Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

তাহমিদুর রহমান

১০ বছর আগে

গণতন্ত্র

ঘটনাটা শুরু হয়েছিল খুব সাধারণভাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ প্রান্তে থাকা টগবগে তরুণ কবিরদের সংসার চলে মূলত বিদেশে অবস্থানরত তার বাবার পাঠানো টাকায়। তাদের বলতে সে, তার মা এবং বোন। মাকে অনেক বলে কয়ে নিজের জন্যে একটা মোটর সাইকেল কিনে ফেলেছিল সে। সেই মোটর সাইকেল নিয়ে বৈশাখের এক সকালে বাসা থেকে ঘুরতে বের হয়েছিল। সদ্য মোটর সাইকেল হাতে পেলে ওর মত যুবক সেটা উড়োজাহাজ বানিয়ে ফেলে এবং কবিরও তা থেকে ব্যতিক্রম ছিল না। এই সকালেও সে ফোর্থ গিয়ারে বিদ্যুৎ গতিতে লিংক রোড দিয়ে শহরের মধ্যে যাচ্ছিল। লিংক রোড শেষ হবার পরেই যে পুলিশ চেক পোস্ট আছে সেখানে পুলিশের কাছে বাধা পেল এবং দাড়াতে বাধ্য হল। পুলিশটি প্রথমে তার নাম ধাম, কি করে জিজ্ঞাসা করে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখতে চাইল। সবকিছু ঠিকঠাক পেয়েও পুলিশ একশ টাকা বখশিশ চেয়ে বসল। সে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তার গালে একটা থাবড়া বসিয়ে দিল পুলিশটি। সে বাপের একমাত্র ছেলে হওয়ায় তেমনভাবে মার খাইনি কোনদিন তাই তার চোখে আগুনের বদলে পানি জমে গেল। এই ঘটনা ঘটার পর সোজা বাসায় ফেরত গিয়ে সারাদিন দরজা বন্ধ করে সে কেঁদেছে। সে নিজেকে যতবার বুঝিয়েছে সে পুরুষ মানুষ, পুরুষ মানুষদের কাঁদতে নেই ততবারই তার চোখে আরও বেশি করে পানি জমে উঠেছে। সন্ধ্যার কিছু পরে ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়ার পাঁচ ছয় সেকেন্ড পর মায়ের চিৎকারে ঘর থেকে বের হয়ে এল। ওর মা রান্নাঘরে ছিল, কারেন্ট যাওয়ার পর অন্ধকারে হাঁটতে গিয়ে বটির উপর পা পড়ে যায় এবং তারপর টাল সামলাতে না পেরে জ্বলন্ত গ্যাসের চুলার মধ্যে হাত। সে রাতটা ওদের জন্যে ছিল বিভীষিকাময় রাত।

প্রায় এক সপ্তাহ কবিরের মা হাসপাতালে ভর্তি থাকল। এর মাঝে কবির অনেক ভেবেছে তারপর হঠাৎ খেয়াল বসেই ফেসবুকে “Save the People” নামে একটা গ্রুপ খুলে ফেলল। ইনফরমেশনে লিখল, “Nobody can go back and start a new beginning, but anyone can start today and make a new ending. So we need revolutions. Only the revolution is an abrupt change in the form of misgovernment.”

প্রথমে কবিরের বয়সী তরুণরাই এই গ্রুপের প্রাণ হয়ে উঠল। তাদের মধ্যকার ক্ষোভ জমা হতে লাগল গ্রুপটির ওয়ালে। এদিকে কবিরের মা আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই রাতে যেখানে ক্ষত ছিল সেখানে ইনফেকশন দেখা দিয়েছে। প্রায় দু’মাস ধরে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় না, মাকে নিয়েই সে দৌড়াদৌড়ি করছে। আবারো মাকে হাসপাতালে ভর্তি করে সে। ভর্তি করার পাঁচ দিন পর এক বিকেলে হাসপাতালে বসে মায়ের সাথে কথা বলে সে,

-মা এখন কেমন আছ?

-ভাল আছি বাবা। তোর শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে কেন?

শরীর যে শুকিয়ে গিয়েছে কবির তা ভালমতই জানে কিন্তু সে সেই প্রশ্নের ধারে কাছেও গেল না বরং তেজের সাথে মায়ের কাছে জানতে চায়,

-মা, আমার মনে হচ্ছে তুমি ভাল নেই। তুমি কি সত্যিই ভাল আছ?

-কেন তোর এরকম মনে হচ্ছে কেন?

-মনে হচ্ছে কেন জানিনা। সমস্যা হলে আমাকে খুলে বল, আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে দেখব।

-ডাক্তারের কথা বাদ দে, সে তো প্রতিদিনই দেখে যাচ্ছে।

একটু চুপ থেকে কবিরের মা কবিরকে জিজ্ঞেস করে,

-তোর বাবাকে জানিয়েছিস?

-হুম জানিয়েছি।

-কি বলেছে?

