Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

তুষ্টি

রুবি বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলেও তার ঘুম আসে না। মইনুদ্দিন ওষুধ এনে দেওয়ার পর একটি ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমুতে চেষ্টা করেছিল সে। কিন্তু চিন চিন করে ব্যথাটা হচ্ছিলই। এর চেয়ে আরও অনেক বেশি ব্যথা নিয়েও সে সংসারের যাবতীয় কাজ করে। তাই এখন ব্যথাটাকে তেমন পাত্তা না দিয়ে উঠে পড়ে একটি পান মুখে দিয়ে বেরিয়ে আসে। মইনুদ্দিনের পাশে টিভির দিকে হা করে তাকিয়ে থাকা ছেলের দিকে তাকিয়ে সে বলে ওঠে, মামুন কী দেখ?

ছেলেটি আঙুল উঁচিয়ে কিছু একটা বলে যা সে বুঝতে পারে না। এগিয়ে গিয়ে ছেলের পাশে বসে পড়ে সে। মেঝেতে নানা রকম জীবজন্তুর পুতুল নিয়ে একমনে খেলছিল মইনুদ্দিনের মেয়ে সুমি। তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ সে উঠে পড়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলে, বউ কী করতাছ?

রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সে বলল আবার, তোমার কাজ বেশি হইলে কিছু করতে হইলে আমারে বইলো।

-না। আপনে কী আর করবেন! কাজই শেষ আমার, এখন গোসলে যামু। আপনে গোসল করবেন কোন সময়?

-যাও তুমি। আমার ভাল লাগলে করমু। তোমার ঘরটা ঠাণ্ডা বেশি।

তখনই মইনুদ্দিন বলে, রুবি এদিকে আস, কথা কই। ভাইয়েরে ফোন কইরা জানাইছিলা?

মইনুদ্দিনের কথা শুনেই যেন তার মনে পড়ে নিজের ফোনের কথা। কাল ট্রেন থেকে নামার কিছুক্ষণ আগ দিয়ে হঠাৎ আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ফোনটা। ফের চালু করতে গিয়ে টের পেয়েছিল ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে গেছে। সে ফিরে গিয়ে ব্যাগ থেকে চার্জার সমেত ফোনটা হাতে করে মইনুদ্দিনের দিকে তাকাতেই সে উঠে এসে বলে, আমার কাছে দাও।

সে রুবির ফোন চার্জে দিয়ে আবার বলে, আস কথা কই।

তখনই দেখা যায় হাসিনা কাপড়-চোপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে সশব্দে দরজা বন্ধ করে।

রুবি এগিয়ে গিয়ে মইনুদ্দিনের পাশে বসতে বসতে খানিকটা নিচু স্বরে বলে, তোমার বউ কি সব সময় এমন করে, নাকি আমারে দেইখ্যাই পাট লইতাছে? সেই যে আমারে দেইখ্যা মুখ কালা করছে এই পর্যন্ত মুখটায় হাসি দেখলাম না। তুমি কি কিছু বুঝতাছ? বলে, সে একবার মুখ বাড়িয়ে বাথরুমের দিকে দেখে নিয়ে ফের মইনুদ্দিনের মুখোমুখি হয়।

-থাউক, এত দিকে চোখ দিও না। বলে, মইনুদ্দিনও হাসে নিঃশব্দে। বাইরের মানুষ আইলে সব বউরাই কম বেশি ভাব লয়।

-বেটির ভাব দেইখ্যা মনে হইতাছে আমি তোমারে ভাগাইয়া নিয়া যামু!

বলতে বলতে মুখে হাত চাপা দিয়ে আরো চাপা স্বরে হাসতে থাকে রুবি।

রিমোট হাতে নিয়ে ঘনঘন কয়েকটি চ্যানেল পালটে দিয়ে ফের আগের চ্যানলে ফিরে এসে মইনুদ্দিন বলে, তুমি আমার দিকের আত্মীয় না, এইটাই সমস্যা। তার গোষ্ঠির কেউ আইলে আমারে কিছু করতেও হয় না, বাজার সদাইও তার অভাব হয় না। ফ্রিজ খুললে দেখবা মাছ-গোস্ত সবই আছে। তোমারে তার হাতে বাজার করা মাছ গোস্ত খাওয়াইবো না, এইডাই কথা।

রুবি খানিকটা মুখ ভার করে বলে, আসতে আসতে ভাবছিলাম, কয়দিন বেড়াইয়া যামু তোমার এখানে। এখন তোমার বউয়ের কাজ-কারবারে চিন্তা করতাছি কালকে সকালের ট্রেনেই যামুগা। তুমি আমারে উঠাইয়া দিয়া আইবা।

-তার লগে লগে কি তুমিও পাগল হইলা?

