নীল....
স্বপ্ন বিভ্রমের পর চরম হতাশায় ভুগছি আজ। দীর্ঘ চার মাসের সংসার জীবনের ইতিবৃত্ত ঘটালে গত ৮জানুয়ারী। আমার আশার বাগানে ফুটন্ত ফুলগুলো অকালে ঝরে পড়লো তোর কান্ডজ্ঞানে। তুইও চলে গেলি,ফুলগুলো ঝরে পড়লো সে রাতেই। যে বাগানে ফুটেছিল নানান রঙের সুবাস ঝরা ফুল। ঘ্রাণে ঘ্রাণে ভরে উঠতো পুরো বাড়ির আঙিনা। তুই যে ছিলি আমার বাগানের সবচে প্রিয় মানবী ফুল। তোর বিচরণে ফুলেরা সরব হয়ে উঠতো। রঙিন প্রজাপতিরা ডানা মেলে আনন্দে এদিক-সেদিক উড়াউড়ি করতো। মুহুমুহু করতো মধু-পোকারা। সন্ধ্যার আঁধারে জোনাকিদের মেলা বসতো। ঝলমলের সে রঙিন আলোয় স্বপ্নের নীড় রুপে সজ্জিত হত আমাদের বসতঘর। এখন আর এই বাড়ির কোন প্রাণবন্ততা নেই। মৃত্যুপুরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে আজ আমাদের প্রাণবন্তহীন নির্জন বাড়িটা।
পুরো বাড়ি জুড়ে এখন নিরানন্দের বিলাপ। গৃহ আঙিনা জুড়ে ধরা পরে শুধু শুকনো পাতার হলুদ-রাঙা রঙ। তুইহীন শুন্যতা, শুকনো পাতার হাহাকার কান্নায় আমিও মর্মাহত হই। ভুলতে পারি না তোকে এক মুহুর্ত। চোখ বন্ধ করলেই তোকে দেখি। খেতে বসলে তোর ছবি ভেসে উঠে। মনে হয় তুই আমাকে খাওয়াচ্ছিস। থালায় ভরে দিচ্ছিস তোর নিজ হাতের পছন্দকৃত রান্নার সব সুস্বাদু খাবার। তোকেও কাছে টেনে খেতে বলি,নীল তুইও বোস না; কত দিন ধরে যেন তুই-আমি পাশাপাশিএকত্রে বসে খাই না। খাবার নিয়ে রসিকতা করিনা;তোর থালার মাছটা আমি ছিনিয়ে নিতে পারিনা। বোস বোস...আবার স্বপ্ন বিভ্রম। রাতের খাবার একাই খাচ্ছি। খাবার মুখে নিচ্ছি কিন্তু ঢোক গিলতে পারছি না। বুকটা প্রচন্ড ব্যথা হয় তোকে ছাড়া। মনটাও নিস্প্রাণ হয়ে যাচ্ছে ইদানিং। জানিনা এই নিস্প্রাণতার ভবিষ্যত পরিণতি কি?
মনের মঞ্জিলের প্রতিটি জায়গায় তোর বিচরন। সারাক্ষণ মনের ভিতর প্রেম দেবীর আসন নিয়ে বসে থাকিস। রক্ত চলাচলের মতোই অনুভব হতে থাকিস। মনের আয়নায় তোর সমস্ত হাসিঝরা ছবি ভেসে উঠতে দেখি। গভীর রাতে স্বপ্নালোকে তোর অস্তিত্ব খুঁজে পাই। তুই ফিরে আসিস আগের সেই নীল নয়োনা হয়েই। এসে আমাকে কাছে টেনে আদর করিস। গালে মুখে চুমু খাস,আমাকে জড়িয়ে ধরে তোর বুকের পরশ দিস। আমি খুব উষ্ণতা অনুভব করি। যৌবনের উত্তেজনায় তোকে কাছে টেনে নিতে উন্মুত্ত হই। সেই মুহুর্তে তুই অদৃশ্য হয়ে যাস,তখনো তোর হাসিমাখা মুখ স্পষ্ট দেখতে পাই। নীল...নীল..নীল বলে ডাকতে থাকি। পা বাড়াই, কিন্তু বিছানা থেকে ঢপাশ করে পরে যাই মাটির মাঝে। অন্ধকারে স্বপ্ন বিভ্রমের পর আঘাত পাই। তারপরেও সেই আঘাতের যন্ত্রণার ভিতর তোকে কাছে পাওয়ার জন্য আরও ব্যকুল হয়ে উঠি।
