Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

ইফ্ফাত রুপন

৭ বছর আগে

ঘোর

ভাই একটা গল্প শুনবেন?

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে আমার পাশে তাকালাম। বেশ কাঠখোট্টা চেহারার একজন মানুষ আমার পাশে বসে রীতিমত দাঁত বের করে হাসছে। ব্যাপারটা দেখে মনে হচ্ছে ভদ্রলোক আমাকে এভাবে হঠাৎ করে চমকে দিতে পেরে বেশ মজা পাচ্ছেন। আমিও যে এক আধটু অবাক হই নি তা নয়। রাত তিনটার দিকে আমার পাশের সিটে বসা যাত্রী ভদ্রলোক যদি এভাবে হুট করে বলে বসে যে ভাই গল্প শুনবেন তাহলে একটু অবাক হবারই কথা। তবে অবাক হবার থেকে আমি যেই জিনিসটা বেশি এই মুহূর্তে হচ্ছি সেটা হচ্ছে বিরক্ত।

কি ভাই খুব বিরক্ত হচ্ছেন তাই না।

আমি একটু অবাক হলাম এবার। এই লোক কিভাবে বুঝলো আমি বিরক্ত হচ্ছি। এবার যদি তার কথার উত্তর না দেই তাহলে রীতিমত অভদ্রতা করা হয়ে যায়। অগত্তা কোন উপায় না দেখে আমি কথা বলতে শুরু করলাম।

না ভাই বিরক্ত হচ্ছি না।

ভদ্রলোক কিছুটা হেসে উত্তর দিলেন, বুঝতে পারছি ভাই কিছুটা বিরক্ত হচ্ছেন। এভাবে রাত দুপুরে কারোরই গল্প শুনতে চাইবার কথা না। তারপরও বাসের সবাই ঘুমুচ্ছিল কিন্তু আপনি ঘুমুচ্ছিলেন না। তাই ভাবলাম আপনার সাথে কথা বলতে বলতে যদি বাকিটা সময় পার করে দেয়া যায়? ঝিনাইদাহ আসতে তো আর বেশি দেরি নেই। তা ভাই আপনি নামবেন কোথায়?

এইতো পায়রা চত্বরে। আপনি?

আমার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। যেখানে খুশি সেখানে নেমে পরবো।

ভদ্রলোককে কোন একটা কারণে আমার কাছে বেশ ইন্টারেস্টিং বলে মনে হোল। যদিও আমার মনোযোগ ধরার মতো তেমন কোন কাজ তিনি করেন নি কিন্তু তারপরও কেন যেন মনে হোল খারাপ কি? ঝিনাইদাহ পৌঁছুতে আরো কম করে হলেও চার ঘণ্টা লাগবে। বাকি সময়টা নাহয় গল্পগুজব করতে করতে কাটিয়ে দেয়া যাক।

আমি ঝিনাইদাহ যাচ্ছি নিতান্ত নিজের অনিচ্ছাতেই। কোন দিন স্বপ্নেও কল্পনা করি নি যে শুধুমাত্র একটা ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের চাকরির জন্য আমাকে ঝিনাইদাহের মতো অজপাড়াগায়ে গিয়ে উপস্থিত হতে হবে। কিন্তু না গিয়ে কোন উপায় ছিল না। মাত্র কিছুদিন আগে মাস্টার্স শেষ করে বেকারদের খাতায় নাম লিখালাম। জীবনে সব কিছুর অভিজ্ঞতা টুকটাক থাকলেও বেকার হবার কোন অভিজ্ঞতা আমার আগে কখনো ছিল না। বেকার জীবন শুরু করার কিছুদিন পর বুঝতে পারলাম সব কিছুই ঠিক আছে কিন্তু তারপরও কোথাও কি যেন একটা নেই। আগে শুনেছিলাম বেকার হবার পর সব ছেলে মেয়েই নিজেদের পরিবারের কাছ থেকে বেশ একটা চাপের মধ্যে পরতে হয়। কিন্তু আমার বেলায় এসে দেখতে পেলাম উল্টো এই সময়টাতে আমি আমার পরিবারের কাছ থেকে সবচাইতে বেশি মানসিক মনোবলটা পাচ্ছি। কিন্তু কেউ একজন বলে গেছেন মানুষের কপালে সুখ নামক বস্তুটার স্থায়িত্ব বেশিদিন হয় না। আমারও হোল না। কোন একটা কারণে প্রচণ্ড অশান্তি অনুভব করতে লাগলাম আমার নিজের ভেতর। তারপর পর পর চারটি মাস কেটে গেলো। কতো জায়গায় ইন্টার্ভিউ দিলাম কিন্তু কোথাও চাকরি হচ্ছিলো না। হতাশা যখন চরম আকার ধারণ করতে যাচ্ছিলো ঠিক সেই সময়েই একটা প্রাইভেট ফার্ম থেকে ফোন এলো। খুবই কম বেতনের মাইনেতে একটা চাকরি আমার হয়ে গেলো। জয়েন করতে হবে আগামী তিন দিনের মধ্যে। পোস্টিং ঝিনাইদাহ।

ভাগ্য ব্যাপারটা আমি খুব কম বিশ্বাস করতাম। বিশ্বাস না করার প্রধান কারণ হোল ভাগ্যের জোড়ে আমার ছাব্বিশ বছর বয়সের জীবনে আজ পর্যন্ত কোন কিছু না হওয়া। তবে কোনদিন খুব খারাপ কিছু আমার জীবনে তেমন একটা হয় নি। কিন্তু একটা স্বনামধন্য সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানের উপর অনার্স মাস্টার্স শেষ করে যখন নামমাত্র বেতনে একটা ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের চাকরির জন্য আমাকে ঝিনাইদাহ যেতে বলা হোল তখন যে কোন কারণেই হোক না কেন ভাগ্যের উপর কিছুদিনের মধ্যেই আমার বেশ আস্থা চলে এলো। আমি বুঝতে পারলাম আমার ভাগ্য আছে, তবে সেটা অন্যান্যদের মতো নয়। আমারটা হচ্ছে মন্দ ভাগ্য।

যাই হোক সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সন্ধ্যা সাতটায় ঝিনাইদাহের উদ্দেশ্যে বাসে উঠলাম। সময়টা জানুয়ারির শুরুর দিকে হওয়াতে প্রচণ্ড শীত পরছে বাহিরে। সেই সাথে গতকাল থেকে শুরু হয়েছে শৈত্যপ্রবাহ। কুয়াশার কারণে রাস্তা ঘাটের কিছুই তেমন দেখা যাচ্ছে না। ড্রাইভার কি করে যে এভাবে এই কুয়াশার মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেটাই আমি বুঝতে পারছিলাম না। যাত্রী কম হবার কারণে আমার পাশের সিটটা প্রথমে খালিই ছিল। কিন্তু ফেরি পার হবার সময় কোথা থেকে যেন এই লোক আমার পাশের সিটে এসে বসলো। একটু পর দেখতে পেলাম আমাদের বাসের পাশে রাখা বাসটি থেকে সব যাত্রীরা আস্তে আস্তে করে সবাই নেমে যাচ্ছে। বাসের সুপারভাইজরকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে বাসটি ফেরিতে উঠার পর কেন যেন স্টার্ট নিচ্ছে না। তাই সেই বাসের সব যাত্রীরা আমাদের বাসে উঠে আসছে।

কি ভাই কি চিন্তা করছেন?

