Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

আহমেদ নীল

১০ বছর আগে

ক্ষীণতোয়া

শ্রীকৃষ্ণদী। কোন চিত্রকরের কল্পনায় যত সুন্দর করে আঁকা যায় তার চেয়েও শতগুন সুন্দর  এই গ্রাম।আর এই স্বপ্নীল গাঁয়ের অনেক গুলো অভাবী সংসারের একটি হল কালুদের সংসার। উঠানের এক কোনে তার ছোট বোন কানের লতিতে হাত দিয়ে ফোপাচ্ছে। কিছুদূরে তার মা অল্প কিছু টাকি মাছ কচলাচ্ছে। কালুহাতে একটি দা নিয়ে সামনের তালগাছটাকে এলোপাথাড়ি  কুপিয়ে যাচ্ছে আর অশ্লীল যত রকমের ভাষা আছে তা ঝেড়ে দিচ্ছে ঐ ছেলেটির দিকে যে কিনা তার বোনের কানের লতি ছিদ্রকরে দিয়েছে। আর ঘরের এক কোনায় ঝিম মেরে আফিম খোরের মত বসে আছে কালুর বাবা, লস্কর মির্জা। ছয় ফুট উচ্চতা আর গায়ের রং কুঁচকুচে কালো। এক সময় বেশ ঝাঁঝ ছিল তার।  গ্রামে জমিজমা নিয়ে প্রায়ই মারামারি হতো। সে সব সময় তালুকদারদের পক্ষ নিয়ে মাঠে নামতো আর প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করত তার হুঁকার আর লাঠি চলতো সমান তালে। এই বিবাদের দিন ছাড়া কেউ কোনদিন তার উচুগলার আওয়াজ শোনেনি। এমনিতে সবাই তাকে সমীহ করত। ছোট ছেলে-মেয়েরো তাকে দেখে দৌড়ে পালাত কিন্তু তার ভাই আজগর মির্জা ছিল ঠিক তার উল্টো। দৈহিক গঠন তার মত হলেও আচরণ ছিল ঠিক তার বিপরীত। আশেপাশের চৌদ্দ গ্রামের সবাই তাকে আজগর ডাকুনামে চিনত। তার পরিণতিকেমনহবে, সুখকর হবে? না মোটেই না, তার পরিণতি ভয়ানক। দিনে দিনে সে বেশি উগ্রহয়ে উঠছিল। হরিদেসদি গ্রামের ওহাব মল্লকিদের বাড়িতে এক রাতে ডাকাতি করতে যায় সে;সোনা-দানা ,টাকা-পয়সা ডাকাতি করেও শান্ত হল না, আজগর মল্লিকের নতুন বিয়ে করা বউকেও তুলে নিয়ে এলো। আর বাড়ির পেছনের বড় তেঁতুল গাছটার নিচে নতুন বউয়ের সব স্বপ্ন ছিড়ে ফেলল তার শাড়ি-ব্লাউজরে সাথে। ওহাব মল্লকি  ধুরন্ধর ব্যাক্তি। শহর থেকে পাঁচজন পেশাদার খুনিকে নিয়ে খালাস করলো আজগরকে।

যদিও তার নতুন বউকে তালাক দিয়ে আবার নতুন বর সেজেছিল সে। সে নির্মম কাহিনী আর কেউ মনে করে না,আর ভাবেও না সেই নিষ্পাপ, নির্দোষ,সরল পুতুলের মত সুন্দরী বউয়ের ভাগ্যে কি ঘটেছিল।

