া খেয়ে কয়েকটি শুকনো পাতা ঝরে পড়লো তার মুখের ওপর। বিষ্ময়ে উঠে বসলো। সামনে সবুজ ধানক্ষেতে চকচক করছে রোদ্দুর। দূরে রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে কেউ। তার সামনে একটা মোষের গাড়ি। পোড়ো ভিটের পশ্চিমেই পুকুর। পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে অনিলের ঠাকুমাকে পুড়িয়েছিল। পোড়া-বাঁশ-কয়লা এখনও চোখ মেলে আছে। সে এখানে কেন! দৃষ্টি ঘুচিয়ে কাছে আনলো। চোখ পড়লো পাশে পড়ে থাকা কলকেটার দিকে। এক ঝটকায় তার সব মনে পড়ে গেল। কাল বিকেলে সে গাঁজা টেনেছিল। আর এখন সকাল। তার মানে সে এখানেই ঘুমিয়েছে রাতে! বাড়ির লোক কি তার খোঁজ করেছে? নিশ্চয় করেছে। পায়নি। বাড়িতে গিয়ে কি বলবে? ধুর! বলবে একটা কিছু। শুরুর বিষ্ময়, ভয় কাটিয়ে উঠলো সাধু। তারপর পায়ের কাছ থেকে কলকেটা হাতে নিয়ে নাকের কাছে ধরে শুকলো। মুখ টিপে হাসলো, অতঃপর কলকেটা জামার পকেটে রেখে বাড়ির পথে পা বাড়ালো।
এর পরপরই সিগারেট ধরেছিল সাধু। ঐ চৌদ্দতেই। পনের তে পা দিতেই ধরেছিল বয়সে বড় সুভাসের আধপাগলী মেয়েটার বুক, তারপর সারা শরীর। আধপাগলী মেয়েটা ওকে একা করে কয়েক মাস পরেই মরেছিল সাপের কাপড়ে। আর ষোলতে সাধু ধরেছিল সখিপুরের পথ।
সরস্বতী প্রতিমার রঙ করা শেষ। ভবতোষ তুলি-হাত ধুয়ে খুঁটিতে বাঁধা কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে বললো, ‘চল, যাইগে’।
সাধু চুলগুলো গুছিয়ে রাখলো মন্দিরের একপাশে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ভবতোষের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘জ্বালা’।
দুই বন্ধু হাত বদল করে সিগারেট টানতে টানতে নির্জন রাতের রাস্তা দিয়ে হাঁটছে, গল্প করছে। সারা গ্রাম এখন সুনসান। দু-একটি বাড়িতে বিজলি বাতি জ্বলছে। গাছ, পাতার ফাঁক দিয়ে ঠিকরে বেরুচ্ছে আলো। মাত্রই কয়েক মাস হলো বিদ্যুৎ এসেছে গ্রামে।
পিছনে টিং টিং শব্দ হলো। উঁচু-নিচু মাটির রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছে সুশীল ডাক্তার। কাছে এসে ডাক্তার বললেন,‘ সাধু নাকি রে?’
‘হ কাকা।’
‘প্রতিমার কাজ কদ্দুর?’
‘পিরায় শ্যাষের দিক।’
‘অ।’
ওদেরকে ছাড়িয়ে দূরে চলে গেলেন ডাক্তার। ওরা আবার নিজেদের আলোচনায় ফিরলো। দু-জনের আলাপের মধ্যেও আগামীকালের অনাগত রাতটির কথা মনে করে বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত শিরশিরানি অনুভব করলো সাধু। সেটা ছড়ালো সারা শরীরে। ভাল লাগায় আপ্লুত হলো সে।
পরদিন বেলা এগারটা নাগাদ দোগাছিয়ার বাওড়ে এসে পৌঁছলো সাধু। আরো আগেই আসতে পারতো। মাঝ পথে বাসটা নষ্ট হয়ে গেল। তারপর পরের বাসের জন্য অপো। পাকা চল্লিশ মিনিট পর এলো বাস। তাও সে কি গাদাগাদি ভিড়! ঐ ভিড়ের মধ্যেই ঠেলেঠুলে উঠেছিল সে। দোগাছিয়া বাজার বাসস্ট্যান্ডে নেমে-চেপেছে ভ্যানে। আধা মাইল পিচ ঢালাই রাস্তা। তারপর এক মাইল ইটের রাস্তার ঝাঁকি সইতে সইতে সবে এসে পৌঁছলো বাওড়ের দক্ষিণ পাড়ে। ইটের রাস্তাটি ডানে জনপদ আর বায়ে বাওড়ের কোল ঘেঁষে, মেটে সাপের মতো চলে গেছে পুবের দিকে।
বাওড় পাড়ে এসে দাঁড়ালে চোখ জুড়িয়ে যায়। বিশাল বাওড়। পশ্চিম দিক থেকে এসে দু-পাশে প্রাচীন জনপদ ফেলে চলে গেছে বাবুনগরের দিকে। চওড়ায়ও প্রায় মাইল দুয়েক হবে। দোগাছিয়ার বাওড় পদ্মফুলের জন্য বিখ্যাত। বাওড়ের শরীরের ভাঁজে ভাঁজে অসংখ্য পদ্মফুল ফোঁটে। পূজা-পার্বণে মানুষ এখান থেকেই পদ্মফুল সংগ্রহ করে। দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ আসে। আশ-পাশের অনেক মানুষ পূজা-পার্বণ এলে, পদ্মফুল তুলে নিয়ে গিয়ে বাজারে বিক্রি করে। বাওড়ে ঘুরতেও আসে প্রচুর মানুষ। ভাড়ায় নৌকা পাওয়া যায়।
সাধু রাস্তা থেকে নেমে কাঁশফুলের ভেতর দিয়ে পায়ে চলা পথে হাঁটতে লাগলো। এদিকটা থেকে জল নেমে গেছে অথবা এবার জল ওঠেইনি। তাই শুষ্ক চড়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে কাঁশবন। অসংখ্য কাঁশফুল শরতের আকাশের আয়নায় তাকিয়ে বাতাসে মাথা দুলাচ্ছে। আকাশের আয়নায় কাঁশফুলের প্রতিচ্ছবি হাসছে আর ভাসছে। সাধু হারিয়ে গেছে কাঁশবনের শরীরে।
মিনিট পাঁচেক পর সাধুকে দেখা গেল কাঁশবনের কোল থেকে বেরিয়ে নৌকার বহরের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
ঘন্টা প্রতি ভাড়া। সাধু একটা নৌকা ভাড়া করলো। যতক্ষণ বাওড়ে থাকবে ততক্ষণের ভাড়া দেবে। বাওড়ে ঘুরে ঘুরে তুলবে পদ্মফুল। কালকের দিন বাদে পদ্মফুল ঠাঁই পাবে দেবী দূর্গার চরণে!
বাওড়ে বাতাস বইছে। আকাশে মেঘের ছুটোছুটি। না, আছড়ী-পিছাড়ী! ক্ষণে ক্ষণে মেঘ ফুঁড়ে ঠিকরে বের হচ্ছে তেজী সূর্যটা। আর তখনই বাওড়ের উত্তরদিকে গাছ-গাছালীর চোয়ালের-ঠোঁটের ফাঁকে দাঁত কেলিয়ে হাসছে একটি টিনের বাড়ির চালা। সে ঐ ক্ষণিক ক্ষণিক-ই। তারপরই জেদি মেঘ পিঠ পেতে দাঁতে দাঁত চেপে খাচ্ছে রোদের চাবুক! বৃষ্টি নামবে নিশ্চিত। ছিটে ফোঁটাই হোক আর অঝোর ধারায়-ই হোক!