-কি বলবে? জানিয়েছে পরের মাসে আসবে।

সে রাগে মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেয়।  

-বাবার উপর রাগ করিস না। অন্য দেশে সে কত কষ্টেই না আছে, সেখান থেকে কি আর এত সহজে আসা যায়?

কবির উত্তর দেয় না। ঘর থেকে বাহির হয়ে হাসপাতালের বাইরে চলে আসে।

 

 

ফেসবুক গ্রুপটার সদস্য সংখ্যা ইতিমধ্যে হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। ম্যাসেজ দেওয়া নেওয়ার মাঝে অনেকের সাথে অনেকেরই ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে। এই বন্ধুত্ব কোন সাধারণ বন্ধুত্ব নয়, এই বন্ধুত্বের মধ্যে ছিল হাজারটা আবেগ। আবেগগুলো এখন সংঘবদ্ধ হতে চাইছে, চাইছে ভার্চুয়াল জগত থেকে বাস্তবে রূপ নিতে। কবির একটা মিটিং প্রস্তাব করে বসল এবং সানন্দে সবাই তা গ্রহণও করল। সে তাই গ্রুপে একটা ইভেন্ট খুলে দিল মিটিং উপলক্ষে। তারপর ইভেন্টের ইনফরমেশনে লিখল “এস কমরেড”।

ইভেন্টের সময় যতই এগিয়ে আসে ততই কবির উত্তেজনাবোধ করে। সেখানে কি কি বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে তারও একটা লিস্ট বানায়। বার বার সেই লিস্টে কাটাকাটি চলতে থাকে, কোন কিছু বাদ পড়ল কিনা।

কবির তাদের নির্বাচিত নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পৌঁছে গেল। অযথায় নিজের ভিতরে এক ধরণের অস্থিরতাবোধ করে এবং সময়ের সাথে সাথে তার মধ্যে অস্থিরতা আরো বাড়তে থাকে। কিন্তু আধ ঘন্টা যায়, এক ঘন্টা যায় তবু কাউকে দেখতে না পেয়ে বাস্তবিকই সে খুব হতাশ হয়। মিটিং এর সময় দেওয়া ছিল বিকেল পাঁচটা কিন্তু ছয়টা পার হয়ে গেলেও “Save The People” এর কোন সদস্যকে দেখা গেল না। ঘড়ির কাঁটা যখন সাতটা ছুঁইছুঁই করছে তখন ফিরে যাবে বলে মনস্থির করল। ঠিক তখনই দুজন ছেলেকে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতে দেখল। সে নিজে থেকেই এগিয়ে গেল তাদের দিকে,

-আপনারা কি “Save The People” এর সদস্য?

দুইজন তরুণের মাঝে যার নাম কামরুল সে কথা বলে উঠল,

-আপনি নিশ্চয় কবির?

-জ্বী আমিই কবির।

কবির দুজনের সাথে হ্যান্ডশেক করে। কিছুক্ষনের মাঝেই তিনজনেই আলোচনা শুরু হয়ে যায়। মনেই হয় না ওরা কিছুক্ষন আগেই ভার্চুয়ালি নয় ফেস টু ফেস পরিচিত হয়েছে। এরপর সময়ের সাথে তাদের সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। যারা দেরি করে এসেছে তারা সরাসরি সবার উদ্দেশ্যে ক্ষমা চেয়ে নেয়। কেউ অফিস ছিল বা রাস্তায় জ্যাম ছিল বলে অজুহাত দেয় না। তাদের আলোচনা তুখোড়ভাবে চলতে থাকে। আলোচনার বিষয় এক এক করে ঘুরতে থাকে। রাজনীতি, দুর্নীতি, অত্যাচার, বেকারত্ব, দারিদ্র এমনকি ক্রিকেট খেলা নিয়েও তাদের আলোচনা হল চা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে। যখন তাদের আলোচনা শেষ হল তখন বুঝা যায় তাদের বন্ধুত্ব আরো দৃঢ় হয়েছে। সবাই একসাথে লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রতিজ্ঞা করে।

 

 

অফিসে এসেই বিরক্তিতে মন ভরে যায় জাহিদের। সে একটা টেলিকম কোম্পানীতে চাকরি করে। কিছুদিন হল সরকার থেকে ফেসবুক সাইট বন্ধ করে রেখেছে। একে তো অফিসে অনেক আগে থেকেই ফেসবুক ব্লক করে দেওয়া হয়েছে, মাঝে মাঝে অনলাইনে একটু ঘোরাঘুরি করে বেড়াত তারও উপায় রইল না। ইউটুউব, গুগল, ট্যুইটার সবই বন্ধ করে দিয়েছে সরকার এবং সে যে টেলিকমের হয়ে চাকরি করছে তার নেটওয়ার্কও ডাউন করে দিতে বাধ্য করা হয়েছে। সে দৈনিক পত্রিকাগুলোর অনলাইন ভার্সন খুলে বসে। পত্রিকাগুলোর আজকের খবর এরকম,

 

“Save The People এখন শুধুই একটি গ্রুপ নয় এটি এখন জনসাধারনের দাবী আদায়ের পথ।”