ভদ্রলোকের কথায় আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম কথা বলার জন্য। মানুষের জীবনে কিছু আফসোস থাকতে হয়। তা না হলে জীবন পরিপূর্ণতা পায় না।

না ভাই আসলে তেমন কিছু না।

ভদ্রলোক হেসে জবাব দিলেন, ভাই বুঝতে পারছি আপনি বেশ বিরক্ত হচ্ছেন। আপনার অসুবিধা হলে থাক। আপনি বোধয় ঘুমুতে চেষ্টা করছিলেন?

না ভাই। জার্নিতে এমনিতেও আমার ঘুম আসে না। আপনি বলুন, কি যেন বলতে চাচ্ছিলেন?

গল্প বলতে চাচ্ছিলাম ভাই। শুনতে চান?

আমি কিছুটা আগ্রহ নিয়েই বললাম, ঠিকাছে বলুন।

শুনুন তাহলে, ভদ্রলোক নিজের ভাষাতে বলতে শুরু করলেন।

আমি জানি আপনি বেশ অবাক হচ্ছেন এই ভেবে যে বলা নেই কওয়া নেই আপনাকে আমি চিনি পর্যন্ত না তারপরও হুট করে আপনাকে এমন একটা প্রস্তাব দিয়ে বসলাম। আসলে আমি মানুষটা এমনই। ভূমিকা জিনিসটা আমার খুব একটা পছন্দের না। আপনাকে আমি আমার সম্পর্কে সব কিছুই বলবো। তবে গল্পের ফাঁকে ফাঁকে। আশা করি গল্প শেষে আপনার আমার ব্যাপারে কোন প্রশ্ন থাকবে না।

আমি বড় হয়েছি নাটোর শহরে। আপনাকে আমার ছোটবেলার কথা বলে আসলে তেমন একটা লাভ নেই কারণ ছোটবেলার তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিই আমার নেই। বাবা একটা প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন আর মা ছিলেন গৃহিণী। তিন ভাই আর এক বোন মিলে মোট ছয় জনের পরিবার আমাদের। আমি আমার ভাই বোনদের মাঝে সবার ছোট। বুঝতেই পারছেন ছোটবেলা থেকেই অনেক আদর যত্নে বড় হয়েছি। আমি মোটামুটি একটা সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। ক্লাস ফাইভে পড়া অবস্থায় দেখতে পেলাম আমার বড় ভাইয়ের বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি হয়ে গেলো। তারপর একে একে আমার সব ভাই বোনই কোন না কোন জায়গায় ভালো ভালো পদে চাকরি পেতে শুরু করলো। বলা বাহল্য তারা সবাই বেশ মেধাবী ছিল। পরিবারের সবাই ভাবতো বড় হয়ে আমিও হয়তো ভালো কোন জায়গায় পৌঁছুতে পারবো। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমি একটু অন্যরকম ছিলাম। এইসব গদবাধা পড়াশুনা আমার কেন যেন পছন্দ ছিল না। আমার মেঝো ভাইয়া শখের বশে মাঝখানে ছবি আঁকা শুরু করেছিলন। পরে অবশ্য একটা পর্যায়ে তার এই শখ আর বেশিদিন টিকে নি। ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় একদিন কি মনে করে যেন ভাইয়ার রুম থেকে তার ব্যবহৃত ছবি আঁকার সরঞ্জামগুলো বের করে আনলাম। ভাইয়া বেশ কিছু ছবিও এঁকেছিল এক সময়। সেই সব ছবি দেখতে দেখতে একটা পর্যায়ে কি মনে করে নিজেও ছবি আঁকা শুরু করলাম। এক সপ্তাহ এভাবে ছবি আঁকতে আঁকতে বুঝতে পারলাম আমি যদি কোন কিছুতে খুব বেশি ভালো হয়ে থাকি তাহলে সেটা হচ্ছে ছবি আঁকা। মাত্র এক সপ্তাহে কেমন অবলীলায় আমি ছবি আঁকতে শুরু করলাম। একটা সময় এসে মানুষের মুখের স্কেচ আঁকার ব্যাপারে প্রচণ্ড আকর্ষণ অনুভব করলাম। সময় পেলে সামনে যাকে পেতাম তাকে বসিয়েই স্কেচ আঁকা শুরু করতাম। সবাই আমার ছবি আঁকা দেখে মুগ্ধ হলেও আমার বাবা বিষয়টার প্রতি বেশ বিরোধিতা শুরু করলেন। তার মতে মানুষের মুখের ছবি আঁকা বিশেষ একটা ভালো নয় এসব বলে আমাকে তিনি বুঝাতে শুরু করলেন। কিন্তু আমি কারো কথাই শুনলাম না। দিন রাত এই ছবি আঁকার ব্যাপারে নিজের মধ্যে প্রচণ্ড আকর্ষণ অনুভব করতাম। রাতের বেশিরভাগ সময়েই আমার ঘরের দরজা বন্ধ থাকতো। কত রাত যে এভাবে ছবি আঁকতে গিয়ে না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি তার কোন হিসেব আমার কাছে নেই।

এভাবে দিন রাত ছবি আঁকার প্রভাব আমার স্বাভাবিক জীবনের অন্য সবকিছুতে পরল। দিনে দিনে আমার পড়াশুনার অবস্থার অবনতি ঘটতে লাগলো। ছবি আঁকা ছাড়া অন্য কোন কিছুই আমার ভালো লাগতো না। একটা পর্যায়ে আমার বন্ধুবান্ধব এমনকি আমার পরিবারের কাছ থেকেও আমি দূরে সরে যেতে লাগলাম। কি যেন এক অদ্ভুত নেশায় ধরেছিল আমায়। ছবি না আঁকলে মনে হতো আমার কি যেন নেই। দিন রাত দরজা বন্ধ করে ছবি আঁকতে শুরু করলাম। দিন রাতের মধ্যে কখন জেগে থাকতাম কিংবা কখন ঘুমিয়ে পরতাম তার কোন হদিস ছিল না। আমার এমন বেপরোয়া জীবন যাপনের জন্য আমার পরিবারে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হতে লাগলো। আত্মীয় স্বজনেরা বলাবলি শুরু করলো আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। অবস্থা খারাপ দেখে আমার বাবা আমার চিকিৎসা করানো শুরু করলেন। সবরকম চিকিৎসার পাশাপাশি আমার  মানসিকভাবেও চিকিৎসা করানো শুরু হোল। কিন্তু কোন কিছুতেই কোন কাজ হচ্ছিল না। আমি আমার মতো ছবি আঁকতে থাকলাম। এভাবে কতো মানুষের যে মুখের পোট্রেট করেছি তা নিজেও জানি না তখন। প্রত্যেকবার কারো ছবি আঁকতাম কিন্তু আঁকার পর মনে হতো কি যেন নেই এই ছবিটার মধ্যে। কেন যেন ছবি এঁকে কোন পূর্ণতা পেতাম না। একটা অতৃপ্তি, কোন কিছুর জন্য একটা তৃষ্ণা সারাক্ষণই আমার মধ্যে লেগে থাকতো।

