Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

রাজু আহমেদ

৯ বছর আগে

জঙ্গিবাদ প্রশ্নে পশ্চিমা নীতি এবং বাংলাদেশ

কয়েকদিন পূর্বে আমেরিকার প্রেসিডেন্টে বারাক ওবাম ঘোষণা করেছেন, মুসলমানদের সাথে আমেরিকার তথা পশ্চিমা বিশ্বের কোন শত্রুতা নাই । বারাক ওবামার ভাষ্যানুযায়ী, তাদের সকল শত্রুতা উগ্রপন্থি মুসলমানদের প্রতি । ইসলামকে শান্তির ধর্ম আখ্যা দিয়ে তিনি আরও বলেছেন, যারা ইসলামের অপব্যাখ্যা করে মানুষ হত্যা করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে তাদের বিরুদ্ধে তার দেশ এবং পশ্চিমা বিশ্ব অভিযান অব্যাহত রাখবে । বারাক ওবামার ঘোষণানুযায়ী যদি তাদের কর্মের মিল থাকত তবে ধর্মীয় মত পার্থক্য থাকার পরেও প্রত্যেক শান্তি প্রিয় মুসলিমসহ বিশ্বের সকল মানুষ তার বক্তব্যকে সাধুবাদ জানাত । কিন্তু বারাক ওবামার বক্তব্যের সাথে আমেরিকা এবং তাদের মিত্রদের কর্মকান্ডের মিল কতটুকু ? তারা কি শুধু ইসলামের নামে যারা উগ্রবাদী মতাদর্শন প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাদের শত্রু নাকি গোটা মুসলিম উম্মাহের শত্রু তা ভাববার সময় হয়েছে । কেননা অতীতে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের দমনে আমেরিকার নেতৃত্বে যে অভিযান পরিচালিত হয়েছে তার সাথে বর্তমান উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে আমেরিকার বাস্তবিক অবস্থানের রয়েছে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য । আমেরিকার এ দ্বৈতনীতির কারণে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, তবে কি ওবামার দেশ শুধু তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্যেই ধর্মীয় উগ্রপন্থার অভিযোগ এনে মধ্যপ্রাচ্য তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল ? মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ বিশেষত আফগানিস্থান ও ইরাকের বিরুদ্ধে আমেরিকা এবং তাদের মিত্রদের যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করলেই বোধহয় বিষয়টি স্পষ্ট হবে । তবে জঙ্গীবাদ ও উগ্রবাদ প্রশ্নে আমেরিকার নীতির বিরুদ্ধে সিদ্ধান্তে আসতে সাহায্য করবে পাকিস্তানের তালেবান, সিরিয়ার ও ইরাকের আইএস এবং নাইজেরিয়ার বোকো হারাম দমনে তাদের অবস্থান ।

 

