সেই কখন থেকে মাথাটা ঝিম মেরে আছে মোতালেব আলীর,এখন ও ঠিক হল না। এই কাঠফাঁটা রোদের মাঝে চায়ের দোকানের ছাওনিটাও কাজে দিচ্ছে না। এখন মনে হচ্ছে এই সূর্যের তাপে এই দশা তাহলে হাশরের ময়দানে কি হবে। আর তাঁর একার কি মরার ভয়, আল্লাহর কাছে হিসাব দেবার ভয়। নাকি সবার আছে এই ভয় ?
হঠাৎ কে যেন মোতালেব আলী ঘাড়ে হাত রাখতেই তিনি চমকে উঠলেন।ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখলেন শাদা দাঁড়িওয়ালা একজন তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।
লোকটি বলে উঠলোন- আরে আমাদের “কুমার আলী না”
বুঝতে পেরেছি তুমি আমাকে চিনতে পারোনি। কত যুগ পর দেখা । এত সহজে কি চেনা যাবে ?
আরে...... আমি সেই জোয়াদ্দার হোসেন। এখন ও চিন্তে পারলে না। আমরা তো একই সেক্টরে যুদ্ধ করেছি।
যুদ্ধের সময় আমি ছাড়াও আমাদের দলে আরও দুই জন আলী আর একজন বড় ভাই ছিলেন মোতালেব নামে। তাই সেই সময় সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে আমার নাম হবে “কুমার আলী”। আমার বাড়ী কুমার নদীর পাশে তাই নামের সাথে কুমার যুক্ত করা হল।
মোতালেব আলী এবার আর বুঝতে বাকি রইল না কে এই লোকটি। এক সময় আমি জোয়াদ্দার ভাই, হাশেম, মমিন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছি। সে প্রায় চার যুগ আগের কথা।
জোয়াদ্দার হোসেন আর মোতালেব আলী একে অপরের হাতে-হাত মেলালেন না। তাঁরা একে অপরের সাথে কোলাকুলি করলেই। ঠিক যেই রকম শক্তি আর বিজয়ী মনোবল নিত,সেই বিজয়ের দিনে মত করে।
মোতালেব আলী আর জোয়াদ্দার হোসেন চায়ের দোকানে বসলেন। জোয়াদ্দার হোসেন জানতে চাইলেন এত দিন পর কি মনে করে এই দিকে এলে, তুমি তো ফরিদপুরে থাকতে জানতাম।
মোতালেব আলী বললেন – হু চাকরির কারনে তো সেই দিকে ছিলাম। তাঁর পর আর ফেরা হয়নি। সেই খানেই দুই কাটা জমি কিনে বাড়ি করেছি খুব কষ্টে। জানেন তো সরকারি চাকরির কত বেতন হয়।
জোয়াদ্দার হোসেন বললেন তুমি না পরিসংখ্যান অধিদপ্তরে চাকরি করতে ?
হু...... করতাম। গত বছর রিটার্ড করেছি।
বুঝলেন জোয়াদ্দার ভাই ছোট বেলায় শুনতাম টাকা নাকি উড়ে বেড়ায়। চাকরি করতে এসে দেখেছি কি ভাবে টাকা উড়ে বেড়ায়। কোন দিন ধারার চেষ্টা করলাম না, নিজে ও না অন্য কাওকে ধরে দিলাম না উড়া টাকা।
জোয়াদ্দার ভাই শুধু হাসলেন মোতালেব আলী কথা শুনে।
কি কাজে এই দিকে আসলে বললে না তো ? প্রশ্ন করলেন জোয়াদ্দার হোসেন
মোতালেব আলী খুব হতাশ গলায় বললেন- এসে ছিলাম একটু মুক্তিযোদ্ধা অফিসে।
জোয়াদ্দার ভাই বলে উঠলেন- কথার সুর শুনে তো মনে হচ্ছে না কাজ হয়েছে। জানি তো কাজ হবে না শুধু শুধু স্যান্ডেল ক্ষয় করো না। আর সেই জন্য তো আমি এই পথে পা বাড়ায়নি।
মোতালেব আলী খুব হতাশ হয়ে বলতে লাগলেন-
আমি নিজে ও তো জানি এই সবে কাজ হবে না। কিন্তু ছেলেটার জন্য আসতে হল। এখন তো মুক্তিযোদ্ধাদের আলাদা কিছু সুযোগ দিচ্ছে। আমার ছেলে বলে যে, সবাই তো সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে, তাহলে তুমি কেন নিবে না। ছেলেটা পড়ালেখা শেষ করেছে কিন্তু এখন ও চাকরি পায়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের তো এখন আলাদা কোটও আছে আর সরকারী চাকরির বয়স ও বাড়িয়েছে। ছেলেটা বলে পরিসংখ্যান অধিদপ্তরে চাকরি করে কি করেছো তুমি। শুধু এই ছাপড়া ঘরটা ছাড়া আর তোমার সাথে যারা চাকরি করেছে তাঁদের কে দেখ এক একজন চারতলা – পাঁচতলা বাড়ি তুলেছে। তাঁর কথা হল ব্যবসা করার টাকা দাও না হলে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের সাটিফিকেট এনে দাও।
জোয়াদ্দার এত খন খুব মন দিয়ে শুনছিলেন মোতালেব আলী কথা। এবার তিনি ও বলে উঠলেন তাঁর কথা-
জানি জানি আর বলো না এই কথা। আজকাল কার ছেলে-মেয়েরা যেন বাবা-মার কথা চিন্তায় করে না। সব নিজের চিন্তায় ব্যস্ত। আমার ছেলেরাও শুরু করেছিল। আমি ও সরাসরি বলে দিয়েছি “যদি নিজের যোগ্যতাই কিছু করতে পারো করো, না পারলে না করো। আমার কোন সমস্যা নেই। আমি যতটুকু করেছি আমার নিজের যোগ্যতাই। আমার বাবা আমার জন্য কিছু করে দিয়ে জায়নি। সে তো আমার সেই ছোট বেলায় মারা গেছে”।
তা কি বলল কুমার আলী মুক্তিযোদ্ধা অফিসের কমান্ডার ?