সেবার কোন মতে ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষায় পাশ করলাম। রেজাল্ট যা হোল তাতে ভালো কোথাও পরীক্ষা দেবার মতো যোগ্যতাও আমার ছিল না। তারপর কি ভেবে যেন বাসায় কাউকে না জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারকলা বিভাগে পরীক্ষা দিলাম। প্রথমবার পরীক্ষাতেই টিকে গেলাম। এই বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করলে হয়তো আমার সমস্যা আরো বেড়ে যেতে পারে এই ভেবে আমার বাবা আমার চারুকলা বিষয়ে পড়া নিয়ে ঘোড় বিরোধিতা করা শুরু করলেন। এক পর্যায়ে কারো সাথে কোন প্রকার কথাবার্তা কিংবা কোন যোগ পরামর্শ ছাড়াই সবার অমতেই আমি চারুকলাতে ভর্তি হলাম।

ভদ্রলোক এই পর্যায়ে কিছুটা থামলেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ থেকে চশমা খুলে তার গ্লাস পরিষ্কার করলেন। আমিও কেন যেন এই মানুষটির গল্পটির প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণ অনুভব করতে লাগলাম। এক পর্যায়ে ভদ্রলোক আবার বলতে শুরু করলেন,

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর নিজেকে সম্পূর্ণ নতুন একটা পরিবেশের মধ্যে আবিষ্কার করলাম। সেখানে আমিও ছবি আঁকি আমার সাথের সবাইও ছবি আঁকে। নিজের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়ে গেলাম আমি সেখানে। প্রতিদিনই নতুন কিছু না কিছু পাচ্ছি ছবি আঁকার জন্য। যদি কখনো নিজের কল্পনা শক্তি ফুঁড়িয়ে যেত তাহলে অন্যের কল্পনা ধার করে নিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করলাম। আমার ছবি আঁকার প্রতি এত মোহ দেখে আমার হলের রুমমেটরা আমাকে রুমের একটা কোণায় পর্দা টানিয়ে আলাদা একটি জায়গার ব্যবস্থা করে দিল। আমি তখন দিন রাত শুধু ছবি আঁকতাম। কেন যে আঁকতাম তা নিজেও আমি জানি না। শুধু এটুকু বুঝতে পারতাম যে কেন যেন এতো ছবি এঁকেও ঠিক তৃপ্তি পাচ্ছি না। কি যেন নেই আমার এই ছবিগুলোর মধ্যে। কিন্তু কি নেই সেই প্রশ্নের উত্তর নিজেকে জিজ্ঞেস করেও কখনো খুঁজে পেতাম না।

মুখের পোট্রেট করার জন্য আমার প্রতিনিয়তই নতুন কোন না কোন চেহারার দরকার হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে এই জিনিসটির কোন অভাব ছিল না। কত নতুন নতুন মুখ ছিল সেখানে। কত জনকে যে এভাবে ছবি এঁকে দিয়েছি তা আমার নিজেরও জানা নেই। মাঝে মাঝে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা দল বেঁধে আমার কাছে আসতো। আমি একে একে তাদের সবার ছবি এঁকে দিতাম। বিনিময়ে তারা সবাই কিছু না কিছু আমার জন্য রেখে যেত। কেউ রেখে যেত শীতের চাদর, কেউবা ছবি আঁকার উপর বই আবার কেউ বা...

ভদ্রলোক এ পর্যায়ে একটু মুচকি হাসলেন। তারপর আবার শুরু করলেন,

থাক বাদ দিন। অন্য দিকে চলে যাচ্ছি। এভাবে করে মোটামুটি আমার দিন কাটছিল। পরিবারের মধ্যে শুধুমাত্র মার সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। আমার অন্য ভাই বোনদের প্রতি বাবার কড়া আদেশ ছিল আমার সাথে যেন কোনভাবেই কোনরকম সম্পর্ক রাখা না হয়। এমনই একদিন সন্ধ্যাবেলা ক্যাম্পাসের বটতলায় বসে আছি। সেদিন ক্যাম্পাসে নবীন বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলছিল। সবাই তখন বিভিন্ন উপায়ে নবীনদের বরণে ব্যস্ত আর সে জায়গায় আমি চুপচাপ বটতলায় বসে আছি। কেন যেন নিজেকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছিল তখন। আর ঠিক সেই সময়ে আমার......

ভদ্রলোক এটুকু বলে কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। আমি দেখতে পেলাম উত্তেজনায় ভদ্রলোকের হাত রীতিমত কাঁপছে। আমি উনার কাঁধে হাত রেখে বললাম,

ভাই বুঝতে পারছি আপনি প্রচণ্ড মানসিক স্ট্রেসের মধ্যে দিয়ে একসময় গিয়েছেন। কিন্তু তারপরও কেন যেন আমার আপনার গল্পটি শুনতে খুব ইচ্ছা করছে। আপনি কি আপনার গল্পটি শেষ করবেন?

ভদ্রলোক আবার সোজা হয়ে বসলেন। ক্লান্ত স্বরে বলতে শুরু করলেন,

আপনি নিশ্চয়ই জানেন প্রত্যেক আর্টিস্টই তার আর্ট এর জন্য নিজের মতো করে সবসময় সাবজেক্ট খুঁজে বেড়ায়। একজন লেখক যেমন সবসময় তার লিখার প্লট খুঁজে ঠিক তেমনি একজন চিত্রকারও সবসময় তার ছবি আঁকার সাবজেক্ট খুঁজে বেড়ায়।

