Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

তাহমিদুর রহমান

১০ বছর আগে

ছন্দের সাতকাহন

ভূমিকাঃ মূল লেখার সাথে ভূমিকার কোন সম্পর্ক নেই। লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল সাদাকাগজ নামে একটি লিটিল ম্যাগ পত্রিকায়। ব্লগে সম্ভবত প্রথম প্রকাশ। অনেক বই ঘেটে কষ্ট করে লেখাটি লিখেছিলাম। আমার দুঃখ পেটের দায়ে এরকম প্রবন্ধ লেখার সময় পাই না। যদি আপনাদের ভাল লাগে তবে ভাল লাগা জানিয়ে দিবেন। শুভেচ্ছা রইল। 

 

 

 

ছন্দ কি? এই বিষয়ে আমি ইচ্ছা করলেই হাজারটা বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে একটা সেইরকম জ্ঞানী প্রবন্ধ লিখে দিতে পারি। কিন্তু আমার সেই উদ্দেশ্য একদম নেই। থাকলে আমি এই লেখা লিখতাম না। কারন ওসব জ্ঞানী কথা লেখা আমার কর্ম নয়। চলুন আলোচনায় চলে যাওয়া যাক।

 

ধরুন আমরা একটা রাস্তা বানাব। রাস্তা বানাতে অবশ্যি রাস্তার দুইপাশের এ্যালাইগমেন্ট ঠিক রাখতে হবে। এই এ্যালাইগমেন্ট যদি কোথাও পরিবর্তন করতে হয় তখন আমরা কি দেখি? একটি নির্দিষ্টমাপে একটু একটু করে পরিবর্তন করে দেওয়া্ হয়। রাস্তার বাঁক কতটুকু হলে একটা বাস রাস্তা থেকে আছড়ে পড়বে না তা সূত্র থেকে বের করা হয়। যারা পদার্থবিজ্ঞান পড়েছেন তারা ব্যাপারটি জানেন। তখনও রাস্তার এ্যালাইগমেন্ট ঠিক থাকে। কখনোই এলোমেলো মনে হয় না। আবার কোন পাহাড়ি রাস্তা চিন্তা করুন। এঁকেবেঁকে দিগন্তে হারানো রাস্তা, এ্যালাইগমেন্ট ঠিক থাকে না অনেক সময় কিন্তু ঠিকই একটা সৌন্দর্য আছে বলে মনে হয়। তবু তাকে এলোমেলো মনে হয় না। বরং চিত্রশিল্পীরা এইরকম একটা ছবি আঁকার জন্যে মুখিয়ে থাকেন। কবিতার ছন্দ ব্যাপারটাও এরকম।

 

তারপর ধরেন, একটা লোক সকালবেলা জগিং করতে বের হয়েছে। সে যদি একটা নির্দিষ্ট বেগে দৌঁড়াতে থাকে তখন একরকম, আবার মাঝে মাঝে এক মিনিট থেমে যদি জগিং করে সেটাও আরেকরকম। কিংবা সকালবেলা বের হয়েই একটা ভোঁ দৌড় দিল, তারপর কিছুক্ষন হাঁটল, এরপর একটু গতি বাড়িয়ে দিল, বাসায় ফেরার পথে আবারও ভোঁ দৌড় দিল। আমরা যদি একটু লক্ষ্য করি, তবে লোকটির জগিং একটা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলেছে কিন্তু তা ব্যবহার হয়েছে স্বাধীনভাবে, তার ইচ্ছার উপর। হ্যাঁ, কারো কারো চোখে এই দৌড়টাকে সুশৃঙ্গল নাও মনে হতে পারে। এটাই আমাদের ছন্দ।

 

আবার একটু শিশু নতুন হাঁটতে শিখেছে। একটু পর পর ধপাস দিয়ে পড়ে। সেখানেও একটা সৌন্দর্য আছে। কবিতার ছন্দ এরকমও বটে।

 

আমি ছন্দ জিনিসটাকে এমনভাবে বুঝাতে চেয়েছি যে, সনাতন ছন্দ এবং আধুনিক ছন্দ দুইই চোখে পড়ে। শেষে বই থেকে একটা উদ্ধৃতি দিয়েই শেষ করি।

 

ড। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “বাক্যস্থিত পদগুলোকে যেভাবে সাজাইলে বাক্যটি শ্রুতিমধুর হয় ও তাহার মধ্যে ভাবগত ও ধ্বনিগত সুষমা উপলব্ধি হয়, পদ সাজাইবার সেই পদ্ধতিটিই হচ্ছে ছন্দ”

