Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

রাজীব নূর খান

৯ বছর আগে

তালপাতার সেপাই



প্রতিদিন রাত বারোটার পর পাশের বাসার আশা ভাবি সুন্দর সুন্দর গান বাজান। আজ বাজাচ্ছেন- রবীন্দ্র সংগীত, আমারও পরাণও যাহা চায় তুমি তাই তুমি তাই গো...। কি সুন্দর সুর, কি সুন্দর কথা! এই গভীর রাতে বুকের ভেতর যেন কেমন করে ওঠে। এই রকম রাতে খুব বেশি বিষন্ন হয়ে পড়ি আমি। একটার পর একটা সিগারেট জ্বালিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে বড় ভালো লাগে। টাকার অভাবে সিগারেটও খেতে পারি না। প্যাকেটে মাত্র একটা সিগারেট পড়ে আছে। খাচ্ছি না, খেলেই তো শেষ হয়ে যাবে। সারারাত পড়ে আছে। আমার বিলাসিতা বলতে শুধু সিগারেট। দামী সিগারেট খেতে পারি না। একটা দামের সিগারেট। কত মানুষ মুহূর্তের মধ্যে হাজার টাকা খরচ করে ফেলে। আমার এক পরিচিত লোককেই দেখেছি মদের আসরে বসে হাজার হাজার টাকা খরচ করতে।

আমার বাবা-মা, ভাই-বোন ওদের জন্য অনেক কিছু করতে চাই। আমার যা দায়িত্ব তার চেয়ে অনেক বেশি করতে চাই। পরিবারের সবাই আমার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি শক্ত করে হাল ধরবো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার্স শেষ করে আমি বেকার বসে আছি। একটার পর একটা চাকরীর ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছি। বাবা'র বয়স হয়েছে- এখন আর পরিশ্রম করতে পারেন না। ছোট বোনটা প্রায়ই বলে দাদা তুমি চাকরী পেলে আমাকে অনেক গুলো ফুল গাছ কিনে দেবে। ছোট বোনের ছোট্র একটা চাহিদাও পূরন করতে পারছি না। মা বুকের ব্যাথায় সারারাত ঘুমাতে পারেন না। বাবা সব জেনে বুঝেও বলেন গ্যাস্টিকের কারনে বুকের ব্যাথা হয়। মাকে খুব দ্রুত ভালো কোনো হাসপাতালে নেওয়া উচিত। কিন্তু পারছি না। চোখের সামনে মা দিনদিন মৃত্যুর দিকে চলে যাচ্ছে। ছোট ভাইটা কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে বেকার অবস্থায়। এখন আবার বাচ্চা হবে। একজন গর্ববতী মায়ের চিকিৎসার অনেক খরচ। টাকার অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না। বড় আপা তার স্বামীর সাথে ঝগড়া করে খুলনা থেকে চলে আসছে। সাথে আছে তার দুই বছরে বাচ্চা। দুলাভাই লোকটা খুব লোভী। টাকার জন্য সে আপা'র গায়েও হাত তুলেছে। আমাদের বাসাটা একেবারে ছোট। মাত্র ছোট ছোট দুইটা রুম। আমরা সাত জন মানুষ। সারারাত আমি ছটফট করি। আমার ঘুম হয় না। একটুও ঘুম হয় না।