সেদিন আমি বটতলায় একটি মেয়েকে দেখতে পেলাম। নীল রঙের শাড়ি পড়া বেশ স্নিগ্ধ চেহারার একটি মেয়ে। খুব সম্ভবত মেয়েটি নতুন কোন ছাত্রী ছিল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের। মেয়েটি এদিক ওদিক বেশ কৌতূহল নিয়ে তাকাচ্ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম মেয়েটি কিছু একটা খুঁজছে। কিংবা কাউকে খুঁজছে। খুব বেশি সময় ধরে না বড়জোর এক মিনিটের মতো মেয়েটি আমার সামনে ছিল। তারপর ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ হারিয়ে গেল। এতো সময়ের মাঝে এতটুকু সময়ের জন্যেও মেয়েটি আমাকে খেয়াল করে নি। কিন্তু মেয়েটি চলে যাবার পর কেন যেন আমার কাছে মনে হোল মেয়েটিকে আমার ভালো করে একটু দেখা দরকার। মেয়েটি কিছু একটা খুঁজছিল তার আশেপাশে। খোঁজার সময় মেয়েটির চেহারার অদ্ভুত এক রঙ দেখতে পেয়েছিলাম আমি। এক অদ্ভুত বিবর্তন যা এর আগে কখনও আমি আমার কোন সাবজেক্টের মাঝে খুঁজে পাই নি। আমি হন্যে হয়ে মেয়েটিকে খুঁজতে শুরু করলাম। সারা সন্ধ্যা পাগলের মতো খুঁজার পরও আমি কোথাও মেয়েটির দেখা পেলাম না।

রাতে ছবি আঁকতে বসলাম। মেয়েটির ছবি কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই কেন যেন আর মেয়েটির মুখ আমি মনে করতে পারছিলাম না। সারারাত অমানুষিক চেষ্টা করেও আমি মেয়েটির ছবি আঁকতে পারলাম না। যতবারই আমি ছবি আঁকতে যাচ্ছিলাম ততবারই আমার কাছে মনে হচ্ছিলো এই একটি ছবিই পারে আমাকে আমার এই অতৃপ্তির জীবন থেকে মুক্তি দিতে। এতদিন ধরে আমি যা খুঁজছিলাম তা এই একটি ছবির মাঝেই লুকিয়ে আছে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও কোনমতেই আমি ছবিটি দাঁড় করাতে পারছিলাম না।

এই ঘটনার পর থেকে দিনে দিনে আমার অবস্থা আরও খারাপ হতে শুরু করলো। মানসিকভাবে প্রচণ্ড রকম ভেঙে পরলাম আমি। সারারাত না ঘুমিয়ে আমার পর্দা টানানো রুমের কোণার জায়গাটিতে গিয়ে চুপচাপ পরে থাকতে লাগলাম।

সেসময় আমার কেমেস্ত্রি ডিপার্টমেন্টের কিছু ছেলের সাথে পরিচয় ছিল। তাদের আমি ঠিক বন্ধু বলবো না কারণ পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কারো সাথে আমার তেমন বন্ধুত্বের কোন সম্পর্ক গড়ে উঠে নি। যাই হোক তেমনি একদিন বিকেল বেলায় আমি আমার ক্যানভাসের সামনে রঙ তুলি নিয়ে চুপচাপ বসে আছি। হঠাৎ করে আমার প্রচণ্ড অস্থির লাগা শুরু হোল। আপনাকে হয়তো বলা হয় নি। মাঝে মাঝে আমার এমন নিজের মধ্যে প্রচণ্ড অস্থিরতা অনুভব করতাম। কিছু একটা না পাওয়ার অস্থিরতা, কিছু হারিয়ে যাবার অস্থিরতা। এই সমস্যাটাও আমার ছবি আঁকার পর থেকেই শুরু হয়েছিল। আমি আমার রুমের দরজা খুলে হলওয়েতে বের হয়ে এলাম। বিকেলের এই সময়টায় ক্যাম্পাস সাধারণত বেশ খালিই থাকতো। কেউ হয়তো আড্ডা দিতে বের হয়ে যেত কিংবা কেউ হয়তো পেটের দায়ে টিউশনি করতে। আমি হলওয়ের রেলিং ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। ঠিক এই সময়ে রোদ্দুর নামে একটি ছেলে হলওয়ে ধরে হেঁটে যাচ্ছিলো। আমাকে দেখে কেন যেন সে থমকে দাঁড়ালো। ছেলেটি গত বছরই কেমেস্ত্রি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়েছে। আমার সাথে কিভাবে পরিচয় আছে সে কথা আমি নিজেও জানি না। হয়তো কোন একদিন তার ছবি এঁকে দিয়েছিলাম। আমি ইতস্তত করে আমার রুমের দিকে রওনা দিলাম। ছেলেটির মতলব ভালো না। দেখেই মনে হচ্ছে এখনই তার ছবি এঁকে দেয়ার জন্য আবার আমাকে ধরবে। কিন্তু আমি তখন ছবি আঁকার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তখন কেন, হয়তো কোনদিনই আর আমি ছবি আঁকার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।

আমাকে মোটামুটি অবাক করে দিয়েই ছেলেটি আমাকে বলে উঠলো, ভাইয়া আপনি কি একটু আমার সাথে আসবেন?

আমি তার কথার উত্তর দিলাম না। আসলে কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না। আমি ইশারায় তাকে যেতে বলে তার পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম। আমাদের হলের পাশেই ছোট্ট একটা পুকুর ছিল। কোন একটা কারণে পুকুরটার বেশ বদনামও ছিল। সে কারণে সন্ধার আগের এই সময়টায় কেউ সেখানে যেতে চাইতো না। ছেলেটি কেন যেন আমাকে সেই পুকুরের কাছেই নিয়ে গেল। নিচু স্বরে বলল,

ভাইয়া আপনার কথা আমি শুনেছি। আপনি যে প্রচণ্ড যন্ত্রণার মধ্যে আছেন সেটাও আমি জানি। আসলে শুধু আমি না পুরো ক্যাম্পাস জানে। তবে আপনি যদি চান আমি আপনাকে এই যন্ত্রণা থেকে বের হয়ে আসার একটা উপায় দেখাতে পারি।

আমি ধরেই নিয়েছিলাম ছেলেটি আমার সাথে ফাজলামো করছে। এরকম ফাজলামো এই কয়দিনে অনেকবার আমার সাথে করা হয়েছে। কারো কারো মানসিক যন্ত্রণা মাঝে মধ্যে অন্যের কাছে হাসির খোঁড়াক হিসেবে বিবেচিত হয়। আমি তখন জানতাম আমারটাও হচ্ছে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে চলে আসার জন্য পা বাড়াচ্ছিলাম। ঠিক তখনই ছেলেটি বলে উঠলো, আমি আপনার সেই মেয়েটিকে আপনার কাছে এনে দিতে পারি। তবে বাস্তবে নয়। আপনার কল্পনায়।

আমি থমকে দাঁড়ালাম। সে সময় যেকোনো কিছুর বিনিময়ে হোক আমার সেই মেয়েটির সাথে একটিবারের জন্য দেখা হওয়াটা খুব জরুরী ছিল। আমি আর কথা বাড়ালাম না। ছেলেটিকে দ্বিতীয় কোন কথা না জিজ্ঞেস করে তার পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করলাম। মানুষের জীবনে এমন অনেক সময় আসে যখন নিজের সম্পূর্ণ অস্তিত্বকে দ্বিধাহীনভাবে অন্যের হাতে সঁপে দিতে হয়। হয়তো আমিও ঠিক সেই মুহূর্তে তাই করেছিলাম।

ভদ্রলোক এবার কিছুটা থামলেন। তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। কেন যেন আমার সেই হাসি দেখে অনেকটা ভয় ভয় করতে লাগলো। ভদ্রলোককে ভয় নয় বরং তার গল্পটি শেষ হয়ে যাবার ভয়। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিলো এই গল্পটি শেষ না হলেই বোধয় ভালো হতো।

কি ভাই? আরও শুনবেন?