 

তিন প্রধান ছন্দ

 

সাধারনত ছন্দকে যে কভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে সেগুলোকে আমি সনাতনী ছন্দ বলব। এভাবে ছন্দ তিন প্রকার।

 

১। অক্ষরবৃত্ত

২। মাত্রাবৃত্ত

৩। স্বরবৃত্ত

 

অনেক ছন্দকার বিভিন্ন নামে এই ছন্দগুলোর নাম দিয়েছেন। প্রবোধচন্দ্র সেনের নামকরন দেওয়া যেতে পারে।

 

১। অক্ষরবৃত্ত - মিশ্রবৃত্ত

২। মাত্রাবৃত্ত – কলাবৃত্ত

৩। স্বরবৃত্ত – দলবৃত্ত

 

বাকি যারা এই তিনটি ছন্দের নামকরন করেছেন তা আমাদের কাছে খুব প্রচলিত না হওয়ায় তা উল্লেখ করার প্রয়োজনবোধ করছি না।

 

এই তিন ছন্দ জানার আগে কিছু বিষয় জেনে নেই।

 

মাত্রাঃ আমরা যা দিয়ে ছন্দকে পরিমাপ করি বা বুঝতে পারি এটা কোন ছন্দ তাই মাত্রা।

পর্বঃ একটি কবিতা পাঠে যে সময় কিছু বিরতি পড়ে তাই পর্ব।

সিলাবেলঃ একে সিলাবেলই বলা ভাল। বাংলা নিয়ে অনেক সমস্যা। এটা দুধরনের ওপেন এবং ক্লোজড সিলেবেল। এখানে একটু উদাহরন দেয়া জরুরী মনে করছি। তাহলে আমাদের পরে সুবিধে হবে। একটা শব্দ নেয়া যাক। যেমন, মধ্যে সিলেবল করে ভাংগলে হয় মধ্+ ধে। প্রথমটি ক্লোজড সিলেবল আর দ্বিতীয়টি ওপেন।

চরণঃ এক বা একধিক পর্ব নিয়ে একটি চরণ হয়।

 

অক্ষরবৃত্ত

 

১। লেখার সময় যে যেভাবে মাত্রাগুলো আসে

 

৪+২=৬

৪+৪+২=১০

৪+৪+৪+২=১৪

৪+৪+৪+৪+২=১৮

 

আরো হতে পারে

 

৪+৪+৪+৪+৪+২=২২

৪+৪+৪+৪+৪+৪+২=২৬

৪+৪+৪+৪+৪+৪+৪+২=৩০

এখানে প্রত্যেকটি একটি মাত্রা আর যেভাবে ভাগ করা হয়েছে সেগুলো এক একটি পর্ব

 

২। এই ছন্দ চিনব বর্ণ সংখ্যা গুনে। অর্থাৎ একটি বর্ণ একটি মাত্রা হিসেবে ধরব।

৩। যুক্তাক্ষরগুলোকে একটি বর্ণ হিসেবে ধরব এবং একটি মাত্রা হিসেবে গণনা করব।

৪। অক্ষরবৃত্ত বর্ণের সংকোচন মেনে নেয়।

৫। ৪/৪/৪/২ কে ৮/৬ হিসেবেও গণনা করা যায়। এভাবে অন্যগুলোও গণনা করা যাবে।

 

কবিতা নিয়ে অ্যানালাইসিস করার আগে আমরা শব্দ নিয়ে আলোচনা করি। উপরের নীতি গুলো শব্দের সাথে মিলিয়ে নিন।

 

আলোঃ দুমাত্রা

অক্ষরঃ তিন মাত্রা (যুক্তাক্ষরটি একমাত্রা হয়েছে)

খাইয়াঃ তিন মাত্রা (আবার চলিত খেয়ে হবে দুমাত্রা)

দূর্দান্তঃ তিন মাত্রা (উচ্চারন দূর+দা+ন্ত হলেও এটি অক্ষরবূত্তে তিন মাত্রায় হবে)

দুঃসাধ্যঃ তিন মাত্রা

সিন্ধান্তঃ তিন মাত্রা (দুটি যুক্তাক্ষর এসেছে তবে তা তিন মাত্রাই হবে)

ফাগুনেরঃ চার মাত্রা (ফা+গু+নের এতে নের সংকুচিত করে ফেললে তিন মাত্রা)

বসুন্ধরাঃ চার মাত্রা

উৎপীড়নঃ চার মাত্রা

তারপরঃ চার মাত্রা (তার্পর ধরলে তিন মাত্রা)

