বিকালের রোদ কাঁচ ভেদ করে অমলের গালে আলতো স্পর্শ করে।গতকালের ঘটনা নিয়ে চিন্তায় ডুবে ছিল অমল।কিন্তু কিছু করার ছিল না অমলের।এই ঘটনা তার কাছে নতুন নয় কিন্তু তবুও তা মুছে ফেলার মত না।আর ভুলবেই বা কিভাবে , তার বাবার সামনে তাকে পাশের বাড়ির ভাড়াটিয়া যাতা বলে গেল।কিন্তু পরক্ষনেই খেয়াল হল , এই রকম ঘটনা তো নতুন কিছু না। আগেও হয়েছে।তবুও চিন্তায় মগ্ন থাকায় হাতের চায়ের কাপে চুমুক দেয়া হয়নি।
অমলদের বাসাটা ঠিক আজিমপুরে, গলির মাথার দোকানটার ঠিক পাশেই।সেইখানে মনির মামার চায়ের দোকান। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে গলিতে গলিতে ঘুইরা নামাজের ডাক দেয় মনির মিয়া। নামাজ শেষ হলেই দোকান খুলে।তার রুটিনের কোন পরিবর্তন লক্ষ করা যায় নি এখন পর্যন্ত। অন্তত এই আজিমপুরে অমলরা যতদিন ধরে থাকছে , অমলের জানালা দিয়ে এই ঘটনার অন্য কোন দৃশ্য এখন পর্যন্ত ধরা পড়েনি।অমল ও সকালে ওঠে।মনির মিয়ার হাঁক ডাক শুনেই হোক , আর অন্য কারণেই হোক ভোরবেলায় চোখ বন্ধ রাখা অমলের হয়ে ওঠে না।ঘুম থেকে উঠে অমলের প্রাতরাশ শেষে জানালা দিয়ে মনির মিয়াঁর দোকানের দিকে তাকায় ।মনির মিয়াঁও ক্যামনে জানি বুঝে তাঁর দিকে দূরদৃষ্টি স্থাপন করা হয়েছে।তাই সেও অমলের বাড়ির জানালার দিকে তাকায়া থাকে।পরক্ষনেই আবার অমলরে বলে,“ কি হইল মামা রাতে ঘুমান নাই !! ”অমল কি বলবে বুঝে ওঠে না।রাতে ঘুম হয়েছে কিনা তাও সে ঠিক মত বলতে পারে না। তাঁর মনে হয় সে পুরাটা রাত জেগেই ছিল।প্রায় মনে হয় সে রাতে ঘড়ির দিকে যখন তাকায় তখন রাত তিনটা সাতচল্লিশ বাজে।এই রহস্যের কিনারা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নাই।তাই মনির মিয়াঁর দিকে নীরব দৃষ্টি দিয়ে তাকানো ছাড়া অমলের আর কোন উপায় থাকে না।
মনির মিয়াঁ আবার কাজে লেগে পড়ে।চায়ের কাপ গুলা বালতিতে ধুয়া এক এক কইরা পুড়ানো স্লেটের উপর সাজায়।কেটলিতে গরম পানির মধ্যে তিন চামচ চা পাতি ঢালে।
আজ অমলের ক্লাস নাই সকালে তাই সে সিঁড়ি দিয়া নিচে নামে চা খাওয়ার জন্য।সিঁড়ি দিয়া নামার সময় অমলের চিন্তা হয় , দোকানে কি বেশী লোক বসছে কিনা। অমলের এই মানুষ ভীতির কারণ সেও নিজেও জানে না।কিন্তু ভিড়ের মধ্যে থাকা অমলের একদমই পছন্দ না।তার মনে হয় সবাই তাঁর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় আর বাজে বকে।আর কেউ যদি নাও তাকায় তবু অমল কানে ফিসফিস শুনতে পায়। এই শব্দের মধ্যে এক প্রকার ঘোর সৃষ্টি হয় যা অমল চাইলেও দূরে রাখতে পারে না।
সকাল কিছুদূর গড়ালেই সাঁজ সাঁজ রব হয়ে বাজতে থাকে নিত্যকার দোকানগুলো। মাল উঠাইতে থাকে একের পর এক। আর হকাররা তাদের সবজির কিংবা মাছের উপর পানি ছিটাইতে থাকে। এই দৃশ্য নিত্যদিনের পরিচিত হলেও অমলের খুব আশ্চর্য লাগে।সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে সে বুঝতে পারে না এই দোকানগুলো কবে থেকে একী জিনিষ বিক্রি করছে আর মানুষ ও সেই একী জিনিষ খেয়ে পড়ে বেঁচে আছে। মনির মিয়াঁর দোকানে বসে সে চা দিতে বলে এক কাপ আর একটা সিগারেট। মনির মিয়াঁও সেই মতে তারে এক কাপ চা আর একটা বেনসন দিয়া বলে মামা , “ কালকে এলাকার পাগলটারে ধইরা নিয়া গেছে এইখান থিকা, শুনছেন নাকি আপনে?”