ভদ্রলোক বুঝতে পারছেন যে তিনি আমাকে তার গল্পের জালে আটকে ফেলেছেন। আর আমিও বুঝতে পারছি তিনি তার এই গল্প শুনার জন্য আমার কাতরতা দেখে বেশ মজা পাচ্ছেন। যদিও আমার এখন কিছু আর করার নেই। আমার তার এই গল্পটি শেষ পর্যন্ত শুনে যেতে হবে। নাহয় কেন যেন আমার মনে হচ্ছে আমি এই গল্পটির শেষ শুনতে না পারলে কোনদিনও শান্তি পাবো না। আমি তাই হালকা স্বরে বললাম,

আমার অবস্থাতো আপনি বুঝতেই পারছেন। আপনি দয়া করে আপনার গল্পটি শেষ করুন।

ভদ্রলোক হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন,

ছেলেটি আমাকে প্রথমে নিয়ে গেল তার রুমে। কিছুক্ষণ বসিয়ে রেখে তারপর তার হাতের ইশারায় আমাকে আবার তার সাথে যেতে বলল। আমিও তার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম। এবার সে আমাকে নিয়ে গেলো ভার্সিটির কেমেস্ত্রি ডিপার্টমেন্ট এর একটি ল্যাবে। তখন প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। অন্ধকার হতে শুরু করেছে। আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না ছেলেটি আমাকে কেন সন্ধ্যাবেলা এই অন্ধকারাচ্ছণ্য ল্যাবে নিয়ে এসেছে। আমার চোখ তখন বেশ জ্বালা করছিলো। সম্ভবত কোন এসিডের উপস্থিতির কারণে। সরকারি ল্যাব, ঠিকমতো কখনোই পরিষ্কার করা হত না। আমার চোখ দিয়ে রীতিমত পানি চলে আসার যোগাড় হোল। আমি আমার হাতের উল্টা পিঠ দিয়ে আমার চোখ মুছতে যাবো আর ঠিক এমন সময় ছেলেটি বেশ শক্ত করে আমার হাতের মুঠি চেপে বলল,

আপনাকে একটা জিনিস দিবো। কাউকে এটার ব্যাপারে কিচ্ছু বলতে পারবেন না, নিজেও আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারবেন না যে এটা কি? শুধু যখন আপনার প্রচণ্ড যন্ত্রণা শুরু হবে তখন এটা খাবেন। তবে মনে রাখবেন, কখনোই আপনি আপনাকে কোনমতে তার হাতে সঁপে দিবেন না। ভুলেও না। যদি দেন তাহলে আপানাকে সাহায্য করার মতো আর কেউ থাকবে না।

আমি কিছু বুঝতে পারার আগেই ছেলেটি আমার হাতে কি যেন ধরিয়ে দিয়ে দৌড়ে ল্যাব থেকে বের হয়ে গেল। আমি বিশাল অন্ধকার ল্যাবের মাঝখানে চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। মানুষ আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে, ফাজলামো করছে তা জানতাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে আমাকে নিয়ে এত নোংরা চিন্তা কেউ করতে পারে তা আমি কখনো ভাবি নি কিংবা ভাবতে পারি নি। আমি অসহায়ের মতো কিছুক্ষণ ল্যাবের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইলাম।

এরপর প্রায় বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। আমাদের টার্ম ফাইনালের ডেট তখন দিয়ে দিয়েছে। সবাই খুব ব্যস্ত পড়াশুনা নিয়ে। ভার্সিটির এই সময়টাকে আমি প্রচণ্ড ঘৃণা করতাম। আমার কাছে পরীক্ষার আগের এই সময়টাকে কেন যেন অশুভ বলে মনে হত। সবাই পড়ছে। কেউ বুঝে পড়ছে কেউবা না বুঝে পড়ছে শুধুমাত্র দুই ডিজিটের একটা সংখ্যার জন্যে। আমার ব্যাপার অবশ্য ভিন্ন ছিল। পরীক্ষার এই সময়টাতে আমাদের ডিপার্টমেন্টের কেউই কখনোই পড়তাম না। আমাদের বেশিরভাগ মার্কসই কাউন্ট করা হতো বিভিন্ন এসাইনম্যান্ট এর উপর। পরীক্ষার এই দীর্ঘ সময়টাতে তাই শুয়ে বসে থাকা ছাড়া আমাদের আর কোন কাজ থাকতো না। ঠিক এরকমই একদিন বিকেলবেলা আমি শুয়ে আছি আমার ব্যাডের উপর। আমার রুমের বাকিরা তখন সবাই ঘুমুচ্ছিল। সেদিন সারা সকাল আকাশে বেশ মেঘ করেছিল। রীতিমত শীতকালের কুয়াশা ঘেরা সকালের মতো সবকিছু অন্ধকার হয়ে ছিল সেদিন। বিকেলের দিকে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পরতে শুরু করলো। বৃষ্টি শুরু হবার কিছুক্ষণ পর আমি খেয়াল করলাম আমার ব্যাডের জানালা দিয়ে ভেতরের দিকে বেশ বৃষ্টির ছিটা আসছে। আমি জানালা বন্ধ করার জন্য এক পাটি ধরে টান দিতেই অদ্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষ করলাম। আমার জানালার ঠিক বরাবর ছিল ক্যাম্পাসের বিশাল মাঠ। সেই মাঠের শেষ প্রান্তে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে গাছগাছারি কিচ্ছু নেই। বৃষ্টির পরিমাণ এতোটাই বেশি ছিল যে কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এমন বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা রীতিমত অসম্ভম ছিল। অসম্ভব কেন ছিল তার আরেকটি কারণ হচ্ছে সেখানে যে মানুষটি দাঁড়িয়ে আছে সেটি হচ্ছে একটি মেয়ে। প্রথমবারের দেখায় বুঝে উঠতে পারি নি। তবে এবার বুঝতে পারছি কারণ বাতাসে তার চুল উড়ছে। সেই চুল সামলাবারও যেন তার কোন ইচ্ছা নেই।

