Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

কিংবদন্তি চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দীনের ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি


সৎ ও পরিশ্রমী চারণ সাংবাদিক ও লেখক মোনাজাতউদ্দীন। তার লেখা ও সংবাদে সবসময় উঠে আসতো গ্রামীন জনপদের সুখ-দু:খ, আনন্দ-বেদনার কথা। তার লেখা ছিল খুব সহজ ও বাস্ততাময়। মফস্বল থেকে উঠে আসা এই প্রতিভাধর সাংবাদিক কখনো তার শেকড়কে ভুলে যাননি। আমেরিকাতে জনসাংবাদিকতা শুরুর আগেই মোনাজাতউদ্দীন তার চিন্তা চেতনার মাধ্যমে এ মডেল সৃষ্টি করে গেছেন। অন্যতম সেরা এ সাংবাদিক নিজের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে এ দেশের সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদান রেখে গেছেন। মোনাজাতউদ্দিন প্রধানত দৈনিক সংবাদ-এর উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়া তিনি দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকাতেও কাজ করেছেন। সৎ সাংবাদিকতার জন্য তিনি ’জহুরহোসেন স্বর্ন পদক, ফিলিপস পুরস্কার, একুশে পদক লাভ করেন । ১৯৯৫ সালের আজকের দিনে পেশাগত দায়িত্ব পালন কালে এক ফেরী দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরন করেন মোনাজাতউদ্দীণ। আজ তার ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যুদিনে তাকে স্মরন করছি গভীর শ্রদ্ধায়

মোনাজাতউদ্দীন ১৯৪৫ সালের ১৮ জুন রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার মরনিয়া গ্রামের কেরানী পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আলিমউদ্দিন আহমদ এবং মাতা মতিজাননেছা। পিতা আলিমউদ্দিন ছিলেন চাকুরিজীবি। মোনাজাতউদ্দিনের পড়াশোনার শুরু গ্রামেরই প্রাইমারি স্কুলে। রংপুরের কৈলাশরঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে রাজশাহী বোর্ডের অধীনে মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা পাশ করেন। এরপর কারমাইকেল কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। কলেজে পড়ার সময়ই তিনি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় মনোযোগী হন। ছড়া-কবিতা-গল্প রচনা এবং সাময়িক পত্রিকার প্রচ্ছদ অংকনে সুনাম অর্জন করেন। বি.এ. ক্লাসে পড়ার সময় পিতার মুত্যুতে পরিবারে বিপর্যয় নেমে আসে এবং তাকে সংসারের হাল ধরতে হয়। ফলে তার পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটে এবং পরে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বি.এ. পাশ করেন।

১৯৬০ সালে ছাত্রাবস্থায় 'বগুড়া বুলেটিন' পত্রিকার মাধ্যমে সাংবাদিকতার জীবন শুরু হয় মোনাজাতউদ্দীনের। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকার 'দৈনিক আওয়াজ' পত্রিকার স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। পরে ১৯৬৬ সালে 'দৈনিক আজাদ' পত্রিকার উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি হিসেবে কাজে যোগদান করেন। এর আগে কিছুদিন 'দৈনিক পূর্বদেশ' পত্রিকায়ও কাজ করেন। স্বাধীনতার পর তিনি কিছুকাল দৈনিক রংপুর পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পযর্ন্ত কাজ করেন দৈনিক পূর্বদেশ ও দৈনিক আজাদ পত্রিকায় । এরপর তিনি দীর্ঘ সময় কাজ করেন দৈনিক সংবাদের উত্তরবঙ্গের প্রতিনিধি হিসেবে। এসব পত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে মোনাজাতউদ্দিন লক্ষ্য করেন অনেক সময় তাঁর রিপোর্ট যথাযথ হবার পরেও ছাপা হয় না। কখনো কখনো স্বাধীন চিন্তা, বিশ্বাস আর আদর্শের ভিত্তিতে প্রাণ খুলে লিখতেও পারছেন না। এই অবস্থায় চিন্তা করেন নিজেই একটি 'দৈনিক' করবেন। সেই চিন্তা থেকেই স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে প্রকাশ করেন 'দৈনিক রংপুর'। শুধুমাত্র স্থানীয় সংবাদের ভিত্তিতে তিনি এই পত্রিকাটি বের করার চিন্তা করেন। 'দৈনিক রংপুর' ছিল মিনি সাইজের পত্রিকা, দাম মাত্র পাঁচ পয়সা। মোনাজাতউদ্দিন ছিলেন এর সম্পাদক- প্রকাশক।

