Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

ছোটগল্প: বিকৃত-ব্যবচ্ছেদ





ছোটগল্প:
বিকৃত-ব্যবচ্ছেদ
সাইয়িদ রফিকুল হক

 
তনুশ্রী আপনমনে হাঁটছিলো। এসময় তার অন্য কোনোদিকে খেয়াল ছিল না। তার সমস্ত মনোযোগ এখন হাঁটায়। তাই, সে খুব মনোযোগ দিয়ে হাঁটছে।
আজ তার মনটাও খারাপ। আর সে বাসা থেকে বেরও হয়েছে এই মনখারাপ নিয়ে।
সে বড় রাস্তার মোড়ে এসে দেখলো রাস্তার একপাশে একটা বিরাট জটলা। আর সেখানে লোকজনের সে-কী চিৎকার ও চেঁচামেচি! তার মনে হলো—আজকাল একশ্রেণীর মানুষ হাতের কাছে একটাকিছু পেলে তা-ই নিয়ে অহেতুক হাঁকডাক করতে খুব ভালোবাসে আর এতে উৎসাহী হয়ে ওঠে। কিন্তু  মানুষের হৈচৈ তার একদম ভালো লাগে না। তবুও তাকে এই ভিড়টার পাশ কেটেই যেতে হবে। সে প্রায় চোখ বন্ধ করে লোকের ভিড় অতিক্রম করলো। আর এইসময় সে লক্ষ্য করলো—একটি অল্পবয়সী ছেলে এই ভিড়ের মধ্য থেকে বেরিয়ে এসে সরাসরি তার পিছু নিয়েছে। সে এখন তনুশ্রীর পিছে-পিছে হাঁটছে। আর তার হাঁটা যে উদ্দেশ্যমূলক—তা সহজেই অনুমেয়।
 
তনুশ্রী ঠিক ভয় পেলো না। তবে সে এতে ভীষণ বিরক্ত হলো। এই ছেলেটি তার একরকম মুখচেনা। ছেলেটি হয়তো তাদের বাসার আশেপাশেই থাকে। এর আগেও সে তাকে তার পিছু নিতে দেখেছে। এই ছেলেটি এরকম আরও কয়েকদিন তনুশ্রীর পিছে-পিছে হেঁটেছে। আর তনুশ্রী দেখেছে,  তার চোখের দৃষ্টি একেবারে ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো। ছেলেটির চোখ দুটো সবসময় লোভে আর ভীষণ ক্ষুধায় চক-চক করে। তবুও তনুশ্রী তাকে ভয় পায় না। তবে সে মাঝে-মাঝে লজ্জা পায়। কারণ, ছেলেটির চোখের দৃষ্টি একটা লোভী-শিয়ালের মতো।
 
ছেলেটি তনুশ্রীর পিছনে হাঁটার সময় একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে ঠিকই। তবে সে খুব একটা দূরেও থাকে না। তনুশ্রী বুঝতে পারে, ছেলেটি তার পিছনে হাঁটছে—আর তাকে লেহন করছে। আর তার সর্বাঙ্গ একটা প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে।
 
তনুশ্রী আরও বুঝতে পারে, ছেলেটি তাকে ভালোবাসে না। আর সে বয়সের দিক দিয়ে তার চেয়ে কয়েক বছরের ছোটই হবে। তবুও সে প্রায় নিয়মিত তার পিছনে হাঁটছে। আর সবসময় তার সর্বাঙ্গ লেহন করছে। আসলে, সে যৌনক্ষুধায় আক্রান্ত এক যুবক।
তনুশ্রী আজ বুঝতে পারলো: সে এখন একজন ধর্ষিত-রমণী। তাকে প্রায় প্রতিদিন এই ছেলেটি কিছুসময় ধরে ধর্ষণ করছে। আর ছেলেটি নিয়মিত তার পিছে-পিছে হাঁটছে—আর তাকে উপুর্যপরি ধর্ষণ করছে। সে এখন ধর্ষিতা!
কথাটা মনে হতেই তার লজ্জাই লাগছিলো। তবুও তার করার কিছু নাই। এখানে, সে কোনোপ্রকার আইনিসহায়তাও নিতে পারবে না। এদেশে এখন ধর্ষণেরই বিচার হয় না। ধর্ষিতা মারা গেলেও কোনো বিচার পায় না। আর সে তো এখানে পরোক্ষভাবে ধর্ষণের শিকার হয়েছে, আর হচ্ছে। একটা ক্ষুধার্ত নেকড়ের দ্বারা সে নিয়মিত কাল্পনিক-ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এই ধর্ষণ-অপকর্ম সে এখন প্রমাণ করবে কীভাবে?
তনুশ্রীরা কয়েক মাস হলো এই এলাকায় এসেছে। আগের এলাকাটা ছেড়েছে এই একই কারণে। আর ওখানকার একটা মাস্তান-কি-পাতিমাস্তান তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো। তনুশ্রী বুঝেছিলো, এটি বিয়ে নয়—এটি বিয়ের নামে স্রেফ একটি বড়সড় শয়তানী। তার দেহটাকে কিছুদিন ভোগ করার একটি ষড়যন্ত্র মাত্র। এখানে, বিয়ে নামক একটি রশি দ্বারা তনুশ্রীকে কিছুদিনের জন্য বেঁধে ফেলে বা আটকিয়ে তার দেহটাকে নেকড়ের মতো ছিন্নভিন্ন করে খেতে চায় ওই মাস্তানকুকুর।
 
