Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

জাপানের দ্রুত উন্নতির কারণ -একটি পর্যালোচনা

  জাপানে এ শতাব্দীর আগেও সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থা অনেক দিন ধরে প্রচলিত ছিল অর্থাৎ রাজা বাদশার শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।জাপান সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ;যুদ্ধে লিপ্ত হয় জার্মানী ও আমেরিকার বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর যে কয়টি দেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন করেছে জাপান নি:সন্দেহে তাদের অন্যতম।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে জাপানের শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের যে বিপুল পরিমাণ ক্ষয় ক্ষতি হয়, তা কাটিয়ে উঠে মাত্র দু,দশকের মধ্যেই পৃথিবীর অন্যতম শিল্পোন্নত দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।তবে শিল্পোন্নয়নের প্রথম দিকে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার অপ্রতুলতার কারণে সরকারই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং ক্রমান্বয়ে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করার প্র্রয়াস চালানো হয়।
জাপানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০% লোক যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিলো।মোট জনসংখ্যার ২% লোক যুদ্ধে মারা যায়এবং বাকী ৮% লোক বিফল মনোরথে ফিরে আসে অথচ তাদের জন্য যুদ্ধ বিধ্বস্ত জাপানে ছিল না কর্মসংস্থানের সুযোগ। যুদ্ধে পরাজয়ের কারণে গোটা ছিল মনোবল শুন্য।জাপানের মোট আয়তন ১,৪৭,০০০ বর্গমাইল। এ জমির মাত্র এক অষ্টমাংশ চাষাবাদযোগ্য দুই তৃতীয়াংশ বনাঞ্চল ,জনসংখ্যা প্রায় ১৪ কোটির ও বেশী।প্রতি বর্গমাইলে প্রায় আটশত ও বেশী মানুষের বাস। তেমন কোন প্রাকৃতিক সম্পদও নেই।দেশের মোট চাহিদার ৯৯% তৈল ,৮২% কয়লা,৯১% প্রাকৃতিক গ্যাস,৯৯% লৌহ এবং ৬৭% কাঠ বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়।এমন অবস্থা সত্ত্বেও জাপান বিশ্বের মোট জাতীয় আয়ের শতকরা ১০ ভাগ একাই উৎপাদন কর্।ধারণা করা হয় এধারা বজায় রাখতে পারলে এ শতাব্দীর কয়েক দশকের মধ্যে জাপান বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশসমূহের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করবে।
কিভাবে প্রতিকুল অবস্থার মধ্যে সংগ্রাম করে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেছে তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন ।সারা পৃথিবী আজ জাপানি ব্যবস্থার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে।১৯৭০ সালের দিকে তারা সারা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দেয়। এশিয়া ও ইউরোপের ইলেকট্রোনিক্স সামগ্রীর বাজার ছিল তাদের দখলে। মধ্যপ্রাচ্যের সব লোকই এক সময় জাপানী জিনিষ ব্যবহার করতো।এখন আমাদের দেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশ চীনের ইলেকট্রোনিক্স সামগ্রী ব্যবহার করছে ;কিন্তু মানের দিক দিয়ে জাপানী পণ্যএখনো অপ্রতিদ্বন্ধী। জাপানীরা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পূনরায় যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে, তারা আবার নিজেদেরকে পূণর্গঠিত করার নিজেদেরকে নিয়োজিত করে।তারা মনে করেছে আবার যুদ্ধে লিপ্ত হলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে।