Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

গল্প

।।১।।

ময়না অপেক্ষায় থাকে কখন লাল লাইটটা জ্বলবে। লাইটটা জ্বলে উঠলেই গাড়ী গুলো একে একে থেমে যায়। ময়না মালা হাতে দৌড়ায়। ময়নার আজ মন ভাল। কারন অনেক মালাবিক্রি হচ্ছে। সিগন্যালটা ছেড়ে দিলে মায়ের পাশে এসে বসে পড়ে ময়না। - ধুর এত তাড়াতাড়ি ছাইড়া দিলো??

ময়নার মাঝে মাঝে মনে হয় গাড়ী গুলো সারাদিন দাড়িয়ে থাকুক। তাহলে তার অনেক মালা বিক্রি হবে। কিন্তু এমনটা কি কখনো হয়? এটা ময়নাও বুঝে। এইরকম প্যাচাল মাঝে মাঝে মায়ের সাথে করে। মা কেবলই হাসে।

- মা জলদি মালা গাথো। আইজ একশটার বেশী বেচতে পারুম। এখনো অনেক সময় আছে। পারুম না মা??

- হ পারবি।

মেয়ের নানান প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে হয়রান। তবুও বিরক্ত হয়না মা।

- মা, আরো কত ট্যাকা হইলে দোকান দিতে পারুম।

- ম্যলা ট্যাকা লাগবো।

- আমরা পারুম না মা??

মায়ের উত্তরের অপেক্ষা করেনা ময়না। তুমি দোকানে বসবা। তুমি রাস্তায় বইসা মালা গাথ আমার ভালা লাগেনা।

আবারো লাল লাইটটা জ্বলে উঠে। দাড়িয়ে যায় সব গুলো গাড়ি। আবারো মালা হাতে দৌড়ায় ময়না। চন্দ্রিমার এই মোড়টায় প্রতিদিন অনেকের মতো ময়নাও মালা বিক্রী করে। এরা সবাই এমনই। কারো বাবা নেই, কারো মা নেই, কারো মাও নেই বাবাও নেই।

পদ্মায় ভেঙ্গেছিল ময়নাদের ঘর। ময়না তখন ছোট। কিছু দিন বেড়ী বাধে, এরপরঢাকায় এসে এই বস্তিতে উঠে। তার বাবা কখনো ঠেলা কখনো ভ্যান চালাতো। ভালই চলছিল ময়নাদের জীবন। বস্তির একটি খুপড়ি ঘরে তিনটি প্রানী অভাবে অনটনেও বেশসুখেই ছিল। কিন্তু সেই সুখ বেশী টিকেনি। ট্রাকের চাপায় মারা যায় ময়নার বাবা। পদ্মায় যা ভেঙ্গেছিল এবার ভেঙ্গেছে তার চেয়ে বহুগুন বেশী। থমকে যায় ময়নার জীবন। মা মেয়ে নেমে আসে রাস্তায়। শুরু হয় তাদের নতুন জীবন।

প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অব্দি চলে তাদের মালা বিক্রি। মাঝে মাঝে ভাল বেচা কেনা হয়। বিশেষ করে ছুটির দিনে। এরপরেও আগের মত বিক্রি হয়না। একেতো বিক্রেতা বেশী আবার রাস্তা ঘাটের জ্যামে যাত্রীরা বিরক্ত, অপেক্ষায় থাকে কখন বাসায় ফিরবে? রাস্তায় দাড়িয়ে ফুল কেনার সময় কোথায়?

এভাবেই চলে ময়নাদের জীবন। থেমে থাকতে পারেনা তাই চলতে থাকে। ভাল থাকার উপায় নেই তাই খারাপই চলে। আজকের এই সময়ে দুইটা প্রানীর দুই বেলা আহার আর র্জীনর্শীন দেহে লজ্জা নিবারনের এক টুকরা কাপড় জোগাড় করা কতটা কঠিন তা ময়নাদের দেখলে বোঝা যায়। আবার যখন দেখি রাস্তায় ছুটে চলা র্মাসিডিস গাড়ীর একটা চাকা কিংবা কোন শিল্প পতির মেয়ের সহচরী কুকুরটা প্রতিদিনের খরচ ময়নাদের সারা মাসের খরচের চেয়ে বেশী তখন মনে হয় এই ব্যবধানটা বুঝি তাদেরই সৃষ্টি। কেউ জীবনকে বাচিয়ে রাখে পরের দিনের জন্য আর কেউ পরের দিনটাকে মেনে নেয় আজ মরতে পারেনি বলে।