এই ছেলেটির ক্ষুধার্তদৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য তনুশ্রী একটা রিক্সা খুঁজছিলো। কিন্তু সকালবেলায় এদিকে রিক্সা খুব কম মেলে। তবুও সে রিক্সার আশায় এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। আর এইসময় ছেলেটি প্রায় তার শরীর ঘেঁষে দাঁড়াবার চেষ্টা করলো। হয়তো সে তার গায়ের গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করছে। আর সে এভাবে তনুশ্রীর গায়ের গন্ধ তার দেহ-মনে মেখে নিজেকে আরও কামাতুর করে তুলতে চায়। এবার তনুশ্রী খুবই বিরক্ত হলো।
শেষমেশ তনুশ্রী রিক্সা না পেয়ে একটা বাসেই উঠে পড়লো।
 
বাসে উঠে তনুশ্রী দেখলো, শিকার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় ছেলেটি খুব মনমরা হয়ে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে ভেবে দেখলো, এখানে তার নিজের কোনো দোষ নাই। সে উগ্রধরনের কোনো পোশাকও পরিধান করে না। পারতপক্ষে সে রাস্তা-ঘাটে চলাফেরার সময় কোনোপ্রকার পারফিউমও ব্যবহার করে না। তার অপরাধ একটাই—সে দেখতে সুন্দর, তার বয়স কম, আর তার ফিগারটাও  আকর্ষণীয়! মেয়েদের যৌবন এখন আশীর্বাদ নয়—এটি যেন একপ্রকার অভিশাপ।
 
বাসে উঠে তনুশ্রী কোনো সিট পায় নাই। এখানে, সে দেখলো—তার গা ঘেঁষে দাঁড়াবার জন্য একদল পুরুষ যেন মল্লযুদ্ধে নেমেছে। তার আশপাশ ছাড়াও অন্যদিকে পর্যাপ্ত জায়গা থাকা সত্ত্বেও কিছুসংখ্যক লোক যেন তার গায়ের উপর উঠতে চায়। একটু সুযোগ পেলেই তাকে ধাক্কাও মারতে চায়। আর বেশিরভাগই পুরুষেরই আকর্ষণ তার পশ্চাৎদেশ। এদিকটা আক্রমণ করার জন্য একেকটা যেন গজনীর সুলতান মাহমুদের মতো হিংস্র ও আগ্রাসী হয়ে উঠৈছে।
তনুশ্রীর একবার মনে হলো: সে বাস থেকে নেমে যাবে। হাঁটলে সহজে তবুও কেউ তার শরীরস্পর্শ করতে পারবে না। এজন্য সে বাসে সহজে উঠতে চায় না। বাসে আজকাল মানুষের পাশাপাশি  শিয়াল, শকুন, নেকড়েও উঠছে দলে-দলে। সে ভাবছিলো: এখন কোথাও একটু বসতে পারলে সে আজ দ্বিতীয়বারের মতো ধর্ষিত হওয়ার অবস্থা থেকে রক্ষা পেতো।
 
