Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

শাহ আজিজ

৭ বছর আগে

কেমন ছিল জমিদার রবীন্দ্রনাথ


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবার নাম মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। স্বভাব-চরিত্রে নাকি অত্যন্ত ভালো লোক ছিলেন বলে লোকে তাকে নামের আগে মহর্ষি শব্দটি জুড়ে দিয়েছে । এই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের চরিত্র কিরূপ ছিল ঠাকুর পরিবারের সদস্য অবনীন্দ্রনাথের মুখ থেকেই শোনা যাক । প্রিন্স দ্বারোকোনাথ ঠাকুরের জমিদারকালীন সময়ের বর্ণনা দিয়ে অবনীন্দ্রনাথ  ঠাকুর “ঘরোয়া” গ্রন্থে লিখেছেনঃ

তখন পরগণা থেকে টাকা আসত কলসিতে করে । কলসিতে করে টাকা এলে পর সে টাকা সব তোড়া বাঁধা হতো । …… কর্তা দাদামশায় তখন বাড়ির ( মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ) বড় ছেলে,মহাসৌখিন তিনি তখন বাড়ির ছেলে। ও বাড়ি থেকে রোজ সকালে একবার করে দ্বারোকানাথ ঠাকুরকে পেন্নাম করতে আসতেন তখনকার দস্তুর ছিল ওই …… তা কর্তা দাদামশায় তো যাচ্ছেন বৈঠকখানায় পেন্নাম করতে- যেখানে তোড়া বাঁধা হচ্ছে সেখানে দিয়েই যেতে হয় । সঙ্গে ছিল হরকরা- তখনকার দিনে হরকরা সঙ্গে সঙ্গে থাকত জরির তকমা পরা, হরকরা সাজের বাহার কত; এই যে এখানে এসেছি তখনকার কালে হলে হরকরাকে ওই পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হত, নিয়ম ছিল তাই । কর্তা দাদামশায় তো বাপকে পেন্নাম করে ফিরে আসছেন । সেই ঘরে যেখানে দেওয়ানজি ও আর আর কর্মচারীরা মিলে টাকার তোড়া ভাগ করছিলেন । এখানে এসে হরকরাকে হুকুন দিলেন- হরকরা দুহাতে দুটো তোড়া নিয়ে চলল বাবুর পিছু পিছু । দিওয়ানজিরা কি বলবেন, বাড়ির বড় ছেলে, চুপ করে তাকিয়ে দেখলেন। এখন হিসেব মেলাতে হবে- দ্বারকানাথ নিজেই হিসাব নিতেন তো ।দুটো তোড়া কম। কি হল ।

আজ্ঞে বড় বাবু………

ও আচ্ছা-

(অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রীমতি রাণীচন্দঃ ঘরোয়া, পৃঃ২৩-২৪)

পরবর্তীতে প্রিন্স দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর এই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে জমিদারী চালিয়েছেন । কিন্তু বুড়ো বয়সে এই বিশাল জমিদারীর দায়িত্ব কোন ছেলের  উপর অর্পণ করবেন তা নিয়ে মহাভাবনায় পড়ে গেলেন। তিনি কবে মারা যান কে জানে ? তিনি ভাবলেন, রবিকে জমিদারীর কাজের মধ্যে না টানতে পারলে আর চলবে না। না হলে এতো বড় জমিদারী সব ছারখার হয়ে যাবে। বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ দার্শনিক মানুষ, বিষয়কর্ম বুঝেও না, দেখেও না। কোনো দিকে খেয়াল নেই তাঁর। হয়তো বলা হলো, জমিদারীতে গিয়ে খাজনা আদায় করে আনো। তিনি গিয়ে প্রজাদের দুঃখে ব্যথিত হয়ে খাজনা মওকুফ করে তো দিলেনই, এমনকি নিজের পকেট থেকে টাকা-পয়সা দিয়ে এলেন তাদের। সতেন্দ্রনাথ সরকারি কাজে আজ এখানে, কাল ওখানে, হয়তো ছুটিতে কেবল দিন কয়েক বাবা- মা আত্মীয়- স্বজনের কাছে কাটিয়ে যান । তাঁর পক্ষে জমিদারী দেখা মোটেই সম্ভব নয়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথেরও সংসারের কাজে টান কম । হেমেন্দ্রনাথ মারা গেছেন; অন্য দুই ছেলে অসুস্থ। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত জমিদারী দেখবার উপযুক্ত আর কোনো ছেলেই তো তাঁর নেই । পাক্কা জহুরীর যেমন খাঁটি স্বর্ণ – হীরে চিনতে কষ্ট হয়না, ঠিক তেমনি পাক্কা জহুরীর ন্যায় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জমিদারী চালানোর জন্য বেছে নেন।