উপরতলা মানুষেরা যেমন নিচতলার মানুষদের দেখে না তেমনি দ্রুত গতিতে ছুটে চলা মানুষ গুলি আশপাশ দেখার সময় পায়না। এটাই বুঝি অলিখিত বিধান। তেমনি এক বিলাসীর হাই ভলিউমে মিউজিক বাজানো গাড়িটা সিগনালের তোয়াক্কা না করে ব্রেকনা কষেই চলে গেল। একটা শব্দ, তারপর ময়না ছিটকে পড়ে গেল ফুটপাতে। মাথা ফেটে রক্ত বের হতে লাগলো। ময়নার মা মাগো বাবাগো বলে চিৎকার শুরু করে দিল। অন্যান্য লোকদের সহযোগীতায় একটা র্ফামেসীতে নেয়া হলো। রোগীর আর্থিক অবস্থা চিন্তা করে কেউ হাসপাতালে নিতে চাইল না। আর নিলেই কি? হাসপাতাল এদের জন্য নয়। ওগুলা মানুষের জন্য। রাস্তায় যারা জন্মে, কিংবা বড় হয় নয়তো ঘুমায় তারা যাই হোক মানুষ হতে পারে না। যদি মানুষই হতো তাহলে তাদের সহাবস্থান মানুষের সাথে হতো, রাস্তায় বেওয়ারিশ কুকুরের সাথে হতোনা।

ডাক্তার ব্যন্ডেজ করলেন। ঔষধ দিলেন। বলে দিলেন যে ঠিক মত ঔষধ খেলে সেরে যাবে। কিন্তু না হয়নি। রাতে প্রচন্ড জ্বর আসলো ময়নার। ঔষধ চলছে কিন্তু জ্বর কমছে না। পানি পট্টিতে কোন কাজ হচ্ছে না। ব্যথায় বার বার কেদে উঠছে। অনেক কস্ট আর আদর নিয়ে শিয়রে বসে আছে তার মা। মেয়ের অসুস্থতা আর অজানা আশংকার কাছে মমতা আর আদর পরাজিত হয়ে রাত অতিক্রান্ত হতে লাগল। ময়নাদের কাছে এইঘটনা গুলো যতনা কস্ট দেহে তার চেয়ে বেশী কস্ট অর্থে। মাঝে মাঝে ভাবি বিধাতার এই রকম কেন খেয়াল বুঝতে পারিনা। কি মজা পান তিনি গরীবদের আরো কস্টে ফেলে, তাদের কস্ট দেখে।

পরদিনও তার কোন উন্নতি হয়নি। মেয়ের এই অবস্থায় আর কাজে যাওয়া হলো না। দুইদিনেই হাতে জমানো টাকা শেষ হয়ে গেল। এরপর শুরু হলো ধার দেনার পালা। কিন্তু এই রকম জায়গায় কে কাকে টাকা দেয়? এখানে হাত পেতে নেয়ার লোক সবাই, হাত খুলে দেয়ার কেউ নেই।

।।২।।

মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে ময়নার মা। রজব আলীর মুখে মুচকি হাসি। ভাবখানা এমন যেন বহুদিন পর শিকার জালে ধরা পড়েছে। পিচিক করে পানের পিক ফেলে কুটিল হাসি দিয়ে ময়নার মায়ের আপাদ মস্ক একবার পরখ করে। রজব আলী বড়ই দিল খোলা মানুষ।কেউ টাকা চেয়ে খালি হাতে ফেরত যায় না। কিন্তু তারও একটা কারন থাকে। তিন বছরে ময়নার মা ভাল করেই রজব আলীকে চিনে ফেলেছে। আর তাই সবসময় এড়িয়ে চলত।কিন্তু আজ আসতেই হলো। ময়নার মাকে আসতে হল। মেয়ের জন্য, মেয়েকে বাচানোর জন্য।

- আমি কথা দিতাছি মাইয়াডা একটু ভালা হইলেই ট্যাকা ফিরত দিয়া দিমু।

- আহা হা , তোমারে কি ফেরত দিবার কইছি। ট্যাকা কি মানুষের চাইতে বড় কিছু। কত লাগবে তোমার?? নিয়া যাও। ফেরত দিতে হইব না।