প্রতিদিনই ভাবি আজ নতুন কিছু ঘটবে। কিন্তু কিচ্ছু ঘটে না। আমি আশাবাদী মানুষ। অপেক্ষা করতে-করতে ক্লান্ত হই না। হাজার হাজার প্রতিষ্ঠানে সিভি জমা দিতেও ক্লান্তিবোধ করি না। শুধু ভাবি এই বুঝি কেউ ডাকলো চাকরীর জন্য। এই চাকরী পাওয়ার আশাটাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। চাকরীটা পাওয়ার পর আমি সব বদলে দিব। আমি সবার মুখে শুধু হাসি দেখতে চাই। মাকে বড় হাসপাতালে ভরতি করাবো। সুস্থ করে বাসায় নিয়ে আসবো। ছোট বোনকে নার্সারিতে নিয়ে গিয়ে অনেক অনেক ফুল গাছের চারা কিনে দিব। বাবাকে বলল- এখন থেকে আপনি আর কোনো চিন্তা করবেন না। আপনি সারাদিন ঘরে বসে থাকবেন। চা খাবেন আর খবরের কাগজ করবেন। আমি আপনার জন্য বাসায় তিনটা পত্রিকা রাখব। ছোট ভাইটাকে বলল- তুই স্ত্রীর হাসপাতালে খরচ নিয়ে চিন্তা করিস না, আমি তো আছি। কোনো ভয় নেই। বড় আপার জামাইকে ব্যবসার জন্য কিছু টাকা দিলেই- দুলাভাই হাসিমুখে এসে আপাকে খুলনা নিয়ে যাবে। মনে হয়, দুনিয়াতে সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো- প্রিয় মানূষদের জন্য কিছু করতে না পারার কষ্ট। আকাশে মেঘ জমেছে বলে ভয়ের কিছু নেই, মেঘ কেটে যাবে- সূর্য হেসে উঠবে। আমি চাকরী পাওয়ার পর পরিবারের সবার মুখের মেঘ কেটে যাবে। প্রতিটা মুখ হবে হাসিমাখা মুখ।

আমার দুঃখ-কষ্ট গুলো আমি কাউকে বুঝতে দিতে চাই না। হাসিমুখে থাকতে চেষ্টা করি। আমার হাতে অনেক সময়। পাড়ার লাইব্রেরী থেকে বই এনে দিন-রাত বই পড়ি। পড়তে শেখার পর গল্পের বই পড়া আমার প্রায় নিত্যদিনের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। আমার প্রিয় লেখক নিড ব্লাইটন। আমি তাঁর মস্ত বড় ভক্ত। যখন কেউ জিজ্ঞেস করে, আমার প্রিয় লেখক কে? আমি এক নিঃশ্বাসে বলি, এনিড ব্লাইটন। তাঁর সব, সব বই আমার প্রিয়। ব্লাইটন এর ফেমাস ফাইভ গোয়েন্দা সিরিজ আমার খুব প্রিয়। সেখানে চরিত্র ছিল পাঁচটি—জুলিয়ান, অনি, ডিক, জর্জিনা, কিরিন ও টিমি। দিন-রাত সারাক্ষন বই পড়ার কারনে মা আমাকে পন্ডিত বলে ডাকেন। কিন্তু বাবা অসহায়ভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বাবার করুন মুখখানি দেখে আমার বুকের ভেতর টা ঝাঝরা হয়ে যায়। আমি মনে মনে বলি, বাবা আর কয়েকটা দিন- অনেক গুলো ইন্টারভিউ দিয়েছি। বড় বড় কর্মকর্তারা কোনো প্রশ্ন দিয়েই আমাকে আটকাতে পারেনি। কাজেই, কেউ না কেউ তো ডাকবেই। চাকরীটা পেয়ে বাবাকে একটা মুজিব কোট কিনে দিব। বাবা বঙ্গবন্ধুকে খুব পছন্দ করেন।