নৌকা এখন বাওড়ের মাঝখানে চলে এসেছে। এদিকটায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য পদ্মফুল। মাঝি ধীরে ধীরে বাইছে নৌকা। কখনও থামছে। সাধু একটি একটি করে পদ্মফুলের কুড়ি বা আধফোটা পদ্মফুল তুলে গুছিয়ে রাখছে নৌকার পাটাতনে। ফুটন্ত পদ্মফুল নিলে এক-দুদিনেই পাপড়ি ঝরে যায়, তাই নিতে হয় পদ্মকুড়ি বা আধফোটা পদ্মফুল।
ফুটন্ত ফুলগুলোতে মৌমাছিরা বসছে আবার উড়ছে। নিশ্চয় বাওড় পাড়ের কোন গাছে অস্থায়ী বসতি গড়েছে ওরা। সেখান থেকে এই মাঝ বাওড়ে, এতোদূরে চলে এসেছে মধু সংগ্রহের জন্য। এই নিভৃত বাওড়ে মধু সঞ্চয়কালে হঠাৎ মানুষের আগমনে ওরা বিরক্ত হয়ে উড়ে কিছুটা দূরে গিয়ে বসছে অন্য ফুলের ওপর। একই কারণে জলপোকাগুলোও জায়গা পরিবর্তন করছে।
সাধু নৌকার পাটাতনে হামাগুড়ি দিয়ে ফুল তুলছে। মেঘে-বাওড়ে এখন রোদের আধিয়ারী। সাধুর মাথার ছায়া পড়ছে পদ্মপাতায়-জলের ওপর। পড়ছে পদ্মফুলের ছায়াও-পদ্মপাতায়, জলে। সবুজ সতেজ এবং মরে আসা হলুদ পদ্মপাতায় পায়চারী করছে নানান রকম জলজ পোকা। একটা জলঢোঁড়া পদ্মপাতার বুক বেয়ে ডুব দিল জলের তলে। কয়েক মুহূর্ত পর আবার জলের ভেতর থেকে শ্যাওলার টুপি মাথায় উঁকি দিল। সাধু মুখে হুস হুস শব্দ করে সেদিকে জল ছিটালো। আবার ডুব দিল জলঢোঁড়াটি। আর দেখা গেল না।
সেই ছোটবেলা থেকে সাধু শুনে আসছে পদ্মফুলে সাপ থাকে। পদ্মফুলকে জড়িয়ে ফনা তুলে ভ্রমরের সাথে খেলা করে। খেলা নাকি যুদ্ধ! ছবিতে দেখেছে শ্রীকৃষ্ণ দাঁড়িয়ে আছে পদ্মফুলের ওপর। আর তাঁর মাথার ওপর ছাতার মতো ফনা তুলে আছে সাত মাথার সাপ। সাত মাথার ফনা তোলা সাপ দূরে থাক, এক মাথার ফনা তোলা সাপও দেখেনি সাধু! দেখেছে ঐ বিষহীন জলঢোঁড়া! অবশ্য ভ্রমর দেখেছে মাঝে মাঝে। আজও দেখেছে একটা- নিঃসঙ্গ কালো ভ্রমর!
সত্তরটি ফুল তোলা হয়েছে। দূর্গাপূজার জন্য আরো আটত্রিশটি ফুল লাগবে। অবশ্য একশো আটটিতেই থেমে যাবে না সাধু। সে অন্তত দেড়শো ফুল তুলবে। ক’দিন বাদেই লক্ষ্মী পূজা। তখন পদ্মফুল লাগবে। তাই পাড়া-পড়শীরা প্রতিবছরই সাধুর কাছে আবদার করে পদ্মফুলের। সাধু তাদের বঞ্চিত করে না।
একটু জিড়োতে নৌকার পাটাতনে পা ছড়িয়ে বসলো সাধু। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে মাঝির উদ্দেশ্যে বললো, ‘সিগারেট খাও?’
মাঝি ছেলেটার নাম আসাদ। বয়স কুড়ি-একুশ হবে। দেখে মনে হয় আরো কম। শ্যামলা, গোলগাল চেহারা। মুখের হাসিটি সুন্দর। দেখেই বোঝা যায় ছেলেটি সরল। দুনিয়ার গরল বিষয়গুলো এখনও ওকে স্পর্শ করতে পারেনি।
‘হ, খাই।’ উজ্জ্বল হলো আসাদের মুখ।
আসাদের কোলের ওপর একটা সিগারেট ছুঁড়ে দিল সাধু। তারপর নিজে একটা ধরিয়ে দুটো টান মেরে জলন্ত সিগারেটা আসাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘বাড়ি কই তোমার?’
‘ঐ যে উচা তালগাছ দ্যাহা যায়, তার পুব পাশে।’ বাওড়ের দক্ষিণ দিকের একটা তালগাছের দিকে আঙুল তুলে দেখালো আসাদ।
সাধু তালগাছ থেকে চোখ ফেরালো আসাদের মুখে। সিগারেটটা ফেরত নিয়ে বললো ‘বিয়ে করছো?’
লাজুক হাসি হাসলো আসাদ। ঘাড় নেড়ে বললো, ‘না’।
‘সখিপুর যাও?’
আচম্বিত এমন প্রশ্নে যেন আরো লজ্জা পেল আসাদ। সাধু আবার বললো, ‘লজ্জার কি আছে! গেলি কও!’
মুখ টিপে হেসে একটু জোড় দিয়ে টেনে বললো আসাদ, ‘না......!’
সাধু হাসলো। সিগারেট টানতে টানতে কি যেন ভাবতে লাগলো। হয়তো গত বছরের স্মৃতি মনে পড়েছে! সিগারেটায় শেষ টান দিয়ে জলে ছুঁড়ে দিল। মৃদুমন্দ তরঙ্গ উঠলো জলে। আর সেই মৃদুতরঙ্গের তোড়ে জলপোকাগুলো তরঙ্গবুক বেয়ে পরি-মরি করে নিরাপদ দূরত্বের দিকে ছুটলো।
পায়ে পায়ে আবার সরে গেছে রোদ্দুর। বাওড়ের ওপর মেঘ এখন যেন কিছুটা নিথর। বাতাস কমে গেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আসাদকে তাড়া দিল সাধু, ‘আগাও, আগাও’।
উত্তরের দিকে নৌকা এগুতে লাগলো। সামান্য দূরত্বে আরো কয়েকটি নৌকা নিয়ে ফুল তুলছে কিছু মানুষ। কলার ভেলায় চড়ে ফুল তুলছে একটি শ্যামলা কিশোরী আর দুটি উদোম গায়ের কিশোর। কিশোর দুটির পরনে গামছা। কাছা দেওয়া। ওরা ফুল তুলে বাজারে বিক্রি করবে।
ওদের তিনজনকে দেখে নিজের কৈশোরের কথা মনে পড়ে গেল সাধুর। বর্ষার সময় ওদের গ্রামের পশ্চিম পাশের বিলে অনেক জল হয়। সাধুর ছেলেবেলায় কোন কোন বছর সেই জল ধাবিত হতো গ্রামেও। থাকতো কিছুদিন। তারপর একসময় বর্ষারানী তার ভরন্ত সংসারের পুইপোনা-সাপ, ব্যাঙ, মাছ, কচ্ছপ, নানান রকম জলজ পোকা-মাকড় কিছু ফেলে, কিছু নিয়ে লোকালয় ছেড়ে বিলে নামতো। তারপর কার্তিকের শেষ ভাগে বিলও শুকিয়ে যেতো। এখনও বিলে জয় হয়, কিন্তু সে জল গ্রাম অব্দি পৌঁছয় না। নদীতে শক্ত বেড়িবাঁধ পড়েছে।