অমলের চোখ দোকানের পোস্টারের থেকে সরিয়ে মনির মিয়ারে বলে , “ না তো , শুনি নাই কেন , কি হইছে? “ আরে মামা বইলেন না , ঐ পাগলে কি করছে শুনবেন , ঐ আমাগো হাশেম চাচা আছে না, ওরে রিকশা থিকা টাইনা ফালাইয়া দিছে ”।এই কথা বলে মনির মিয়াঁ একটা তৃপ্তির হাসি ফুটাইয়া ধরল মুখে।যেন পাগলটা যাওয়াতে তাঁর রক্ষে হইছে।অবশ্য এই খুশী হওয়াটা প্রাসঙ্গিক, তার কারণ ঐ পাগল হুট-হাট আইসা তাঁর কাস্টমারদের ডিস্টার্ব করত। আর মনির মিয়াঁ আবার পাগল দুই চোখে দেখতে পারত না।সে কাপ ধুইতে ধুইতে বলে , “ আল্লাহ বাচাইছে , গরীব বানাইলেও ভালই আছি, পাগল তো আর বানায় নাই।” অমলের ক্যামন জানি মনির মিয়াঁর কথায় এই লাইনটা খুব আঘাত করে। তার মনে হয় সত্যিই তো , গরীব হোক বা ধনী হোক কেউ কিন্তু পাগল হইতে চায় না।
বিকালে অমল পরিবাগের দিকে হাঁটতে গেল। এদিকে বিকালটায় তেমন লোক জন হয় না। অন্তত ধানমণ্ডি লেক ,ঢাকা ভার্সিটি , জিয়া উদ্যানে যেমন মানুষের ঢল বয়ে যায় তেমনটা না । কিন্তু শহর তার কোলাহল কোথাও ঢেকে রাখতে পারে না। আর পরিবাগেও অন্যান্য এলাকা থেকে বেশ আলাদা কিছু না। তবুও অমল এই দিকটায় বিকালে প্রায়ই আসে, এখানে মানুষের ভিড় কম তাই। হাতে সিগারেট নিয়ে অমল চারিপাশ দেখে খুব মনোযোগ দিয়ে। অমলের মনে পড়ে , স্কুলে থাকতে তার বন্ধুরা তাকে রানি-ক্ষেত রোগী বলে ক্ষেপাত এই চুপ করে বসে থাকার কারণে। কিন্তু অমল কিছুতেই তাদের বুঝাতে পারত না যে সে চিন্তা করত তাই চুপ থাকত।অমলের স্কুল জীবন তেমন ভাল কাটেনি। আর কাটতই বা কিভাবে সে তেমন মিশুক ছিল না। সব সময় চুপ করে বসে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে থাকত।অমল পাশের দোকানদারকে এক কাপ চা দিত বলল। হুট করে কোত্থেকে স্কুলের এক ছেলে এসে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল , “ কিরে ক্যামন আছিস ”। অমলের চোখ চোখ থরথর করে কাঁপতে থাকে , ছেলেটাকে দেখে। তার মনে পড়ে এইতো সেই ছেলে যে তাকে স্কুলে ক্ষেপাত , যে তাকে মেরেছিল।অমল কিছু না বলে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে।“ শোন দোস্ত , স্কুলের জন্য আমি সরি , আমার তোকে মারা উচিৎ হয় নাই”। বলে ছেলেটি আবার হাত বাড়িয়ে দেয়।অমল এবার ওর দিকে তাকায় , আস্তে আস্তে হাতটা ধরে। তারপর বলে , সমস্যা নাই ,তুই ক্যামন আছিস”।অমল হটাত লক্ষ করে সে ছেলেটাকে তুই বলে ডাকতে শুরু করেছে , কিন্তু ছেলেটার নাম সে কিছুতেই মনে করতে পারছেনা। ছেলেটা চারিদিকে তাকিয়ে বলে , “ তুই এইখানে , কোন কাজে আসছিস নাকি?” অমল খেয়াল করে তার সিগারেটটা এখনও জ্বালানো হয় নাই। সে সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে বলে , “ না ,আমি হাটতে আসি মাঝে মাঝে।” ছেলেটা অবাক হয়ে অমলের দিকে তাকায়। স্কুলে থাকতেও অমলের চেহারায় কখনো কঠিন কোন ছাপ পড়েনি। কিন্তু এখন চেহারায় বেশ একটা মলিন বিষণ্ণতার ছাপ পরেছে। আর সবচেয়ে অবাক লাগল যেই অমল সব সময় চুপ থাকত , কোন খারাপ কাজে তাকে কখনো পাওয়া যায়নি কিংবা করতে দেখাও যায় নি আজ সেই অমল সিগারেট টানছে।ছেলেটার খুব খারাপ লাগল অমলের অবস্থা দেখে। সে অমলের পিঠে হাত রেখে বলল , কি ব্যাপার তোর এই কি দশা চেহারার , আর তুই সিগারেটই বা ধরলি কবে? অমল এই প্রশ্নটারই ভয় পাচ্ছিলো। সে জানে এর কোন উত্তর নাই কিংবা থাকলেও তাঁর জানা নাই। অমল দ্রুত প্রশ্নটা চেঞ্জ করার জন্য ছেলেটাকে বলল, “আচ্ছা তোর নামটা আমার ঠিক মনে পড়ছে না”। ছেলেটা কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে অমলের দিকে তাকিয়ে থাকল।