হাতরাতেঃ চার মাত্রা (হাত্রাতে ধরলে তিন মাত্রা)

বুলবুলিঃ চার মাত্রা (বুল্ সংকোচিত করে তিন মাত্রা)

হা্তিরপুলঃ পাঁচ মাত্রা (হাতির্পুল ধরলে চার মাত্রা)

ভাল লেগেছেঃ পাঁচ মাত্রা (ভাল্লাগেছে ধরলে চার মাত্রা)

 

অনেক সময় পর্ব ভাংগতে গিয়ে শব্দের মাঝে ভেঙ্গে যায়। যেমন

 

“আমাদের দেয়ালে লালচে দুটি ছোঁয়া”

(লাইনের অর্থ কি সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়)

 

এটাকে ভাংলে কি হবে?

 

“আমাদের/ দেয়ালে লা/লচে দুটি/ ছোঁয়া”

 

এরকম বেজায়গায় ভাংগলে অনেক সময় শ্রুতিমধুর হয় না।

 

তাই অক্ষরবৃত্ত সাজাতে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে গিয়েছেন “বিজোড়ে বিজোড় গাঁথ আর জোড়ে গাঁথ জোড়”

 

 

মাত্রাবৃত্ত

 

১। অনেক ক্ষেত্রেই মাত্রাবৃত্ত কে অক্ষরবৃত্তের বিপরীত ধরা হয়।

২। অক্ষরবৃত্ত আমরা চিনেছি বর্ণ গুনে কিন্তু মাত্রাবৃত্তে আমরা ধ্বনির উচ্চারন দিয়ে মাত্রা নির্ধারন করব।

৩। এখানে অবশ্যি যুক্তাক্ষরকে দুমাত্রা ধরতে হবে।

৪। অক্ষরবৃত্ত যেমন বর্ণের সংকোচন মেনে নেয় তেমনি মাত্রাবৃত্ত ধ্বনির বিভাজন মেনে এগোয়।

৫। কোন শব্দের মাঝে বা শেষে থাকাও সত্ত্বেও যদি পূর্ববর্তী বর্ণটিতে হসন্ত থাকে তবে যুক্তাক্ষরটি এক মাত্রার হবে।

৬। মাত্রাবৃত্তে পর্বগুলো ৪,৫,৬,৭ এমনকি কখনো কখনো ৮ মাত্রার হতে পারে।

 

আবারো কিছু শব্দ নেয়া যাক। প্রথমে অক্ষরবৃত্তে উদাহরন দেওয়া কিছু শব্দ নেওয়া যাক নতুন শব্দের পাশাপাশি।

 

অক্ষরঃ অক্ষরবৃত্তে তিন মাত্রা কিন্তু মাত্রাবৃত্তে চার মাত্রা।

দূর্দান্তঃ অক্ষরবৃত্তে তিন মাত্রা কিন্তু মাত্রাবৃত্তে চার মাত্রা।

সিন্ধান্তঃ অক্ষরবৃত্তে তিন মাত্রা কিন্তু মাত্রাবৃত্তে পাঁচ মাত্রা।

সান্ত্বনাঃ চার মাত্রা। (সা+ন+ত্ব+না)

ব্যাঘ্রঃ তিন মাত্রা। (ব্যা+ঘ+রো)

মৈত্রীঃ তিন মাত্রা(ম+ই+ত+রী হিসেবে চার মাত্রা হওয়ার কথা, প্রথমে যুক্তস্বরের আধিক্য থাকায় মই+ত+রী হয়ে তিন মাত্রা।

 

স্বরবৃত্ত

 

১। স্বরবৃত্ত ছন্দের মাত্রা ধরব সিলেবল অনুযায়ী। প্রত্যেক সিলেবল একটি মাত্রার যোগ্যতা পাবে।

২। সিলেবল অনুযায়ী মাত্রা হয় কম।

 

উপরের উদাহরনের শব্দগুলো থেকে শব্দ নেয়া যাক।

 

অক্ষরঃ অক্ষরবৃত্তে তিন মাত্রা, মাত্রাবৃত্তে চার মাত্রা এবং স্বরবৃত্তে দুই মাত্রা (অক্+খর)।

ছন্দঃ অক্ষরবৃত্তে দুই মাত্রা, মাত্রাবৃত্তে তিন মাত্রা এবং স্বরবৃত্তে দুই মাত্রা (ছন্+দ)

