Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

রাজীব নূর খান

৭ বছর আগে

ধাবমান কালো চোখে আলো নাচে-৫ (ধারাবাহিক উপন্যাস)

'...শুন্যে দিলাম উড়ারে ভাই যাইতে চান্দের চর, ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কইলকাত্তার উপর । তোমরা আমায় চিনোনি ... '

পাকিস্তানের জাতীয় কবি আল্লামা ইকবাল তার বাবাকে কথা দিয়েছিলেন তিনি কবিতা লেখার বিনিময়ে কোন অর্থ নিবেন না। সব কথা রাখা যায় না, একসময় টাকার অভাবে কবিতা দিয়েই জীবন নির্বাহ করতে হলো তাকে। কবিতার জন্য পেয়েছিলেন বৃটিশ সরকারের দেয়া নাইট উপাধি। বৃটিশদের নাইট উপাধি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও পেয়েছিলেন, যদিও পরে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে এই নাইট উপাধি ত্যাগ করেন। তবে এই দুজনের মিলও আছে। মিলটা কবিতা দিয়ে রাষ্ট্রে প্রভাব ফেলায়। ইকবালের লেখার দ্বারা খুব প্রভাবিত আরও দুজন মানুষ ছিলেন। একজন পাকিস্তানের কায়েদ-ই-আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। 
শশীভূষন অবাক! সত্যি সত্যি দেশটা ভাগ হয়ে গেল। তার বুকটা কেমন খালি খালি লাগছে। তার মেয়ে অলকা লেখা পড়া শেষ করে আমেরিকা থেকে কবে ফিরবে কে জানে!  দেশ ভাগ হয়ে ভালো হলো কি মন্দ হলো তিনি কিছুই ঠাওর করতে পারছেন না। দেশভাগ কি জরুরি ছিল? আর সেই চিন্তা তিনি এই বয়সে করতে চান না। তিনি জানেন, বিপুল সমুদ্রের মধ্যে নেমে পড়লে পথভ্রান্ত হবার সমূহ সম্ভাবনা। তবুও ব্রিটিশ আসার আগে হিন্দু মুসলিম তো একই দেশে ছিল পাশাপাশি । ধর্মীয় ব্যাপারটা এত প্রকট হয়ে দেখা দেয় নি। পলাশীর যুদ্ধে মুসলিম নবাবের হয়ে হিন্দুরাই তো মরণপণ লড়েছিল। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?  জিন্নার দাবি অনুসারে মুসলিমরা যদি একটি পৃথক জাতি হয়, তা হলে ভারত আসলে কী? দেশভাগের পর যা রইল, তা কি একটি জাতি নয়? আমরা কি অনেকগুলি গোষ্ঠীর একটি সমষ্টি? নাকি জিন্নার কথামতো, অনেকগুলি জাতির সহাবস্থান মাত্র?

আসলে ব্রিটিশ শাসক হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়কে ব্যবহার করেছে নিজের সুবিধা মত। মুসলিমরা শিক্ষায় ও চাকুরিতে পিছিয়ে পড়েছে , দোষ হয়েছে হিন্দুদের। সেই অবস্থা কাজে লাগিয়েছে শাসক। মুসলিম কৃষকেরা ব্রিটিশ করের বোঝা বয়েছে; দোষ হয়েছে হিন্দু জমিদারদের। ব্রিটিশ শাসক সেটাকেও কাজে লাগিয়েছেন নিপুনভাবে। কার লাভ কার ক্ষতি কে তার বিচার করে। একটি দেশ ভেঙে তিনটি দেশ। সন্ত্রাস, দারিদ্র, রাজনৈতিক ওলট পালট, দুর্নীতি কি... নেই ! দেশভাগে যা হওয়ার কথা ছিল, হল ঠিক তার উলটো। দুই জাতির মধ্যে বিদ্বেষ দূর করার চাইতে বরং হিন্দু, মুসলিম, শিখ প্রভৃতি পরিচয় আরও উসকে দিল।

অলকা তার বাবাকে চিঠি লিখেছে। ডাকপিয়ন সকালে চিঠি দিয়ে গেছে। অলকা'র চিঠি পেলেই শশীভূষনের মনটা খুশিতে ভরে যায়। তিনি ডাকপিয়নকে বখশিস দেন। অলকা চিঠিতে তার বাবাকে লিখেছে- বাবা, কিছু ঘটে গেলে তা সহজ ভাবেই মেনে নেয়াই ভালো। গতমাসে তোমার চিঠি পড়ে মনটা ভীষন খারাপ হয়েছে। দেশভাগ ব্যাপারটা কেন তুমি মেনে নিতে পারছো না? কেন এক আকাশ সৃতি বুকে ধরে রেখে কষ্ট পাচ্ছো? তুমি দেশভাগ নিয়ে আমার মতামত জানতে চেয়েছো। তাই বলি- আমার মতে দেশভাগের মূল কারণ ছিল ধর্ম । হিন্দু ও মুসলমান কোনকালেই মিলেমিশে থাকেনি। তারা দুই পৃথক জাতির মতই ছিল । ইংরেজদের কোনো দোষ নেই। তারা যেমনভাবে হিন্দু আর মুসলমানকে দেখেছিল, তেমনভাবেই তারা ইতিহাস লিখেছে।



