Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

জীবনস্রোতে ভাসা মোহনা

স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। বাচ্চারা সবাই বাড়ি চলে গেছে। মোহনা স্কুল ভবনের পাঁচতলায় বসে আছে। তার ছুটি হয়নি। শিক্ষকদের ছুটি হয় দেরিতে। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে নেয়ে সাফ সুতরো হওয়া কদম গাছ দেখছে। রোদের আলো পড়ে ঝকঝক করছে গাছের পাতাগুলি। বৈশাখ শেষ, যখন তখন হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামে। আর কদিন পরেই ফুল ফোটাবে গাছটা। ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চোখ ফিরিয়ে নিলো মোহনা। এসব দেখতে আর আগের মতো ভালো লাগেনা। প্রকৃতি আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় এখন তার নেই। নিজের জীবন নিয়ে ভেবেই সে অস্থির হয় আজকাল।    মোহনা নিজের জীবন নিয়ে ভাবেনি কখনোই। স্বামী, সন্তান, সংসার নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ততার ভেতর সময় কাটিয়েছে। দেবর-ননদ-শ্বশুর-স্বাশুড়ির প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি সমস্যা নিজে দেখেছে। একান্নবর্তী সংসার না হবার পরেও মোহনা দুই ননদকে তিন চার বছর নিজের কাছে রেখে বিয়ে দিয়েছে। তাদের বিয়ের পর বিয়ে পরবর্তী প্রত্যেকটা আচার অনুষ্ঠান নিজের হাতে করেছে। বিয়ের পরেও ননদ দেবরদের অসুবিসুখে সবার আগে ছুটেছে। সেই মোহনা আজ একা। শূন্য হাত। সব কিছু খেয়াল করতে গিয়ে, সবাইকে খেয়াল করতে গিয়ে সে নিজের ভবিষ্যতের দিকে তাকায়নি।    মোহনা নিছক মনের টানে পিয়াসের কাছে গিয়েছিলো। পিয়াসের অর্থ-শিক্ষা-পারিবারিক যোগ্যতা কিছুই নেই জেনেও নিজের ভবিষ্যৎ, পরিবার-পরিজন সব ফেলে এক কাপড়ে ছুটে গিয়েছিলো। এমনকি পিয়াস প্রেম করে অন্য এক মেয়েকে বিয়ে করে তার সাথে কয়েক মাস সংসার করেছে জেনেও সে অকপটে পিয়াসকে বিয়ে করেছে। একটা সময়ে পিয়াসের অর্থ, বিত্ত, প্রভাব সবই হলো কিন্তু ওসবের সাথে সাথে সে নিজেও বদলে গেলো। নারীলিপ্সু পিয়াসের কাছে মোহনা সঠিক মূল্যায়ন পায়নি। না পেয়েছে কোনো সম্মান, না পেয়েছে কোনো গুরুত্ব। বহুগামি পিয়াসের অপরিসীম জৈব পিপাসা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে বহুদূর আর সে একলাটি পড়ে রয়েছে এক কোণে।    ব্যবসার নাম করে পিয়াস প্রতি মাসে দু তিনবার করে দেশের বাইরে যেতো। মোহনা টের পেয়েছিলো তার স্বামী দেশের বাইরে গিয়ে অন্য নারীর সাথে মেলামেশা করে কিন্তু এ নিয়ে সে কখনোই পিয়াসকে কিছু বলেনি। অনেক রাতে মাতাল পিয়াসের ঘরে ফেরাকেও সে খুব স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলো। ড্রাইভার বা অফিসের স্টাফদের কাছে পিয়াসের ব্যাপারে খোঁজ খবর করতে যাওয়াটা নেহাতই অভদ্রতা মনে করে এসব থেকে দূরে থেকেছে ও। পিয়াসের অনৈতিক কর্মকাণ্ড যতদিন দূরে ছিলো মোহনা পিয়াসকে কিছুই বলেনি। কিন্তু মেয়েকে দেয়া ল্যাপটপে পিয়াস আর এক বিদেশী মেয়ের ঘনিষ্ঠ ছবি নিয়ে রাগ করে মোহনা নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়। অন্যান্য বারের মত করে এবারে নিজেকে সে কিছুতেই বশ মানাতে পারেনি। ছেলেমেয়েদের শুনিয়ে ঝগড়া করতে চায়নি বলে সে বোবা হয়ে থেকে সব শুনে গেছে। পিয়াসও সেই সুযোগ লুফে নিয়ে যাচ্ছেতাই করতে লাগলো। এক পর্যায়ে সে বাসায় খাওয়া বন্ধ করে দিলো, সংসার খরচের জন্য টাকার পরিমাণও কমিয়ে দিলো।    সাড়ে তিন বছরের মাথায় তার ছেলে একদিন রাতে তাকে জানালো বাবার ফোন নিয়ে খেলতে গিয়ে সে দেখেছে তার বাবা এক মহিলাকে চুমু দিয়ে ছবি তুলেছে। শুনে রাগে দুঃখে কষ্টে মোহনার কান্না চলে এলো। তার মাথায় ঘুরতে লাগলো, সে বাইরে নষ্টামি করে বেড়ায় বেড়াক, এসবের প্রমাণ রাখতে হবে কেন? আর সেই প্রমাণ এই বাচ্চা ছেলে দেখবে কেন?  