Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

রাজু আহমেদ

৯ বছর আগে

নিরাপরাধ মানুষ হত্যা ও গণতন্ত্রের চর্চায় কার্যকারণ নীতি

দর্শনের ইতিহাসে মহামতি এরিস্টটলের কার্যকারণ তত্ত্ব বহুল আলোচিত একটি অধ্যায় । এরিস্টটল তার জগৎ সৃষ্টি বিষয়ক আলোচনা থেকে শুরু করে পৃথিবীর সকল ঘটনা-দূর্ঘটনার পিছনে কার্যকারণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন । বহুধা গুনান্বিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক ও দার্শনিক এরিস্টটলের মতে, প্রতিটি কার্য সংঘটিত হওয়ার অন্তরালে একটি কারণ থাকে । সে কারণটি কাজের অদূরে কিংবা দূরেও থাকতে পারে । তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, কার্যকারণ নীতি অনুসরণ করা ব্যতীত কোন ঘটনা কিংবা দূর্ঘটনা সংঘটিত হতে পারে । যদিও আধুনিক যুগের সংশয়বাদী দার্শনিক ডেভিড হিউম এরিস্টটলের কার্যকারণ নীতির সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন তবুও এরিস্টটলের কার্যকারণ বিষয়ক আলোচনা উপেক্ষা করা যায়নি বরং ডেভিড হিউমের যুক্তিকে অনেকটা সমালোচিত হতে হয়েছে । দর্শন থেকে এবার ফিরে আসতে চাচ্ছি বাংলাদেশের রাজনীতিতে । দর্শনের আলোচনার সাথে দেশের রাজনৈতিকে প্রেক্ষাপট মিলিয়ে দেখতে চাই, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং জ্বালাও পোড়াওসহ মানুষ হত্যার রাজনীতিতে কার্যকারণ নীতি কতটুকু প্রভাব ফেলছে । স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যার শিকার হতে হয়েছে অসংখ্য মানুষকে । স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান, স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান, জাতীয় চার নেতাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে জীবন দিতে হয়েছে কেবল রাজনীতির কূট-কৌশলের ষড়যন্ত্রে । এ দীর্ঘ সময়ে যতজন রাজনৈতিকক নেতা-কর্মীকে জীবন দিতে হয়েছে তার চেয়ে নিরাপরাধ নিরীহ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে অনেক বেশি অথচ এরা দেশের রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় নি । তিন বেলা খেয়ে বেঁচে থাকাই ছিল যাদের একমাত্র লক্ষ্য সেই মানুষগুলোকে কেন জীবন দিতে হয়েছে তার কৈফিয়ত দেয়ার জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি বরং রাজনীতির জ্ঞানশূণ্য যে সাধারণ মানুষগুলো বিভিন্নভাবে নিহত হয়েছে তাদেরকে নিয়েও করা হয়েচে রাজনীতি । নিরাপরাধ নিহতদেরকে বিভিন্ন দল তাদের সমর্থক দাবী করে রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে । অথচ এই স্বার্থালোভী রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতার মসনদের আরোহন করেছে তখন একটি বারের জন্যও নিহতের পরিবারের খোঁজ নেয়নি । সাধারণ বাংলাদেশীরা খুব বেশি বুদ্ধিমান না হলেও একেবারে বোকা না হওয়ায় দেশের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ মেলানোর কাজে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করার কথা স্বেচ্ছায় ভূলে গেছে । বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানে দাবী করা হয়, দেশের মোট জনসংখ্যার ৯০ ভাগেরও কিছু বেশি সংখ্যক রাজনীতি পছন্দ করে না । অথচ সুষ্ঠু গণতন্ত্রের চর্চা হলে পরিসংখ্যান ঠিক উল্টো হত । তখন ১০ শতাংশও পাওয়া যেত না যারা রাজনীতি নিয়ে নিজেদের মতামত ব্যক্ত না করে । নগণ্য সংখ্যক রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী যখন গোটা জনসমষ্টিকে জিম্মি করে জনমতকে উপেক্ষা করে নিজেদেরকে ক্ষমতার চেয়ারে রাখতে চায় তখন অন্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা তাদের স্বার্থ ফিরে পেতে শান্তির পথ ত্যাগ করে ক্ষমতা ফিরে পেতে চায় । দু’ই দলের লড়াইয়ে জীবন দিতে হয় নিরীহ সাধারণ মানুষকে ।  রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের অনেকের যে জীবন যায়না তা নয় তবে সে অনুপাত সাধারণ মানুষের তুলনায় নিতান্তই কম । তবুও দুঃখ ছিল না যদি দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের চর্চা হত । ১৯৯৬ সালের বির্তর্কিত নির্বাচন এবং বিএনপির ২১ দিন ক্ষমতায় থাকা এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী আরেক বিতর্কিত নির্বাচন এবং আওয়ামীলীগের বহাল তবিয়তে ক্ষমতা বসে থাকায় গণতন্ত্রের দাফন হয়ে গেল । মানুষ হত্যার হলিখেলায় মেতে উঠেছে দেশ । অগণিত সাধারণ মানুষের জীবন নেয়া হয়েছে অথচ তারা জানতেই পারলনা তাদের অপরাধ কি ? জীবন ও জীবিকার তাগিদে বাসা থেকে কর্মস্থানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে পথিমধ্যে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে জীবনের ইতি ঘটল । যিনি মারা গেছেন তিনি হয়ত মরে বেঁচেছেন কিন্তু তার আয়ের ওপর নির্ভরশীল পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের করুণ দশায় বেঁচে থাকার চেয়ে তাদেরও মরন হলে তারাও মুক্তি পেত ।