বাসের মহিলা-সিটগুলো একদল নেকড়ের দখলে। এদের সরতে বললেও এরা সরে না। আরও এদের যে সরতে বলে এরা তার উপর ভয়ানক বিরক্ত হয়। এমনকি তখন এরা আরও বেশি কুদৃষ্টিতে তাকায় ওই অভিযোগকারী-মেয়েটির দিকে। তবুও তনুশ্রী সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে মহিলা-সিটের পাশে দাঁড়িয়ে একটাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “ভাই, এটি তো মহিলা-সিট।”
একটা ছোকরাবয়সী-ষণ্ডা সেখানে বসে ছিল। তার দু’কানের মধ্যে এয়ারফোন গোঁজা। আর তার হাবভাব আর বসার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিলো—এটি তার পৈতৃকসূত্রে পাওয়া বাড়িটার নিজস্ব ড্রইংরুম। তাই, সে প্রথমটায় তনুশ্রীর কথাটা পাত্তা দিলো না। তনুশ্রী দ্বিতীয়বার একইকথা বলার পর ছোকরাটি তার কান থেকে এয়ারফোন খুলে তনুশ্রীর দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে বললো, “সরি!”
তনুশ্রী এবার জোরে বললো, “এটা মহিলা-সিট। ওঠেন।”
এতে ছোকরাটি বাসের ডানদিকের জানালার উপর তাকিয়ে দেখলো সেখানে ‘মহিলা’শব্দটি স্পষ্টভাবে  লেখা আছে। সে খুব বিরক্ত হয়ে ধীরেসুস্থে উঠে সিটের কাছাকাছি একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো। আর তনুশ্রীর দিকে ঘৃণামিশ্রিতচোখে বারবার তাকাচ্ছিলো।
ছেলেটির অসভ্যতা তনুশ্রীকে ভীষণভাবে ব্যথিত করলো। আর সে ভাবলো: এখনই যদি এই দুরাবস্থা হয়—তাহলে, আরও পঞ্চাশবছর পরে এই দেশের অবস্থা কী হবে? এই দেশে মেয়েরা তো তখন স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবে না। তার বুকের ভিতরটা দুমড়েমুচড়ে বেরিয়ে এলো আত্মবিলাপ: দেশটা স্বাধীন করেছেন মহাপুরুষেরা। আর এটি এখন ভোগদখল করছে কিছুসংখ্যক শূয়রের বাচ্চা! এখানে, বাসের ভিতরে মহিলাদের জন্য নির্ধারিত ও সংরক্ষিত সিটগুলো পর্যন্ত দখল হয়ে যাচ্ছে! আর এগুলো ওই দখলবাজ-রংবাজদের ছেড়ে দিতে যেন কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে! সবখানে আজ এই শূয়রের বাচ্চাদের ভয়াবহ আধিপত্য!
 
মেয়েদের এখন সুন্দর-ফিগার হলে নেকড়ের দৃষ্টিতে পড়াটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশিরভাগ মানুষই এখন নেকড়ের দলে। আর যারা এই ছেলেটির মতো নেকড়ে—তারা বলবে এটি কোনো ঘটনাই নয়। আর যারা এভাবে মেয়েদের দেখে-দেখে মনে মনে ধর্ষণে ব্যতিব্যস্ত—তারা এইসব নেকড়েকে ভালোবাসে। এরা তাদের স্বজাতি। সুতরাং, এই দেশে নেকড়ের গায়ে হাত দেওয়া এখন সহজ নয়। এই দেশে ধর্ষকরা এখন অনেকের মাথার মুকুট।
 
নিউমার্কেটের সামনে তনুশ্রী নামলো। তারপর বাকুশাহ-মার্কেটের সামনে দাঁড়ানো তেঁতুলগাছটার নিচে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সে নিজের জন্য প্রয়োজনীয় কয়েকটি বই খুঁজলো। বইগুলো পেতে তাকে বেশ বেগ পেতে হলো। তবুও সে সবক’টা বই পেলো না। দোকানদার বললো, “আপা, আইজ নাম দিয়ে যান। পরশু পাবেন।”
তনুশ্রী তা-ই করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে হাঁটতে লাগলো।
 