জমিদার রবীন্দ্রনাথ * 

জমিদার রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁরই স্বজাতি অমিতাভ চৌধুরী লিখেছেনঃ

“রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সামন্তবাদী প্রজাপীড়ক জমিদার ছিলেন। তাঁর দফায় দফায় খাজনা বৃদ্ধি এবং জোর-জবরদস্তি করে তা আদায়ের বিরুদ্ধে ইসমাইল মোল্লার নেতৃত্বে শিলাইদহে প্রজা বিদ্রোহ ঘটেছিল।“ (জমিদার রবীন্দ্রনাথ, অমিতাভ চৌধুরী, দেশ, শারদীয় সংখ্যা, কলকাতা ১৪৮২)

রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরের প্রাইভেট সেক্রেটারি অমিয় চক্রবর্তী একবার বিশাল জমিদারীর একটি ক্ষুদ্র অংশ দরিদ্র প্রজাসাধারণের জন্য দান করার প্রস্তাব করেছিলেন । ঠাকুর মশায় ইজি চেয়ারে আধ শোয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসে বলেছিলেন-

‘‘বলো কি হে অমিয় ! আমার রথিন তাহলে খাবে কি ?’’ (অন্নদা শংকর রায়ের রচনা থেকে উদ্ধৃত, রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তাধারা, আবু জাফর, বইঘর, চট্টগ্রাম ১৯৮৫)

একবার না-কি খাজনা মওকুফের ফলে এক লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ।যা রবীন্দ্র ভক্তরা প্রজাদের প্রতি তাঁর মহানুভবতা প্রমাণ করে থাকেন । কিন্তু ১৮৯৪ সালে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে জমিদারীতে খাজনা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন একথা তাঁরা বলেন না। গরীব মুসলমান প্রজারা তাঁর পায়ে পড়লো, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নির্মমভাবে তা আদায় করলেন । পরে সেই বাড়তি আয়ের টাকায় মার্কিন কোম্পানীর কাছ থেকে ডেবরাকোল জমিদারী খরিদ করেছিলেন ।  এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত প্রবন্ধকার শ্রী অরবিন্দু পোদ্দার লিখেছিলেনঃ

“জমিদার জমিদারই । রাজস্ব আদায় ও বৃদ্ধি, প্রজা নির্যাতন ও যথেচ্ছ আচরণের যেসব অস্ত্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার জমিদার শ্রেণীর হাতে তুলে দিয়েছিল, ঠাকুর পরিবার তাঁর সদ্ব্যবহারে কোনও দ্বিধা করেনি। এমনকি জাতীয়তাবাদী হৃদয়াবেগ ঔপনিষদিক ঋষি মন্ত্রের পুনরাবৃত্তি এবং হিন্দু মেলার উদাত্ত আহবানও জমিদার রবীন্দ্রনাথকে তাঁর শ্রেণীস্বার্থ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।“( শ্রী অরবিন্দু পোদ্দার, রবীন্দ্রনাথ ও রাজনৈতিক গ্রন্থ দ্রষ্টব্য)।  

প্রজাপীড়ক  জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ডঃ আহমদ শরীফ পশ্চিম বাংলার ‘স্বাধীন বাংলা’ পত্রিকায় একটি ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন।  এই ইন্টারভিউটি পরবর্তীতে আমাদের দেশের দৈনিক বাংলা বাজার পত্রিকায় দু’কিস্তিতে যথাক্রমে ২৪ এপ্রিল ও ১লা মে ১৯৯৭ পুনঃ প্রকাশিত হয়।

” আমাদের প্রয়োজনেই রবীন্দ্রনাথের যথার্থ মূল্যায়ন প্রয়োজন। তার সুদীর্ঘ আশি বছরের জীবনে কোনও ত্রুটি নেই, এটা কোনও কথা হল। অথচ পাওয়া যায়।অন্নদা শঙ্কর রায় বলছেন, ” শান্তি নিকেতনে” একটি চাকরি পেয়ে তার সরকারী চাকুরী ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ হলেন জমিদার মর্জির, ঠিক নেই কখন আবার চাকরি নষ্ট করে দিলে তার খাবার অভাব হবে। রবীন্দ্রনাথ ইনটলারেন্ট ছিলেন। যে মাস্টার রবীন্দ্রনাথের কথার প্রতিবাদ করতেন তার চাকরি থাকত না।…..রবীন্দ্রনাথের আরো একটি লোভ ছিল পৌরহিত্যের লোভ।”