“শুধু তরুণরাই নয়, হাজার হাজার সাধারণ মানুষ এখন Save The People এর কাতারে।”

“ফেসবুকের পর এবার বিভিন্ন ওয়েবসাইট ব্যবহার করছে Save The People এর সদস্যরা।”

“নতুন বাবা তার কন্যার নাম রাখলেন ফেসবুক।”

 

জাহিদ কেন জানি নিজের ভেতর থেকেই আন্দোলনের ডাক পায়। অন্য সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করে Save The People এর কিছু ওয়েব সাইট বের করতে সমর্থ হয়। সেইসব ওয়েবসাইটে যোগাযোগের মাধ্যম বের করে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল।

 

পরেরদিন অফিসে এসে আবারো দৈনিক পত্রিকাগুলোর অনলাইন ভার্সন খুলে বসে। বিক্ষোভ এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আজকের সংবাদ শিরোনামগুলো এরকম,

 

“বিক্ষোভে পুলিশি বাঁধা, কাঁদানে গ্যাস। এরপর কি বুলেট?”

“এক যুবকের শরীরে আগুন ধরিয়ে আত্নহত্যা করার চেষ্টা।”

 

আজ জাহিদ তার মেইলের উত্তর পেয়েছে। তার ভাবনাটা বিদ্রোহীদের কাজে লাগবে বলে জানিয়েছে। ও তাদের দুটি বিষয় জানিয়েছিল,

১। সরকার মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে রেখেছে, কখন ইন্টারনেটের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় তার ঠিক নেই। তার কিছু বন্ধু আছে যারা কয়েকটি বিদেশি ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানীতে চাকরি করে। ও বললে নিশ্চয় ওরা এগিয়ে আসবে। যদি তারা বিনামূল্যে আমাদের এক্সেস কোড আর টেলিফোন নাম্বার দেয় তবে সেটা দিয়ে ডায়াল আপ ইন্টারনেট কানেকশন পাওয়া যাবে।

২।ভয়েস মেইল সিস্টেম ব্যবহার করা যায়। সরকার ল্যান্ডফোন বন্ধ করবে বলে মনে হয় না। যদি না করে তবে কেউ একজন যদি একটা নির্দিষ্ট নাম্বারে ফোন করে ভয়েস মেইল রাখে তবে তা সঙ্গে সঙ্গে সেটা টেক্সটে পরিণত হয়ে ট্যুইট হয়ে যাবে। ফলে বিশ্বের যে কেউ তখন ঐ নাম্বারে ফোন করলে ভয়েসমেইলটা শুনতে পাবে। এটিও তথ্য আদান-প্রদানের একটা মাধ্যম হতে পারে।

 

ওর মেইলের উত্তর পড়তে পড়তে তার নিঃশ্বাস ভারি হতে থাকে। তাকে “Save The People” এর সদস্য হওয়ার জন্যে আহবান জানানো হয়েছে। সে মেইলের আবারো উত্তর দেয়। কিছুক্ষন পরে ব্রাউজারে পেজ লোড না হলে তার বুঝতে বাকি রইল না তার ধারনা সত্যি হয়েছে। সরকার থেকে ইন্টারনেট যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

 

পরিশিষ্ট

 

সরকার বিরোধী এই আন্দোলনে নেমেছিল সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রযুক্তিবিদ, ডাক্তারসহ আরো অনেকে। বাংলাদেশে আরেকবার গণতন্ত্র সূচিত হল পরের বছরের বৈশাখের এক রৌদ্রজ্জ্বল দিনে। তবু প্রশ্ন আসে, গণতন্ত্র কি এবার সফল হবে? এবার কি  আমরা পারব সাধারণ মানূষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে? পারব কি মিথ্যার আশ্রয় না নিয়ে ঘরে ঘরে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, গ্যাস দিতে? "Save The People" এর সদস্যরা অনেকেই বেঁচে নেই। তাদের সম্মানে একমাস ধরে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে।   

১ Likes ১০ Comments ০ Share ৬৮৭ Views

Comments (10)

  • - মরুভূমির জলদস্যু

    দেশ নিয়ে ভাবাভাবির কিছু নেই। আমরা রসিক জাতি। যে কোন কিছু নিয়ে আমাদের রসিকতা করার অভ্যাস আছে।

     

    খাঁটি কথা বলছেন দাদা খাঁটি কথা।

    • - আহমেদ ইশতিয়াক

      ধন্যবাদ দস্যু ভাই...

    - লুৎফুর রহমান পাশা

    এর শেষ কোথায়। আমাদের দেশের এই অবস্থার অবসান ঘটবে কবে।

    কেউ জানেনা উড়ছি কেনো?

    যাচ্ছি কতদুর।

     

    • - আহমেদ ইশতিয়াক

    - শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

    দেশ নিয়ে ভাবতে হবে। ভেবে কোন লাভ হচ্ছে না। রাজনীতিতে ঠ্যাটামী চলছে।

    • - আহমেদ ইশতিয়াক

      আসলেই ...

    Load more comments...