১৯৭৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর সোভিয়েত (ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোশ্যালিষ্ট রিপাবলিক্স) এর সামরিক বাহিনী আফিগানিস্তান আক্রমন করে । উদ্দেশ্য ছিল আফগানিস্তানের কম্যুনিষ্ট বিরোধী গেরিলাদের দমন । তবে এ যুদ্ধে আনুমানিক ১০ লাখ আফগান প্রাণ হারালেও সোভিয়েতের সৈন্যরা আফগানদের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি । সোভিয়েতের দক্ষ সৈন্যদের বিরুদ্ধে আফগানদের সাফল্যের নেপথ্যে ছিল মার্কিন সরকারের সরাসরি সাহায্য । তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার আফাগানিস্তানের ইসলামী প্রতিরোধ বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য ‘মুজাহিদিন’ নামে একটি প্রোগ্রাম হাতে নেন । এ কর্মসূচীর আওতায় ১৯৭৯-১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পর‌্যন্ত আফগানিস্তানকে আনুমানিক ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্য দেয় । যার মধ্যে অস্ত্র-শস্ত্র ছিল উল্লেখযোগ্য পরিমান । সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানের সাথে পেরে উঠতে না পারায় জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ‘জেনেভা অ্যাকর্ড’ চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারীর মধ্যে সকল সোভিয়েত সৈন্যকে আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করে নিয়ে যায় । সোভিয়েত বাহিনী মূলত তাদের ১ লাখেরও বেশি সৈন্য নিয়ে কখনই আফগান প্রতিরোধ বাহিনীকে নিয়্ন্ত্রনে আনতে পারেনি । কারণ আফগান প্রতিরোধ বাহিনীকে যুক্তরাষ্ট্র যেমন সাহায্য করেছিল তেমনি পাকিস্তান, সৌদি আরব, ইরান, চীন, ইস্রায়েল (বিশেষতঃ মোসাদ) সহযোগিতা করেছিল । তৎকালীন সোভিয়েত প্রধান মিখাইল গর্বাচেভ ১৩০০০ সৈন্যের প্রাণহানীর পর খানিকটা লজ্জার সাথেই প্রচন্ড ব্যয়বহুল ভূলটা শুধরে নেন । জেনেভা অ্যাকর্ডের শর্ত ভঙ্গ করেও যখন যুক্তরাষ্ট্র মুজাহিদিনকে অস্ত্র সাহায্য করতে থাকে তখন আফগানিস্তানে অনেকগুলো মুজাহিদ গোষ্ঠীর উত্থান হয় । যাদের মধ্যে ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে আল কায়েদা ছিল সর্ববৃহৎ । ১৯৮৮ সালেই আল কায়েদা গঠিত হয় । আলকায়েদা গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি চিনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে । সমাজতান্ত্রিক চীন আফগানিস্তানের মুক্তির জন্য নয় বরং মার্কিনিদের শক্ত ঘাঁটি গড়ে দেওয়ার জন্যই আফগানিস্তানকে সাহায্য করেছিল ।

 

মার্কিনিদের ছত্র-ছায়ায় ওসামা বিন লাদেন আল কায়েদা গঠন করলেও আফগানিস্তানের ওপর মার্কিনিদের প্রভূত্ব তিনি মেনে নিতে নারাজ ছিলেন । মার্কিনিদের স্বার্থ যখন আফগানিস্তান রক্ষা করতে অস্বীকৃতি জানায় তখন আল কায়েদাকে উগ্রপন্থি সন্ত্রাসী সংঘঠন আখ্যা দিয়ে এটাকে ধ্বংসের জন্য তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ মরিয়া হয়ে ওঠেন । তবে শুধু আল কায়েদাকে ধ্বংস করাই মার্কিনিদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না বরং গোটা আফগানিস্তানকেই মেরুদন্ডহীন করে দেয়ার সুযোগের জন্য তারা ওঁৎ পেতে থাকে । যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম দেওয়া লাদেনকেই তারা আমেরিকার একচ্ছত্র আধিপত্যকামীতার অন্তরায় মনে করে এবং তারা আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমন চালানোর মওকাও পেয়ে যায় । কিছু দুস্কৃতকারী ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার’ এবং পেন্টাগনে বিমান হামলা চালায় । টুইনটাওয়ারে এ হামলায় কয়েক সহস্র মানুষ প্রাণ হারায় । জর্জ বুশ এটাকেই আফগানিস্তান আক্রমনের এজেন্ডা হিসেবে ব্যবহার করে এবং আল কায়েদার তৎকালীন প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে ৯/১১ এর হামলার জন্য দায়ী করা হয় । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর কাবুল ও কান্দাহারে আক্রমনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তান আক্রমন করে । যদিও মার্কিনিদের প্রধান টার্গেট ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করতে বেশ কয়েক বছর লেগেছে । অবশেষে ২০১১ সালের ১লা মে পাকিস্তানের গ্যারিসন শহরের একটি বাড়ি থেকে লাদেনকে হত্যা করা হয় । যদিও লাদেনের মৃত্যু ও বেঁচে থাকা নিয়ে এখনও রহস্য রয়ে গেছে । কেননা লাদেনকে অতীতেও বেশ কয়েকবার হত্যা করার খবর বেশ ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল । অবশেষে ১১ বছরের দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে ২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর আমেরিকা আনুষ্ঠানিকভাবে আফগান যুদ্ধের ইতি ঘোষণা করেণ । এ যুদ্ধে ২২০০ মার্কিন সৈন্য নিহত হয়েছে । যদিও যুদ্ধের পরিসমাপ্তি হয়েছে তবুও ওবার ঘোষণানুযায়ী ১৫০০ ন্যাটো সেনা আফগানিস্তানে থাকবে এবং ধারাবাহিকভাবে তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে । আমেরিকা যে উদ্দেশ্যে আফগানিস্তান আক্রমন করেছিল তাদের সে উদ্দেশ্য সফল হয়েছে কিন্তু আল কায়েদার ঘাঁটি বোধ আরও শক্ত হয়েছে । আয়মান আল জাওয়াহিরির নেতৃত্বে বর্তমানে কথিত আল কায়েদা সংগঠনটি তাদের কাজ সাফল্যের সাথেই চালিয়ে যাচ্ছে । যদিও আল কায়েদার অস্তিত্ব নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন । সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবিন কুক বলেছিল, ‘এটাই সত্য যে আল কায়েদা নামে কোন ইসলামী আর্মি বা সন্ত্রাসী বাহিনী নেই এবং প্রত্যেক গোয়েন্দা বাহিনীর লোক এ বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত । তবে এ নিয়ে মিডিয়ার নাটক রচনার উদ্দেশ্য, সাধারণ মানুষের কাছে মার্কিনীদের সম্রাজ্যবিস্তারে কথিত ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ’র গ্রহন যোগ্যতা সৃষ্টি করা’ । উল্লেখ্য যে, এ বক্তব্য প্রদানের কয়েক দিনে পর অতি রহস্যজনকভাবে স্কটল্যান্ডের পাহাড় থেকে পরে মারা গিয়েছিলেন রবিন কুক । মার্কিন সাংবাদিক ওয়াইনি ম্যাডসেন আল কায়েদা সম্পর্কে প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ‘আল কাযেদা হচ্ছে সিআইএ ও মোসাদের বানানো এক রুপকথার নাম’ ।