তিন চারঃ অক্ষরবৃত্তে চার মাত্রা, মাত্রাবৃত্তে চার মাত্রা এবং স্বরবৃত্তে দুই মাত্রা। তিনটি ক্লোজড সিলেবল।

কর্পূরঃ অক্ষরবৃত্তে তিন মাত্রা, মাত্রাবৃত্তে তিন মাত্রা এবং স্বরবৃত্তে দুই মাত্রা। দুটি ক্লোজড সিলেবল।

 

এবার আরো কিছু ছন্দ নিয়ে আলোচনা করা যাক। অবশ্য অনেকে এই ছন্দ গুলোকে অক্ষরবৃত্তের অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু আসলে এসব ছন্দ অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত বা স্বরবৃত্ত তিন ছন্দেই বাঁধা সম্ভব।

 

১। পয়ার

২। মহাপয়ার

৩। প্রবাহমান পয়ার ও মহাপয়ার

৪। অমিত্রাক্ষর ছন্দ

৫। দীর্ঘ ত্রিপদী

৬। দীর্ঘ চৌপদী

৭। দিগক্ষরা

৮। লঘু ত্রিপদী

৯। লঘু চৌপদী

১০। একাবলী

 

পয়ার

দুটি চরণের মাধ্যমে একটি পয়ার তৈরি হয়। আর প্রতিটি চরণে দুটি পর্ব থাকে। প্রথম পর্বে মাত্রা সংখ্যা থাকে আট এবং দ্বিতীয় পর্বের মাত্রা সংখ্যা হয় ছয় অর্থাৎ ৮+৬ হবে। অক্ষরবৃত্তে ৪+৪+৪+২ ছন্দকেও ৮+৬ হিসেবে বাঁধা যায়। কিন্তু চরণের জন্যে সেই ছন্দকে পয়ার থেকে আলাদা করে। পয়ারে চরণদুটি পরস্পর মিত্রাক্ষর হবে অর্থাৎ চরণের শেষে অন্ত্যানুপ্রাস শব্দালংকার থাকবে। প্রতি চরণের শেষে ভাবের আংশিক বা সামগ্রিক পরিসমাপ্তি ঘটে।

 

মহাপয়ার

মহাপয়ারেও দুটি চরণ এবং প্রতিটি চরণে দুটি পর্ব থাকে। প্রথম পর্বে মাত্রা সংখ্যা থাকে আট এবং দ্বিতীয় পর্বের মাত্রা সংখ্যা হয় দশ হবে অর্থাৎ ৮+১০ হবে। অক্ষরবৃত্তে ৪+৪+৪+৪+২ ছন্দকেও ৮+১০ হিসেবে বাঁধা যায়। কিন্তু চরণের জন্যে সেই ছন্দকে মহাপয়ার থেকে আলাদা করে। মহাপয়ারেও চরণদুটি পরস্পর মিত্রাক্ষর হবে অর্থাৎ চরণের শেষে অন্ত্যানুপ্রাস শব্দালংকার থাকবে। এখানেও প্রতি চরণের শেষে ভাবের আংশিক বা সামগ্রিক পরিসমাপ্তি ঘটে।

 

প্রবাহমান পয়ার ও মহাপয়ার

যে পয়ার বা মহাপয়ারে প্রতি চরণের শেষে ভাবের আংশিক বা সামগ্রিক পরিসমাপ্তি হওয়ার অনিবার্য নয়, ভাব প্রয়োজন মতো চরণ থেকে চরাণান্তরে প্রবাহমান হতে পারে তাকে প্রবাহমান পয়ার ও মহাপয়ার বলে। এদের কেউ কেউ সমিল অমিত্রাক্ষরও বলে থাকেন।

 

অমিত্রাক্ষর ছন্দ

যে পয়ারে অন্ত্যানুপ্রাস অলংকার থাকে না কিন্তু পয়ারের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য বজায় রাখে তাকে অমিত্রাক্ষর ছন্দ বলে।

 

দীর্ঘ ত্রিপদী

দীর্ঘ ত্রিপদীতে দুটি পরস্পর মিত্রাক্ষর চরণ, প্রতি চরণে তিনটি করে পর্ব থাকবে এবং প্রথম দুই পর্বেই শুধু অন্ত্যানুপ্রাস থাকে। এর মাত্রা ৮+৮+১০ হবে। এটার একটা উদাহরণ দেওয়া প্রয়োজনবোধ করছি। উদাহরণটি আমি দেওয়ার চেষ্টা করলাম।

 

ভালবেসেই তো হয়েছি/ যেন বিষ পান করেছি

৮+৮

হৃদয়ে ব্যাথা সান্ধ্য বিকেলে;