যাই হোক সেই ঘটনার পর লস্কর মির্জার জীবনে আরও একটি র্দুঘটনা ঘটেছিল। তার বিয়োগ ঘটেছিল দুই মাস পর। আত্মঘাতিনী হয়েছিল সে। এই নিয়েও গ্রামে অনেক কথা উঠেছিল। সবাই সুর তুলেছিল আজগরের সাথে তার বউয়ের পরকীয়া চলছিল। তাই আজগর এর মৃত্যুতে দুঃখ  পেয়ে তার বউ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে।তার পর থেকেই লস্করের দেহ আর মন দুটিই কুঁকড়ে যায়।নতুন করে বিয়ে করে পাঁচ বছর পর।কালু আর ছোট মেয়েটি  লস্কর মির্জার দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান।এখন সে নির্জীব মাকড়শার বদলে ফেলা খোলসের মত।শরীরের মাঝখানে ভাঁজ পরে গেছে আর বড় বড় চোখ দুটো যেন তিনভাগের দুই ভাগই গর্তে। দুই গ্রাম দূরে গিয়ে সে ভিক্ষা করে আর তার বউ পরের বাড়িতে কাজ করে যা পায় তাতেই তাদের সংসার চলে,যেমন চলে দুই তিন  মিনিট পরপর চেইন পরে যাওয়া তিন চাকার ভ্যান। মেয়েটা নরম স্বভাবরে। কিন্তু ছেলে কালুকে নিয়েই তার যত চিন্তা।এই ছেলের দৈহিক গঠন আর আচরণ দুটোই যেন তার ভাই আজগরের মত।বয়স ১২ হবে আগামী কার্তিকে।দৈহিক গঠনের কারণে তাকে মনে হয় ২২ বছরের যুবা। কুচকুচে কালো হাত দিয়ে শান দেয়া দা টা ধরলো,মনে হয় যেন আজগর ডাকাত নতুন করে ফিরে এসেছে।

কালুর  মা মাছ ধোয়া শেষ করেই ছেলের কাছে এলো। বাঁ’পাতে পোলিও রোগ তার,তাই তার হাঁটতে হয় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।বাঁ দিকে বারে বারে দোল দিতে দিতে পৌঁছা মাত্রই দুরুম করে একটা কিল বসালো কালুর মাঝ পিঠ বরাবর।হঠাৎ মার খেয়ে পিছিয়ে গিয়ে ক্রন্দনরত কন্ঠে মায়ের প্রতি অশ্রাব্য  শব্দ ব্যবহার শুরু করলো।“মারানির জি মারানি,তুই আমারে মারস ক্যান।” ঘরের ভিতর থেকে পুরাতন হুক্কার নলের সুরেলস্কর মির্জাও বলে উঠলো “বান্দির বাচ্চা,ছেলানির ছাউ,তুই আবার আমার পোলার গাঁয়েহাত উডাইছস।” স্বামীর কাছ থেকে এমন অকথ্য ভাষা শোনার জন্য প্রস্তুত  ছিল না আমেনা।ডুকরে কেঁদে  উঠলো আর রাগে গজ গজ করতে করতে মাছের পাতিলটা আছড়ে মাটিতে ফেলে দিল।আর পাশের ঘরের সবাইকে শুনিয়ে বলতে থাকলো-“দেহ তোমরা... আমি এই তাজা বয়সেও এই বুইরার  যতন করতাছি, ওর কাশটাও আমি দুই  আত দিয়া মুইছা দেই।আর এই গোলামের পুত গোলামে আমারে জাতপাত তুইল্লা গালি দেয়। থাক তুই তোর সোনার পোলা-মাইয়া লইয়া। আমি আর তোর গর করমু না। দরকার অইলে কলাগাছ বিয়া করমু।” অনিচ্ছা সত্ত্বেও রোগাক্রান্ত জিরাফ যেমন গর্ত থেকে উঠে, তেমনি উঠে দাড়ালেো লস্কর। দরজার সামনে এসে দাড়াল। ফেলে দেওয়া মাটির পাতিলটি ভেঙ্গে চৌঁচির।