বাবা ভুলে গেলে চলবে না, মুঘল আমলে সামান্য কারণে দাঙ্গা হত। যদিও তখন দাঙ্গা গুলো একতরফা হত। হিন্দুদের বিরুদ্ধে। কারণ তখন মুসলিম আমল। ১৭২০ সালে কাশ্মিরে এক মুসলমানের প্রতিহিংসাবশত দাঙ্গা হয়। ১৭২৯ সালে দিল্লিতে এক মুসলমানের হত্যাকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা হয়। ১৭৮২ সালের ডিসেম্বর মাসে আসামে মুসলিমরা হিন্দুদের মহরমের সময় তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে বলে, হিন্দুরা অসম্মত হয়- পরিনামে দাঙ্গা। ১৭৮৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বেড়ার জেলায় মুসলিমরা হিন্দু ধর্মীয় উত্সবে সশস্ত্র হামলা করে। ১৮০৯ সালে বারানসিতে হিন্দুরা একটা বাড়ি বানাচ্ছিল মসজিদ আর বিশ্বেশ্বরের মন্দিরের মাঝে- তাই নিয়ে দাঙ্গা শুরু হয়। ১৮৭৪ সালে বোম্বেতে এক পার্সি প্রফেটদের উপর এক বই লিখে, সেই বই নিয়ে দাঙ্গা। এই রকম বহু উদাহরণ আছে।

তারপর, ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মুসলিমদের জমানা গেছে। তাই এবার দাঙ্গা গুলোর চরিত্র কিছুটা বদলেছে। এবার একতরফা হিন্দুরা মার খেল না। তারা পাল্টা মার দিতে শিখলো। ১৮৮৯ সালে দিল্লিতে এক হিন্দুর ধর্মান্তরকরণ নিয়ে দাঙ্গা বাঁধে তখন ১৮৯১ সালে কলকাতায় মসজিদ বানানো নিয়ে দাঙ্গা লাগে। ওই একই বছরে পলাকাদে হিন্দু ধর্মীয় মিছিলের উপর মুসলিম আক্রমন হয়। ১৮৯২ সালে প্রভাসপাতনে মহরম নিয়ে হিন্দুরা দাঙ্গা লাগায়। ১৮৯৫ সালে পোরবন্দর-এ হিন্দুর ঘরের পাশ দিয়ে মুসলিম ধর্মীয় মিছিল বেরোলে হিন্দুরা আক্রমন করে। এইরকম হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে বহু দাঙ্গা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। আমি আমেরিকা আসার দুই বছর পর লাখ লাখ মানুষ ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় নিহত হয়। এদের ঘৃণা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে মুসলিম প্রধান এলাকায় হিন্দুদের দেখামাত্র হত্যা করা হতো আর হিন্দু প্রধান এলাকায় মুসলমানদের দেখামাত্র হত্যা করা হতো।

ইংরেজরা এইসব দাঙ্গা দেখে হিন্দু আর মুসলিমদের দুই পৃথক জাতি ভেবে নিল। ভাবাটাই কি স্বাভাবিক নয়? এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের আর্থিক ক্ষতি হলে তারা ভারত স্বাধীন করার কথা ভাবতে থাকে। এতে ব্রিটিশদের দোষ কোথায়? অতএব দেশভাগের জন্য দায়ী সংকীর্ণ ধর্মীয় আবেগ আর সাম্প্রদায়িকতা। ইংরেজরা কোনভাবেই দায়ী নয়। দেশভাগের প্রধান কারণ যে ধর্ম সেটা অনেকে মানে না। একবার ভেবে দেখো বাবা, কাদের স্বার্থে ব্রিটিশরা দেশভাগ করলো? দেশভাগের সময় কিন্তু কোনো হিন্দু বাধা দেয় নি বরং গান্ধীজি বাধা দিয়েছিলেন বলে নাথুরাম গডসে তাকে গুলি করেছিলেন। এর থেকে কি প্রমান হয়? হিন্দুদেরও দেশভাগে মৌন সম্মতি ছিল।

বাবা তুমি জানতে চেয়েছিলে- ইংরেজরা কাশ্মিরের সমাধান কেন করে যাননি সে বিষয়ে জানতে চেয়েছিল। সেই বিষয়ে পরের চিঠিতে বিস্তারিত জানাবো। এখন আমি বের হবো। ফ্রিজে কিছু নেই। বাজার করবো। তুমি ভালো থেকো। মন খারাপ করে থেকো না।  

মেয়ের লেখা চিঠি শেষ করে শশীভূষনের একটা কথাই বার বার মনে হচ্ছে- ইস! দেশটা যদি ভাগ না হতো, তবে কতই না ভালো হতো । আমার সবাই এক সাথে থাকতাম। ইস, কতই না ভালো হতো।
০ Likes ০ Comments ০ Share ৩১০ Views