ছেলেটা অপ্রস্তুত ছিল প্রশ্নটার জন্য , কিন্তু তবুও বলল , “ কি বলিস , আমার নাম মনে নাই , আমি সজল দোস্ত , আমি ঐ যে তোর মাকে নিয়ে খারাপ কথা বলেছিলাম , তারপর তুই আমার দিকে খাতা ছুড়ে মাড়লি”।একটু থেমে আবার সজল বলল , “ শুনেছি তোর মা নাকি আবার বিয়ে করেছে” ? বলেই সজল বুঝতে পারল ওর এই কথাটা বলা উচিৎ হয় নাই। অমল হুট করে উঠে দারিয়ে যায়।“দোস্ত আমি যাইরে , আমার কাজ আছে” বলে অমল বাস- স্ট্যান্ডের দিকে দ্রুত হাঁটতে থাকে।এই পাখার মত অংশটার জন্য অমল মানুষের ভিড়ে থাকতে পছন্দ করে না। তাছাড়া মানুষ ওর দিকে তাকিয়ে ক্যামন একটা ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে দেয় , এই তাকানোর মাঝে অমল করুণাও দেখতে পায় আবার ভয়ও দেখতে পায়।অমলের মাঝে মাঝে ঘৃণা হয় নিজেকে নিয়ে , কিন্তু এই বেপারটা অমল সবার সামনে আনতে চায় না। সে নিজেকে শক্ত করার জন্য আসে পাশের গরীব বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে সে বাস-স্ট্যান্ডে পৌছায়। তার কপালের উপর রগটা তখনও দপদপ করছে। এই বাস-স্ট্যান্ডেও অমলের অস্থির লাগে , মানুষের ভিড়ে। অমল এক কোনায় গিয়ে দারিয়ে থাকে।তার দ্রুত সব কিছু মনে হতে থাকে, তার মা বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। অমল তার বাবার সাথে থাকে। তার মা বাপের বাড়ি চলে গিয়েছে।এখন হয়ত নতুন বিয়ে করেছে,কিন্তু অমলের বাবা টাকে এই ব্যাপারটা জানতে দেয় নি।সে পাশের দোকান থেকে একটা সিগারেট কিনে । কিনার সময় দেখে তার হাত কাঁপছে, দ্রুত সে আরেক হাত দিয়ে তার অপর হাতটা ধরে যাতে হাত কাঁপা বন্ধ হয়। সিগারেটটা ধরানোর পর সে কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞেস করে , “আচ্ছা ভাই শেষ বাসটা কখন ছাড়ে ?” “ মামা রাত দশ টার দিকে”। অমলের চোখ ছলছল করত থাকে । সে অন্য সময় রাত নয়টা পঁয়তাল্লিশ এ এখানে এসে শেষ বাসে উঠে বাড়ি যায় কারণ শেষ বাসে মানুষের ভিড় তেমন নেই বললেই চলে।কিন্তু এখন বাজে মাত্র সাতটা পঁয়তাল্লিশ ।তার এই শেষ বাসের অপেক্ষা কখন শেষ হবে , কখন সে এইসব স্মৃতি থেকে দূরে থাকতে পারবে।
Comments (6)
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মৃত্যুদিবসে আমার গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
প্রিয় লেখক সম্বন্ধে অনেক কিছু জানলাম। কিন্তু ছবিগুলো দেখতে পাড়লাম না আফসোস রয়েই গেলো। বুঝলাম না, ছবি না দেখার সমস্যা কি শুধু আমার এখানেই হচ্ছে না সবার বেলায় হচ্ছে কে জানে। ধন্যবাদ নুরু ভাই।
ঘাস ফুল ছবিতো আমরা দেখতে পাচ্ছি, আপনার সমস্যা হচ্ছে কেন? আপনি কি ক্রোম ইউজ করছেন নাকি মজিলা?
শ্রদ্ধাঞ্জলি
কোথায় গেলেন মানিক বাবু...