আমি জানালাটা বন্ধ করে আমার ছাতাটা হাতে নিয়ে নিচে নেমে এলাম। মেয়েটা এখনো সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি মেয়েটির দিকে এগিয়ে যাবো কি যাবো না এরকম চিন্তা করতে করতে কখন যে ছাতা খুলে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটা শুরু করেছি তা আমি নিজেও জানি না। এক পর্যায়ে আমি নিজেকে মেয়েটির ঠিক সামনে আবিষ্কার করলাম। আসলে ঠিক সামনে না। মেয়েটি পেছন দিকে ফিরে কি যেন দেখছিল খুব মনোযোগ দিয়ে। আমি কয়েকবার মেয়েটিকে ডাক দিতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু বৃষ্টির শব্দের কারণে আমার গলার আওয়াজ মেয়েটির কাছে পৌছাচ্ছিল না। আমি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ডাকতে যাবো ঠিক এমন সময় আমার সমস্ত হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো।

মেয়েটি ততক্ষণে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসির একটা ছাপ। সে এগিয়ে আসছে ঠিক আমার দিকে। হঠাৎ দেখতে পেলাম সে তার ডান হাতটাও আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। যেন সে চাচ্ছে আমি তার হাতটা একটু যাতে স্পর্শ করি। কিন্তু আমার তো তখন তার হাত ধরবার সময় নেই। আমি তাকিয়ে আছি তার মুখের দিকে।

এই তো সেই মুখ। যাকে আমি এতোদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। কিভাবে সম্ভব এটা? কিভাবে আমি তাকে খুঁজে পেলাম। উত্তেজনায় আমার তখন হাত পা ঠকঠক করে কাঁপছিল। আমি আমার হাতের ছাতাটা ফেলে দিলাম। সে তো ভিজছে। আমারও ভিজতে আর দায় কোথায়? ততক্ষণে আমি আমার কাঁপতে থাকা ডান হাতটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছি। সে আলতো করে আমার হাতটা স্পর্শ করলো। আমি দেখতে পেলাম সে তার অন্য হাত দিয়ে তার মুখের উপর এসে পরা চুলগুলো সরানোর চেষ্টা করছে। আর আমি বিহ্বলের মতো তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। তার চুলগুলো অনেক বড় ছিল। শুধু যে বড় তা নয় প্রায় পায়ের কাছাকাছি ছিল তার চুলের শেষ প্রান্তগুলো। সেই চুল থেকে কেমন যেন এক ধরণের সোনালী রঙের আভা ঠিকরে এসে আমার চোখে লাগছিল।

মেয়েটি তখনও হাসছে। সেই সাথে তার চোখদুটোও হাসছে। নিজের অজান্তেই আমার মুখ থেকে মেয়েটিকে বলা আমার প্রথম কথাটি বের হয়ে আসলো,

 “কেমন আছো স্বর্ণপ্রভা?”

ভদ্রলোক দম নেবার জন্য আবারো একটু থামলেন। একটু পর আবার বলতে শুরু করলেন,

মেয়েটিও আমাকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই হঠাৎ করেই কেন যেন সবকিছু ফ্যাকাসে হতে শুরু করলো। আমি দেখতে পেলাম মেয়েটি আমার কাছ থেকে কেমন যেন ছিটকে দূরে সরে যাচ্ছে। আমি তার হাতটি আরও শক্ত করে ধরতে যাবো ঠিক সেই মুহূর্তে আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম আমার ব্যাডের উপর। আমি আমার ব্যাডের পাশের জানালাটি লাগাই নি। বৃষ্টির পানি এসে আমার সমস্ত ব্যাড এমনকি আমার শরীরও ভিজিয়ে দিয়ে গেছে।

তার মানে কি আমি স্বপ্ন দেখছিলাম? কিন্তু এ কি করে সম্ভব? স্বপ্ন কি করে এতোটা বাস্তব হতে পারে? আমি আমার হাতে এখনও মেয়েটির হাতের স্পর্শ অনুভব করতে পারছি। আমি হতভম্ভ হয়ে আমার ভেজা বিছানার উপর বসে রইলাম। মেয়েটিকে এতোটা দিন ধরে আমি খুঁজছি কিন্তু সে তো কখনও আমার স্বপ্নেও আসে নি। তাহলে আজ কেন এভাবে? আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। শুধু এটুকুই বুঝতে পারছিলাম যে আজ থেকে মেয়েটির একটি নাম আছে। আর তা হচ্ছে স্বর্ণপ্রভা।

আমি আমার রংতুলি আর ক্যানভাস নিয়ে আমার পর্দা টানানো জায়গাটিতে বসে গেলাম। ছবি আঁকতে শুরু করলাম। আমার স্বর্ণপ্রভার ছবি। সে বৃষ্টিতে ভিজছে। বাতাসে তার চুল উড়ছে। একহাতে সে তার মুখের উপর পরে থাকা চুল সরাচ্ছে আর তার আরেকটা হাত সে বাড়িয়ে রেখেছে তার সামনের দিকে। যেন সে চাচ্ছে কেউ একজন তার হাতটুকু একটুখানি স্পর্শ করুক। আর সেই স্পর্শের সাথে সাথে সেই কেউ একজনের জীবনের সমস্ত গ্লানি মুছে যাক, মুছে যাক তার সমস্ত যন্ত্রণাময় অতীত।

আমি প্রায়ই ভাবতাম মানুষ তার বর্তমান সাজাতে পারে, তার ভবিষ্যৎ গুছাতে পারে, তাহলে কেন তার অতীত নিজের হাতে গড়তে পারে না? সৃষ্টিকর্তা আমাদের সেই ক্ষমতাটুকু দেন নি। তিনি তার নিজের জন্য কিছু জিনিস রেখে দিয়েছেন। সেই অতীতটাও বোধয় তার জন্যই রাখা।

আমি আমার ছবিটির নাম দিলাম “স্বর্ণপ্রভা”

আমার গল্প শোনার মধ্যে আবারো ব্যাঘাত ঘটলো। বাসের সুপারভাইজর এসে আমাকে আর ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করতে লাগলো যে জেগে আছি যেহেতু তাই চা কিংবা কফির কোন ব্যবস্থা তারা আমাদের জন্য করবে কিনা? আমি এবং পাশের সিটে বসা ভদ্রলোক দুজনেই একসঙ্গে মানা করে দিলাম। সুপারভাইজরকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় করার পর আমি ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম,

আপনার গল্পের শেষটাতো বেশ ভালই হয়েছে।

আমার কথায় মনে হোল ভদ্রলোক বেশ আহত হলেন। তার চোখে আমি সেই আহত হবার ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। তিনি আবারও বলতে শুরু করলেন,

আপনার জন্য হয়তো গল্পটি এখানেই শেষ। আসলে শেষ হবারই কথা ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে আমার জন্য গল্পটি মাত্র শুরু হয়েছিল তখন।