বড় কষ্ট হয় রাতের বিছানায় যখন একাকী ঘুমাই। তুই-ই বল, তুই-আমি যেখানে এক বিছানায় ঘুমাতাম। তোর শরীর আমার শরীর মিলে কখনো এক শরীর হয়ে যেত। শরীরের ঘ্রাণে সৃষ্টি হতো পরম রসায়ন। চুম্বুকের মতো টেনে নিতে থাকতো এক শরীর আরেক শরীরকে। আর গভীর রাত পর্যন্ত কবিতা আবৃত্তি চর্চা চলতো। রাত কয়টা বাজতো সেদিকে নজর থাকতো না। কবিতা আবৃত্তির ভিতর তুই-আমি মিশে যেতাম কবিতার নানা চরিত্রে। আমার কাব্যগল্পগুলো তোকে খুব আসক্ত করতো বলতি, তাই ওইগুলোই বেশি বেশি পড়তি লক্ষ্য করতাম। হাসি টেনে বলতি,তোমার কবিতা ছাড়া আর কারও কবিতা আমার ভালো লাগে না। শুনে খুব খুশি হতাম। তোকে নিয়েও কাব্যগল্প লেখার মনস্থ করতাম। সুন্দর সব কাব্যগল্প। যেখানে গল্প থাকবে খুবই চমকপ্রদ। ওই কাব্যগল্পগুলোতে ফুটিয়ে তুলতাম তোর-আমার স্বপ্নজয়ের সব চিত্র। ফুটে উঠতো আমাদের দাম্পত্য জীবনের এক একটি রঙিন স্বপ্নের প্রামাণ্যচিত্র।
আমাদের চমৎকার কিছু স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন পথেই যেন চলতাম আমরা দুজন। স্বপ্ন দেখতাম কিভাবে আমাদের কাংখিত ‘বৃষ্টিবিলাস’ বাড়িটা গড়ে তোলা যায়। যার নকশা,চিত্র,রঙ তুই কল্পনা করতিস। ‘বৃষ্টিবিলাস’-এ কোথায় কি থাকবে। পুকুর ভরা মাছ, সাতার কাটা চোখ জুড়ানো কৃত্রিম-অকৃত্রিম হাঁস, গৃহের ছাদ ও আঙিনা জুড়ে ফুলের বাগান কিভাবে নয়নাভিরাম করে সাজানো হবে। আর সেই ফুল বাগানেসেখানে কোন রঙের প্রজাপতিরা আমন্ত্রিত হয়ে আসবে, তার একটা নকশা তুই চিত্রকরণ করেছিলি। আর বৃষ্টিবিলাস রুম গুলো হবে খুব আকর্ষণীয়।সে রুমগুলোর মধ্যে অন্যতম হবে ‘কাব্যরজনী’নামের রুমটি। ওই রুম জুড়ে থাকবে বিশাল সাহিত্যের সম্ভার। কবিদের কবিতার বসবাস হবো আমাদের এই বৃষ্টিবিলাস। তার দেওয়াল জুড়ে থাকবে প্রিয় কবিদের ছবি। ছবির পিছনে লাগানো থাকতো সাজ রঙিন বাতি। সারাক্ষণ সেই রঙিন আলোয় কবিরা যেন ছবির ভিতর থেকেই কথা বলতে থাকবে পৃথিবীর অবধিকাল। এর সাথে অডিও স্বরে আবৃত্তি হতে থাকবে বিমুগ্ধ সব কবিতা।
দুজনের স্বপ্নের আরেকটা চমক ছিলো আমাদের সন্তান। ছেলে তামিম আহমেদ লিংকন ও মেয়ে তামাম্মুম শোভা ওলিপ্রিয়াকে নিয়ে সাজাতাম কল্পনাতীত ভবিষ্যত। ওদের মানুষ করতে আমাদের থাকতো নিত্যনতুন চিন্তাধারার অক্লান্ত পরিশ্রম। কিভাবে নতুন অথিতির জন্য নতুন পৃথিবী গড়ে তোলা যায়। এ নিয়ে চলতো দুজনের চিন্তা-যুক্তির প্রয়াস। ওরা বড় হওয়ার পথেই শিক্ষা দিতাম,কিভাবে স্বপ্নকে জয় করতে হয়? সে বিষয়ে বেশি দীক্ষা দিতে তুই মা হয়ে। এক সময় ওরা যখন বড় হয়ে যেত,শিক্ষা-দীক্ষায় অর্জন করে দেশ-বিদেশের সেরাদের সেরা হতো। সেদিন আমরা গর্ব করে বলতাম,আমাদের সন্তানরা আজ পৃথিবী ছুঁয়েছে। গর্বের মুকুট মাথায় পরিয়ে দিতাম তোর। কিন্তু সেই স্বপ্নের ‘বৃষ্টিবিলাস’কে চোরাবালিতে রুপ দিয়ে চলে গেলি তুই। হয়তো দূজনের দেখা হবে কিন্তু স্বপ্নের বৃষ্টিবিলাসটা নি:সঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে দু’জনের মাঝখানে একটা কঠিন দেয়াল বাঁধা হয়ে।
১৩ জানুয়ারী/১৩
Comments (2)
besh laglo
অসংখ্য ধন্যবাদ :)