 

মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম তেল সম্মৃদ্ধ রাষ্ট্র ইরাককেও পঙ্গু করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র জোট । ইরাকে ব্যাপক ধ্বংসাত্বক জীবানু অস্ত্র তৈরি করছেন (যদিও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এমন কোন অস্ত্রের হদিস পাওয়া যায়নি) অভিযোগ তুলে ২০০৩ সালের ২০ মার্চ মার্কিন-ইঙ্গ বাহিনী দক্ষিণ বাগদাদ দিয়ে ইরাকে আক্রমন চালায় । ২০০৩ সালের ১৩ ডিস্বেম্বর ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন আমেরিকান সেনাদের কাছে ধরা পড়েন । পরবর্তীতে আমেরিকা-ইরাকি সরকারের হাতে সাদ্দাম হোসেনের বিচার হয় । সাদ্দামের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকার কথিত অভিযোগ উত্থাপন করা হয় এবং তা প্রমাণও করা হয় ! অবশেষে ২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ইরাকি সময় সকাল ৬.০৬ মিনিটে সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি কার‌্যকর করা হয় । ইরাককে ধ্বংস করে দিয়ে সেখানে আমেরিকার মনঃপুত পুতুল সরকার বসিয়ে দীর্ঘ ৮ বছর ২৭৩ দিনের তান্ডব শেষে ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর যুদ্ধের ইতি টানা হয় । ইরাকের লাখ লাখ মানুষ হত্যার পর মার্কিনিদের পক্ষ থেকে মুচকি হেসে বলা হয়েছিল, যে অভিযোগে ইরাক আক্রমন করা হয়েছিল তার তথ্য সঠিক ছিল না । তবে সাদ্দাম হোসেন কম দামে আমেরিকায় তেল সরবরাহে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে যে ইরাক আক্রমন করা হয়েছিল এবং সাদ্দাম হোসেনকে হত্যা করাই যে মূল উদ্দেশ্য ছিল  সে সত্যটুকু একবারের জন্যও উচ্চারণ করা হয়নি । মূলত মার্কিনিদের সম্রাজ্যবাদী বিকাশের জন্য সাদ্দাম হোসেন হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে বলেই ইঙ্গ-মার্কিন বাহীন ইরাকবাসীর প্রতি এ বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছিল । যে মানবতা বিরোধী অপরাধের ধুয়োধ্বনি তুলে সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসি দেওয়া হল সেই একই মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ মার্কিন প্রেসিডেন্টদের বিরুদ্ধে তোলার হীম্মত বিশ্বের কারো আছে বলে পরিলক্ষিত হয়নি ।