 

৮ম জাতীয় সংসদের শাসকদল বিএনপি-জোট ক্ষমতা হস্তান্তরের পর থেকেই দেশে রাজনৈতিক সংকট ঘণীভূত হয় । গণতান্ত্রিক মনস্ক রাজনৈতিক দলগুলো যখন নিজেদের মধ্যে আপোস মীমাংসায় ব্যর্থ হয় তখন দেশের ঘাড়ে সেনাশাসন চেপে বসে । যদিও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সেনাশাসন কাম্য নয় তবুও বলতে দ্বিধা নাই, সেনাশাসনের আমলে দেশের ১০ ভাগ মানুষ ব্যতীত সকলেই শান্তিতে ছিল । তবুও কেউ চায়নি সেনাশাসন দীর্ঘস্থায়ী হোক । কেননা সেনাশাসনের সময়টাতে আন্তর্জাতিক মহলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন এবং বৈদেশিক সাহায্যের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায় । ২ বছরের সেনাশাসনের সময়টাতে দেশের প্রধান দু’রাজনৈতিক দলের প্রধান নেত্রীদ্বয়কে জেলে যেতে হয় এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদেরকে চরম অত্যাচারের মূখোমুখি হতে হয় । যদিও বিএনপির তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান ও বিএনপির নেতাদেরকে বেশি নির‌্যাতন করা হয় তবুও নবম জাতীয সংসদে নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মেয়াদে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলুপ্তি করেন এবং সংবিধানের বিধি মোতাবেক নির্বাচিত সরকারের অধীনেই নির্বাচন আয়োজন করেন । সংবিধানের সে বিধি মোতাবেক দশম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে আওয়ামীলীগ পুনরায় সরকার গঠন করলেও অন্যতম বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ দেশের নিবন্ধিত দুই-তৃতীয়াশ রাজনৈতিক দল সে নির্বাচনে অংশগ্রহন না করায় দেশের রাজনীতিতে অসনি সংকেত দেখা দেয় ।

 

গত ৫ জানুয়ারী সরকার দশম জাতীয় সংসদের বর্ষপূর্তি উদযাপন করেছে । ঐ দিনে বিএনপি এবং তাদের জোট সমর্থকরা ঢাকায় সমাবেশ করার অনুমতি চাইলে এবং বিএনপি ও আওয়ামীলীগ পাল্টাপাল্টি কর্মসূচী ঘোষণা করায় ঢাকা মেট্রোপলিটন কর্তৃপক্ষ সকল ধরণের প্রকাশ সভা সমাবেশের ক্ষেত্রে ১৪৪ ধারা জারি করে এবং বিএনপি নেত্রীকে তার গুলশানের অফিসে বালির ট্রাক ও অসংখ্য আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয় । যদিও ১৪৪ ধারা বহাল থাকলেও ক্ষমতাশীনদের নেতা-সমর্থকরা পুলিশি পাহারায় কয়েক দফা কর্মসূচী পালন করেছে । অন্যদিকে বিএনপি নেত্রী বিকালে তার কার‌্যালয় থেকে বের হতে চাইলে তাকে লক্ষ্য করে পিপার স্প্রে করা হয় । তখন বিএনপি নেত্রী দেশব্যাপী টানা অবরোধের ঘোষণা দেন । টানা অবরোধ ও বিভিন্ন স্থানে হরতাল পালনে করতে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মী ও পুলিশের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে । এ পর‌্যন্ত ২৫ জন মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে । যার মধ্যে নিরীহ মানুষের সংখ্যাই বেশি । ২’শতাধিক বাস-ট্রাক পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে দেয়া হয়েছে । অগ্নিদগ্ধ হয়ে কিংবা অন্যভাবে আহত হয়ে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছে হাজার হাজার মানুষ । গ্রেফতার হযে কারবারস করছে অসংখ্য । উদ্দেশ্যমূলকভাবে মামলার আসামি হয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ । জীবনের অনিরাপত্তাহীনতায় ভূগছে কোটি কোটি সাধারণ মানুষ । এভাবে আর কতদিন চলতে পারে ? বিএনপির নেতারা বলছে চলমান আন্দোলনে যদি বিএনপি সফল না হয় তবে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যাবে অন্যদিকে আওয়ামীলীগ যদি বিএনপিকে দমন না করতে পারে তবে আওয়ামীলীগ অস্তিত্বহীনতায় পড়বে বলে আওয়ামীলীগের কতিপয় মন্ত্রী মনে করছে । একপক্ষের জনসমর্থন অন্যপক্ষের সরকারি প্রশাসন এখন মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে । মধ্যখানে দেশের সাধারণ মানুষ পিষ্ঠ হচ্ছে এবং বিভিন্ন অঙ্গনের ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসানীতে পড়েছে । যে কারণে দেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড গার্মেন্টস শিল্পে প্রায় ধ্বস নেমেছে ।  শীতের মওসুম হওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের উত্তরাঞ্চলের সবজি উৎপাদনকারী কৃষক শ্রেণী । অবরোধের কারণে ট্রাক চলাচল বিঘ্নিত হওয়ায় কৃষকরা প্রায় মরতে বসেছে ।