অনেক ঝামেলা করে সেই ছবি হাত করে সেই ছবি দেখিয়ে সে পিয়াসকে বলল, এসবের মানে কী?  পিয়াস ছবি দেখে আকাশ থেকে পড়লো, এইটা কার ছবি জানিনা। আমার ছবি না। আজকাল ফটোশপ করে এমন ছবি বানানো কোনো ব্যাপার না। -আচ্ছা! আমার কম্পিউটারের ছবি না হয় ফটোশপ করে বানিয়েছি, তোমার ফোনে এই ছবি গেলো কেমন করে?  মোহনা ছেলেকে বললো বাপের ফোন নিয়ে আসতে। ছেলে এক ছুটে সেই ফোন এনে ছবি বের করে দিলো। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলোনা মোহনা। ঠাস করে পিয়াসের গালে এক চড় বসিয়ে দিয়ে বললো, -লুইচ্চামি করবে করো, বাচ্চাদেরকে কেনো সেইটা দেখতে হবে? আবার ছেলে কি এসব দেখার মত বড় হয়েছে?   সেদিনই দুপুরে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়ার নাম করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো পিয়াস। রাতে ফোন দিয়ে মেয়েকে জানালো সে রাতে বাসায় ফিরবেনা, তারা যেনো খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে। বাচ্চারা অপেক্ষা করে তাদের বাবা ফিরবে কিন্তু পিয়াস আর বাসায় ফিরলোনা। দুই সপ্তাহের মাথায় মোটা এক খাম এলো মোহনার নামে। খাম খুলে পাওয়া গেলো পাঁচ মাস আগের তারিখে ইস্যু করা এক ডিভোর্স লেটার যা ওই কাগজের হিসেবমতে ততদিনে কার্যকর হয়ে গেছে আর উকিলের লিগ্যাল নোটিশ যাতে মোহনাকে বাসা ছাড়তে বলা হয়েছে। খাম হাতে নিয়ে বজ্রাহতের মত বসে রইলো মোহনা। সে স্বপ্নেও ভাবেনি পিয়াস এমন কিছু করতে পারে। পিয়াসের নৈতিক স্খলনের কথা তো আর অজানা নেই কিন্তু সে যে মনের দিক থেকেও এতোটা নিচে নেমে গেছে তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো খুব।  মোহনা এখন জীবনের এমন এক মোহনায় দাঁড়িয়ে আছে যেখানে সে একাই দাঁড়িয়ে আছে, সাথে কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। ভীরু মোহনা সবসময়েই কঠিন সবকিছু থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছে, কিন্তু এখন? এখন কি করবে? এখন কোথায় পালাবে? কার কাছ থেকে পালাবে? সময়ের ফেরে পড়ে এমন এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। ভাগ্যের বিড়ম্বনায় আজ ও নিদারুণভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। মোহনার মেয়েটা যখন ভীষণভাবে অসুস্থ ছিলো তখন রোজ দুবেলা ডাক্তার আসার সময়টাতে পালিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতো। কখন ডাক্তার কোন রিপোর্ট দেখে খারাপ কি বলে বসে সেই ভয়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যেতো। তার মনে হতো নিজের কানে মেয়ের জীবনের অন্তিম রায় শুনতে পারবেনা। অথচ আজ? আজ তার চোখের সামনে তার সন্তানেরা একটু একটু করে ধুঁকে ধুঁকে মরছে হাজারবার। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে। এর শেষ কোথায়? আজ এই মুহুর্তে এই প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই।    বেলের কর্কশ শব্দে চমকে উঠে ঘড়ির দিকে তাকালো মোহনা। ছুটি হয়ে গেছে। ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো।   
১ Likes ৪ Comments ০ Share ৩৮৩ Views

Comments (4)

  • - টি.আই.সরকার (তৌহিদ)

    তবুও জীবন শানিত হয়
    বাঁচার প্রবল স্পৃহা অক্টোপাশের মতো ঘিরে রাখে
    ঐ যে মখোশের আঁড়ালে ঢাকা সর্বনাশ।

    কবিতার প্রেমে পড়ে পাঠকেরও যে সর্বনাশ ! সুন্দর হয়েছে !

    - এই মেঘ এই রোদ্দুর

    তবুও জীবন শানিত হয়
    বাঁচার প্রবল স্পৃহা অক্টোপাশের মতো ঘিরে রাখে
    ঐ যে মখোশের আঁড়ালে ঢাকা সর্বনাশ।

     

    খুব সুন্দর

     

    - সুমন সাহা

    খুব ভালো লাগলো লেখা।

    শুভেচ্ছা জানবেন।