তারা চিন্তা করেছে,তারা কিভাবে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী করার মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে সমৃদ্ধ জাতি হিসাবে টিকে থাকা যায়।তারা চিন্তাভাবনা করেছে, তারা অর্থনৈতিকভাবে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে।তারা যুদ্ধ থেকে এ শিক্ষা লাভ করেছে যে,যুদ্ধ কোন জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে না।পরাজিত হবার প্রতিহিংসা তারা ত্যাগ করেছে অত্যন্ত সুকৌশলে।যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে তাতে কি? কিভাবে অর্থনেতিকভাবে তাদের পরাজিত করা যায়, এটাই ছিল তাদের চিন্তাভাবনা।কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল যুদ্ধ কোন জাতির সত্যিকারের মাপকাঠি হতে পারে না।
কাম্পুচিয়া মতবাদ চীনে উৎপত্তি লাভ করে। জাপানী ব্যবস্থাপনায় কাম্পুচিয়া মতবাদ থেকে যায়,যদিও চীনে এর বিলুপ্তি ঘটে।ব্যবস্থাপনা একটি ঐতিহাসিক কৃষ্টিগত ব্যাপার।ব্যবস্থাপনা শিল্প সংস্কৃতি হতে বিচ্ছিন্ন কোন জিনিষ নয়।তাই জাপানী ব্যবস্থাপনারও একটি ভিন্ন ইতিহাস, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি রয়েছে।অর্থাৎ জাপানের এ উন্নতির পিছনে একটি ঐতিহাসিক ব্যাখা আছে।তারা আত্মকেন্দ্রিক পুরুষ শাসিত সমাজ। পুরুষ শাসিত সমাজে জাপানের একটা ইতিহাস হচ্ছে সামন্ত প্রথা।সামন্ত প্রভূ হচ্ছে পুরুষ, সেখানে মেয়েদের স্থান গৌণ।সুতরাং সেই সামন্তপ্রথার আলোকে জাপানে যে ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে সেটা আমেরিকা বা অন্য কোন দেশে সম্ভব নাও হতে পারে।কারণ আমেরিকাতে কোন সময়ই সামন্তপ্রথা ছিলো না।যেমন - জাপানে স্বামী-স্ত্রী যদি একত্রে বাসা ভাড়া করে থাকে
এবং ভাড়ার পরিমাণ যদি ১০০০ ডলার হয় তবে সেটা পরিশোধ করার দায়িত্ব একমাত্র স্বামীর।আমেরিকায় সামন্ত প্রথার সাথে,রীতিনীতির সাথে তাল মিলিয়ে কোন নিয়ম কানুন গড়ে উঠে নাই। কিন্তু জাপানের রীতিনীতি ব্যবস্থাপনা সামন্তপ্রথার সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত।
জাপানে কোন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হয় নাই।ধনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মালিক ও ধনিক শ্রেণির মধ্যে দ্বন্ধ থাকে।মালিক চায় সর্বাধিক মুনাফা,শ্রমিক চায় সর্বাধিক মজুরী।এখানে একটি অর্থনৈতিক দ্বন্ধ বিরাজমান।এই দ্বন্ধ নিরসনের জন্য ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের কথা বলা হয়। জাপানী ব্যবস্থাপনায় এ ক্ষেত্রে সীমিত গণতন্ত্র দেয়া হয়।আমেরিকার অগ্রগতি যেখানে ২.৩% সেখানে জাপানের অগ্রগতি ১০% এর বেশী।
জাপানে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে মেজাই নামক সম্রাট শাসনভার গ্রহন করেন।তখন থেকেই জাপানীদের জন্য অন্যান্য দেশের দ্বার উম্মুক্ত হয়। যে দেশের কোন অস্তিত্বই ছিল না বিশ্ব অর্থনীতির মানচিত্রে,অথচ সে দেশটি ব্যবস্থাপনায় সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে।এক জরীপে দেখা যায়,জাপানের শিল্পপতিরা সুপ্রতিষ্ঠ এবং স্বীয় প্রতিভার গুণে তারা শিল্প ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেছেন।বলা যায়, সরকার ও শিল্পপতিদের যৌথ প্রচেষ্ঠাই জাপানের উন্নতির মূল কারণ।