১০

এই যেন বর্তমান/ সকালটা থাকে ম্লান

৮+৮

এখনো আমি বেশ সেকেলে।

১০

 

কবিতাটা উচ্চমানের হয়নি, তবে বুঝা যাচ্ছে মনে হয়। দীর্ঘ ত্রিপদীকে আমি অক্ষরবৃত্তে বাঁধার চেষ্টা করেছি।

 

দীর্ঘ চৌপদী

দীর্ঘ ত্রিপদির সাথে এর পার্থক্য হচ্ছে এখানে টোটাল চারটি পর্ব থাকবে এবং প্রথম চরণে তিনটি পর্ব থাকবে। অর্থাৎ এটি ৮+৮+৮+৬ ছন্দে বাঁধতে হবে।

 

দীগক্ষরা

এই ছন্দে প্রতি চরণে দুপর্ব এবং প্রতি পর্বে দশ মাত্রা থাকে অর্থাৎ ১০+১০।

 

লঘু ত্রিপদী

এখানে দুটি পরস্পর মিত্রাক্ষর চরণে তিনটি করে পর্ব থাকে। মাত্রা বাঁধতে হবে ৬+৬+৮ হিসেবে।

 

লঘু চৌপদী

এখানে দুটি পরস্পর মিত্রাক্ষর চরণে চারটি করে পর্ব থাকে। মাত্রা বাঁধতে হবে ৬+৬+৬+৫ হিসেবে।

 

একাবলী

এখানে প্রতি চরণে এগারো মাত্রা করে থাকে এবং প্রতি পর্বে মাত্রা ৬+৫ হিসেবে বাঁধতে হবে।

 

এটাই সারমর্ম যে, অক্ষরবৃত্ত আর মাত্রাবৃত্ত মূলত যুক্তাক্ষর নির্ভর ছন্দ আর স্বরবৃত্ত হচ্ছে সিলেবল নির্ভর ছন্দ। এখন বিভিন্ন কবির কবিতা নিয়ে আলোচনা করা যাক। হাতের কাছে বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতার বইটা পেলাম। সেটারই কিছু কবিতা নেওয়া যাক।

 

“বর্ষার দিন” কবিতার প্রথম চার লাইন,

 

সকাল থেকেই/ বৃষ্টির পালা/ শুরু,

৬/৬/২

আকাশ-হারানো/ আঁধার-জড়ানো/ দিন।

৬/৬/২

আজকেই, যেন/ শ্রাবণ করেছে/ পণ,

৬/৬/২

শোধ ক’রে দেবে/ বৈশাখী সব/ ঋন।

৬/৬/২

 

এখানে দেখা যাচ্ছে ছন্দ ৬+৬+২ চালে গঠিত হয়েছে। সুতরাং এটি মাত্রাবৃত্ত। কারন এরকম পর্বে ৬ মাত্রার চাল মাত্রাবৃত্তেই হয়ে থাকে।

 

“কাউস্টের গান” কবিতার প্রথম চার লাইন,

 

প্রজ্বলিত,/ লুপ্ত আচ/ম্বিতে,

৪+৪+২

অঙ্গ তার/ বৈ্দ্যুতিক,/ চতুর :

৪+৪+২

ব্যগ্র মুঠি/ শূন্য ছেনে/ ফতুর,

৪+৪+২

কিংবা ঠকে/ ছিন্ন কাঁচু/লিতে।

৪+৪+২

 

গত আলোচনা থেকে এমনিতেই বুঝতে পারছেন যে এটি অক্ষরবৃত্তে লেখা।

 

“ম্যাল্ – এ” কবিতার অংশবিশেষ

 

‘আপনারা কবে? আমরা এসেছি সাতাশে।

(আপ+না+রা ক+বে/ আম+রা এ+সে+ছি/ সা+তা+শে)

৫+৫+৩

ওকভিলে আছি। আসবেন একদিন।’-

(ওক+ভি+লে আ+ছি আস/+বে+ন এক+দি+ন)

৬+৫

শাড়ির বাঁধনে শোভে শরীরের ইশারা,

(শা+ড়ির বাঁ+ধ+নে/ শো+ভে শ+রী+রের/ ই+শা+রা

৫+৫+৩

ঠোঁটের গালের রঙের চমকে কী সাড়া!