-তোমার বউয়ের ছ্যানছ্যান আমার সহ্য হইতাছে না! আমার তো মনে হয় বেটি আমারে দিয়া তোমারে সন্দেহ করতাছে। দেখলা না তোমারে বাজারে আর ইশকুলে পাঠাইলো!

বলতে বলতে ফিক ফিক করে হাসছিল রুবি। তারপর সে আবার বলে, আইচ্ছা, এই বেক্কল বেটি কি এইটা বুঝে না, কেউ খারাপ হইতে চাইলে তারে পাহারা দিয়া ভাল রাখন যায় নাকি?

-আজাইরা কথা ছাড় দেখি! এখন কও, ভাই কেন আইলো না?

মইনুদ্দিন সোফার ওপর ঘুরে রুবির মুখোমুখি হয়ে দু পা তুলে বসে আবার জিজ্ঞেস করে, আমারে বলছিল, ফোনে এত কথা কওন যাইবো না।

-তাইলে তোমার ফোনটা দেও! বলে, হাত বাড়ায় রুবি। সেই সঙ্গে আরো বলে, আমার পৌঁছানির খবরটা আগে জানাইয়া কারণ কইতাছি।

মইনুদ্দিন ফোন এগিয়ে দিলে রুবি নিজেই নাম্বার টিপে কানে লাগানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলে ওঠে, আমি ভাল মতনই আইসা পৌঁছাইছি। আপনে কোনো চিন্তা কইরেন না!

তারপরই ফোনের ওপ্রান্তে কিছু শুনে হঠাৎ হেসে উঠে সে বলে, আপনের মুখে খালি নানান কু-কথা। আমি ফোন রাখি। সময় মতন খাওয়া-দাওয়া কইরেন! বলেই ফোনের লাইন কেটে দেয়।

রুবি কথা শেষ করে মইনুদ্দিনের হাতে ফোন সেট এগিয়ে দিলে সে ফোনটাকে আবার আগের জায়গায় রেখে দিয়ে বলে, এইবার কও, শুনি! আর তখনই বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায় হাসিনাকে।

গোসল করতে ঢুকলে এতটা কম সময়ে সে কখনোই বের হয় না। আজ কী এমন হলো যে, পাঁচ-সাত মিনিটের ভেতরই সে তার গোসল সেরে বের হয়ে এসেছে? ব্যাপারটা মনেমনে আঁচ করতে পারলেও এ নিয়ে কোনো কথা বলতে আগ্রহী হয় না মইনুদ্দিন। সে তাকিয়ে ছিল হাসিনার দিকেই। আর হাসিনা তখনই তাকে তাড়া দিয়ে বলে যাও গোসল করতে, আমি ভাত বাড়তাছি!

মইনুদ্দিন বলল, নাহ, এত ঠাণ্ডার ভিতরে গোসল আর করমু না। তুই ভাত দিলে দিয়া দে!

ভাতের কথা মামুন মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলে ওঠে, আমি ভাত খামু না!

পাশ থেকে এ কথা শুনতে পেয়ে সুমি বলে উঠল, আমি খামু। অনেকগুলা ভাত খামু! বলতে বলতে সে তার খেলার সরঞ্জাম ফেলে উঠে পড়ে।

স্কুল থেকে ফেরার পর এই প্রথম কথা বলতে শোনা গেল মেয়েটিকে। তা ছাড়া এমনিতেও খুব প্রয়োজন না হলে তার মুখ দিয়ে সহজে কথা বের হয় না।

হাসিনা বারান্দার রেলিঙে ভেজা কাপড় মেলে দিয়ে রুবির পাশে দাঁড়িয়ে বলল, আপা কি সত্যিই গোসল করবেন না? কইলে গরম পানি কইরা দেই!

-না গো বউ, আমি হাত-মুখ ধুইয়া আসতাছি। বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়ে সে ছেলের হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে চলে সঙ্গে সঙ্গে।

খানিকটা চলার পরই হঠাৎ সে নুয়ে পড়ে ছেলের কপালে হাত দেয়। জামার নিচ দিয়ে পিঠে হাত দিয়ে বলে, কীরে বাবা, তর শইলডা গরম লাগে যেমন! তারপরই সে হাসিনার উদ্দেশ্যে বলে, বউগো, মামুনের শইলডা কেমন জানি গরম গরম মনে হইতাছে, নাকি জ্বর-জারি আসলো?

হাসিনা এগিয়ে না এসেই বলে, আরে নাহ, শীতের মইধ্যে গরম কাপড় পইড়া রইছে দেইখ্যা এমন মনে হইতাছে। খাওয়া-দাওয়ার পরে থার্মোমিটার দিয়া দেখমুনে জ্বর আছে কিনা।

রুবি যেন তেমন একটা ভরসা পায় না হাসিনার কথায়। সে কেমন একটি হতাশা মিশ্রিত দৃষ্টি দিয়ে তাকায় মইনুদ্দিনের দিকে। মইনুদ্দিন উঠে এসে তাদের শোবার ঘর থেকে ওয়ারড্রোবের একটি ড্রয়ার খুলে সেখানে কিছু একটা খোঁজে। না পেয়ে খানিকটা উচ্চস্বরে বলে, বউরে, থার্মোমিটারটা কই রাখছিলি?

