শ্রাবনের সকাল। সারারাত মুষল ধারে বৃষ্টি হয়েছে। এখনও বৃষ্টি জাবর কাটছে। মেঘের ফাক গলে চিকন র্সুযালোক উকি দিয়েছে। বৃষ্টিস্নাত গাছের পাতায় ভেজা রোদের খেলা। ছাদের র্কানিশ থেকে জমানো বৃষ্টির পানি পড়ছে টবের গোড়ায়, টপাশ, টপাশ।
শমরিতার বহুদিনের সাথী তার বিছানা। ডান কাত হয়ে শুয়ে বারান্দায় বৃষ্টির ফোটা পড়ার দৃশ্য দেখছে। বহুদিন হয় বিছানা ছাড়তে পারেনা শমরিতা। অথচ এক সময়কত জায়গায়তেই না ঘুরে বেড়িয়েছে। এখন সবই অতীত কাল। বিছানা ছেড়ে আর উঠতে পারবেনা। মরন ব্যধিতে আক্রান্ত শমরিতার ডাক্তারের বেধে দেয়া সময়ের আজই শেষদিন। এতে সে মোটেও ভীত নয় কেননা এভাবে বেচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো।
কাকতালীয় ভাবে আজ তার জন্মদিনও। তাই বাসায় জন্ম দিন পালনের আয়োজন করা হচ্ছে। সকাল থেকেই লোকজনের আনা গোনা শুরু হয়ে গেছে। একে একে বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থার লোকজন আসছে আর শমরিতাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। আজ বাড়ী র্ভতি মানুষের কোলাহল থাকবে। এর পর সবাই চলে যাবে। বাড়িটার মত সে নিজেও নিরব হয়ে যাবে। এমনিতেও সে একাই থাকে। আলিশান বাড়িটিতে মানুষ বলতে দুজন কাজের লোক আর শমরিতা। বিশাল বাড়িটা সারাক্ষনই শুন্যতায় খা খা করে। অভাব নেই অর্থের, প্রার্চুযের তেমনি অভাব নেই গুন গ্রাহীর। আজকের এই কোলাহলের মাঝেও একজনের কথা তার মনে হয়। মনের অজান্তে বোধোদয় ঘটে আসলেই কি সবাই এত আপনজন? চারিদিকে এত আয়োজন, আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু আন্তরিকতা কোথায়? সে একজনের কাছেই ছিল। পেয়ে হারিয়ে ফেলার একটা অস্ফুষ্ট চাপা কষ্ট অনুভুত হয়। কাপড় নিংড়ানো জলের মতো এক ফোঁটা জল চোখের গল বেয়ে বালিশে এসে নামে।
আজ থেকে তিরিশ বছর আগে শাহেদের সাথে বিয়ে হয় শমরিতার। দুজন একসাথে অর্নাস করে মার্ষ্টাস করেছিল। এরপর নিজেদের পছন্দের বিয়ে। নাটকের গল্পের মতই কাটছিল দিন গুলো। ছিন্নমুল শাহেদকে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিল না শমরিতার বাবা। আবার শমরিতাকে নিয়ে গ্রামেও যেতে পারছেনা তার অসম্মতির কারনে। ভালবাসার গল্পে শুরুটা ভালই থাকে। চমকপ্রদ উপাখ্যান রচিত হয় ভালবাসার প্রাসাদের চার দেয়ালে। একসময় সেই উপাখ্যান গুলো মুছে যেতে থাকে নয়ত ঢেকে যেতে থাকে ধুলোর আস্তরনে। তাদেরও হয়েছিল তাই। অল্প আয়ের শাহেদের সাথে কোন ভাবেই চলতে পারছিলনা বিলাসী পরিবারের মেয়ে শমরিতা। তাই বছর ঘুরতেই ভাঙ্গনের সুর। ঘরের ভেতরে অভাব আর অভাব, আর বাইরে আলোকজ্জল পৃথিবী। পরাজিত হয় শাহেদ। মেনে নিতে হয় শাহেদকে শমরিতার জীবন যাপন। কারন আয়টা যে তারই বেশী। এভাবে চলে না শাহেদের। কিছুতেই বুঝাতে পারেনি শমরিতাকে। একসময় নিয়তির কাছে পরাজিত হয়ে শাহেদ ফিরে যায় গ্রামে।