(ঠোঁ+টের গা+লের র+ঙের/ চম+কে কী সা+ড়া)

৬+৫

 

এখানে প্রথম ও তৃ্তীয় চরণে তিন মাত্রার ভাঙ্গা পর্ব আছে। কিন্তু বুঝা যাচ্ছে ছন্দটি স্বরবৃত্ত।

 

আমি চেষ্টা করলাম বের করার। এবার আপনারা মিলিয়ে নিন তো।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের একটি কবিতার অংশবিশেষ

 

সবচেয়ে যে ছোট্ট পীড়ি খানি

সেই খানি আর কেউ রাখে না পেতে;

ছোট্ট থালায় হয়নাকো ভাত বাড়া,

জল ভরে না ছোট্ট গেলা সেতে।

 

এটিও স্বরবৃত্ত। ভাংগলে ৪+৪+২ চালে আসে। প্রশ্ন হচ্ছে এটা তো অক্ষরবৃত্তের চাল। কিন্তু সেই ছন্দে ভাংগলে এই চাল মিলানো যায় না।

 

আধুনিক কবিতার ছন্দ

 

আধুনিক কবিতার ছন্দকে দুইভাগে ভাগ করব।

 

১। গদ্যছন্দ ২। মিশ্রছন্দ

 

 

গদ্যছন্দ

 

১। অনেকে গদ্যছন্দকেই আধুনিক কবিতার একমাত্র হাতিয়ার বলে মনে করেন। কিন্তু তা ঠিক নয়। আধুনিক কবিতা মানেই গদ্যকবিতা নয়।

২। বিষ্ণু দে গদ্যকবিতাকে নিয়ে বলেছেন, “আবেগই শুধু এ ছন্দের বেগ নির্দিষ্ট করে এবং দুই ব্যক্তির আবেগের মাত্রা এক চালে নাও চলতে পারে”

৩। অন্ত্যানুপ্রাস ছাড়া যেমন গদ্যছন্দে গদ্যকবিতা লেখা যায় ঠিক তেমনি তা দিয়েও লেখা যায়। আবার টানা গদ্যেও গদ্যকবিতা লেখা হয়। আবার একটি কবিতায় কিছু ছন্দবদ্ধ হয়ে লিখে তারপর কবিতার মত ছোট বড় পংক্তি জুড়ে দেওয়া যায়।

৪। একমাত্র গদ্যছন্দেই মানুষের বাকরীতিতে লেখা সম্ভব। ফলে গদ্যকবিতায় উঠে এসেছে প্রতিদিনের ব্যবহার্য ভাষা।

৫।কাব্যিক গদ্য কখনো কবিতা হয়ে উঠে না কিন্তু গদ্যকবিতা অবশ্যই কবিতা হয়ে উঠবে।

৬। গদ্যকবিতায় ছন্দের মাপজোখ না থাকায় তা অনেকখানি গদ্যগুণ সঞ্চার করে। ফলে এখানেই একমাত্র গদ্য ও কবিতার মাঝে মিলনবন্ধণ করা যায়।

৭। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এই যে, আমাদের মহৎ পাঁচ আধুনিকেরা খুব কমই গদ্যছন্দে লিখেছেন। যদি গদ্যকবিতা মাত্রই আধুনিক কবিতা হত তবে রবীন্দ্রনাথকেই এক্ষেত্রে আধুনিক বলতে হবে। আবু সায়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত “আধুনিক বাঙলা কবিত” সংকলনে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা তুলে দেওয়া যাক।

 

“এখানে নামল সন্ধ্যা। সূর্য্যদেব, কোন দেশে কোন সমুদ্রপারে

তোমার প্রভাত হ’ল?

অন্ধকার এখানে কেঁপে উঠচে রজনীগন্ধা, বাসর-ঘরের

দ্বারের কাছে অবগুন্ঠিতা নববধূর মতো; কোনখানে ফুটল

ভোরবেলাকার কনকচাঁপা?”

(সন্ধ্যা ও প্রভাত)

 

মিশ্রছন্দ

 

১। প্রথমেই প্রশ্ন আসে গদ্যছন্দই কি মিশ্রছন্দ? ফরাসি Vers Libre মানে অনেকেই মুক্তছন্দ মনে করেন এবং যেহেতু গদ্যছন্দতে ছন্দের মাপজোখ নেই সেহেতু অনেকে গদ্যছন্দকে মুক্তছন্দ বা Vers Libre মনে করেন। কিন্তু এখানে অর্থের বেড়াজালে পড়ে যায়। কারন ফরাসি Vers Libre যে অর্থে ব্যবহৃত হয় তা মুক্তছন্ধ বললেও আসলে মিশ্রছন্দ বললে প্রকৃ্ত অর্থ ফুটে উঠে। এটা ঠিক Vers Libre কখনোই ছন্দের প্রধান সূত্রগুলোকে মেনে চলে না তবু এর মধ্যে একটি ছন্দ ঠিকই থেকে যায়। এই ছন্দ অনেকটাই কবির মর্জির উপর নির্ভর করে।