-আমি পরে খুঁইজ্যা দিমুনি। রান্নাঘর থেকেই হাসিনাকে বলতে শোনা যায়। তুমি এদিকে আইসা প্লেট-বাটি কিছু নিয়া যাও!

মইনুদ্দিন তখনই থার্মোমিটার হাতে করে এগিয়ে আসে। তারপর সেটাকে বার কয়েক ঝাঁকিয়ে নিয়ে মামুনের বগলের তলায় দিয়ে দেয়ালের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ধরে রাখে কিছুক্ষণ

রুবি হয়তো অস্থিরতা থেকেই বলে ওঠে, জ্বর আইলো কিনা দেখতে কি থার্মোমিটার লাগে?

তখনই মইনুদ্দিন থার্মোমিটারটা বের করে নিয়ে শূন্যে তুলে বলে, আছে কিছুডা জ্বর। মনে হয় আসতে শুরু করছে।

হাসিনা দু হাতে দুটো প্লেট আর পানির জগ নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বলে, শীতের দিনে এমন মনে হয়ই। শইল গরম হইলেই কি জ্বর আইসা যায় নাকি?

মেঝেতে প্লেট আর জগ নামিয়ে রেখে মইনুদ্দিনের দিকে ফিরে বলে, তুমি মাদুরটা বিছাইয়া ফালাও দেখি, আমি ভাত তরকারি নিয়া আসতাছি!

মইনুদ্দিন আবার ফিরে গিয়ে থার্মোমিটার রেখে এসে বলে রুবিকে, তোমার পোলারে হাত-মুখ ধোয়াইতে হইব না। তুমিই ধুইয়া আস তাড়াতাড়ি। এই বলে সে সোফা সেটের আড়াল থেকে মুড়ে রাখা একটি প্লাস্টিকের মাদুর বের করে মেঝেতে বিছিয়ে দেয়।

হাসিনা আবার দু হাতে করে ভাত তরকারি নিয়ে আসে। সেগুলো মেঝেতে নামিয়ে রাখতে রাখতে মইনুদ্দিনকে বলে, তুমি হাত লাগাইলেও তো কিছুটা তাড়াতাড়ি হইতো!

-ক আর কি বাকি আছে? আইতাছি আমি। বলেই উঠে দাঁড়ায় মইনুদ্দিন।

-থাক, তোমারে দেখা আছে আমার। তুমি হাত-মুখ ধোও আগে।

হাসিনা ফিরে যেতে যেতে রুবির উদ্দেশ্যে বলে, আপা বইসা পড়েন আপনের ছেলেরে নিয়া।

রুবি হাত-মুখ ধুয়ে বের হয়ে আঁচলে হাত-মুখ মুছতে মুছতে এগিয়ে আসে। তখনই তার ছেলেটা ছুটে গিয়ে মাদুরের ওপর পা গুটিয়ে বসে পড়ে। দেখাদেখি সুমিও বসে এক পাশে। একটি প্লেট টেনে নিতেই মইনুদ্দিন মেয়ের হাত থেকে প্লেটটা টেনে নেয়। তোমার আম্মু আসুক, তুমি প্লেট টানাটানি কইরা বিপদ লাগাইও না।

মেয়েটা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলে ওঠে, আমি খামু না?

-খাইও মা। সবগুলাই তো তোমার। তুমি খাইয়া বাকি থাকলেই আমরা খামু।

মইনুদ্দিন হাসতে হাসতে তাকায় মামুনের দিকে। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। ছেলেটির দু চোখ কেমন যেন মনে হয় তার কাছে। কপালে হাত দিয়ে বলে জ্বর বাড়তাছে মনে হয়।

হাসিনা প্লেট এগিয়ে দিতে দিতে বলে, খাওয়ার পরে এইচ খাওয়ায় দিমু।

রুবি একবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে, ভাত খাইবা আব্বা?

সে মাথা দুলিয়ে বলে, খামু। তোমার হাতে।

কিন্তু রুবি প্লেটে ভাত তরকারি নিয়ে খানিকটা ভাত ছেলের মুখে দিলে, সে খাবার মুখে নিয়ে হা করে থাকে।

উদ্বিগ্ন রুবি বলে, কিরে, খাবি না?

-ঝাল! বলে সে মুখ নিচু করলে রুবি সঙ্গে সঙ্গে তার মুখের সামনে হাত পাতে।

০ Likes ১৫ Comments ০ Share ৫৮১ Views

Comments (15)

  • - মোঃসরোয়ার জাহান

    বেশ লাগলো

    • - কবি ও দার্শনিক

      ধন্যবাদ সরোয়ার ভাই ।।