- না না, এমনিই এমনিই নিমু না। আমারে এক হাজার ট্যাকা দেন।

- হোন ময়নার মা। দুনিয়াতে কাউরে কেউ এমনি এমনি কিছু দেয় না। এমনি এমনি কিছুহয়ও না। এই যে তুমি মাইয়া হাসি মুখ দেখবার চাও। মাইয়া তো এমনি এমনি ভালা হইবোনা, এমনি এমনি হাসবো না। তার জন্যি তোমার ট্যাকা দরকার। তোমার ট্যাকানাই কিন্তু আমার আছে। আমি ট্যাকা দিমু। তুমি অন্য...........।

ময়নার মা কোন উত্তর দিতে পারছেনা। মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে।একশ ওয়াটেরজ্বলন্ত লাইটের সামনে দাড়িয়েও চোখে মুখে অন্ধকার লাগছে। সন্তানের জন্য মা কি করতে পারে, কত সহ্য করতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না।সন্তানের জন্য আদরে কুসুম কোমল হয় আবার মা বাঘিনীর মত সাহসীও হয়, কিন্তু আজবড় অসহায় হয়ে উঠে ময়নার মায়ের জীবন। আত্নহত্যা যদি আনন্দের কিংবা সমাধান হতো তাহলে এখন হয়তো তাই করতো।

রজব আলী ময়নার মায়ের হাত ধরে। ময়নার মা কোন কথা বলেনা। ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক সে আজ নিরব।

- এই লও ট্যাকা লও। আগে মাইয়ারে ভালা করো। তারপর তোমার লগে দেখা হইবো।

হাত পা অবশ হয়ে জমাট বরফের মত হয়ে উঠছে। মনে হয় পৃথিবীটা ভেঙ্গে পড়ছে। রজব আলী তাড়া দেয় ,”আরে যাও যাও মাইয়ার কাছে যাও।” হাত ধরে ঘর থেকে বের করে দেয়। টাকা হাতে নিয়ে ধীর পায়ে বেড়িয়ে ঘরের পানে রওয়ানা হয় ময়নার মা। ঘরে ফিরে হাতের মুষ্টি খোলে, কড়কড়ে চার চারটি নোট। একবার টাকা আরেকবার মেয়ের দিকে তাকায়। চোখে মুখে হাজারো প্রশ্ন উত্তর দেবার কেউ নাই।

তিনদিন ঢাকা ম্যডিক্যালের বারান্দায় চিকিৎসা শেষ হলো ময়না। আজ সকালের সোনা রোদের সাথে সাথে হেসে উঠে ময়না। ঘুম ঘুম চোখে মেয়ের হাসি মাখা মুখ দেখে ভুলে যায় টানা কয়েক দিনের কষ্ট। ডাক্তার বললেন বাড়ী নেয়া যান। একটু সেবাযত্ন করলেই ঠিক হয়ে যাবে।

কিছুক্ষন পর রজব আলী আসে। হাসপাতালের যাবতীয় বিল পরিশোধ করে। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে একটা সিএনজিতে তুলে দেয় দুজনকে। দোকানে রাখা একটা ব্যগ তার হাতেতুলে দেয়। হাসি হাসি মুখ রজব আলীর।

- এই ব্যগটা ন্যাও। এর মইধ্যে ফল, আর ঔষধ আছে। মাইয়ারে খাইতে দিবা। আরো একটা জিনিস আছে সেইটা তোমার। সিএনজিটা ছেড়ে দেয়। ময়নার মায়ের মুখ থেকে অস্ফুষ্ট স্বরে বেড়িয়ে আসে বদমাইশ।

।।৩।।

বস্তির অন্যান্য মহিলারা আড় চোখে তাকায়। ফরিদের মা দাঁত মুখ খিচিয়ে বলে ,”কি লো তোর গতরে নতুন কাপড়। কই পাইলি। ঘটনা কি??“

- ঘটনার কি হইল?? নতুন কাপড় কিনবার পারিনা?