এরশাদের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবর নিয়ে সংবাদ পএিকায় নিয়মিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তুলে ধরতেন সংবাদের সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দীন। ক্যামেরা আর কলম হাতে মোনাজাতউদ্দিন যখন উত্তরের মঙ্গাপীড়িত জনপদের আনাচেকানাচে ঘুরতে থাকেন, রচনা করতে থাকেন একের পর এক অনবদ্য সংবাদসাহিত্য স্বৈরাচারী শাসক এরশাদ তখন পাঁকে পড়ে যান। একজন কলম সৈনিকের ভয়ে স্বৈরাচারও কাঁপে। স্বৈরশাসনের মুখোশ খুলে যাবার ভয়ে তিনি খুঁজতে থাকেন মোনাজাতকে। এর পর ১৯৯৫ সালে মোনাজাতউদ্দীন যোগ দেন দৈনিক জনকন্ঠে। মোনাজাতউদ্দীন ছিলেন রোমান্টিক সাংবাদিক এবং সংবাদ সংগ্রহে তার ধারণা ছিলো বৈজ্ঞানিক। এ সময়ের সমাজবিজ্ঞানীরাও তার মতোই সমাজকে বিশ্লেষণ করে। সে বিবেচনায় তিনি একজন সমাজবিজ্ঞানীও বটে। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি প্রচুর সমাজসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। গ্রামীণ এলাকায় মানুষের কুসংস্কার, অন্ধতা দূর করতে তিনি তরুণদের নিয়ে সংগঠন করেছেন। কখনো তাদের নিয়ে নাটক করিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলতে। তিনি নিজেও ছিলেন একজন গীতিকার ও নাট্যকার। রংপুর বেতারে নিয়মিত কাজ করতেন। তাঁর একাধিক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। তিনি একজন দক্ষ ফটোগ্রাফারও ছিলেন। যদিও চারুশিল্পে তাঁর তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না কিন্তু নিজের অধ্যাবসায়ের ফলে তিনি অনেক বই ও ছোট কাগজের প্রচ্ছদ করেছেন।

মোনাজাতউদ্দীন তাঁর সাংবাদিক জীবনে নানা মাত্রিকতার রিপোর্ট করেছেন। রিপোর্টিং ছাড়াও গল্প, কবিতা, ছড়া ও নাটক রচনায় তাঁর দক্ষতা ছিল। সংবাদ লেখার পাশাপাশি তিনি কবিতা, গল্প ও নাটক লিখেছেন। সংবাদ প্রতিবেদন এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত তাঁর গ্রন্থগুলি বহুল পঠিত ও প্রশংসিত। তাঁর মৃত্যুর আগে ৯টি ও পরে ২টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি লিখেছেন জীবনের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ নানা ঘটনা। তাঁর বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘পথ থেকে পথে’, ‘সংবাদ নেপথ্য’, ‘কানসোনার মুখ’, ‘পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ’, ‘নিজস্ব রিপোর্ট’, ‘ছোট ছোট গল্প’, ‘অনুসন্ধানী রিপোর্ট’: ‘গ্রামীণ পর্যায়’, ‘চিলমারীর এক যুগ’, ‘শাহ আলম ও মজিবরের কাহিনী’, ‘লক্ষীটারী’, ‘কাগজের মানুষেরা’ ইত্যাদী তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদে মোনাজাতউদ্দিন সেখানকার নারীর জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন। বাল্যবিয়ে, যৌতুক ও নারী নির্যাতনের ভয়াবহ গল্প শুনিয়েছেন। এছাড়াও মাসিক মোহাম্মদি, দৈনিক আজাদ, সওগাত ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় তাঁর বেশ কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয়। নাটকের একমাত্র প্রকাশিত বই ‘রাজা কাহিনী’। এছাড়া তিনি প্রচুর ছড়া লিখেছেন। কর্মরত অবস্থায় মাসে ৩০ দিনই তাঁর খবর ছাপা হয়েছে। এর পাশাপাশি খবরের ফলোআপ তুলে ধরে তিনি পাঠকের তৃষ্ণা মিটিয়েছেন। পত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে জীবন বাজি রেখে তিনি খবর সংগ্রহ করেছেন। সেই খবরের জন্যই জীবন উৎসর্গ করেছেন। ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর পেশাগত দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় গাইবান্ধার ফুলছড়ি থানাধীন যমুনা নদীতে কালাসোনার ড্রেজিং পয়েন্টে ‘শেরেবাংলা’ নামক ফেরিতেই তিনি দুর্ঘটনার মুখে পতিত হন। নৌপথের নির্দিষ্ট একটি এলাকায় কেন বারবার দুর্ঘটনা ঘটে- এ বিষয়টির অনুসন্ধান করতে গিয়ে কর্তব্যরত অবস্থায় ফেরি থেকে পড়ে তাঁর মৃত্যু হয়। কেউ কেউ মনে করেন, তাঁর মৃত্যু রহস্যজনক। আমাদের সমাজে ঘুষ-দুর্নীতি আছে, প্রতারণা আছে, ব্যাংক লুটপাটের ঘটনা আছে, সবজিক্ষেতে পোকার আক্রমণ আছে, বাল্যবিয়ে, যৌতুক আছে, অফিস ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা আছে; কিন্তু এসব নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখার সেই চারণ সাংবাদিক মোনজাতউদ্দিন নেই।