 
দুপুরে ক্লাসের ফাঁকে-ফাঁকে তনুশ্রী ভাবছিলো: এখন শরীরলোভী আর শরীরঘেঁষা অমানুষের সংখ্যা খুব বেড়ে যাচ্ছে। অনেকেই এখন তার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলতে চায়—শুধু তার এই শরীরটার জন্য। শরীরের জন্য এখন একেকটা অমানুষ কী ভয়ানক পাগল! এরা সবাই শরীরলোভী-জঙ্গি। এরা নারীদেহের জন্য আজ খুনাখুনি পর্যন্ত করতে রাজী। এদের লজ্জাশরম-বিবেকবুদ্ধি বলে আজ আর কিছু নাই। সে আরও দেখেছে, এখন শরীরের জন্য আশিবছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত লালায়িত! অথচ, সে শুনেছে, আগের কালে এই বয়সের একটা লোক মৃত্যুভয়ে ধর্মকর্ম ও ধর্মচিন্তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকতো। তবে সেকালেও কিছুসংখ্যক শরীরলোভী-জানোয়ার ছিল। এখন তার খুব লজ্জা লাগে যখন সে দেখে, একটা ষাট-সত্তর-আশি-বছরের বৃদ্ধ ঘুরিয়েফিরিয়ে তার শরীরটা দেখছে। আর তাও খুব লোভাতুর ও কামাতুর দৃষ্টিতে তার শরীরের বিশেষ-বিশেষ অঙ্গগুলোকে এতো নিখুঁতভাবে পরিমাপ করছে—যেন এগুলো তার নিজের সম্পত্তি। তাই, সে যখন-তখন যেমন-খুশি তেমনভাবে এগুলো দেখতে পারে আর নাড়াচাড়া করতে পারে।
 
তনুশ্রী তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে ঢুকছিলো। সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, লাইব্রেরির ভিতরের চেয়ে বাইরে আড্ডাবাজ ছেলে-মেয়েদের সংখ্যা অনেক বেশি। এরা সবসময় আড্ডাবাজি করে বেড়ায়। আর পরীক্ষার সময় হলে এরা বন্ধুবান্ধবকে ধরে নোটপত্র জোগাড় করে ঠিকই পরীক্ষায় পাস করে যায়। কিন্তু এরা কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে এতো সমৃদ্ধ একটা লাইব্রেরি থাকতে সেখানে হোম-ওয়ার্ক করবে না। এরা যেন লাইব্রেরি-ওয়ার্ক একেবারে ভুলে গেছে। এদের অধিকাংশই এখন শুধু শরীর চেনে—ছেলেগুলো মেয়েদের আর মেয়েগুলো ছেলেদের! আর তাই, এরা শরীরের লোভে আর সস্তা-ভালোবাসার নামে প্রেমের অভিনয় করে থাকে। এরা অতিসহজে দেহটাকে নোংরা করতে সামান্যতম দ্বিধা করছে না। এরা জানেও না বোঝেও না যে—তার এই বয়সটা বই পড়ে কাটানোর একমাত্র উপযুক্ত সময়। আর এরা নিজেদের জন্য অপরিহার্য লাইব্রেরি-ওয়ার্ক বাদ দিয়ে খেলাধুলার মতো একটি গৌণবিষয় নিয়ে আলোচনায় মশগুল হয়ে জীবনের মুখ্যবিষয় বইপড়াটাকে বিসর্জন দিচ্ছে। এদের জীবন থেকে মুছে যাচ্ছে লাইব্রেরি-ওয়ার্ক। আর তার বদলে সেখানে তারা খুঁজে নিচ্ছে দেহ-ওয়ার্ক।
 