তিনি আরো বলেন: ” জমিদার হিসেবে ঠাকুর পরিবার ছিল অত্যাচারী। গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল। বুট পরে প্রজাকে লাথি মেরেছেন,পায়ে দলেছেন দেবেন ঠাকুর।এটাই রেকর্ড করেছিল হরিনাশ মজুমদার। যিনি মহর্ষি বলে পরিচিত,  তিনি এ রকমভাবে মানুষকে পদাঘাতে দলিত করেন। গ্রাম জ্বালাবার কথাও আছে। আবুল আহসান চৌধুরীর কাছে এর সমস্ত ডকুমেন্ট আছে। সমগ্র ঠাকুর পরিবার কখনো প্রজার কোনও উপকার করে নাই। স্কুল করা,দীঘি কাটানো এসব কখনো করে নাই। মুসলমান প্রজাদের চিট করার জন্য নমঃশূদ্র প্রজা এনে বসতি স্থাপনের সাম্প্রদায়িক বুদ্ধি রবীন্দ্রনাথের মাথা থেকেই বের হয়েছিল। কাঙাল হরিনাথ মজুমদার তার ‘গ্রাম্য বার্তা প্রকাশিকা’  পত্রিকায় ঠাকুর পরিবারের প্রজা পীড়নেরর কথা লেখে ঠাকুর পরিবারের বিরাগভাজন হয়েছিল।” (দৈনিক বাংলাবাজার, ১৪ এপ্রিল ও ১মে ‘৯৭ দ্রষ্টব্য)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে এরূপ গুরুতর অভিযোগ শুধু ডাঃ আহমদ শরীফই করেননি।  এককালীন আওয়ামী লীগ নেতা জনাব কামরুদ্দীন আহমদ “পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি” গ্রন্থে লিখেছেনঃ

” সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অভাব ছিল সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনেরর দুর্বলতা। কেবলমাত্র  চাঁদার উপর নির্ভর করে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব ছিল না। কাজেই অর্থ সংগ্রহের জন্য এদের অবলম্বন করতে হল ডাকাতির পথ। নানারূপ বাধা-বিঘ্ন সত্বেও অনুশীলন দল প্রায় ত্রিশ বছর ধরে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।……১৯৬০ সালে সন্ত্রাসবাদীদের দ্বিতীয় দল স্থাপিত হয় কলকাতায়।অধ্যাপক অরবিন্দু ঘোষ ও তাঁর ভাই রাবীন্দ্রনাথ ঘোষের নেতৃত্বে।এর নাম হল ‘যুগান্তর’ দল।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এ দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। (কামরুদ্দীন আহমেদ,পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি, পৃ, ৫-৬)
পশ্চিমবঙ্গেরর প্রখ্যাত মার্কসবাদী ঐতিহাসিক ডঃ সুপ্রকাশ রায় দেখিয়েছেন; কিভাবে রবীন্দ্রনাথ ও তার পরিবার গত শতকে এবং এ শতকের প্রথম দিকে অত্যাচারী শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, কিভাবে তারা তাদের জমিদারীতে প্রজা আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করেছিলেন ইংরেজ বেনিয়া গোষ্ঠীর সহযোগীতায়। মানবতার কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিঃস্ব দীন প্রজাকুলের উপর অন্যান্য জমিদারের সাথে পাল্লা দিয়ে কেমন করে ট্যাক্স বাড়িয়ে গেছেন এবং আদায় করেছেন তা আজ কারো অবিদিত নয়।শুধু তাই নয় জমিদারী প্রথার পক্ষে নির্লজ্জভাবে কবি ওকালতি করে তিনি বলেছেন-“জমিদারী উঠে গেলে গাঁয়ের লোকেরা জমি নিয়ে লাঠালাঠি,  কাড়াকাড়ি ও হানাহানি করে মরবে।”