- দেখ, সবই বুঝি, আমরা আন্ধা না..ময়নার মা আর কথা বাড়ায় না। ফরিদের মায়ের জানায় ভুল নাই। কিন্তু কেন কি হয়েছে তার জানার শোনার কেউ নাই। ময়নার দায়িত্ব আমার না। সমাজেরও না। মানুষে মানুষে এই ব্যবধান দুর করা দায়িত্ব রাস্ট্রের। যে দেশে একটা কুকুরের পিছনে মাসে লাখ টাকা খরচ হয় সে দেশে ময়না আর তার মায়ের এই অবস্থার জন্য কারা দায়ী এইটা দেখার দায়িত্ব রাস্ট্রের। রাস্ট্র যখন তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থহয় তখন ময়নার মায়েদের মনে যন্ত্রনার বিষ জমা হয়। তখন বিষের নেশার নেশা খোরেরা তাদের সন্ধানে নামে। এই দোষ রজব আলীদের না। তাদের চাই বিষ,চাইনেশা। একটা না দুইটা না, শত চাই, হাজার চাই। আর ময়নার মায়েরা জীবন বাচানোর জন্য এভাবেই জীবন বাজী রেখে বিষ বিক্রী করতে বাধ্য হয়।

চন্দ্রিমার উদ্যান মোড়টায় ফুটপাতে বসে মালা গাথে ময়নার মা। হাতের মালাটা বিক্রী করেই ফিরে আসে ময়না।

- এখনো মালা হয়নাই মা?? জলদি আরেকটা মালা বানাও।

অজানায় হারিয়ে যাওয়া ময়নার মায়ের সম্বিত ফিরে। মনোযোগ ফিরে আসে সুই সুতোতে। মালা গাথতে থাকে একটা ফুলের পর আরেকটা ফূল। একটা দিনের পর আরেক দিন, আবারএকটা রাত মালা গাথে ময়নার মায়ের জীবনে।

প্রতিটি সিগন্যালে গাড়ী থামে। ময়নার চোখ জ্বল জ্বল করে উঠে। “মা জলদি মালা দেও। আইজ আর বিশটা হইলে একশ টা হইব।“ আবার ফিরে আসে। মন খারাপ কইরনা মা।দেইখো আমরা আবার ট্যাকা জমামু। সেই টাকা দিয়া একটা দোকান দিমু। তুমি দোকানে বসবা। তুমি রাস্তায় বইসা থাকো এইটা আমার ভালা লাগেনা। সব কথা তার কান র্পযন্ত পৌছায় না।

সিগন্যাল ছেড়ে দিলে গাড়ি গুলো অজানার পানে ছুটে যায়। আর শেষহীন, লেশহীন অন্তহীন ভাবনা নিয়ে গাড়ি গুলোর পানে তাকিয়ে থাকে। মেয়ের ডাকে সম্বিত ফিরে তার। আবারো শুরু হয় মালা গাথা। সুই আর সুতোয় একটার পর একটা ফুল, একটা দিনের পর আরেক রাত, তারপর আবার দিনের শেষে রাতের মতো।

 

০ Likes ১১ Comments ০ Share ৫৫৯ Views

Comments (11)

  • - নীল সাধু

    শুভেচ্ছা কালপুরুষ দা

    বিষণ্নতার সুর বাজে বেহালার তারে,

    শীতার্ত সারসী কাঁদে নিঃশব্দ প্রহরে।

    জোনাকীর মৃদু আলো হিজলের বনে,

    মেঘের আঁচলে লুকায় চাঁদ ঐ গগনে।

    দারুন শুরু করেছেন

    পুরোটাই ভালো লেগেছে অনেক

    - সালাহ্‌ আদ-দীন

    বিষণ্নতার সুর বাজে বেহালার তারে,

    শীতার্ত সারসী কাঁদে নিঃশব্দ প্রহরে।

    জোনাকীর মৃদু আলো হিজলের বনে,

    মেঘের আঁচলে লুকায় চাঁদ ঐ গগনে।

    আপনার কবিতা সব সময়েই আমার খুব প্রিয়। ভাল থাকুন সবসময়।

    - ঘাস ফুল

    নিঃসঙ্গতার প্রহর শেষে বিষণ্ন এই মন,

    একাকিত্ব ভুলে নেয় রোদের আলিঙ্গন।  

    অন্ত্যমিলের কবিতা অনেকদিন হল পড়া হয় না। গদ্য কবিতার ছড়াছড়ি। অনেক ভালো লাগলো কালপুরুষ দা। 

    Load more comments...