সে আস্তে-আস্তে লাইব্রেরিতে ঢুকলো। এখানটা অনেক নিরাপদ। আর এখানে লোকজনও কম। এখানে,  ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কম থাকায় তনুশ্রী তার পছন্দমতো একটা জায়গায় বসার সুযোগ পেলো। সে বই খুঁজে টেবিলে বসলো। কিন্তু একটু পরে সে নিজেই উপলব্ধি করতে পারলো যে, তার এখন পড়ায় মনোযোগ নাই। ওই নেকড়ে-ছেলেটার কথা মনে হতেই ঘৃণায় তার গা-টা রি-রি করে উঠলো। সে এখানে বসেও খুব ঠাণ্ডামাথায় ভেবে দেখলো: তার ধারণা সঠিক। সে প্রায় প্রতিদিন ওই নাম-না-জানা ক্ষুধার্ত নেকড়েটার কাছে ধর্ষিত হচ্ছে। এখন তার আরও মনে হচ্ছে—ওই নেকড়েটা শুধু তাকে রোজ-রোজ ধর্ষণই করছে না—সে যেন তাকে প্রতিদিন বিবস্ত্র করে তাকে ধর্ষণের পাশাপাশি রীতিমতো তার শরীরের ব্যবচ্ছেদও করছে। তাকে সে নিয়মিত উলঙ্গ করে পোস্টমর্টেম করে চলেছে। মৃত-মানুষের পোস্টমর্টেম করাটা না হয় একটা স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এভাবে রাস্তাঘাটে, বাসে, ট্রেনে, ফুটপাতে জীবিত মানুষকে বা নারীদেহের এই পোস্টমর্টেম কতটা জঘন্য! তবুও এখানে তার বলার কিছু নাই। সে যদি কাউকে কিছু বলতে যায়—তাহলে, সবাই তাকে বলবে তোমার শরীরটা খুব আকর্ষণীয়-লোভনীয়! তাই, এই বয়সের ছেলে-ছোকরারা একটু তাকাবেই! এই হলো সমাজের প্রকৃত চেহারা। এখানে, শূয়রের বাচ্চাদের কিছু বলা যাবে না। করা যাবে না। কারণ, শূয়রের বাচ্চাদের খুব ধারালো দাঁত-নখ আর শক্তিশালী শরীর আছে। আর সে তো মেয়েমানুষ! তাকে কেউ নারী কিংবা একটা মানুষও ভাবে না। সেও যে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ—এই সমাজ আজও তা স্বীকার করে না। এই শূয়রের বাচ্চাদের সমাজে প্রতিবছর নারীদিবস এলে নারীউন্নয়নের জন্য বড়-বড় কথা বলা হয়। বড়-বড় আর হোমরাচোমরাদের বড়-বড় বাণীও রেডিও-টিভিতে সরবরাহ ও প্রচার করা হয়। আর সমাজের লম্পট-ধর্ষক-মাতাল-বদমাইশদের প্রতিনিধি কতকগুলো সংবাদপত্র এদেরই পক্ষে সাফাই গায়।
 
তনুশ্রী দেখলো, তার সামনে বইটা খোলা অবস্থায় রয়েছে—কিন্তু সে কিছুতেই পড়তে পারছে না। তার আজ মনে হচ্ছে—এদেশে এখনও যেন বেগম রোকেয়ার যুগের অবস্থাই বিরাজ করছে। আর এখন মেয়েরা স্কুল-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুটা স্বাধীনভাবে পড়তে পারছে কিন্তু তারা এখনও স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে কিংবা স্বাধীনভাবে নিজেদের মতো করে কোনো কাজ করতে পারছে না। এখনও দেশের পাবলিক কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ্রেণীর শিক্ষক-নামধারী নেকড়ে মেয়েদের ধরার জন্য ওঁত পেতে আছে। এইসব শিক্ষক এখন গবেষণা করার সময় পায় না। এদের মাথায় দেশ-জাতি-মানুষ বলে কিছু নাই। আর এদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান ও তাঁদের ত্যাগতিতিক্ষার কথা অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় বিরাটকিছু মনে হয় না। দেশটা যে এখন জঙ্গিতে ছেয়ে যাচ্ছে—এবিষয়ে তাদের কোনো জোরালো বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায় না। এদের কাছে শিক্ষার্থীরা ভালোকিছু জিজ্ঞাসা করতে গেলে তার কোনো সদুত্তর দিতে পারে না কিংবা জানার জন্য কোনো শিক্ষার্থী এদের সঙ্গে দেখা করারও সুযোগ পায় না। কিন্তু এরাই জোর করে ধরে ছাত্রীদের সঙ্গে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা আলাপসালাপ চালিয়ে যাচ্ছে। এরাও ওই রাস্তার ক্ষুধার্ত নেকড়েটার উন্নত-সংস্করণ। এরাও মেয়েদের-ছাত্রীদের দেহটাকে সারাক্ষণ পোস্টমর্টেম করতে চায়! দেশে আসলে নারীদেহলোভী-পুরুষবেশ্যার সংখ্যা বাড়ছে। এদের স্টাইল ভিন্ন—কিন্তু এদের ক্ষুধাপ্রকৃতি এক ও অভিন্ন। আর এরা একই গোত্রভুক্ত নেকড়ে।
 