মোনাজাতউদ্দিন তাঁর কর্ম জীবনের সাধনা ও স্বীকৃতিস্বরূপ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে-১৯৭৭ সালে রংপুর নাট্য সমিতি কর্তৃক সংবর্ধনা, ১৯৮৪ সালে পান সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী স্মৃতি পদক, আলোর সন্ধানে পত্রিকা তাঁকে ১৯৮৫ সালে সংবর্ধনা দেয়, ১৯৮৬ সালে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব বগুড়া কর্তৃক সম্মাননা সার্টিফিকেট অর্জন করেন, দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ‘মানুষ ও সমাজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের জন্য বাংলা ১৩৯৩ সালে পান ঐতিহ্যবাহী ফিলিপস্ পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে সংবাদপত্রে প্রভূত অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স পুরস্কার পান, রংপুর পদাতিক গোষ্ঠী তাঁকে গুণীজন হিসেবে সংবর্ধনা দেয় ১৯৮৮ সালে, বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার পান ১৯৯০ সালে, একই সালে লেখনির মাধ্যমে প্রযুক্তির অন্তর্নিহিত শক্তিকে প্রত্যক্ষ ও জনপ্রিয় করার দুরূহ প্রচেষ্টা চালানোর জন্য সমাজ ও প্রযুক্তি বিষয়ক পত্রিকা ‘কারিগর’ সম্মাননা পান, ১৯৯৫ সালে মর্যাদাশালী অশোকা ফেলোশিপ লাভ করেন, রংপুরের নাগরিক নাট্যগোষ্ঠী কর্তৃক তাঁকে পুরস্কার প্রদান করা হয় ১৯৯৬ সালে, ১৯৯৬ সালে তিনি লালমনিরহাট ফাউন্ডেশন ও উন্নয়ন সমিতি স্বর্ণপদক পান, ঢাকাস্থ রংপুর জেলা সমিতি তাঁকে গুণীজন হিসেবে সংবর্ধিত করে ১৯৯৫ সালে, ১৯৯৭ সালে পান রংপুর জেলা প্রসাশন কর্তৃক গুণীজন সংবর্ধনা, ১৯৯৭ সালে অর্জন করেন রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদক একুশে পদক, খুলনায় তাঁকে রুমা স্মৃতি পদক প্রদান করা হয় ১৯৯৮ সালে। এছাড়া ওয়াশিংটনের পদ্মার ঢেউ বাংলা সম্প্রচার কেন্দ্র সম্মাননা প্রদান করা হয় মোনাজাতউদ্দিনকে। তবে মোনাজাতউদ্দীন এই পুরস্কারের চাইতেও বড় পুরস্কার মনে করতেন মানুষের শ্রদ্ধা, স্নেহ ও ভালবাসাকে, যা তিনি অকুন্ঠই পেয়েছেন।

মোনাজাতউদ্দীনের প্রতিবেদনসংগ্রহ নিয়ে ১৯৯১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ "পথ থেকে পথে" থেকে নেয়া একটি উদ্ধৃতি খুবই প্রাসঙ্গিক আজকের পটভূমিতে, "আর আমি, অসম সমাজের আমি, সম্পদের সুষম বন্টনহীন সমাজের আমি, জ্যান্ত মানুষের দুর্গতি-দুর্ভাগ্য পন্য করে খাই। এবং এই কাজটি করি কৌশলে, সবার চোখের আড়ালে, ফর্সা কাপড়ে দেহ ঢেকে। আমার মেকআপ খুব কড়া। ধরা যায় না"। মোনাজাতউদ্দীন কটাক্ষ করছিলেন তার নিজেকে আর তার মতো সচেতন মানুষদেরকে যারা নির্বিকার আর নিস্পৃহ থাকে সকল অন্যায়, অবিচার আর দুর্দশার প্রত্যক্ষ করে। পরিবর্তনের হাতিয়ার নির্মাণের জন্য এধরণের লেখার আজ খুব প্রয়োজন।

সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা এবং পেশায় সফল এক নাম মোনাজাতউদ্দীন। দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে চিরবরনীয় হয়ে থাকবেন মোনাজাতউদ্দীন। আজ তার ১৮তম মৃত্যুদিন। মৃত্যুদিনে চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দীনকে স্মরন করছি গভীর শ্রদ্ধায়।

০ Likes ৭ Comments ০ Share ৬৮৩ Views

Comments (7)

  • - মাসুম বাদল

    ‘দেখা গেলেই অল্প ভাড়া
    এইটা যদি বিবেক কয়,
    চাঁনপুর আর চান্দের ভাড়া
    কখনো কি সমান হয়’?

     

    চমৎকার...

     

     

    • - শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

      ধন্যবাদ ভাই মাসুম বাদল। শুভেচ্ছা রইল।

    - রোদেলা

    অনেক হাসলাম।

    • - শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

      ধন্যবাদ বোন রোদেলা। অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল।

    - রুদ্র আমিন

    বেশ ভাল লিখেছেন ভাই। আমরা সকলেই রিকসাওয়ালাকে না ডেকে রিকসাকেই ডাকি। সুন্দর উপস্থাপন।

    • - শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

      ধন্যবাদ ভাই আমিনুল। আপনার মন্তব্যে খুশি হলাম।

    Load more comments...