২। অর্থাৎ মিশ্রছন্দ আসলে একাধিক ছন্দের মিলিত রূপ।

৩। অবাক করা ব্যাপার এই, ত্রিশের আধুনিকেরা গদ্যছন্দের চেয়ে এই মিশ্রছন্দেই বেশিরভাগ কবিতা লিখেছেন।

৪। প্রকৃ্ত অর্থে রবীন্দ্রনাথ কখনোই মিশ্রছন্দে কবিতা লিখেননি। উনি গদ্যছন্দে কবিতা লিখেছেন। এই অর্থে তাকে আধুনিক বলা যাবে না।

৫। আবার মিশ্রছন্দের কথা আসলে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কথা অবশ্যই স্মরণ করতে হবে। তিনিই প্রথম প্রচলিত ছন্দের বাইরে এসে কাব্যরচনা শুরু করেন। বাঙলা কবিতায় অমিত্রাক্ষর ছন্দ আর মুক্তক তারই সৃষ্টি। এদিক দিয়ে বলতে হয়, মাইকেলেই আধুনিকতার শুরু।

 

জীবনানন্দ দাশের “ঝরাপালক” কাব্যগ্রন্থে “শরীরের ঘ্রাণ” কবিতাটি উদাহরন হিসেবে নেওয়া যাক।

 

আহলাদে অবসাদে/ভরে আসে আমার শরীর

৮+১০

চারিদিকে ছায়া-রোদ-/খুদ-কুড়ো কার্তকের ভিড়ঃ

৮+১০

চোখের সকর ক্ষুধা/মিটে যায় এইখানে,/এখানে হতেছে স্নিগ্ধ কান

৮+৮+১০

পাড়াগাঁর গায় আজ/লেগে আছে রূপশালী/ধানভানা ধূপসীর।

৮+৮+১০

 

আমরা জানি, মহাপয়ার ৮+১০ ছন্দে লেখা হয়। সেদিক দিয়ে প্রথম দু’লাইন অবশ্যি অক্ষরবৃত্তের পয়ার। কিন্তু পরের দুলাইন তিনি প্রচলিত নিয়মের বাইরে এসে আরো একটি বাড়তি ৮ মাত্রা পর্ব দিয়েছেন।

 

হুমায়ুন আজাদ সম্পাদিত “আধুনিক বাঙলা কবিতা” থেকে বিষ্ণুদের “অন্বিষ্ট” কবিতাটি নেওয়া যাক। কবিতার প্রথমদিকের কিছু লাইন (৯-১৫) উদ্ধৃতি করছি,

 

“দিনান্তে আমার সঙ্গী সূর্যাস্ত আকাশ

৮+৬

কিংবা ভোরে আরম্ভের মুক্তির আভাস এই কর্মময় বেগার্ত সুনীলে

৮+৮+৮+২

কাকে-চিলে-শালিকে-টিয়ায়

৮+২

ট্রামে-বাসে পায়ে-পায়ে গ্রামান্ত-শহরে-কলে-মিলে

৮+৮+২

ঘনিষ্ঠ প্রহরে এই আনন্দ জঙ্গম

৮+৬

মেঘে-মেঘে গতির স্থিতির মিলনে সন্তাপে

৮+৬

বাষ্পে-বাষ্পে ছাপে রঙে রঙে আমাদেরও চিদম্বরম”

৮+৮+২

 

বোঝা যাচ্ছে কবিতার এই অংশুটুকু অক্ষরবৃত্ত।

 

কবিতাটির আরেকটি অংশ (৩১-৩৬) নেওয়া যাক।

 

“আমারও অন্বিষ্ট তাই

৪+৪+২

অণুর সংহতি

আসুক জীবনের রঙে মানবিক আমি চাই আমরা সবাই

৭+৬+৪+৬

সূর্যাস্তে ও সূর্যোদয়ে ইন্দ্রধনু ভেঙে দিই জীবনে ছড়াই

৬+৫+৭+৭

হে সুন্দর বাঁচার বিস্ময়ে বিষাদে সম্ভ্রমে জীবনে আকাশ

৫+৭+৭+৬

অবকাশ বাঁচার আনন্দ চাই”

৭+৬

 