তখন ভরা বর্ষায় বড়রা কলাগাছের ভেলা বানাতো। সবার তো আর নৌকা বানানোর সামর্থ্য ছিল না। গ্রামের নিন্মবিত্তদের জন্য ভেলাই ছিল বর্ষার একমাত্র কান্ডারী। ভেলা নিয়ে হাট-বাজার করতো, আত্মীয়স্বজন কে কেমন আছে খোঁজ-খবর নিত। বড়দের কাজ শেষে ভেলার যখন একটু অবসর মিলতো, তখনই অবসর ভাঙতে হাজির হতো সাধুরা। সাধু, তুলিকা, নিমাই, দীপন, নীলা। সবাই অবশ্য একদিনে থাকতো না। এককজন একেক দিন থাকতো। তবে সাধু থাকতো রোজ। ওর কোন বাঁধন ছিল না। না স্কুলের, না পরিবারের। বলিষ্ঠ স্বাস্থ্যের কারণে সাধুর মতো ভেলা চালাতে কেউ পারতো না। অদম্য সাহসীও ছিল।
একদিন দুপুরবেলা সাধুর মা বললো, ‘কডা শাপলা তুলে আন দিনি। বড়া ভাজে দিবানে।’
চললো সাধু শাপলা তুলতে। অন্যের ভেলা নিলে প্রায়-ই বকা খেতে হয়। তাই সে বছর নিমাই আর দীপনকে সঙ্গে নিয়ে নিজেরাই একটা ভেলা বানিয়েছিল। সাধু বিলের ধারে এসে দেখলো ওদের ভেলাটা যেখানে রাখা সেখানে নেই। কে নিল? নিমাইরা? না, ওরা তো স্কুলে গেছে। তবে কে নিল? যেই নিক আচ্ছা মতো ঠেঙাবে। ভেলা বানাতে অনেক ধকল গেছে। সুশীল ডাক্তারের কলাবাগান থেকে সন্ধ্যেবেলা বিচিকলার গাছ চুরি করে আনতে হয়েছে সাপ-খোপের ভয় ডিঙিয়ে! সেই সাধের ভেলা আরেকজন বাইবে, তা হবে না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো সাধু। কিন্তু ভেলার দেখা নেই। পাশেই ছিল আরেকটি ভেলা। সুবলদের। সাধু আশ-পাশ তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই। তারপর দড়ি খুলে ঐ ভেলাতেই চড়ে বসলো। রোদ নেই। মেঘলা আকাশ। বাতাসে সুভাষের পাগলী মেয়েটার গায়ের জোড়! বিলে ঢেউ উঠেছে খুব। ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে রাস্তায়। মাটির রাস্তার পাড় ভাঙছে। প্রতিবারই ভাঙে। ভাঙতে ভাঙতে চওড়া রাস্তা সরু হয়ে যায়। রাস্তা কমে আর চাষের জমি বাড়ে। কেউ গায়ে মাখে না।
এদিকটায় আউশ ধান জলের অনেক উপরে উঠে গেছে। আউশের সবুজ ক্ষেতের ভেতর দিয়েই জলের সাদা পথ। একটা দুইটা নয়। অনেকগুলো পথ। যার যেখান দিয়ে খুশি ডিঙ্গি নৌকা বা ভেলা চালিয়ে দেয়। আর নতুন নতুন পথ পড়ে। ধানগাছগুলো শুয়ে পড়ে। এই কাজটা বেশি করে যারা কারেন্ট জাল পেতে মাছ ধরে তারা।
সাধু ভেলা বাইতে লাগলো। আউশের তে পাড়ি দিয়ে যেতে হবে গভীর বিলের দিকে। ওদিকটায় অথৈ জল। অনেক শাপলা। একেকটা শাপলার ডাটা প্রায় মানুষ সমান লম্বা। সাধু নৌকা থামালো। ধানক্ষেতের কোল ঘেঁষে কেউ জাল পেতেছে। জালের টোন নড়ছে, ধানগাছ নড়ছে। বোধহয় শোল-মাগুর কিছু আটকেছে জালে। সে হাতের বাঁশ দিয়ে জাল উঁচু করে ধরলো। কোথায় শোল! মস্ত এক ঢোঁড়া সাপ জড়িয়েছে জালে। যতই মুক্ত হবার চেষ্টা করছে ততই আরো জড়িয়ে যাচ্ছে। সামান্য দূরত্বে জালে জড়ানো একটি জ্যাতা টাকি ভীত চোখে সাপের কসরত দেখছে এবং নিজেও মুক্ত হবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
সাধু কান খাড়া করলো। ধান ক্ষেতের ওপাশ থেকে কারা যেন নিচু স্বরে কথা বলছে। আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। আবার শোনা গেল কথা। কথা বোঝা যাচ্ছে না। সাধু সন্তর্পণে জাল নামিয়ে ভেলা বেয়ে বাম পাশের ধানতে অতিক্রম করলো। দুটো ধান ক্ষেতের মাঝখানে তাকালো সে, নিমাই!
পরক্ষণেই নিমাইয়ের মাথার পাশ দিয়ে বের হয়ে তুলিকার বিষ্ফারিত চোখ পড়লো সাধুর চোখে। নিমাইও ঘুরে তাকিয়ে মাথা নিচু করলো। সাধু ক্ষীপ্র গতিতে ভেলা সরিয়ে, জলের বুক কুপিয়ে চললো বিলের গভীরের দিকে। বুকের ভেতরটা মুচড়ে যেতে লাগলো ঈর্ষায়। ঈর্ষার গহ্বরে জন্ম হলো ক্ষোভের। আর সেই ক্ষোভ গিয়ে পড়লো নিরীহ ভেলার ওপর। বিকেলে এসে দা দিয়ে কুপিয়ে ফালা ফালা করলো নিজ হাতে বানানো ভেলা! তারপর নির্জনে একা বসে কাঁদলোও!
সাধু আনমনে হাসলো। আজ এতোদিন বাদে দো-গাছিয়ার বাওড়ে এই তিনটে কিশোর-কিশোরকে দেখে তার মনে পড়লো সেদিনের ঐ ঘটনাটা। ‘শালা নিমাইটা একটা হারামী! তুলিকাকে ল্যাঙ মেরে এখন এক শহুরে মেয়ের সাথে প্রেম করছে। তাকেই নাকি বিয়ে করবে। আর তুলিকাও বিয়ে করেছে এক উকিলকে।’ নিজেই নিজেকে শোনালো সাধু।
সাধুর ছেলেবেলার বন্ধুরা সবাই শিক্ষিত। কেউ চাকরি করছে, কেউ এখনও পড়ছে। তার সাথে দূরত্ব তৈরি হয়েছে অনেক আগেই। ওরা যখন লেখাপড়ার জন্য গ্রাম ছেড়েছে তখন থেকেই। তারপর তো সাধুর গায়ে বখাটে ছেলের তকমা লেগেছে, গাঁজাখোর-মাগিবাজের তকমা লেগেছে। গ্রামে এলেও সবাই ওকে এড়িয়েই চলে। কেবল দীপন বাড়ি এলে ওর সাথে কথা বলে, খোঁজ-খবর নেয়। সাধুর তখন অন্যদের মনে পড়ে, কাঁন্না পায়।
বৃষ্টি শুরু হলো। পুরো বাওড় এখন ভিজছে। পদ্মফুল-পদ্মপাতা ভিজছে, কলমীলতা-শালুকফুল জলে হাবুডুবু খাচ্ছে, মৌমাছি, জলপোকারা পদ্মফুলের ভেতরে লুকোতে চাইছে। ডিঙ্গি নৌকায় ছই নেই। কাঠের বাটের বড় একটা ছাতা রাখে আসাদ। সেটার নিচেই দুজন আশ্রয় নিল। অঝোর ধারায় বৃষ্টি। দু-পাশের গ্রামগুলো এখন ঝাপসা। বালিহাঁসগুলো হুটোপুটি খাচ্ছে। পানকৌড়িগুলো থম মেরে বসে আছে কলমী লতার ওপর। দারুন মিষ্টি একটা গন্ধ এখন ভাসছে বাওড়ে। পদ্মফুলের গন্ধ নয়, শালুকফুলের গন্ধও নয়। বাওড়ের শরীরের গন্ধ! জলের বুকের গন্ধ! বৃষ্টি পেয়ে উথলে উঠেছে। আসাদ ছাতা ধরে আছে মাথার ওপর। সাধুর চোখ পদ্মফুলে। পদ্মফুলে হাসছে সখিপুরের মেয়ে!