 

যে অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে হামলা চালিয়েছিল সেই একই ধরণের কর্মকান্ড পাকিস্তানে প্রতি নিয়ত সংঘঠিত হচ্ছে । মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে উগ্রপন্থি তালেবানরা প্রতিনিয়ত আত্মাঘাতী বোমা হামলা কিংবা বন্দুকের গুলিতে নিরীহ মানুষ মারছে । অথচ আমেরিকার পক্ষ থেকে তালেবানদের বিরুদ্ধে সে অর্থে কোন কঠোর হুঁশিয়ারী নেই যতটা ছিল লাদেনের আল কাযেদার ওপর । মার্কিনিদের এ দ্বৈতনীতি কি শুধু পাকিস্তান গরীব বলেই ? তবে সত্য এটাই । পাকিস্তান আক্রমন করলে আমেরিকার অর্থনৈতিক লাভের চেয়ে ক্ষতিটাই বেশি হবে । একই অবস্থা নাইজেরিয়ার উগ্রপন্থি বোকো হারামের প্রতিও । নাইজেরিয়ার মত একটি গরীব রাষ্ট্রে আমেরিকা কোন অবস্থাতেই উগ্রপন্থিদের দমনে অভিযান পরিচালনা করবে না, তাতে মানবতার প্রতি বোকো হারাম যতই আঘাত করুক । কারণ সেখানে যে স্বার্থ নাই । বর্তমান বিশ্বের ত্রাস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আইএস গোষ্ঠী । সিরিয়া ও ইরাক কেন্দ্রিক এ উগ্রপন্থি গোষ্ঠীর তৎপরতা চালু থাকলেও দ্রুত তাদের নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে । অল্প দিনের মধ্যেই আইএস যোদ্ধারা মধ্য প্রাচ্যের তেল সম্মৃদ্ধ অনেক জনপদ দখল করায় তারা অর্থনৈতিকভাবেও বিত্তশালী হয়ে ওঠেছে । মুখে মুখে মার্কিন প্রাশসন আইএস বিরোধী বক্তব্য-বিবৃতি দিলেও সে অর্থে এখনো কোন পদক্ষেপ তারা কিংবা তাদের পশ্চিমা মিত্ররা গ্রহন করেনি । তবে এটুকু নিশ্চিত পশ্চিমারা আইএসকে বেশি দিন স্থায়ী হতে দিবে না । তারা বোধহয় শুধু সুযোগের অপেক্ষায় আছে কখন আইএস-এর বিরুদ্ধে অভিযান চালালে মধ্য প্রাচ্যের শান্তিকামী মুসলিমদেরকেও আক্রমন করা যায় এবং অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হওয়া যায় ।

 