-বলল দেখি কি করতে পারি। আমার হাতে তো সব কিছু না। অনেক হাত হয়ে আমার কাছে আসে। আসল মুক্তিযোদ্ধাদের কাগজ পেতে খুব বেগ পেতে হয়। তিনি নিজেই বললেন।
তবে কমান্ডারের সাথে কথা শেষ করে বের হবার পর একজন নিজে থেকে এসে আলাপ করলো। তাঁর কথা শুনে মনে হয়নি যে এত সহজে কোন কিছু হবে।
জোয়াদ্দার এবার হাসতে হাসতে বলে উঠলেন- আরে কমান্ডার তো ভাল। সে তো জানে কে সত্যি মুক্তিযুদ্ধ করেছে আর কে করেনি। সমস্যা তো অন্য খানে। তোমার মনে আছে তোমাদের পাশের গ্রামের পাল পাড়ায় যে কয়টা মুসলমান বাড়ি ছিল তাঁর মধ্যে লালুর কথা ?
হ্যাঁ মনে আছে তো। ওকে তো আমারা মেরেই ফেলতে চেয়েছিলাম শুধু আপনাদের কয়জনের জন্য একে ছেড়ে দিয়ে ছিলাম। বেইমান টা হাশেম বাড়ি যাওয়া খরব টা শান্তি বাহিনীকে দিয়েছিল। তারপর না তাঁকে ধরে নিয়ে গেল আর আমরা হাশেমের গুলিবিদ্ধ লাশ পেলাম নদীতে।
তুমি কি জানো সেই লালু এখন আলতাব সাহেব হয়েছে আর সে এখন এখানকার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডার।
কি বলছেন জোয়াদ্দার ভাই আপনি এই সব !!!
হ্যাঁ এটায় সত্যি। যদি ওদের কে দিয়ে কাজ করাতে চাও তবে রাজাকারদের দিয়ে কাজ করাতে হবে আর সাথে হলুদ খাম দিয়ে হবে।
কি পারবো করতো ??
মোতালেব আলী প্রায় চিৎকার করে উঠলেন
না কখনও না । সেটা কখনও সম্ভব না। আমি কোন রাজাকারের সাথে কাজ করবো না আর ঘুষ সে তো প্রশ্নই ওঠে না ।
মোতালেব আলী নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলেন তাহলে কি এই দেশ দেখার জন্য আমরা নয় মাস প্রাণটা হাতের মুঠোয় নিয়ে যুদ্ধ করেছিলাম। ঘুষ, দুর্নীতি আর স্বাধীনতা বিরোধী মানুষকে সম্মানিত করার জন্য।
এত কষ্ট করে শত্রুমুক্ত করার পর এই পেল আমার প্রিয় মাতৃভূমি!!
Comments (15)
দারুণ ভাই !! দারুণ !
ভাই ,একটা অনুরোধ থাকবে । বিবেচনায় নিতে পারেন । কবিতার সাথে ছবি যোগ করে দেন । বুঝতে পারি আপনার সেটা ভালো লাগে । কিন্তু সেটা কোনো পাঠকের বিভ্রান্তি করতে পারে । কিছু কিছু কবিতায় ছবি না দিলেই ভালো হবে । আর নয়তো নিজে স্কেচ করে দিতে পারেন । শুভ কামনা রইলো । ভালো থাকবেন ।
অনেক অনেক ধন্যবাদ টোকাই। অস্তিত্বের ফসিল লেখাটির থিম। ভালো লাগলো জেনে আমারও ভালো লাগলো। ছবি দিতে আমার সত্যিই ভালো লাগে। প্রাসঙ্গিক ছবি মাঝে চয়ন করতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পেয়েও যায়। এক্ষেত্রে যে ছবিটি ব্যবহৃত হয়েছে সেটি সিংহ ও জিরাফ সম্পর্কিত না হলেও দানবীয় একটা ব্যপার ফুটে ওঠে। অস্তিত্বের ফসিল হিসেবেও মোটামুটি কিছুটা মিলে যায়। সেজন্যেই ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে। মূল থিমের সঙ্গে আমার নির্বাচিত ছবিটি ছিলো অন্য আরেকটি ছবি। কিন্তু সেটা কোন কারণে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি বিধায়, এটি ব্যবহৃত হয়েছে। তবে আপনি যে মতামত প্রদান করেছেন সেটি আমার মাথায় থাকবে।আপনার সুন্দর মতামতের জন্য সত্যিই আমার ভালো লাগলো। কৃতজ্ঞতাও অনেক।
শুভেচ্ছা রইলো অনেক অনেক।