রাত পোহালে মা দূর্গা খাটে চড়বে। প্রতিমার সাজ-সজ্জার কাজ শেষ। মাকে বরণ করার সকল আয়োজন শেষ। অথচ সাধুর দেখা নেই! গতকাল-ই সন্ধ্যার মধ্যে ফেরার কথা তার। অথচ কাল রাত গিয়ে, আজ দিন ফুরিয়ে আবার সন্ধ্যে! তবু সাধুর টিকিটির দেখা নেই। পূজা কমিটির সভাপতি অশোক নন্দী চিৎকার-চেচামেচি করে বাড়ির দিকে গেলেন। অন্য মাতব্বরেরাও গজগজ করতে করতে বাড়িমুখো হলেন। এখন মন্দিরের বারান্দায় বসে সেবক তিনজন সাধুকে নিয়ে নানান কথার রঙীন জাল বুনছে।
সন্ধ্যা রাতের দিকে গড়ালো। ছেলে-ছোকরারা মন্দিরের চাতাল ফাঁকা করে ঘরে ফিরলো। এবছর মন্দিরের সেবকের দায়িত্বে আছে ষাটোর্দ্ধ আরতী পিসিমা, মধ্য চল্লিশের দুলাল আর মধ্য ত্রিশের গৌড়। আরতি পিসিমা মন্দিরের পাশেই সুবলদের ঘরে শোবে। দুলাল আর গৌড় শোবে মন্দিরের বারান্দায়। গল্প করতে করতে আরতি পিসিমার চোখ উল্টে গেল! আরতি পিসিমার এই এক স্বভাব, এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকলেই তার চোখে ঘুম নেমে আসে। ঘুমোলেও চোখের পাতা বন্ধ হয় না। মণি’র অর্ধেকটা থাকে পাতার নিচে আর অর্ধেকটা বাইরে। ভয়ংকর দেখায়! গৌড় মুখ টিপে হেসে দুলালকে খোঁচা দিল।
‘ও পিসিমা।’ ডাকলো দুলাল।
ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো আরতি পিসিমা, ‘সাধু আসলো রে?’
দুলাল বললো, ‘না। সাধুর আশায় বসে থাকলি, সুখ তারা ডুবে যাবেনে। তুমি যাও ঘুমাও গে।’
সাদা থানের আঁচল মাটি থেকে কুড়িয়ে কাঁধের ওপর ফেলে আরতি পিসিমা শুতে গেল। বিছানা পেতে গৌড় আর দুলাল শুয়ে পড়লো।
সারা গ্রাম এখন সুনসান। মন্দির প্রাঙ্গণ খা খা করছে। গৌড় শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছে। দুলালের ঘুম আসি আসি করছে। তখনই মন্দিরের চাতালের সামনের রাস্তায় একটা ভ্যান এসে দাঁড়ালো। মাটির রাস্তায় ভ্যানের শব্দ পেয়ে মুখ উঁচিয়ে তাকালো দুলাল। দু-জন মানুষ ভ্যান থেকে নেমে মন্দিরের চাতাল পেরিয়ে বারান্দার কাছে এসে দাঁড়াতেই একজনকে চিনলো দুলাল। একজন তো সাধু, বউটি কে!
সাধু পদ্মফুল আর মাটির ব্যাগটা দুলালের হাতে দিল। দুলাল হতবাক হয়ে একবার সাধুর দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার বউটির দিকে তাকাচ্ছে।
‘কি দেখতেছ হা করে! আগে রাখে আসো তারপর কতেছি।’ বললো সাধু।
দুলাল ব্যাগটা মন্দিরের ভেতরে রেখে এসে সাধুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বেত্তান্তডা ক দেহি?’
‘আমার বউ।’ বললো সাধু।
‘অ্যা, সত্যি!’
‘তয় মানষির বউ ধরে আনছি নাকি!’ এরপর বউকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘পোনাম করো, এ দুলাল কাকা।’
প্রণাম গ্রহণ শেষে দুলাল গৌড়’র পেঠে ধাক্কা দিয়ে বললো, ‘ অ গৈরো, গৈরো...। মরার মতো ঘুমাচ্ছিস! এই দ্যাখ সাধু কামডা করছে কি। ক্ষ্যমতা আছে ব্যাটার। পিত্তিমের নাহাল বউ বিয়ে করে আনছে। অ গৈরো...’
গৌড় চোখে মুখে বিরক্তি ফুঁটিয়ে, চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসলো।
‘দ্যাখ সাধুর বউ! বৌমার বাপের বাড়ি কনেরে?’ আবার বললো দুলাল।
‘ঐ তো দো-গাছিয়ার দিকেই।’ সাধুর সাবধানী উত্তর।
সাধুর বউয়ের মুখের দিকে তাকাতেই গৌড় যেন খানিকটা চমকালো! নিমেষেই তার ঘুম মিলিয়ে গেল। চোখ সরিয়ে নিল সাধুর দিকে।
‘এহন আর দাঁড়াবো না কাকা। কাল সহালে আসপানে। চলো।’ বলেই বউকে নিয়ে চলে গেল সাধু। গৌড় স্থির চোখে ওদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলো।
দুলালও সেদিকে তাকিয়ে বললো, ‘সাধুর বউডা ফাইন সুন্দরী নারে?’
‘হুম!’ গৌড়’র গালে হাত।
পরদিন গ্রামে খবর ছড়িয়ে পড়লো সাধু বিয়ে করেছে। সুন্দরী বউ। পাড়া-পড়শীরা দলে দলে দেখতে এলো সাধুর সুন্দরী বউ। সাধুর মা আহ্লাদে আটখানা। বউয়ের জন্য কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। তার ভাঙা ঘরে এমন চাঁদের মতো বউ যে!
সপ্তমীর রাতে সবাই যখন ঘুমালো, তখন সাধু দরজায় শিকল তুলে চুপি চুপি বউকে নিয়ে বাড়ির সামনের কালভার্টের ওপর এসে বসলো। বিছানায় শুয়ে যে বউকে আদর করতে করতে দুজনে নিরিবিলি কথা বলবে, সে উপায় কি আছে! চাটাইয়ের বেড়ার ওপাশেই যে বাপ-মা ঘুমায়!
ফ্যাকাশে আলখাল্লায় হালকা শিশির পড়ে রাতের শরীর ক্রমশ ভারী হতে লাগলো। এখন নৈঃশব্দের প্রহর। তবু নৈঃশব্দের গা থেকেই যেন পলেস্তারার মতো খসে পড়ছে কিছু শব্দ। রাস্তার ধার ঘেঁষা বাবলা গাছে থেকে থেকেই খসখস শব্দ। পাখির বাসায়। কালভার্টের দক্ষিণে ডোবার মাথায় ঘন কোঁকড়া চুলের মতো কচুরীপানা, তার নিচে গহীন কালো জল। সেই জলের কোল থেকে একটা অদ্ভুত ডাক ভেসে আসছে কিছুক্ষণ পরপরই। কচ্ছপের ডাক। শীতের শেষে জল যখন শুকিয়ে যায়। তখন মাছের সাথে কাদার গভীরে কচ্ছপও পাওয়া যায় এখানে। পা ঝুলিয়ে বসে আছে ওরা দুজন। পায়ের নিচে মৃদু কলকল শব্দ। কালভার্টের মুখ দিয়ে জল নেমে যাচ্ছে ‘দ’ আকৃতির নালা বেয়ে বিলে। ওরা কখনও পাশাপাশি বসে একে অন্যের কাঁধে মাথা রেখে, কখনও একজন আরেকজনের কোলে মাথা রেখে শুয়ে, কখনও একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে চাঁদটাকে ডুবিয়ে তবেই ঘরে ফিরলো।