ছবিটি শেষ করার পর বেশ ভালো লাগছিল আমার। বলতে পারেন মনে হচ্ছিল হয়তো এবার আমি আমার যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেতে শুরু করেছি। মনের মধ্যে একধরণের প্রফুল্লতা অনুভব করছিলাম আমি তখন। আমার রুমমেটরা প্রথমে আমার আঁকা ছবিটি দেখতে পেল। তারপর দেখতে দেখতে পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে খবর ছড়িয়ে পরলো যে আমার বিখ্যাত সেই ছবিটি যেটি আমি ভেবেছিলাম কখনোই আর আঁকতে পারবো না সেটি আমার আঁকা শেষ হয়েছে। দল বেঁধে ছেলেমেয়েরা আমার আঁকা ছবি দেখতে আসতে শুরু করলো। সবাই দেখল এবং প্রায় এক প্রকার নির্বাক হয়েই ফিরে গেল। এই ছবির সৌন্দর্য বর্ণনা করার ক্ষমতা তাদের নাকি কাররই ছিল না।

সেদিন অনেকদিন পর পুরো একটা দিন আমি বেশ হাসিখুশি রইলাম। রাতে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমাতে যাবো ঠিক এমন সময় কি মনে করে যেন আমার ব্যাডের পাশে রাখা আমার টেবিলের ড্রয়ারটা ধরে টান দিলাম। আর সাথে সাথে নিজের অজান্তেই আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা একটা স্রোত নেমে এলো।

ছেলেটি সেদিন আমাকে ল্যাবের মধ্যে সাদা কাগজে মোড়ানো দুটি ছোট ছোট বেগুনি রঙের ক্যাপসুল দিয়েছিল। আমিও সেই কাগজটি এনে ভাঁজ করে আমার ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ ড্রয়ার খুলে দেখতে পেলাম যে কাগজটি খোলা। আর ক্যাপসুলও মাত্র একটা আছে কাগজটির মধ্যে। তাহলে আরেকটি গেল কোথায়?

আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। আমি ছাড়া আর কেউ জানে না এই ক্যাপসুলের কথা। তাহলে? আর আমি তো এই ক্যাপসুলে হাত দেই নি। তাহলে যাবে কোথায় আরেকটি ক্যাপসুল?

আমি হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করলাম। সারা ঘর আমার বিছানা এমনকি আমার ছবি আঁকার সব সরঞ্জাম সবকিছু তন্ন তন্ন করে ফেললাম এবং খুঁজতে খুঁজতে এক পর্যায়ে এসে বুঝতে পারলাম এই ক্যাপসুল কোথাও হারায় নি। ক্যাপসুলটি আমিই খেয়েছি। আর সেই কারণেই আমি সেদিন মেয়েটিকে স্বপ্নে দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু সেই ড্রাগের কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেই হোক আর যে কোন কারণেই হোক মস্তিষ্ক আমার সেই স্বপ্নের আগে ঘটে যাওয়া কিছু স্মৃতি তার সেল থেকে মুছে ফেলেছে। যার কারণে আমি মনে করতে পারছি না যে আমি কখন ক্যাপসুলটি খেয়েছি।

আমি দৌড়ে আমার পাশের হলে গেলাম সেই ছেলেটিকে খুঁজার জন্য। ছেলেটির নাম আমার কেন যেন তখন মনে আসছিল না। অনেক চেষ্টা করেও আমি তার নাম মনে করতে পারছিলাম না। হলে গিয়ে একটা পর্যায়ে আমি সেই ছেলেটির রুম খুঁজে বের করতে সক্ষম হলেও ছেলেটিকে পেলাম না। তার রুমমেটটা আমাকে জানালো সে কিছুদিনের জন্য তার দেশের বাড়িতে গেছে। ফিরতে কিছুদিন দেরি হবে।

আমি আবার আমার সেই আগের যন্ত্রণার মধ্যে পরে গেলাম। একি করলাম আমি? শেষ পর্যন্ত এতোটা নিচে নেমে গেলাম যে আমাকে ড্রাগের সাহায্য নিতে হোল? সেদিনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম যে, আমি আজকের পর থেকে আর কখনও ছবি আঁকবো না?

গল্পের এই পর্যায়ে আমি নিজে ভদ্রলোককে থামালাম। বললাম,

একি বলছেন আপনি? ছবি আঁকা ছেঁড়ে দিয়েছিলেন?

ভদ্রলোক হেসে জবাব দিলেন,

হ্যাঁ দিয়েছিলাম। আর তাছাড়া আমার আসলে আর ছবি আঁকার দরকারও ছিল না। আমরা যারা আর্টিস্ট তাদের প্রত্যেকের জীবনে একটি হলেও Breakthrough থাকে। আমার জীবনে সেটি ছিল আমার আঁকা “স্বর্ণপ্রভা” ছবিটি। এই ছবিটি আমার জীবনে পরিপূর্ণতা নামক জিনিসটি এনে দিয়েছিল। এখন আর ছবি না আঁকলেও আমার কোন সমস্যা নেই। তবে ছবি আঁকার জগত থেকে যে সম্পূর্ণ বের হয়ে এসেছি তা কিন্তু নয়। আমি এখন ছবি আঁকা শেখাই। একটা ছোটখাট বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টের প্রফেসর হিসেবে আছি।

তো যাই হোক নিজের মধ্যে প্রচণ্ড গিল্ট ফিল হতে লাগলো। আপনি বোধয় জানেন এই জাতীয় অনুভূতিগুলো বেশিদিন স্থায়ী হয় না। আমার ক্ষেত্রেও হোল না। আমি আমার স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফিরে যাবার জন্য সবকিছু গুছাতে শুরু করলাম। ততদিনে বাসার সবার সাথে আমার যোগাযোগও হয়েছে। বাবার আমার উপর জমে থাকা রাগ ভেঙেছে। তিনি আমাকে বাড়িতে যাবার জন্য অনুরোধ করেছেন। আমিও ঠিক করে রেখেছিলাম যে বাড়িতে যাবো আর ঠিক সেরকম সময়ে একদিন রাতে আমি আবার স্বর্ণপ্রভাকে স্বপ্ন দেখলাম।

এবারের স্বপ্নটা একটু অন্যরকম ছিল। স্বপ্ন সাধারণত মাঝখান থেকে শুরু হয়। আপনি এর শুরুটা কখনোই বের করতে পারবেন না। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে দেখা গেল আমি এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু বের করতে পারছি এমনকি মনেও রাখতে পারছি। স্বপ্নটা অন্যরকম ছিল তার কারণ আমার স্বপ্নে আমি স্বর্ণপ্রভাকে ঠিক যেরকমটি প্রথম স্বপ্নে দেখেছিলাম সে ঠিক তেমনটা আমার এই দ্বিতীয় স্বপ্নে ছিল না। স্বপ্নের সাবজেক্ট কখনও বদলে যাবার কথা নয় কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমার এই স্বপ্নে স্বর্ণপ্রভার চুল আগের থেকে ছোট করে ছাটা। যেন এই কিছুদিনের মধ্যে সে তার চুলের প্রান্ত কিছুটা কেটেছে। আমি এই নিয়ে তার সাথে স্বপ্নের মধ্যে বেশ অভিমানও করলাম। সে আমাকে কথা দিল যে সে আর কখনো তার চুল কাটবে না। ও হ্যাঁ আরেকটা কথা বলেরাখি, স্বপ্নের মধ্যে আমি আর স্বর্ণপ্রভা বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল দুজন দুজনকে যেন কতোদিন ধরে চিনি।