আমার যেভাবে ভাংতে সুবিধে হল সেভাবে ভেংগে দিলাম। বিশেষঙ্গরা আপত্তি জানাতে পারে তবে বুঝা যাচ্ছে এটা মাত্রাবৃত্ত।

 

এবার আরো কিছু লাইন (৭৮-৮২) নেওয়া যাক।

“আমার হৃদয় এক আকাশের একটি হৃদয়

৪+৪+৪

অনেকের এক পরিচয়

৪+৪

ধমনীতে শালের আবেগ লালমাটি রক্তে বয়

৪+৪+৬

শিরস্ত্রাণ আকাশের হাওয়া

৬+২

সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় আমার দু-চোখে”

৭+৫

 

এখানেও আমার যেভাবে ভাংতে ইচ্ছা হল ভেংগে দেখালাম। হয়ত আইডিয়ালভাবে ভাংতে পারলাম না। তবু ধরা যায় এটি স্বরবৃত্ত।

 

এখানে দেখা যাচ্ছে, এক কবিতায় তিন ধরনের ছন্দই ব্যবহৃত হয়েছে।

৩ Likes ২৫ Comments ০ Share ২৩০৪ Views

Comments (25)

  • - ঘাস ফুল

    প্রথমেই অভিনন্দন জানাচ্ছি গল্প লেখার প্রয়াসের জন্য। ভুলত্রুটি আমরা সবাই করি। সুতরাং ওসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে ভুলত্রুটি থাকলে সেগুলো শুধরে নেয়ার চেষ্টা করবেন। 

    গল্পটার শুরুটা অনেকটা প্রবন্ধ টাইপের লাগলো। এই লাগাটা আপনার ছয় লাইন কবিতার পরের প্যারা পর্যন্ত চলছিল। আমার মনে হয় আপনার গল্পই শুরু হয়েছে এর পর থেকে। গল্পের সংলাপগুলোতে ভালোবাসার অভাব বোধ করলাম। সংলাপে আরও একটু দক্ষতা দেখানো উচিৎ ছিল। কারণ আকাশ রুপাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েছিল। রূপাও অনেকটা তাই ভেবেছিল। কিন্তু তাদের কথাগুলো খুব সাদামাটা হয়ে গেছে। তানিমের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার কারণ রূপার মা আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। রূপা যদি তাদের পছন্দের ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করে, সেক্ষেত্রে রূপার মা মরার হুমকি দিয়ে রেখেছে। এই অবস্থায় রূপা আবার কীভাবে আকাশের সাথে প্রেম করতে চাচ্ছে বুঝতে পাড়লাম না। 

    রুপাঃ সব কিছু জানার পর যদি আমাকে আপনার ভাল লাগে তাহলে আপনি প্রকাশ করতে পারেন। আর এসব কথা সম্পর্কের পর একদিন শুনতেই পারবেন। আপনার মনে প্রশ্নজাগবে তখন এসব কেন আমি লুকিয়েছি ? তখন হয়তবা হিতে বিপরীত হতে পারতো। তাই বললাম। বাকিটা আপনার উপর। 

    রূপার এই সংলাপ থেকেই বুঝা যায় রূপাও আকাশকে পছন্দ করে। তাই আকাশের প্রস্তাব পাওয়ার আগেই তাকে পরিষ্কার করে দেয়ার জন্য রূপা এই কথাগুলো বলেছে। রূপা যদি মায়ের অবাধ্য হয়ে আকাশকেই পছন্দ করতে পারে, তবে কেন তানিমের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলো? হয়তো আর সমাধান আগামী পর্বে পাওয়া যেতে পারে। তাই আগামী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম আমিনুল। 

    গল্পের শেষে আপনার গল্প লেখার প্রয়াস নিয়ে কথাগুলো ব্র্যাকেট বন্দী করে দেয়া দরকার ছিল। 

    • - রুদ্র আমিন

      সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ভাইজান। লিখতে পারি না একটু চেষ্টা করে দেখলাম। আপনার উপদেশ মনে থাকবে।

    - মোঃ খালিদ উমর

    ঘাসফুলের সাথে একমত। ধন্যবাদ।

    • - রুদ্র আমিন

      ধন্যবাদ ভাইজান। দোয়া করবেন।

    - মাসুম বাদল

    এই প্রথম আপনার গল্প পোস্ট পেলাম...

    • - রুদ্র আমিন

      চেষ্টা করে দেখলাম বাদল ভাই। তা দেখি নৌকা পুরোটাই ডুবে গেছে।

    Load more comments...