আসমার এখনও কানে হাত। রক্ত পরা বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। কিন্তুপুনরায় লাল রঙের তরল পদার্থে আবার তার মুখ  ভরে যেতে পারে  সেই ভয়ে হাত সরাচ্ছে না। বয়স তার সবেমাত্র সাত। কিন্তু বংশগত গঠন ও সাহস সেও পেয়েছে। কারণ অন্য মেয়েরা কখনই ছেলেদের মোরগ লড়াই, লাটিম কিংবা নাট-বল্টু খেলার ধারে কাছেও যায় না। যে কোন সময়ই একটা র্দুঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু সে বরাবরই এই সব খেলা দেখায় অভ্যস্ত। অদ্ভুত এক আনন্দ পায় সে। বিশেষ করে মিন্টু যখন খেলায় অংশ গ্রহনকারী থাকে। আছমার চেয়ে বয়সে চার বা পাঁচ বছরের বড় হবে মিন্টু। সব খেলায়ই ওসদাদ এই মিন্টু। বড় ঘরের ছেলে সাধারণত এমন  ডানপিটে  হয় না। কিন্তুমিন্টু আলাদা। তার লাটিমটি শহর থেকে আনানো। কাঠের না। তবে খুব শক্ত। সে এটাকে বলে লোহা-প্লাষ্টিক। কোন লাটিমের হাল তার এই লোহা-প্লাষ্টিক ছেদ করতে পারবে না। কিন্তু  কোন কারণে আজকে তার এই ধারণা ভ্রান্ত  হয়েছে এবং সে খুবই রাগান্নতি। সে সাই সাই  করে লাটিমের দড়ি পেচাচ্ছিল আর তার প্রতপিক্ষ লাটিমকে আহত করার চেষ্টা করছিল। দুপুররে  রোদে এই রাগান্বতিকিশোরের লাল মুখ খানা দেখতে আসমার বেশ ভালই লাগছিল। হঠাৎ করেই ডাক পড়ল বাড়ি থেকে।একটু অন্যমনষ্ক আর খানিকটা আক্ষপে  নিয়ে সে বাড়ির দিকে আসছিল। খেয়ালই করে নি যে সে ভুল  করে সেই অগ্নি কিশোরের অনেকটা নিকটে আর শান দেওয়া লাটিমের হাল তার কানের লতিতে। ব্যাথায় কাতর হয়ে সে বাড়িতে এসে এখন পর্যন্ত ফোপাচ্ছে।

 একটি টাকিমাছ এখনও ক্ষীণ জীবিত। শুধু তার লেজের নিচের অংশ মাটি থেকে একটু উপড়ে উঠছে আর পতিত হচ্ছে। এইভাবেই এর বেঁচে থাকাটা জানান দিচ্ছে পৃথিবী অথবা ইহার কোন আপনজনকে। মাছগুলোকে মাটিতে দেখেই আবার ক্রোধে ফেটে পড়ল লস্কর মির্জা। আবার কুকিয়ে উঠল “বান্দির ঝি বান্দি ,তুই আমার  পোলা-মাইয়্যার খাওন মাটিতে ফালাইছস। তর তাজা শ্যইলে অনেক তেল অইসে না! সব আইজকা আদা ছেছনি দিয়া বাইর করমু।” আর একটা গোলমেলে পরিবেশ। ইতিমধ্যেই আশেপাশের ঘরগুলো থেকে বাচ্চা-কাচ্চারা ভিড় করেছে। আরও এসেছে কিছু অবিবাহিতা মেয়ে আর মাঝবয়সি মহিলারা। এই হতদরিদ্র পরিবারের ঝগড়া থেকে কিছু রস নেওয়াই যেন এদের উদ্দেশ্য। তৎক্ষণাৎ একটা অন্যরকম ঘটনা ঘটে গেল। কিছু দূরইে  অনেক মানুষরে ভিড় আর আনন্দের চেঁচামেচি শোনা গেল।কালুর মা ও আর সবাইকে একটা আট-নয় বছরের ছেলে চিৎকার দিয়ে বলল “ঐ তোমরা এহনও বাড়িতে কি কর? আলতাফ চৌধুরীর পোলা আশেক চৌধুরী  শহর থনে আইছে।” বলেই সে ছুটতে লাগল। কালু তার মাংশল চোয়াল শক্ত করল এবং দা টা মজবুত করে ধরে ক্ষিপ্র গতিতে একটা দৌড় দিল। পেছন থেকে তার মা বলল “কালু খাড়া ,আমার কথাডা হোন।পরে তোর যা ইচ্ছা করিস। কিন্তু মায়ের এই মিনতি তার কানের কাছে পৌঁছল না।

মুহুর্তেই সে পৌছে গেল ভিড়ের কাছে।দিগন্তেরঅস্তিরতারেখে কালুর অক্ষিদ্বয় আশেক এরদিকে আটকে গেল আর হাজার বছররে ধ্যানকরার মত এক দৃষ্টিতেতাকিয়ে রইল তার দিকে.....।   

(চলবে...)    

২ Likes ৩ Comments ০ Share ৬৫৬ Views

Comments (3)

  • - মাইদুল আলম সিদ্দিকী

    অনন্য

    • - মুন জারিন আলম

      রঙের গায়ে রঙের খেলা

      রঙ চিনিনা  রঙের মেলা

      রঙ ধনুতে কি রঙ থাকে

      কি রঙ থাকে সাঝের বেলা।।

    - কেতন শেখ

    সুন্দর! শুভেচ্ছা রইলো।

    - ব্লগার ভাই