মাসের পর মাস চলে যায়। পার হয়ে যায় বছর কিন্তু চাকরী আর হয় না। এত ইন্টাতভিউ দেয়ার পরও কেউ ডাকে না। আমিও কসম কেটেছি যে পর্যন্ত একটা ভালো চাকরী না পাবো- সে পর্যন্ত ইন্টাতভিউ দিয়েই যাবো। একটা ভালো চাকরী পাওয়ার যোগ্যতা আমার আছে। কিন্তু আমার মামা-চাচা নেই। আমার চেয়ে কম যোগ্যতা নিয়ে অনেক যদু-মধু বড় বড় প্রতিষ্ঠানে কাজ করে যাচ্ছে। কোনো পথ না পেয়ে অবশেষে সাতটা টিউশনি খুজে নিলাম। ছাত্রদের সাথে কথা বলতে বলতে আমার গলা শুকিয়ে যায়। টিউশনি করতে গিয়ে জানলাম সুক্ষ্ম একধরনের অপমান আছে। জ্বালা আছে। অনার্স পড়ার সময় যে মেয়েটাকে ভালোবাসতাম, শুধু মাত্র একটা চাকরীর জন্য মেয়েটাকে বিয়ে করতে পারলাম না। মেয়েটা এখন অন্য ঘরের ঘরনী হয়ে গেছে। মেয়েটা আমাকে খুব-খুব ভালোবাসতো। একবার বলল- চলো কোথাও পালিয়ে যাই। কিন্তু আমি জানি আবেগ দিয়ে কাজ করলে হয় না। কাজ করতে হয় বুদ্ধি দিয়ে। মেয়েটা অন্যসব মেয়েদের মত খুব সাজতো না। কিন্তু শুধু চোখে একটু কাজল আর কপালে একটা টিপ পড়তো- কি যে সুন্দর লাগত। মনে হতো এত মাতাময় একটা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা জমম পার করে দেয়া খুব কঠিন কিছু না। যেদিন মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেল- সেদিন আমার কলিজাটা যেন ছিঁড়ে গেল।

অপ্রত্যাশিত সেই চাকরীটি আজ আমি পেলাম। কিন্তু আমার একটুও খুশি লাগছে না। চাকরীতে জয়েন করতেও ইচ্ছা করছে না। চিকিৎসার অভাবে মা মারা গেলেন। মার মৃত্যুতে বাবা এখন প্রায় পাগল। ছোট ভাইয়ের স্ত্রী বাসায় দাইয়ের কাছে বাচ্চা প্রসব করতে গিয়ে মারা গেল। তারপর থেকে ছোট ভাইকে আর কোথাও খুঁজে পেলাম না। একদম নিখোঁজ হয়ে গেল। ছোটবোনটা একদম চুপ হয়ে গেছে। মুখে হাসি নেই, কারো সাথে কোনো কথা বলে না। যেন একটা জীবন্ত মৃত মানুষ। খুলনা থেকে দুলাভাই বড় আপাকে তালাকের কাগজ পাঠিয়েছে। এখন, এই চাকরী পারবে আমার হারিয়ে যাওয়া ছোট ভাইকে ফেরত দিতে। পাগল হয়ে যাওয়া বাবাকে সুস্থ করতে। ছোট বোনের মুখে হাসি ফোটাতে বা বড় আপার মুখে হাসি ফোটাতে? এখন, আমার ভাবতে ভালো লাগে ঈশ্বর নেই। ঈশ্বর থাকলে এরকম হতে পারত না। দিনের পর দিন, মা-বাবা, ভাই-বোন এদের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বুকের ভেতরটা তছনছ হয়ে গেছে। কি কষ্ট...কি কষ্ট, বুকের ভেতর।

সময় মত একটা চাকরীর অভাবে এক গভীর ঝড়ের মত আমাদের পরিবারটা লন্ড-ভন্ড হয়ে গেল। এরকম হওয়ার তো কথা ছিল না। কথা ছিল, মাকে ভালো একটা হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে বাসায় নিয়ে আসবো। ছোট বোনটাকে একটা সুন্দর বাগান করে দিব, ছোটভাইকে ছোট একটা ব্যবসা ধরিয়ে দেব, বাবা বারান্দায় বসে চা খাবেন আর মাকে খবরের কাগজ পড়িয়ে শুনাবেন ( মা বিরক্ত হবেন কিন্তু তারপরও হাসিমুখে শুনবেন), বড় আপা স্বামী সন্তান নিয়ে খুলনায় সুখে বসবাস করবেন। কিন্তু কিছুই হলো না। শেষ। সব শেষ আমার। এখন, যদি আমি বাবু বাজার ব্রিজের উপর উঠে নিচে একটা লাফ দেই- খুব একটা অন্যায় হবে না আমার। একটা পরিবার ধ্বংসের জন্য দায়ী কে? যারা আমাকে যোগ্যতা থাকা শর্তেও চাকরী দেয়নি তারা? নাকি ঈশ্বর? নাকি সরকার? নাকি সমাজ।
২ Likes ৪ Comments ০ Share ৪৮৩ Views