২০০১ সালের দিকে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমন করে তখন ঢাকায় মিছিল হত, ‘বাংলা হবে আফগান এবং আমরা হব তালেবান’ । তখনকার এ স্লোগান মানুষ বুঝে দিত যতটা তার চেয়ে অধিক বেশি দিত না বুঝে । বিশ্বের প্রধান পরাশক্তি মার্কিন মুল্লুকের বিরুদ্ধে ওসামা বিন লাদেনের শক্ত অবস্থানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই এ স্লোগান দেয়া হত । বন্ধুরা মিলে যখন বাজারে যেতাম তখন দুই টাকায় লাদেন বোম পাওয়া যেত এবং সেগুলো কিনতাম । হাফ প্যান্ট পড়ার বয়সের স্লোগান ছিল, ‘ওসামা ইজ আওয়ার হিরো’ । তখন লাদেন কে বা আফগানিস্তান কোথায় তা বোঝার বয়স হয়নি । শুধু ইসলাম ধর্মের সম্পর্ক এবং মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে কথা বলায় লাদেন জনপ্রিয়তা পেয়েছিল । সেদিনগুলোতে এলাকার অর্ধশিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত মুরুব্বীরা বিবিসি কিংবা রেডিও তেহরানের খবর শোনার সময় লাদেনের জন্য দোয়াও করত । বোঝা না বোঝার দোলাচলে যখন মানুষ বুঝতে পারল তালেবান আর আফগান ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে এদেশের রাজনৈতিক দলগুলো বৈষম্য সৃষ্টিতে মেতেছ তখন মানুষের ভূল ভাঙ্গতে সময় লাগেনি । বাংলাদেশে প্রকৃত জঙ্গিবাদ উত্থানের সাথে ছোট বেলায় পাঠকৃত মিথ্যুক রাখাল বালক এবং প্রতিদিন বাঘ আগমনের গল্পের অনেক দিক দিয়ে মিল রয়েছে । রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে জঙ্গিবাদ উত্থানের গল্প বলতে বলতে বোধহয় এবার সত্যিকারেই জঙ্গিবাদ শিকড় দিয়েছে । কিছুদিন পূর্বে আয়মান আল জাওয়াহিরির প্রকাশিত ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশকে নিয়ে তার পরিকল্পনার ঘোষণা দেশবাসীকে সত্যিকারার্থেই চিন্তায় ফেলেছে । ছোটবেলায় যাদের মূখে লাদেনের প্রশংসা শুনেছি সেই তারাই এখন ‘ছেড়ে দে মো কেঁদে বাঁচি অবস্থায়’ । তবে ইতোঃপূর্বে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ নিয়ে যতটুকু সত্য প্রকাশ হয়েছে তার চেয়ে নাটক হয়েছে বেশি । উগ্রপন্থি মতাদর্শের কিছু মানুষ ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দিয়ে ‍কিছু তরুণকে বিপথগামী করেছে এবং এরা মানুষ ও মানবতার ক্ষতি সাধনে ব্যস্ত হয়ে ওঠেছে । তবে এক্ষেত্রে জঙ্গীরা যতটুকু সুযোগ পেয়েছে তার চেয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সুযোগ করে দিয়েছে বেশি বলেই প্রতীয়মান হয় । কথিত বন্দু যুদ্ধে এদেশের নিরীহ মানুষ মারা যেতে পারে কিন্তু জঙ্গীদের কাউকে গ্রেফতার করে ক্রসফায়ার দেওয়া হয়েছে এমন সংবাদ কালে-ভদ্রেও প্রকাশ পায়না । শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলা ভাইদের উত্তরসূরীদের সংখ্যা এদেশে খুব বেশি এখনো হয়নি কাজেই এখনই যদি কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হয় তবে বাংলাদেশকে ব্যর্থতার কবল থেকে রক্ষা করা সম্ভব । রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যত বেশি দূরত্ব সৃষ্টি হবে জঙ্গিবাদ এবং উগ্রবাদ উত্থানের সম্ভাবনা তত বেশি ত্বরাণ্বিত হবে । কাজেই ভিন্নকোন স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য দূরীভূত না হলেও অন্তত জঙ্গী দমনে সবার ঐকমত্য পোষণ করা জরুরী । এক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থ অগ্রাধিকার দেওয়া সময়ের দাবী ।

 