অষ্টমী পূজার দিন সাধু আর সাধুর মায়ের সাথে নতুন বউ অঞ্জলি দিতে গেল মন্দিরে। মন্দিরের চাতালে পা দিতেই সমবেত নারী-পুরুষের মধ্যে শুরু হলো কানাঘুষা। সবাই সাধুর বউয়ের দিকে তাকাচ্ছে, নিজেদের মধ্যে কানাকানি করছে, কেউ বা মুচকি হাসছে। চরিত্রহীন, গাঁজাখোর, বখাটে সাধু আজ সকলের আলোচনার কেন্দ্রে অবস্থান করছে। অথচ সাধু বা সাধুর মা কেউ-ই তা টের পাচ্ছে না। টের পেল তখন যখন সাধুর মা নতুন বউকে নিয়ে মন্দিরের বারান্দায় উঠতে গেল মা দূর্গাকে প্রণাম করার উদ্দেশ্যে।
সাধুর মা মন্দিরে পা দিতেই নলিনী গোঁসাইয়ের বউ চেচিয়ে উঠলো, ‘খবরদার সাধুর মা, ঐ বউ নিয়ে তুই বারান্দায় উঠপিনে!’
সাধুর মা অবাক, ‘কি কতা কন, মা গুসাই! নতুন বউ মারে পোনাম করবিনে?’
‘এ...বেবুশ্যের আবার সগ্গে যাবার সখ!’
কাছেই ছিল সাধু। বেবুশ্যে শব্দটা কানে যেতেই সে ঘুরে তাকালো নলিনী গোঁসাইয়ের বউয়ের দিকে। সাধুর মা কিছু বলতে যাবে তার আগেই নলিনী গোঁসাইয়ের বউ আবার বললেন, ‘তোর ছাওয়াল যে বেশ্যা বিয়ে করে আনছে, এ খবর জানিসনে তুই! এই বউ ঘরে তুলছিস!’
ঘটনা সত্য! দো-গাছিয়ার বিল থেকে পদ্মফুল তুলে সাধু গিয়েছিল সখিপুরের পতিতালয়ে-পতিতালয়ের মাটি আনতে। পতিতার দোরের মাটি ছাড়া দূর্গাপূজা হয় না। পূজা কমিটি গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে সাধুকে মাটি আনার দায়িত্ব দেয়। সাধুর মতো এমন উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে তো আর গ্রামে নেই! অন্তত প্রকাশ্যে। সাধু নিষ্ঠার সাথে এই দায়িত্ব পালন করে। তার রথ দেখাও হয়, কলা বেচাও হয়। কোন বছর বিপত্তি বাঁধেনি। বাঁধলো এবার।
মেয়েটা ছায়ার মতো নয়, চিকের আড়ালের আবছা আলোর মতোও নয়। দীপাবলির আলোর মতো উজ্জ্বল-মাধুরী। মাধুরী, মেয়েটার নাম।
সখিপুরের পতিতালয়ে সাধু প্রায়-ই যায়। যার ঘরে ঢোকে তাকে তুই-তোকারি করে। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে এমন ভাব দেখায় যে, সে একজন ওজনদার খরিদ্দার। তাতে তার আপ্যায়নে ত্রুটি হয় না। দেখতে তো সে একবারে মন্দ নয়!
দ্বিগুণ রেট দিয়ে এবার সে ঢুকেছিল মাধুরীর ঘরে। মাধুরীর রুপের আভায় থতমত খেয়ে গিয়েছিল প্রথমে। ‘তুই’য়ের বদলে মুখ দিয়ে আপনা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল-‘তুমি’। আড়ষ্ট হাতে মাধুরীকে ছুঁয়েছিল ঘরের আলো নেভানোর পর। অবশ্য আড়ষ্টভাব কাটিয়ে উঠেছিল অল্পক্ষণেই। কামগঙ্গার নিপূণ সাতারু সাধু কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝে গিয়েছিল এ গঙ্গায় স্রোত বড় কম। দুকূল উছলানো লীলায়িত ঢেউ নেই। ছলাৎ ছলাৎ শব্দ নেই! কথায়ও চকচকে ধারালো ছুঁড়ির ধার নেই। পরিপাটি চেহারার মতো কথায় পরিপাটির সুস্পষ্ট ছাপ। বোঝাই যায় এ পাড়ার বুনট ধুলোর আস্তরণ, ঘন কাদার প্রলেপ মাধুরীর দেহ-মনের ওপর এখনও পড়েনি। এ মেয়ে হয়তো নতুন! তাই কামবিদ্যা এখনও ভাল মতো রপ্ত করতে পারেনি। খরিদ্দার ধরে রাখার ছলাকলা শেখেনি। এখানকার মেয়েদের শুধু শরীরের ছলাকলা জানলেই হয় না, ছাল ছাড়ানো খানিকটা তেঁতুল, লবণ আর মিষ্টি মেশানো কথা জানতে হয়। আবার ধেনো মরিচের ঝাঁঝও থাকতে হয়। মাধুরীর যেন কোনটাই নেই! আছে অপূর্ব সুন্দর মায়াময় ফর্সা মুখমন্ডলী, মোহনীয় দেহবল্লরী আর মন কেমন করা দুটো চোখ। যে চোখদুটির কাছে নতজানু হয়ে গেছে সাধু।
‘তুমি নতুন?’ কামগঙ্গায় ডুবসাঁতার শেষে মাধুরীর পাশে রতিকান্ত শরীর রেখে বলেছিল সাধু। তখনও ঘর অন্ধকার।
‘হুম।’ কয়েকমুহূর্ত সময় নিয়ে বলেছিল মাধুরী।
‘কদ্দিন হলো?’
‘দুই মাস।’
‘ক্যান আসলে এই লাইনে?’
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো মাধুরী। সাধু মাধুরীর মুখে, চুলে হাত বুলিয়ে ওর মাথাটা টেনে নিল নিজের রোমশ বুকের কাছে।
মাধুরীর এখানে আসার গল্প এখানকার আর পাঁচটা মেয়ের মতোই। চেনা গল্প। গ্রামের নিন্মমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। মফস্বল শহরের একটি কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে মেসে থাকতো। ফোনে কথা হতো অচেনা এক ছেলের সঙ্গে। ছেলেটি ব্যাংকার, ঢাকায় নিজস্ব ফ্যাটে বাবা-মা’র সঙ্গে থাকে, আর কোন ভাই-বোন নেই, বাবা-মা দুজনই সরকারী কর্মকর্তা ইত্যাদি। বলেছিল মাধুরীকে। অতঃপর প্রেম। সেদিন বিকেলে ছেলেটির হাত ধরে নৌকায় ঘুরতে বেড়িয়েছিল পদ্মার বুকে। ছেলেটির কাঁধে মাথা রেখে আগামী দিনের স্বপ্ন বুনছিল মাধুরী। কথা জানতো ছেলেটি। কথার মনোমুগ্ধকর বুননে আরেক জগতে নিয়ে যেতে পারতো। কি করে যে সে তন্দ্রচ্ছন্ন হয়েছিল জানে না। যখন তন্দ্রা ভাঙলো, তখন সে সত্যি সত্যিই নিজেকে আবিষ্কার করলো আরেক জগতে। যে জগতের মোহে তার কাছে গিয়েছিল সাধু।
অবশ্য সাধুকে সে অতীত জীবনের সব কথা খুলে বলেনি। শুধু বলেছে, সে ভালবাসার মানুষটির সাথে ঘুরতে বেড়িয়েছিল। মানুষটি তাকে এখানে বেঁচে দিয়েছে।
‘আমারে তুমি বিয়ে করবা?’