পদ্মার চরের মুসলমান প্রজাদের কাবু করার জন্য নমশূদ্র প্রজা এনে বসতি স্থাপনের সাম্প্রদায়িক বুদ্ধি ও কবির মাথা থেকে এসেছিল। এছাড়া পুত্র রথীন্দ্রনাথের শখের কৃষি খামারের প্রয়োজনে গরীব মুসলমান চাষীর ভিটে মাটি দখল করে তার পরিবর্তে চরের জমি বরাদ্দের মহানুভবতাও (?) কবি দেখিয়েছেন। তিনি দীর্ঘ সাহিত্যচর্চার  জীবনে প্রজাদের নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন ‘দুই বিঘা।’ এ কবিতার একস্থানে বলা হয়েছে:

“এ জগতে হায় সেই বেশী চায়

আছে যার ভুরি ভুরি

রাজার হস্ত করে সমস্ত

কাঙালের ধন চুরি।”

তবুও আমাদের সান্ত্বনা এই যে, উক্ত কবিতায় জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিবাদী বক্তব্য না থাকলেও প্রজাদের জন্য তাঁর আক্ষেপ রয়েছে।  কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘দুই বিঘা’ কবিতা সম্পর্কে যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা হলোঃ

রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘদিন বাংলাদেশেরর প্রধানত তিনটি অঞ্চলের কুঠিবাড়ি থেকে তাঁর জমিদারী পরিচালনা করেন। কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহ, পাবনা জেলার শাহজাদপুর এবং রাজশাহী জেলার পতিসরে তাঁদের জমিদারীর কুঠিবাড়ি ছিল। এখনো তা বিদ্যমান রয়েছে। কবি সবচেয়ে বেশি দিন থেকেছেন শিলাইদহে। এ কুঠিবাড়িতে গেলে স্থানীয় লোকেরা কুঠি সংলগ্ন বাগানের একটি অংশকে দেখিয়ে বলে, ‘ এটাই হচ্ছে উপেনের দুই বিঘা জমি।’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক প্রফেসর ডক্টর কাজী আব্দুল মান্নান “রবীন্দ্রনাথ নজরুল ইসলাম ও অন্যান্য প্রসঙ্গ” গ্রন্থে লিখেছেনঃ

“আমি এবং যশোর শিক্ষা বোর্ডের যোগ্য চেয়ারম্যান মরহুম হারুনুর রশীদ সাহেব প্রায় আঠার বছর আগে (বর্তমানে ৩০ বছর) শিলাইদহের কুঠিবাড়ি দেখতে গিয়াছিলাম। ‘উপেনের জমি কথিত অংশটি লোকজনের সাহায্যে মেপে আমরা আনুমানিক দু’বিঘার মতই হবে বলে দেখতে পাই।জমিটির অবস্থান এমন যে, এটি কুঠিবাড়ির মূল বাগানের সঙ্গে যোগ করার ফলে সমগ্র বাগানটি দৈর্ঘ্য-প্রস্থে সমান আকার লাভ করেছে।”দেখতে পেলাম দুই বিঘে প্রস্থে ও দীর্ঘে সমান হবে টানা”-জমিদার বাবুর উক্তিটির সঙ্গে লোক প্রবাদের মিল আমরা দেখতে পেয়েছিলাম। জমিদার রবীন্দ্রনাথের কোন প্রতাপশালী পূর্বপুরুষ, শিলাইদহের দরিদ্র এবং অসহায় একজন কৃষকের শেষ সম্বলটুকু জমিদারী বাগানের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য হয়ত আত্মসাৎ করেছিলেন। যারা সমাজে সুবিচার পায়না,  যাদের বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে,উপেন তাদেরই একজন।তাঁর বাচনে কবি আমাদের শুনিয়েছেন জমিদারের নিষ্ঠুর অত্যাচারের কাহিনীঃ রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।ভয়ঙ্কর এ সত্যটি উচ্চারিত হয়েছে আর একজন জমিদারের কন্ঠ থেকে। জমিদারের উদ্ধৃত মুখোশকে কলমের খোঁচায় ছিঁড়ে ছরকট করেছেন তথাকথিত অত্যাচারী জমিদার রবীন্দ্রনাথ ‘তুমি মহারাজ,সাধু হলে আজ,আমি আজ চোর বটে।’