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটে মূলত ১৯৮৯ সালে । সে সময়ে ‘হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী’ বা হুজি নামে এদেশে প্রথম জঙ্গী গ্রুপ আত্মপ্রকাশ করে । অতপর ১৯৯৮ সালে আত্মপ্রকাশ করে ‘জামা’আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ’ বা জেএমবি নামে আরেকটি জঙ্গি সংগঠন । যার প্রধান ছিলেন শায়খ আব্দুর রহমান । অতঃপর ‘জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ’ বা জেএজেবি নামক উত্তরবঙ্গে আরেকটি জঙ্গি গ্রুপের আবির্ভাব ঘটে । এর প্রধান ছিলেন ছিদ্দীকুল ইসলাম ওরফে  বাংলাভাই । এছাড়া পূর্ব বাংলা কমিউনিষ্ট পার্টি, জাসদ গণবাহিনী, সর্বহারা প্রভৃতি নামে প্রায় ডজন খানেক জঙ্গী গ্রুপের আবির্ভাব হয় । ১৯৯৯ সালে জেএমবি সর্বপ্রথম কুষ্টিয়ার বড়কান্দি গ্রামে সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় সন্ত্রাসী হামলা চালায় । এর কিছুদিন পর যশোরে উদীচির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এক শক্তিশালী বোমা হামলা চালায় যাতে সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিল্পীসহ ১০ জন নিহত হয় । অতঃপর ২০০১ সালে রমনার বটমূলে, ২০০২ সালে পল্টনময়দানে কমিউনিষ্ট পার্টির এক জনসভায় এবং ২০০৫ সালের ১৭ আগষ্টে নারায়ণগঞ্জ ব্যতীত দেশের ৬৩ টি জেলায় প্রায় ৫’শতাধিক স্থানে বোমা হামলা চালায় । এছাড়াও ২০০৫ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে ঝালকাঠী, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের আদালত প্রাঙ্গনে আত্মগাতী বোমা হামলা চালিয়ে বিচারকসহ বহু নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করে । তাছাড়াও ছোট-খাট আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটে ।

 

অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে উগ্রপন্থি কিংবা জঙ্গীবাদের উত্থান অনাকাঙ্খিত । তবুও প্রশাসনের নাকের ডগায় যাদের উত্থান হয়েছে তাদেরকে যে কোন মূল্যে দমন করতে হবে । জঙ্গীবাদের ইস্যূকে নিয়ে যদি রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করা হয় তবে পরিণামে বাংলাদেশের ক্ষতিটাই বৃহৎ আকার ধারণ করবে । উপমহাদেশের মধ্যে উগ্রপন্থি যে শুধু বাংলাদেশে তা নয় বরং আমাদের প্রতিবেশী ভারতে মাওয়াবাদীরা কিংবা শ্রীলঙ্কায় তামিলারা বেশ শক্ত অবস্থানে রয়েছে । ক্ষতির দিকটা হিসেব করেলেও মাওয়াবাদীরা কিংবা তামিলরা বাংলাদেশের জঙ্গীদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি সাধণ করেছে । তবে শুধু ইসলামিক কতিপয় শব্দ যুক্ত থাকার কারণে বাংলাদেশের প্রতি সবার নজর । অথচ ইসলামের সাথে জঙ্গিবাদের কিংবা উগ্রপন্থিদের যে ন্যুণতম সম্পর্কও নাই তা কে বুঝতে চায় ? ইসলামের প্রাথমিক যুগে খারেজীদের মতাদর্শে নিয়ে যে উগ্রপন্থার উদ্ভব হয়েছিল তার সাথে ইসলামের মূল ধারা আদৌ সম্পর্কিত নয় । কাজেই জঙ্গিদের দমনে সবাইকে একাট্টা হয়ে কাজ করতে হবে । অতি সম্প্রতি ঢাকায় বিজ্ঞানমনস্ক লেখক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অভিজিৎ রায় নিহত হয়েছে । এখন পর‌্যন্ত যা ধারণা করা হচ্ছে, তাতে বোঝা যায় এটা উগ্রপন্থিদের কাজ । অবশ্য প্রকৃত অপরাধী কারা তা বের করার জন্য বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বোধ হয় যথেষ্ট ছিল । যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে এফবিআইকে বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ দানের সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক হয়েছে তা প্রকাশ হতে বোধহয় খুব বেশি সময় লাগবে না । যাইহোক উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হওয়ার জন্য নৈতিক আবেদন জানাই । কোন পক্ষের স্বার্থের কারণে যেন বাংলাদেশও ব্যর্থ পাকিস্তানের পরিণতি লাভ না করে ।

                 

রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।

facebook.com/raju69mathbaria/

 

 

 

০ Likes ২ Comments ০ Share ৩৩৫ Views