আচম্বিত এমন প্রশ্ন শুনে মাধুরী প্রথমে থমকালো। তারপর বাম হাত দিয়ে সুইচ টিপে বাতিটা জ্বেলে দিল। মাধুরী সাধুর মুখের দিকে তাকালো। তার ভালবাসার মানুষটির মুখের সাথে মেলানোর চেষ্টা করলো। এও কি আরেক প্রতারক। তাকে নিয়ে নতুন কোন প্রতারণার ফাঁদ পাতছে?
‘মা কালির কিরে, তুমি যদি আমারে বিয়ে করো আর কোনদিন মাগিপাড়া আসপো না। কোন নেশাও করবো না।’ উঠে বসলো সাধু।
‘তুমি নেশা করো?’
‘করি। গিরামে আমার হেভি বদনাম। বিড়ি-সিগারেট খাই, গাঁজা খাই, আবার মাঝে মাঝে বাংলা মদও খাই।’
মাধুরীর তালগোল পাকিয়ে যায়। তাকে বিয়ে করতে চাইছে, আবার নিজের সম্পর্কে এমন একান্ত গোপন কথাও বলছে! নাকি তাকে নিয়ে কোন ছক কষছে ও? এখান থেকে তাকে বের করে অন্য কোথাও বিক্রি করে দেবে? সে শুনেছে, দেহ বিকিকিনির এই বাজারে তার দারুণ চাহিদা। এখানকার মাসি তাকে চড়া দামে একটা পার্টির কাছে বিক্রি করে দেবে। এরপর তার দেহসুধারস ঢালতে হবে দামী হোটেলে, ধনী খরিদ্দারের লালসার কামপল্লবে।
অতঃপর ভোর রাতে সাধুর হাত ধরে পালালো মাধুরী। পিছনে তাড়া করেছিল দালালরা। ধরতে পারেনি। গৃহস্থ বাড়ির উঠোন, আদাড়-বাদাড় পেরিয়ে পতিতালয়ের অল্প দূরত্বে নদীর পাড়ে এসে নৌকায় এসে উঠেছিল ওরা। ক্ষিপ্র গতিতে নৌকা বেয়ে সাধু তাকে নিয়ে অচেনা এক বাজারের ঘাটে যখন উঠলো, তখন সূর্য উঠে গেছে। তখন মাধুরীর মাথার যুদ্ধ চলছিল। যে করেই হোক সাধুর কাছ থেকেও পালাতে হবে। কিন্তু তারপর কি করবে, বাড়ি ফিরে যাবে? বাবা-মা কে কি বলবে? গ্রামের লোকজন তাকে দেখতে ভিড় করবে। তাদের কৌতুহলী প্রশ্নবাণে জর্জরিত হবে সে। কোনো বিশ্বাসযোগ্য উত্তর কি সে তাদের দিতে পারবে? নাকি গত দু-মাসে বাবা-মা’র মেয়ে হারানোর থিতিয়ে আসা শোকের সাথে নতুন করে যুক্ত হবে অপমান! তাকে নিয়ে বিব্রত হবেন বাবা-মা। আবার সাধুর মতো অশিক্ষিত, চরিত্রহীন গোঁয়ারকেই বা সে কেমন করে বিয়ে করবে? যদিও সাধুকে বিয়ে করবে বলে সে কথা দিয়েছে। কিন্তু সে তো কেবল পালানোর জন্য!
নৌকা বাইতে বাইতে সাধু হঠাৎ বললো, ‘চলো, তোমারে তোমার বাড়ি পৌঁছায়ে দেই।’
মাধুরী অবাক হয়ে তাকিয়েছিল সাধুর দিকে।
সাধু আবার বললো,‘আমি গরিবের ছেলে। মানুষে কয় বখাটে। তোমার পাশে আমারে মানাবেন না। তুমি বাড়ি-ই ফিরে যাও।’
গত দু-মাসে পুরুষজাতটার প্রতি ঘেন্না ধরে গেছে মাধুরীর। তার কাছে পুরুষ মানেই প্রতারক আর দেহলোভী এক অদ্ভুত পিশাচ। তখন পর্যন্ত সাধুকেও সে তাই মনে করতো। বিয়ে করে আজীবন তার শরীরটাকে ভোগ করবে বলেই পতিতালয় থেকে তাকে মুক্ত করে এনেছে। অথচ সকালের আলোয় সাধুকে আবার নতুন করে চিনতে হলো।
‘নইলে এক কাজ করো। তোমার বাবা-মা’রে ফোন করো, তারা আসে তোমারে নিয়ে যাক।’ বললো সাধু।
‘না।’
‘না ক্যান?’
‘তুমি না কইলে আমারে বিয়ে করবা?’
‘তুমি দেখতি কতো সুন্দর। আমার চেয়ে অনেক ভাল জামাই পাবা তুমি।’
‘কে আমারে বিয়ে করবে? আমি যে.....।’
‘ধূর! ওসব ভুলে যাও। তুমি তো আর ইচ্ছে করে যাও নাই। অ্যাকসিডেন্ট! সংসারে থাকেও কতো মানুষ ছেনালিপানা করতেছে, আবার সংসারও করতেছে। তাগের চেয়ে বেশ্যারাও ভাল।’
বেশ্যা শব্দটা শুনেই জলের দিকে চোখ নামিয়ে নিল মাধুরী। সাধু হয়তো সেটা ধরতে পেরেই বললো, ‘তুমি কিছু মনে করো না। আমি অমনই। মুখে যা আসে কয়ে ফেলি। আর এহন তো তুমি আর বেশ্যা না।’
মাধুরী এবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো সে সাধুকেই বিয়ে করবে। সাধু পুরুষজাত, সাধু চরিত্রহীন। কিন্তু সাধু অন্যরকম। শুধু সঠিক পরিচর্যার অভাবেই হয়তো সাধু এমন হয়েছে। সাধুর মতো আরো অনেক সাধুর জীবন হয়তো বখে যায় এমনিভাবে। কিন্তু সুললিত পরিচর্যা পেলে সাধুদের জীবনও যে সুন্দর হতো না কে বলতে পারে! সাধুকে আরেকবার বাজিয়ে দেখতে মাধুরী বললো, ‘আমার ইজ্জত নাই, লোকে তোমাকে মন্দ বলবে, এজন্যে তুমি আমারে বিয়ে করতে চাও না, না?’
সাধুর মুখটা কালো হয়ে গেল। এমনটা সে একবারের জন্যও ভাবেনি। বাজারের ঘাটে নৌকা থামিয়ে সাধু খাবার আনতে গেল। খাবার খেয়ে আবার নৌকা ছাড়লো সে। কিছুটা আসার বৈঠাটা নৌকার পাটাতনে রেখে মাধুরীর কাছে গিয়ে বসলো। নৌকা স্রোতের টানে এলোমেলোভাবে ঘুরতে ঘুরতে ভাটির দিকে যেতে লাগলো।
‘বৈঠা তুলে রাখলে যে? নৌকা তো ডুবে যাবে!’
‘ডুববেন না।’
সাধুর দৃঢ় উত্তর শুনে মাধুরী তার মুখের দিকে তাকালো, ‘কি হলো?’
‘সাধু কোন কিছুতে ভয় পায় না। সাধুর কোন লজ্জা-শরমের বালাই না। সাধু বুক ফুলাইয়ে কইতে পারে, যে তার বউ দুই মাস বেশ্যাখানায় ছিল। সাধু কাউরে পরোয়া করে না।’
পকেট থেকে একটা সিঁদুরের কৌটো বের করলো সাধু। বাজার থেকে কিনে এনেছে। আঙুলের ডগায় সিঁদূর নিয়ে পরিয়ে দিল মাধুরীর সিঁথিতে-কপালে। মাধুরীর মুখ থেকে একটা কথাও বের হলো না। সে কেবল বিষ্ময়ে সাধুর দৃঢ়তা দেখলো। মুহূর্তেই চোখটা ভারী হয়ে উঠলো। সাধু সিঁদূরের কৌটোটা ছুঁড়ে ফেলে দিল নদীর জলে। রক্তাভ জলের আয়নায় উঁকি দিচ্ছে সূর্য। ঢেউয়ের মাথার গুতোয় ছড়িয়ে পড়লো রক্তবর্ণ। মিশে যেতে লাগলো জলের শরীরে। মাধুরী সেদিকে তাকিয়েই রইলো!