শমরিতা পেয়ে যায় র্পুন স্বাধীনতা। আগের চাকুরীটা বদলে পেয়ে যায় আরো ভাল চাকুরী। এরপর আর চাকুরী লাগেনা। যেখানে শমরিতা পা রাথে সেখানেই তার জয়। পৃথিবীর তাবত জটিল ফাইল গুলির লাল ফিতা খুলে যায় তার চোথের ইশারায়। বিনিময়ে শুধু অর্থ আর অর্থ। শত নয় হাজার নয়। লাখের পাল বাতাসে দুলে। সেই সাথে শমরিতা।
একসময় নিজেকে আবিস্কার করে বারবনিতা হিসেবে। র্পাথক্য একটাই ফুটপাতে খদ্দেরের জন্য দাড়িয়ে থাকতে হয়না। কেউ কিছু বলার সাহস নেই। তার জন্য লেন্সার কিংবা র্মাসিডিস গাড়ি বাড়ির সামনে লাইন ধরে। তার পায়ের কাছে গড়াগড়ি খায় কত অর্থ আর বিত্তশালি পুরুষ। একজন অর্থহীন মানুষকে ত্যাগ করে কত অর্থবানের সাক্ষাত ঘটেছে এটা সে নিজেও হিসেব করে বলতে পারবেনা।
এভাবে চলে টানা বিশ বছর। সে হয়ে যায় কোটিপতিদের একজন। একসময় নিজের ভেতরের আসল পরিচয়টা পেয়ে যায়। তাকে জড়াতে হয় নানা সংগঠনের সাথে। আপাত তাবত সামাজিক মহত কাজ গুলিতে তার সরব উপস্তিতি। একসময় এইডস বিষয়ক সংগঠনের র্সবোচ্চপদের অধিকারী হয় শমরিতা। ততক্ষনে নিজেও তা ধারন করে আছে। এই টুকু সে বুঝতে পারে মুখে যাই বলুক না কেন মনের কথা তা নয়। একজন এইডস রোগী চায় অন্যেরাও আক্রান্ত হোক। এটাও একটা নেশার মত। তার উপর তাকে সংখ্যা বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। কারন উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক রোগী না হলে সংগঠন চলেনা। ফান্ড আসেনা। তার র্কম সে ঠিকই পালন করে। আর এইভাবেই সমাজের চোখে অনেক বড় মহান নেত্রীতে পরিনত হয় শমরিতা।
সুর্দশিনী শমরিতার আজ সেই রুপ নেই। তার বাড়ীর নিচে সেই গাড়ি গুলোর লাইন নেই। গাড়ি গুলো হয়ত অন্য কোথাও লাইন লাগিয়েছে। তবে এখন আসে অন্য রকম গাড়ী। অন্য রকম মানুষ। বিভিন্ন র্কপোরেট কোম্পানী র্মাকেটিং অফিসাররা। তার মহানর্কমের প্রতিদান হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্টানের দেয়া অসংখ্য পদক শোভা পাচ্ছেতার শোকেসে। যার সবকিছুই এখন অর্থহীন অর্থব মনে হচ্ছে।
আজ বহুদিন পর শাহেদের কথা মনে পড়ছে। আরো মনে পড়েছে দশ বছর আগের একটি ঘটনা। বিশ্ব এইডস সম্মেলনে গিয়েছিল একজন মন্ত্রীর সাথে। সেখান থেকে ফিরে আসার পর তার ভেতরে নুতন প্রানের অস্তিত্ব অনুভব করে। মন্ত্রীকে বিষয়টা জানিয়েছিল। বিনিময়ে যা শুনেছে এর পর আর কোন দিন বলার সাহস পায়নি। এক সময় সেই প্রান এই পৃথিবীর আলো দেখে। কিন্ত তাকে সাথে রাখতে পারেনি। বিদেশে তার বোনের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পাথরে বুক বেধে আজ র্পযন্ত তাকে নিজের পরিচয় দিতে পারেনি। আর দেয়ার সময়ও পাবেনা। সেই মেয়েটার কথাও আজ মনে পড়ছে।