দু’দিন বাদেই তনুশ্রীর টিউটোরিয়ালপরীক্ষা। সে জোর করে পাঠে নিজের মনোযোগবৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু তার মনজুড়ে কেবলই এসব ভাবনা তাড়িয়ে বেড়ায়। সে এর আগে যখন অন্য একটা এলাকায় থাকতো সেখানকার একটা দেহলোভী-ছেলের বিরুদ্ধে তার বাবা-মা’র কাছে অভিযোগ করেছিলো। সব শুনে ওই ছেলের মা অত্যন্ত দায়সারাভাবে বলেছিলো, “আচ্ছা, তুমি চিন্তা কোরো না। আমি ও-কে শাসন করে দেবো। কিন্তু তুমিও একটু সামলে চলিও। আর নিজেকে আরেকটু ঢেকেঢুকে রাখিয়ো।”
সে বুঝে উঠতে পারে না—সে নিজেকে আর কত ঢেকে রাখবে? একজন বাঙালি-নারী হিসাবে সে সবসময় শালীন পোশাকপরিধান করে থাকে। এতেও তাদের আপত্তি! সে কি এখন কালোকাপড়ের বোরকা পরবে নাকি? আর বোরকা পরলেও তো তাদের রেহাই মিলবে না। কারণ, তার জানা আছে নেকড়েদের ঘ্রাণেন্দ্রিয় খুব প্রখর। সবচেয়ে বড়কথা হলো—দেশে কত বোরকাপরা মেয়ে ধর্ষিত হচ্ছে! মাদ্রাসায় পড়া মেয়ে পর্যন্ত ধর্ষিত হয়েছে, আর এখনও হচ্ছে! শুধু পোশাক কি ধর্ষণ ঠেকাতে পারবে? না, কক্ষনো না। নেকড়েগুলোকে আগে মানুষ হতে হবে। নেকড়েপ্রবৃত্তি আর তাদের কামমানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আর এসব সম্ভব না হলে নেকড়েগুলোকেই শিকার করতে হবে। তবুও মেয়েদের বাঁচার মতো বাঁচতে দিতে হবে। আর নইলে, প্রয়োজনে সমাজে দস্যু ফুলনদেবীদের জন্ম হবে। এসব ভাবতে-ভাবতে সে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
বই বন্ধ করে তনুশ্রী উঠে পড়লো। দুপুরের খাবারগ্রহণের জন্য সে রোকেয়া-হলের দিকে হাঁটতে থাকে। খেয়েদেয়ে মনটা ভালো হলে সে আবার পড়তে বসবে।
 
 
বাসায় তার বিয়ের কথা নিয়ে আজ সকালে সে তার মায়ের সঙ্গে খুব কথা-কাটাকাটি করেছে। তার মা চাচ্ছেন, এখনই তাকে একটা বিয়ে দিতে। যাতে, তাকে নিয়ে আর-কোনো দুশ্চিন্তা না করতে হয়। কিন্তু তনুশ্রী এখনই বিয়ে করতে চাচ্ছে না। এখন বিয়ে করলে তার পড়ালেখাটা নষ্ট হয়ে যাবে। বিয়ের পর তার শরীরের দখল চলে যাবে একটি লোকের অধীনে। আর তাকে সর্বক্ষণ সেই লোকটিদের আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হবে। সে স্বামীকে মানবে। সংসার করবে। সবার সঙ্গে মিলেমিশেও থাকবে। তবে পড়ালেখা শেষ না করে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না। এখন তাকে কেউ বুঝতে চাচ্ছে না। তাদের এক আত্মীয় বিদেশে থাকে। লোকটি দেশে এসেছে কিছুদিন হলো। একদিন তাকে দেখে সেই লোকটি পাগল হয়ে গেছে। তনুশ্রী ঠিক বুঝতে পেরেছে, এই লোকটিও তাকে ভালোবাসেনি। সেও তার লোভনীয় শরীরটা দখল নিতে চাচ্ছে। জগতটা যেন শরীরের খেলা হয়ে যাচ্ছে। সবাই এখন একটি মনোরম ও মনোলোভা শরীর চায়। এদিক থেকে তনুর শরীরটা সবার পছন্দ। সে তাই উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আর এই বিষয়টা নিয়েই সে আজ সকালে তার মায়ের সঙ্গে অনেক ভদ্রভাবেই তর্ক করেছে। কিন্তু তার মা কিছু বুঝতে চাইছিলো না। তাই, সে নিরুপায় হয়ে কঠিনস্বরে মাকে বলেছে, “আমি এই ছেলেকে বিয়ে করবো না। সেও তো খিলজীরোডের ওই মাস্তানটার মতো আমার শরীর চাচ্ছে! আমি এখন কাউকে শরীর দিতে পারবো না। আর যদি কেউ-এখন আমাকে ভালোমন নিয়ে বিবাহ করতে চায়—তাহলে, তাকে বলবে সে যেন আমার জন্য আরও দুটি বছর অপেক্ষা করে। তাহলে, এর মধ্যে আমার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষাটাও শেষ হবে। আর তেমন কষ্ট থাকবে না। কিন্তু এখন কিছুতেই বিয়ে নয়।” এই বলে সে বাসা থেকে মনখারাপ করে বেরিয়ে এসেছে।
 