 

এখন পর‌্যন্ত ২৫ জন মানুষ নিহত হয়েছে । এ সংখ্যাই কি শেষ ? কারো মধ্যে নমনীয়তার লক্ষণ নাই । আওয়ামীলীগ দাবী করছে, সকল দায়ভার বিএনপিকে নিতে হবে । বিএনপি বলছে, সকল দায় সরকারের । এভাবে পারস্পরিক দোষারোপের সংস্কৃতিতে সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করবে কে ? যতদূর মনে পড়ে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দশম নির্বাচনের পূর্বে বলেছিলেন, সংবিধানের নিয়ম রক্ষা করতেই নির্বাচন করা হচ্ছে । নির্বাচনের পর আলোচনার মাধ্যমে একটি মধ্যবর্তী নির্বচনের আয়োজন করা হবে । কিন্তু নির্বাচিত হয়ে প্রধামন্ত্রী বোধ হয় সে কথা ভূলে গেছেন । আওয়ামীলীগের বিভিন্ন পদমর‌্যাদার নেতারা ভিন্ন ভিন্ন কথা বলছেন । কেউ ২০১৯ আবার কেউ আরেকটু এগিয়ে ২০৪১ সালের কথাও বলছেন ! সাধারণ মানুষ রাজনীতি বিমূখ হলেও দেশের স্বার্থে একতাবদ্ধ হতে জানে । ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশগ্রহন করেছিল তাদের সবাই রাজনীতি করত না কিংবা স্বাধীনতার সংজ্ঞাও জানত না । তবুও সকলের হাত ধরেই দেশ স্বাধীন হয়েছিল । আওয়ামীলীগ কিংবা বিএনপি অথবা অন্যকোন দলের যারাই ক্ষমতায় থাকুক তাতে সাধারণ মানুষের খুব বেশি কিছু আসে যায়না বরং দেশের জনগণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শান্তিতে থাকতে চায় । সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করার অধিকার দেশের কোন রাজনৈতিক দলের নাই । রংপুরের মিঠাপুকুর এলাকায় পেট্রোল বোমা মেরে যাদেরকে মারা হয়েছে তারা রাষ্ট্রের কোন স্বার্থের বলি হল ? বিএনপি কিংবা আওয়ামীলীগ কেউ এ হ্ত্যার দায় এড়াতে পারবে না । জনতার আদালতে তাদের বিচার হবেই । একদলের সরাসরি অপরাধ এবং অন্য দল কার্যকারণ নীতি চর্চার করাতে বাধ্য করার কারণে দু’পক্ষকেই কৈফিয়ত একদিন দিতেই হবে । দু’দল আলোচনার মাধ্যমে যতদ্রুত শান্তির পথে আসতে পারবে তা তাদের জন্যই মঙ্গলের । জনগণকে নিরাপত্তা দেয়া যাদের দায়িত্ব সেই তারাই উল্টোপথে হাটলে জনতা ক্ষমা করবে না । আজ অথবা কাল এর খেসারত দিতেই হবে ।

 

রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।

raju69mathbaria@gmail.com

০ Likes ০ Comments ০ Share ৩৫১ Views