আমার ঘুম কখন ভাঙলো তা আমি বলতে পারবো না। ঘুম আর জাগরণের মধ্যকার পার্থক্য আমি কেন যেন ধরতে পারছিলাম না। যখন বুঝতে পারলাম আমি এখন জেগে আছি তখন ড্রয়ার খুলে দেখি আমার দ্বিতীয় ক্যাপসুলটিও নেই।

আমি পুরোপুরি ভেঙে পরলাম। কিন্তু এতো কিছুর পরও কেন যেন মনে হচ্ছিল আমার স্বর্ণপ্রভা তো আছে আমার সঙ্গেই। তারপরের কিছুদিন বেশ কষ্টের মধ্যে অতিবাহিত করলাম। স্বর্ণপ্রভার কথা খুব মনে পরতে লাগলো। এক পর্যায়ে আর থাকতে না পেরে আমি আবার সেই ছেলেটিকে খুঁজতে বের হলাম। এবার তাকে তার হলের মধ্যেই পাওয়া গেল। তাকে জানালাম আমার অবস্থার কথা। সে মাথা নেড়ে আমাকে আরও সাতটি ক্যাপসুল দিয়ে দিলো। তার কাছ থেকে যতটা বুঝতে পারলাম সেটা হচ্ছে এই ক্যাপসুল সে নিজের হাতে বানিয়েছে। আমি এবং সে ছাড়া তৃতীয় কোন ব্যাক্তি তার এই ক্যাপসুলটির কথা জানে না।  

ক্যাপসুলগুলো আনার পর থেকে আমি প্রায় প্রতিদিনই স্বর্ণপ্রভাকে স্বপ্নে দেখতে লাগলাম। আর আমার স্বপ্নও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগলো। সেই সাথে আমার আর স্বর্ণপ্রভার সম্পর্কও। আমি মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। আমার এই ভালোবাসার পার্থক্য শুধু এইটুকুই ছিল যে আমার ভালোবাসার মানুষটি বাস্তব জীবনে কোন অস্তিত্ব বহন করে না। সে থাকে শুধু আমার কল্পনায়।

আমার আচার আচরণে অনেক পরিবর্তন ঘটতে লাগলো। কেন যেন আমি ঘুম আর জাগরণের মাঝখানে এক ঘোরের মধ্যে বসবাস করতে লাগলাম। আমার স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে শুরু করেছিল। এক পর্যায়ে দেখতে পেলাম বাস্তবতা আর স্বপ্নের মধ্যকার কোন পার্থক্য আমি আর ধরতে পারছি না। আমি সেই ছেলেটির কাছে আরেকবার গিয়েছিলাম। সে আমাকে দেখে বলেছিল, “আমি আপনাকে বলেছিলাম না যে তার হাতে ভুলেও আপনি আপনার নিজেকে সঁপে দিবেন না। এখন আপনি আর এই জগত থেকে বের হতে পারবেন না। আপনার স্বর্ণপ্রভাই এখন আপনার জগত। আপনার বর্তমান, আপনার অতীত এবং আপনার ভবিষ্যৎ। আপনার জগতের অস্তিত্ব শেষ হতে চলেছে। আপনার ধ্বংস হয়ে যাওয়া জগতের অস্তিত্ব নিয়েই স্বর্ণপ্রভা তার নিজের জগতের সূচনা করবে। আপনি এখন তার হাতে বন্দি। আমি চাইলেও আর আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারবো না। আমি কেন আপনি নিজে চাইলেও আর কোনদিন নিজেকে সাহায্য করতে পারবেন না”।

আমি সেদিন কিছু না বলেই আমার রুমে ফিরে এলাম। রাতে বেশ আয়োজন করে ঘুমুতে গেলাম। ঘুম জিনিসটা আমার জন্য তখন খুবই আশ্চর্যের একটি অনুভূতি ছিল। কারণ আমি তো ঘুমাতাম না। বিছানায় শোয়া মাত্র স্বর্ণপ্রভা আমাকে এসে নিয়ে যেত। এভাবে কতদিন যে না ঘুমিয়ে থেকেছি তা আমি নিজেও জানি না। সেদিনও স্বর্ণপ্রভার সাথে সময় কাটাচ্ছিলাম। আমাকে সে ঐদিন দূরে কোথাও নিয়ে গিয়েছিল। এমন একটি জায়গায় যে জায়গাটি আমি ঠিক চিনি না। এমনকি আগে কখনও দেখিও নি। আমি আর স্বর্ণপ্রভা পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটছিলাম। আমাদের চারপাশটা কেমন যেন ধূসর বলে মনে হচ্ছিল আমার কাছে। এক পর্যায়ে আমি বুঝতে পারলাম আমার এই স্বপ্ন আর শেষ হচ্ছে না। হয়তো আর হবেও না। আমি স্বর্ণপ্রভার দিকে তাকালাম। সে আমার ডান হাতটা বেশ শক্ত করে ধরে বলল,

পারবে না আমার সাথে থাকতে?

আমি তার কথার আর উত্তর দিলাম না। কিছু কিছু উত্তরের জন্য শব্দের কোন প্রয়োজন হয় না।
















ঝিনাইদাহ আসতে আর বেশি দেরি নেই। বড়জোর ঘণ্টা খানিক লাগতে পারে। আমি আর আমার পাশের ভদ্রলোক চুপচাপ বসে আছি। ভদ্রলোক এই শীতের মধ্যেও বেশ ঘামছেন। আর আমি অনেকটা নির্বাক হয়েই বসে আছি। কোন একটা কারণে এই নীরবতাটা এখন বেশ উপভোগ করছি আমি। তবে মানুষের মধ্যকার অনেক অনুভূতির মধ্যে এই নীরবতাও এমন একটি অনুভূতি যা বেশিক্ষণ উপভোগ করা যায় না। নীরবতা ভেঙে ফেলতে হয়।

আপনি এখন তাহলে কেমন আছেন?

ভদ্রলোক আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,

ভালই তো আছি। আমার স্বর্ণপ্রভার জগতে আছি। সেখানে আমার গতিশীল একটা জীবন আছে, আমার ছবিময় জীবন আছে, আমার ছোট্ট একটি সংসার আছে, স্বর্ণপ্রভা আছে............

ভদ্রলোক আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন,

আপনিও আছেন।

আমি আমার সাথে করে আনা চাদরটা গায়ে জড়িয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম। ঝিনাইদাহ এখনও আরও এক ঘণ্টার পথ। এই সময়টা অন্তত একটু ঘুমানো যেতে পারে।

 

০ Likes ০ Comments ০ Share ৪৬৩ Views