তার বাবা তাকে সমর্থন করেছেন। তিনি মেয়েকে আরও পড়ার সুযোগ দিতে চান। মেয়েটিকে মাস্টার-ডিগ্রী পর্যন্ত পড়িয়ে তবেই ভালো একটা ছেলে দেখে তাকে বিয়ে দিতে চান। তিনি এখনই মেয়ের বিয়ের কথা ভাবেন না। তার চাকরি আছে এখনও দশ বছর। তাও আবার সরকারি চাকরি। এজন্য তিনি মেয়ের বিয়ে নিয়ে এতোটা চিন্তিত নন। কিন্তু মাঝখানে বিরাট সমস্যা করেছিলো খিলজীরোডের ওই মাস্তানটা। তার ভয়ে তারা প্রায় রাতের আঁধারে কাউকে কিছু না বলে তার এক নিকটাত্মীয়ের সহায়তায় বছিলার মতো একটা গণ্ড এলাকায় চলে এসেছেন। তবে এখানে এসে বেশ নিরাপদবোধ করছেন। তার মেয়েটি এখন সবসময় খুব সাবধানে চলাফেরা করে। আর সে এমন এক রাস্তায় চলাফেরা করে যে, এদিকটায় ওই মাস্তানটার আসার তেমন কোনো সুযোগ নাই।
 
মেয়েদের হলে যাওয়ার পথে তনু ভাবছিলো: সে কিছুতেই একটা শরীরলোভী-জানোয়ারকে বিয়ে করবে না। এরা মদমাতালের মতো ভয়ানক পাশবিক। এদের কোনো হিতাহিতজ্ঞান থাকে না। এরা হয় চরম ভোগবাদী। আর এরা কিছুদিন একটা দেহ নিয়ে নাড়াচাড়া করে—আবার প্রয়োজন ফুরালে সেই দেহটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তাই, সে কিছুতেই একটা দেহলোভীকে বিয়ে করবে না। এরা ভালোবাসতে জানে না। এরা নারীর সুরভিত-হৃদয়ের সৌন্দর্য-আবিষ্কার করতে পারে না। এরা হয় সীমাহীন নির্বোধ। আর সে কারও-কোনো বুদ্ধিতে এতো পড়ালেখা শিখে একটা নির্বোধকে জীবনসঙ্গী বানাবে না।
 
 
বিকালে বাসায় ফিরছিলো তনুশ্রী। এবার বাস থেকে নেমে সে দেখলো, প্রতিদিনের সেই ছেলেটি এখন তার আরও দুই বন্ধুর সঙ্গে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে বাস থেকে নামামাত্র সব চোখ তার দিকে নিবদ্ধ হলো। আর চোখগুলো যেন এবার হায়েনার মতো একসঙ্গে জ্বলে উঠলো। আর সে বুঝলো, সকালে সে একটা নেকড়ের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিলো। আর সে এখন গণধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ছয়টি চোখ তার সর্বাঙ্গ লেহন করছে ইচ্ছেমতো। ওরা ভয়ানক কামুক-পুরুষ। তাই, ওরা ইচ্ছেমতো যখন-তখন যেমন-খুশি তেমন করে মেয়েদের ধর্ষণ করতে পারে। এই দেশে ওদের পাহারা দেওয়ার জন্য রয়েছে আইন, পুলিশ, প্রশাসন—সবকিছু। এখানে, শুধু তনুশ্রীদের স্থান নাই।
 
তনুশ্রী একসময় ক্লান্তদেহে বাসায় ফিরলো। আর সে মনে মনে ভাবলো—সে তার লক্ষ্যে পৌঁছাবেই।
 
 
 
 
 
 
সাইয়িদ রফিকুল হক
পূর্বরাজাবাজার, ঢাকা,
বাংলাদেশ।
১২/০৬/২০১৭
২ Likes ২ Comments ০ Share ১৮১ Views