জাপানে উচ্চপদে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গকে সবাই সম্মান করে। এখানে একটি পারিবারিক সম্পর্ক বিদ্যমান।তারা মনে করে তারা সবাই একই পরিবারের সদস্য।জাপানে এমন কোন উদাহরণ নেই তারা উচ্চপদস্থ নির্বাহীর সাথে দুর্ব্যবহার বা বেয়াদবী করেছে। এাট সত্যিই পৃথিবীতে সত্যিই বিরল।জাপানীরা কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় সবাই একসাথে বসে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।সুতরাং সিদ্ধান্তটি সবার নিকট গ্রহনযোগ্য হয়।জাপানীদের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো তারা একক ভাবে কোন কাজ করে না,কাজ করে দলীয়ভাবে।সুতরাং ব্যর্থতার চাপ এককভাবে কাউকে দেয়া যায় না।উন্নত কাজর জন্য দলীয়ভাবে পুরষ্কার দেয়া হয়।জাপানে কোম্পানীর পক্ষ হতে শ্রমিক কর্মচারীদের কল্যানের জন্য নানা ধরণের অনানুষ্ঠানিক কর্মসূচী গ্রহন করা হয়।যেমন-উচ্চপদে আসীন ব্যবস্থাপক তার অধীনস্থ কর্মচারীদের বিয়ের ঘটকালী বা ছেলে মেয়েদের বিয়ের ঘটকালী করে থাকে,কর্মীদের ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল ঠিক করে দেয়,অসুস্থ কর্মচারীদের দেখতে যায়-ফলে তাদের মধ্যে একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে।জাপানে ৯৯% লোক শিক্ষিত।তারা কাজকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়।জাপানে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপক ,শ্রমিককর্মী নিয়োগ করা হয়ে থাকে।তারা শ্রমিকের সাথে একটা চুক্তি করে-সেটা হচ্ছে স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা।এটা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে।স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাকে জাপানে ’নেনকো’বলে।এর ফলে শ্রমিকরা পায় চাকুরীর নিরাপত্তা এবং গড়ে উঠে শ্রমিকদের মধ্যে একাত্মতাবোধ।চাকরীর প্রথম দিকে স্থায়ী কর্মসংস্থানের অনেক অসুবিধা রয়েছে, কিন্তু জাপানে এর কোন খারাপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায় নি।জাপানীরা মনে করে তারা যে কাজ করছে, তা দেশের জন্য এবং নিজের জন্য। এখানে কেউ স্বার্থপর হতে পারে না।পরস্পর কে সস্মান করার যে রীতি তাদের সমাজে প্রচলিত ছিল সেটা তারা তাদের ব্যবস্থাপনায় নিয়ে এসেছে।তারা শুধু গণতন্ত্র ,গনতন্ত্র না বলে –এই বলে শুরু করেছে যে,”আসুন সবাই মিলে মিশে কাজ করি,শৃংখলা আনি।”জাপানীরা মনে করে তারা যে কাজ করছে,সেটা তার জন্য মঙ্গলজনক ও দেশের জন্যও মঙ্গলজনক।জাপানীরা প্রতিষ্টানে মান নিয়ন্ত্রন চক্র চালু করে।ফলে তারা তুলনা মূলকভাবে ভাল জিনিষ বাজারে দিতে পারে।জাপানের প্রত্যেক কর্মীই কোয়লিটি কন্ট্রোল অফিসার।তারা শুধু কাজই করে না কাজের মানও নিয়ন্ত্রন করে।জাপানে প্রতিষ্ঠানে গ্রুপ রেসপনসসিভিলিটি বিদ্যমান।সুতরাং ম্যানেজারকে দেখতে হয় না কে কোথায় ফাঁকি দিল।জাপানে প্রত্যেক কর্মীর ও পরিবারের পূর্ণ সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা রয়েছে।এখানে দুর্নীতি ও তদবিরের মাধ্যমে ব্যবস্থাপক হওয়া অসম্ভব।
সুতরাং দেখা যায়, জাপানী ব্যবস্থাপনা অন্যান্য দেশের ব্যবস্থাপনা থেকে সম্পুর্ণ পৃথক একটি ব্যবস্থা।তাদের অদম্য স্পৃহা, নিয়ম শৃংখলা আনয়ন,তদুপরি বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার হওয়ার জন্য তাদের অদম্য প্রচেষ্টা,দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিরোধ ইত্যাদির কারণে জাপানীদের এত দ্রুত উন্নতি সম্ভব হয়েছে।      
০ Likes ৩ Comments ০ Share ৫৭৮ Views