“দুই বিঘা” জমি কবিতার রচনা হল ৩১মে জ্যৈষ্ঠ, ১৩০২ সন,১৮৯৫ খৃষ্টাব্দের মে-জুন মাস। এ সময় শিলাইদহে বসেই প্রত্যক্ষভাবে রবীন্দ্রনাথ জমিদারী পরিচালনায় লিপ্ত ছিলেন। ১৩৩৩ সনের আষাঢ় মাসে লিখিত ‘রায়তের কথা’ প্রবন্ধে কবি জমিদারের শোষণের কথা স্পষ্ট করেই বলেন:  “আমি জানি, জমিদার নির্লোভ নয়।তাই রায়তের যেখানে কিছু বাধা আছে জমিদারের আয়ের জালে সেখানে মাছ বেশি আটক পড়ে। (কাজী আব্দুল মান্নান,রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, পৃঃ ১৫৭,১৫৭  ও ২৯৮।)

উল্লেখ্য,শিলাইদহ জমিদারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চার পুরুষের। কাজেই ‘দুই বিঘা ‘জমির ঘটানাটি যে তাঁর পূর্ব পুরুষদেরই সৃষ্টি তা বলাই বাহুল্য। ইংরেজদের নয়া চিরস্থায়ী ব্যবস্থায় হিন্দু জমিদার শ্রেণী হলো বাবু ও ভদ্রলোক এবং মুসলমানরা হলো চাষা।রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর একাধিক প্রবন্ধে ঠিক এই অর্থেই শব্দ দুটির ব্যবহার করেছেন।জমিদার-নন্দন রবীন্দ্রনাথ মুসলমানকে জানতেন রায়ত হিসেবেই, তাঁর কর্তব্য হিন্দু জমিদারদের জন্য আল্লাহরর কাছে দোয়া করা এবং তাদের করুণা ভিক্ষা চাওয়া।শোষিত প্রজারা শোষক জমিদার -মহাজনকে পিতা-মাতা  জ্ঞানে তাদেরই মঙ্গল কামনায় আল্লাহরর কাছে আরাধনা করবে-এই ছিল জমিদার-নন্দনের স্বাভাবিক জীবন দর্শন। তাঁর নিম্নের উক্তিটি লক্ষ্যণীয়- “যখন কোন কৃতজ্ঞ মুসলমান রায়ত তাহার হিন্দু জমিদারের প্রতি আল্লাহর দোয়া প্রার্থনা করে, তখন কি তাহার হিন্দু হৃদয় স্পর্শ করে না।”(আবদুল ওয়াদুদ, মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, পৃঃ ৪১৯)।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশি ভাগ প্রজা ছিলো পূর্ব -বাংলায়। এই পূর্ব -বাংলার মুসলমান প্রজাকুল থেকে খাজনা আদায় করে পশ্চিম – বাংলার কলিকাতায়  শান্তি -নিকেতন, বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।  নোবেল প্রাইজ-এর পুরো অর্থও ব্যয় করেছেন বিশ্ব ভারতীতে। কিন্তু পূর্ব -বাংলার প্রজা -কল্যাণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ছিলো একেবারে মুষ্টিবদ্ধ। রবীন্দ্রনাথেরর এই আদর্শ ছিলো সুবিধাবাদিতা এবং স্বার্থপরতা। যার কারণে স্বদেশী -যুগের নেতৃবৃন্দ তাঁকে কখনোই বিশ্বাস করেননি, এমনকি তাঁকে বিশ্বাসঘাতক বলতেও কুন্ঠাবোধ করেননি।

যারা জমিদার রবীন্দ্রনাথকে ভক্তির আতিশয্যে “আত্মার আত্মীয় ” বলে অভিহিত এবং দেবত্ব আরোপ করেছেন তাদের উদ্দেশ্যে  ‘বিক্রম’- এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব মাসুদ মজুমদার সাপ্তাহিক বিক্রমে ১২-১৮ মে ‘৯৮ সংখ্যায় “রাজনীতির হিং টিং ছট” নিয়মিত কলামে লিখেছেনঃ