মনে পড়ছে কি হবার কথা ছিল আর কি হয়েছে? শাহেদকে নিয়ে সুন্দর সচ্ছল জীবনের স্বপ্ন দেখেছিল। স্বচ্চলতা ঠিকই এসেছে কিন্তু তার শাহেদ নেই। নেই কোন সংসার। সেদিন যদি শাহেদের ভাল আয় হতো তাহলে তাকে আর আজকের এই অবস্থানে আসতে হতোনা। মৃত্যুকালে অন্তত একজন আপন মানুষকে কাছে পাওয়া যেত। প্রগতিশীল আজকের সমাজ ডজন ডজন শমরিতাকে সোনায় মুড়িয়ে দিতে পারে কিন্তু শমরিতাদের সংসারটাকে বাচিয়ে রাখার জন্য শাহেদদেরকে কোন কাজ দিতে পারেনা। প্রতি পদে শমরিতারা ভন্ডামির নানা আয়োজন দেখে। নিজেরা গিনিপিগ হয়। একসময় আটকে যায় জালে। আর বের হয়ে আসতে পারেনা।
তথাকথিত প্রগতির তোড়ে ভালবাসার বন্ধন যৌথ সংসার গুলি ভেঙ্গে একক করে দিয়েছে। আর এখন একক থেকে একজনই এক পরিবার। চারিদিকে আনুষ্টানিকতা আর জৌলুস। হৃদয় মরে যায় পাথরের আঘাতে। জীবন সেই কবে পিচ ঢালা পথে মিশে গেছে বুলডোজারের কঠিন চাপে।
নারী উন্নতির মহান বানী বহুবার শুনেছে। এখন নিয়ত নিজেই দিয়ে চলেছে। সমাজে খারাপ ছাড়া ভাল কোন পরির্বতন হয়েছে কি কিছু? হয়নি। কারন গোড়া কাটা হয়ে গেছে অনেক আগেই। আগায় পানি ঢেলে লাভ নেই। আজ শমরিতারা পলে পলে অনুভব করে ভুলটা কোথায় হয়েছিল, কোথা থেকে ভুলের শুরু আর কোথায় গিয়ে শেষ হয়। আজ তাদের অনেক সন্মান কিন্তু মনের কোনে বারবার উকি দেয় আসলেই কি সন্মানের উপযুক্ত।
নানা অনুষ্টানের মধ্যে দিয়ে শমরিতার জন্মানুষ্টান পালিত হয়েছে। র্দীঘ আলোচনা হয়েছে তার জীবনের মহত র্কমগুলি নিয়ে। বুদ্ধিজীবিরা তার মত একজন মহীয়সির নারীর জন্য র্গব বোধ করেন। তাদের আলোচনা শেষে আবারো পদক জুটে অস্তগামী র্সুযের সাথী শমরিতার।
বিজ্ঞান আজ মানুষের জন্ম মৃত্যুও র্নিধারন করছে। যেমন করা আছে তার। তাই আজ শমরিতার মৃত্যু হবে। তাকে আইসিইউতে নেয়া হলো। ডাক্তাররা বোর্ডে বসলেন। তাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে বাচিয়ে রাখা হয়েছে। গভীর রাতে যথারীতি তাকে মৃত ঘোষনা করলেন ডাক্তার। পত্রিকার সাংবাদিকরা একটা গুরুত্ব র্পুন নিউজের জন্য হাসপাতালে বসে রইল।
পরদিন পত্রিকাগুলো লিড নিউজ ছাপল। একজন মহীয়সী নারীর প্রস্থান। বুদ্ধিজীবিদের কলমের ডগা দিয়ে বের হয়ে আসল শমরিতার জীবনালেখ্য। শমরিতা এখন লাশ, হিমাগারে রক্ষিত গবেষনার জন্য, র্কপোরেটদের স্মৃতিতে আর বেঁচে আছে কাগজের পাতায় কালো কালির ছাপানো অক্ষরে।
Comments (14)
বা
সুন্দর ভাবনার কবিতা
অভিনন্দন-------
কবিতা পড়ে আপনি কি চমকে উঠলেন নাকি আলমগির ভাই ।
চীর্ণ না চূর্ণ হবে
লিখে যাও অবিরত
এক কথায় ধন্যবাদ । তাও আবার এক ডজন
সুন্দর লিখা। কবিতায় ভাল লাগা জানাই। বানানটি ঠিক করে নিন।