মন্দিরের চাতালে ছিড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কৌতুহলী লোকজন ঘন হয়ে এলো। তাদের দৃষ্টি উড়ছে মাধুরীর মুখে, সারা শরীরে। পরিবেশ আর সাধুর অনুকূলে থাকলো না। মন্দিরের বারান্দায় বসে অঞ্জলি দেওয়া দূরে থাক। সাধুকে গ্রামছাড়া করার কথাও উঠলো। সাধুর মা চাতালের একপাশে বসে আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো। সাধু বুঝলো কথা বলে আর কোন লাভ নেই। এই সমাজে গৃহী, সংসারী পতিতার স্থান আছে, মাধুরীর মতো পতিতার স্বীকৃতি নেই। এরপর সবাই তাকে নিয়ে শালিশে বসবে। তারপর তাকে গ্রামছাড়া করবে। সেই অপমানের চেয়ে এখনই গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া ভাল। কিন্তু একটা ব্যাপার সাধু কিছুতেই বুঝতে পারছে না, মাধুরী যে পতিতালয়ে ছিল এই খবর গ্রামে চাউর হলো কি করে! সে তো কাউকেই বলেনি। সাধু মাধুরীর হাত ধরে বললো, ‘চলো। এই গ্রামের তে আজ আমার বরাত উঠলো।’
মাধুরী সাধুর দিকে তাকালো। সাধু কেমন অনুদ্বিগ্ন। যেন এর জন্য সে প্রস্তুতই ছিল। মা দূর্গার চোখে চোখ রেখে যেন মৌন অনুযোগ ছুঁড়ে দিল মাধুরী, ‘কাল রাতে আমি নিজ হাতে আমার ঘরের দরজার সামনে থেকে মাটি খুঁড়ে আনলাম। সে মাটি হলো তোমার নৈবদ্য। আর আমার জন্য যত অপমান। অঞ্জলি দেবার সুযোগটুকুও দিলে না! সত্যিই পাথুরে প্রতিমা তুমি, তোমার হৃদয় বলে কিছু নেই। আর তোমার এই ভক্তরা! এরা তো না বোঝে পরান, না বোঝে পুরাণ! কেবল স্রোতে ভেসে যায়।’
সাধু মাধুরীর হাতে চাপ দিল, ‘চলো।’
সাধুর হাত ধরে কয়েক পা এগিয়ে পিছন ফিরে বারান্দায় বসে থাকা গৌড়’র দিকে তাকালো মাধুরী। গৌড় চোখ নামিয়ে নিলো। মাধুরী আনমনেই যেন মুখ টিপে হাসলো গৌড়’র অবনত মুখের দিকে তাকিয়ে। মাধুরী আবার পা মেলালো সাধুর সাথে। মজা দেখতে থাকা মানুষগুলো পথ করে দিল ওদের। ওরা রাস্তায় উঠতেই উচ্চস্বরে শোনা গেল সাধুর মায়ের কাঁন্নার রোল। দাঁড়ালো না ওরা। রোদ চড়েছে। সামনে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। কাদামাটির উঁচু-নিচু পথ!