……আমাদের দেউলে বুদ্ধিজীবীরা জমিদার রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যখন বেশি মাতামাতি করেন তখন ভাবতে কষ্ট হয় শাহজাদপুর,  শিলাইদহ,  নওগাঁর কুঠিবাড়িতে ‘ক্ষুধিত -পাষাণের’ ভেতর কত না নিপীড়িত প্রজারর আহাজারী লুকিয়ে আছে।পূর্ব-বাংলার কত সম্পদই না ঠাকুর বাড়ির সিন্দুকে জমা পড়েছে।আমি একজন মহান কবিকে শ্রদ্ধা জানাতে চাই। কিন্তু কোন জমিদারের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানাবার প্রশ্নই উঠে না-কারণ পূর্ব-বাংলার গণ-মানুষকে জমিদারী প্রথার নির্মমতা থেকে উদ্ধার করার জন্য শেরে-বাংলার নেতৃত্বে পরিচালিত প্রজাস্বত্ব আন্দোলনের ইতিহাস আমার কাছে রবীন্দ্রনাথের জন্ম দিনের চেয়ে কম প্রোজ্বল নয়।” 

শোষক জমিদারের প্রজা দরদী চরিত্র নির্মাণ * 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯২ সালে শিলাইদহ জমিদারী এষ্টেটের ভার গ্রহণ করেন। ১৯১৩ সালের নভেম্বরে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। এর কিছুদিন পরই তিনি শিলাইদহ জমিদারীরর দায়িত্ব অর্পণ করেন খ্যাতিমান সবুজপত্রের সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীকে। কেননা শিলাইদহের জমিদারী সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ১৯২২ সালে শিলাইদহ ত্যাগ করেন।  রবীন্দ্রনাথ জমিদারী ছাড়া প্রসঙ্গে বলেছেনঃ আমার জন্মগত পেশা জমিদারি, কিন্তু আমার স্বভাবগত পেশা আসমানদারি। এই কারণেই জমিদারির জমি আঁকড়ে থাকতে আমার অন্তরের প্রকৃতি নেই” (রবীন্দ্র রচনাবলী, খন্ড ২৪, পৃঃ ৪২৭)।

কিন্তু প্রজারা রবীন্দ্রনাথের জমিদার সুলভ স্বভাব দেখলেও আসমানদারি স্বভাব দেখার সৌভাগ্য তাদের হয়নি। মুখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রজাদেরকে সন্তানতুল্য বলে আখ্যায়িত করলেও বাস্তব ক্ষেত্রে প্রজাদের আর্থ- সামাজিক উন্নয়নে বা কল্যাণে তার হাত ছিলো একেবারে মুষ্টিবদ্ধ। প্রজাদের মঙ্গলার্থে এমন কোন প্রশংসনীয় কর্মকান্ডের দৃষ্টান্ত রবীন্দ্রনাথের ইতিহাসে নেই। তবে সস্তা জনপ্রিয়তা এবং মানুষকে চমক লাগানোর জন্য অনেক ভালো ভালো,  সুন্দর সুন্দর কিছু কথা বলে গেছেন। যেমন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে শোনা একটি ঘটনা মৈত্রেয়ী দেবী বর্ণনা করেছেন এভাবে-

আজকাল এই ঘোর কমিউন্যাল বিদ্বেষের দিনে সে সব কথা মনে পড়ে কই, একবিন্দু অভিযোগ করার কারণ কখনো ঘটেনি। যখন প্রথম গেলুম, দেখলুম বসার বন্দোবস্ত অতি বিশ্রী। ফরাস পাতা রয়েছে উচ্চ জাতের হিন্দু আর ব্রাহ্মণদের জন্য, আর মুসলমানরা ভদ্র লোক হলেও দাঁড়িয়ে থাকবে নয়তো ফরাস তুলে বসবে। ঘোর   আপত্তি উঠল,  ব্রাহ্মণরা তাহলে বসবে না।  আমি বললুম, বেশ তাহলে বসবে না কিন্তু এ ব্যবস্থা চলবে না, তাতে যাদের জাত যাবে তারা না হয় নিজেদের শুচিতা নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকবেন।”(মৈত্রেয়ী দেবী, মংপুতে রবীন্দ্রনাথ,  ১৪২-৪

অন্নদা শঙ্কর রায় কবির একটি আচরণের উল্লেখ করে বলেছেনঃ

তার পিতৃশ্রাদ্ধের সময় প্রজারা তাঁকে যে সব উপঢৌকন দিয়েছিল, প্রথম দিন তিনি সে সব নিয়েছিলেন, কেননা ওটা একটা প্রথা।কিন্তু পরদিন তিনি সেগুলি ফিরিয়ে দিলেন, কি লজ্জা!আমার পিতা শ্রাদ্ধে আমি নেব তাদের উপহার!এই বলে তিনি তাদের অবাক করে দিলেন। বোধ হয় এমন অপূর্ব উক্তি ভূ-ভারতের কোনো জমিদারের মুখে শোনা যায়নি।(অন্নদা শঙ্কর রায়, প্রবন্ধ সমগ্র, প্রথম খন্ড,পৃঃ ১০৮।।

জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি নির্মম সত্য কথা বয়ান করে গেছেন। তিনি বলেছেনঃ

আমি জানি জমিদার জমির জোঁক। সে প্যারাসাইট, পরাশ্রিত জীব।আমরা পরিশ্রম না করে, উপার্জন না করে, কোন যথার্থ দায়িত্ব গ্রহণ না করে ঐশ্বর্য ভোগের দ্বারা দেহকে অপুট ও চিত্তকে অলস করে তুলি।যারা বীর্যেরর দ্বারা বিলাসের অধিকার লাভ করে আমরা সে জাতির মানুষ নই। প্রজারা আমাদের অন্ন জোগায় আর আমলারা আমাদের মুখে অন্ন তুলে দেয়- এর মধ্যে পৌরুষও নেই, গৌরবও নেই (কালান্তর,পৃঃ ২৯৪)।

উপরোক্ত কথাগুলো যে মনের কথা নয়, চমক সৃষ্টির জন্য কথার কথা।কবির জমিদারীর এলাকায় এ কথার প্রতিফলন কখনো দেখা যায়নি।

“যায় যাক প্রাণ যাক, স্বাধীনতা বেঁচে থাক

বেঁচে থাক চিরকাল দেশের গৌরব।

বিলম্ব নাহিক আর, খোল সবে তরবার

ঐ শোন ঐ শোন যবনের রব।

এইবার বীরগণ, কর সবে দৃঢ় পণ

মরণ শয়ন কিম্বা যবন, নিধন,

যবন নিধন কিম্বা মরণ শয়ন,

শরীর পতন কিম্বা বিজয় সাধন!”

—— জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (পুরুষ নাটক,বিক্রম)

শেষ কথা* 

বৃটিশ বড়লাট (ভারতের) লক্ষ্মৌতে ভারতবর্ষের সমস্ত জমিদারদের এক সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। জমিদাররা তাদের পাদুকা জোড়া বিছানো কার্পেটের বাইরে রেখে গিয়েছিলেন কিন্তু জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (চাঁন মিয়া) পাদুকা পায়ে রেখেই সগর্বে উক্ত সম্মেলনের চেয়ারে গিয়ে বসেছিলেন। তখন বড়লাট বলে উঠেছিলেন, Bravo! You are the most honourable Zaminder in the sub- continent.

এই জমিদার চাঁন মিয়া পূর্ব বাংলার অবহেলিত মুসলমানদের শিক্ষা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। এমনকি প্রজা-কল্যাণে নিজের জমিদারী পর্যন্ত দান করে গিয়েছিলেন। অথচ বর্তমান বংশধরেরা তাঁর নামই জানে না। যারা আমাদেরকে কাক-কুকুরের সাথে তুলনা করেছেন, শূয়োর-ইতর বলে গালি দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী  ঘটা করে পালন করা হয়;  কিন্তু যাঁদের কল্যাণে আমরা ‘চাষার বেটা’ থেকে ‘সাহেবের বেটায়’  পরিণত হয়েছি সেই চাঁন মিয়াদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে কোন স্মৃতি বা স্মরণ  সভা হয় না।  দুর্ভাগ্য এ দেশের! দুর্ভাগ্য এ জাতির…..

[উৎসঃ সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ,  ইতিহাসের নিরিখে রবীন্দ্র- নজরুল চরিত, পৃষ্ঠা ২৬৯-২৮৪ ]

* উপ-শিরোনামগুলো মূলধারা সম্পাদকের দেয়া

প্রাসঙ্গিক পোষ্টঃ 

জমিদারি শোষণের স্মৃতি ও চিরস্থায়ী যন্ত্রণার বন্দোবস্ত

সাম্প্রদায়িকতাঃমুক্ত নন রবীন্দ্রনাথও

বাংলাদেশে কালচারের রবীন্দ্রায়ন ও আমাদের স্যাকুলারিটি

জমিদারি শোষণের স্মৃতি ও চিরস্থায়ী যন্ত্রণার বন্দোবস্ত-পর্ব ২



মূলধারা থেকে সংগৃহীত

০ Likes ০ Comments ০ Share ২২৮ Views