 

 

 

 

 

 

২ Likes ১২ Comments ০ Share ৫৬১ Views

Comments (12)

  • - নীল সাধু

    কবিকে হতে হবে দ্রষ্টা, সে শুধু ভবিষ্যত দেখবে না-দেখবে নিজের অন্তঃকরণ, ছায়া, মগ্নচৈতন্য-হৃদয় খুঁড়ে জাগাবে বেদনা, স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, ললাটিলিপির মতো যুক্তিহীনতা

     

    এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত পোষ্ট আশা করছি কবি তাহমিদ। 

    ভালো লেগেছে পোষ্ট।

    পোষ্টে প্লাস +

     

    • - তাহমিদুর রহমান

      লিখব অবশ্যই লিখব। আসলে ব্লগিং প্ল্যাটফর্মটা এদিক দিয়ে আসলেই অনন্য। এসব প্রিন্ট নিউজপেপার আর অনলাইন নিউজপেপারের চেয়ে অনেক আরামদায়ক।

    - লুব্ধক রয়

    ধন্যবাদ।

    বর্তমানে ফেসবুক বা ব্লগে এই ধারার কবিতা কেউ কি লিখছেন? আপনার জানা আছে?

    • - তাহমিদুর রহমান

      ইতিহাস সময়ের মধ্যেও যোগসূত্র এঁকে দিচ্ছে।

    - শাহ মাইদুল ইসলাম

    কবিতা সম্পর্কে এমন সুন্দর আলোচনার জন্য লেখককে ধন্যবাদ। এরকম লেখা আরো বেশি চাই।

    • - তাহমিদুর রহমান

      লিখব অবশ্যই লিখব।

    Load more comments...