Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

আশরাফুল কবীর

১০ বছর আগে

কাগজের নৌকা..মন গহীণে ছুটে চলা সাম্পান এক

আমাদের কল্পনা অন্তহীন। আমাদের প্রতিদিনকার ধরাবাঁধা জীবন তার নিয়মিত গণ্ডির বাইরে এসে তৃপ্তি-অতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার পাশাপাশি পূর্ণতা-অপূর্ণতার হিসেব নিকেশে অনবরত খোঁজাখুজি করতে চায় কল্পলোকের আস্তাবলে। এই অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায়, পারিপার্শ্বিকতার যাঁতাকলে কখনো কখনো আমাদের স্পন্দন হয় অবলার ন্যায় পিষ্ট, আত্ম-সংকুচিত, সীমাবদ্ধ আবার কখনোবা সমস্ত বিধি-নিষেধ অগ্রাহ্য করে ভর দেয় ইকারুসের ডানায়। যুক্তি-প্রথার নিয়ম-নীতিকে তোয়াক্কা না করে, বিস্তারের সীমাবদ্ধতাকে গোঁজামিল দিয়ে ছুটে চলে নিরন্তর,স্বল্পতাকে পুঁজি করে আস্তানা গাড়তে চায় নূতন কোন বাহানায়।

 

কাগজের নৌকৌয় ভর দিয়ে উত্তাল কোন বিশাল জলরাশির মোকাবেলা করা যাবে কি যাবেনা সে প্রশ্নটিকে আপাতত আমাদের মনের একটি ওয়াটারপ্রুফ কম্পার্টমেন্টে তালাবদ্ধ করে রাখি, সুপ্রিয় লেখক আশীফ এন্তাজ রবির আমন্ত্রণে কাগজের নৌকায় সওয়ার হয়ে ভেসে পড়ার পরে না হয় চিন্তা করা যাবে উত্তাল সমুদ্রে, বিশাল বিশাল দানবাকৃতির ঝড় মোকাবেলা করে সেই নৌকা টিকে থাকতে পারবে, নাকি পারবেনা? নাকি চিরটাকাল হালবিহীন হয়ে অজানা পথে ভেসে বেড়াবে?

 

জলে নৌকা থাকুক সমস্যা নেই,নৌকায় জল থাকলে সমস্যা। তুমি সংসারে থাকো ক্ষতি নেই, কিন্তু তোমার মধ্যে যেন সংসার না থাকে। আমরা কেউ শ্রীরামকৃষ্ণ নই। কাজেই সুনাগরিকের মতো আমাদের সংসারের ভেতর যেমন বাস করতে হয়, তেমনি আমাদের ভেতরেও জোরালোভাবে সংসার আছে, সংসার থাকে। মাস গেলে বাড়িভাড়া, আইপিএসের ব্যাটারি নষ্ট হলে, সেটি বদলে ফেলা, বড় মেয়েটা অন্কের চেয়ে ইংরেজিতে কেন কম নম্বর পেল, সেটি নিয়ে ভাবা, ছোট মেয়েটার জ্বর হলে তার মুখে থার্মোমিটার পুরে দেয়া-কত কাজ। সংসারে না থেকে উপায় আছে।

 

সংসারে আবদ্ধ থাকা বা না থাকার ইচ্ছেটিকে সুপ্ত রেখে গল্পের দুই মূল কুশীলবের একজন রাজীব হাসান এর উপর প্রথমেই দৃষ্টি ফেরানো যাক। বয়স ৩৫, পেশায় সাংবাদিক, লেখকের ভাষায় “সাংবাদিক বলতে যে সাহসী, নিষ্ঠাবান, দুর্ধর্ষ, যুযুধান, জঙি এবং সত্যপ্রকাশে উদগ্রীব একদল মানুষের ছবি ভেসে ওঠে, আমি ঠিক তাদের দলে নই” বাঁইশটি অধ্যায়ে বিভক্ত অনেকটা ডায়ালগের ছলে কাহিনীর ব্রম্মাণ্ডে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি লেখক আমাদের শোনান তার শ্যাওলা পড়া, ছকবাঁধা জীবনের গল্প, যে জীবনে ভরপুর হয়ে আছে কপট মান-অভিমান, হাসি, আনন্দ আর কিছু জমে থাকা,ভারী হওয়া দীর্ঘশ্বাস। সে জীবনে সওয়ারী হয়ে ক্রমে ক্রমে আসে রাজীব হাসানের স্ত্রী মিতু, সিমু ইসলাম, মারুফ, মুসা, জিমিসহ আরো গোটাকয়েক।

 

আমরা তিন হতভাগা পুরুষ, তিন মতিচ্ছন্ন স্বামী, তিন বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস, তিনটি গ্লাসের দিকে তাকিয়ে থাকি। ক্রমেই তিনটি গ্লাস ঘেমে ওঠে। সিমু চিয়ার্স শব্দটার বাংলা করেছে, মালে বাড়ি। আমরা গ্লাস ঠোকাঠুকি করে একযোগে বলি, মালে বাড়ি। এক চুমুক খেয়েই মারুফের চেহারা থেকে বিষণ্নতার পর্দা সরে যায়। দারুন একটা হাসি দিয়ে বলে, লাইফ ইজ বিউটিফুল।

 

জীবন সুন্দর কিনা সেটিকে মুহুর্তের মধ্যে প্রমাণ করতে চারপাশ আলোকিত করে অবশ্যম্ভাবীভাবে হাজির হয় মূল গল্পের আরেক কুশীলব নীল অপরাজিতা।

 

আমি নীল, দ্য নীল অপরাজিতা। আমি ফরসা, মারকুটে সুন্দরী। রোজ সকালে আমি আয়নার সামনে দাঁড়াই। অনেকটা সময় নিয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকি। তাকিয়েই থাকি, আমার আশ মেটেনা। নিজেকে খুব করে জরিপ করি। কোথাও কি কোন খুঁত আছে? নাকটা কি একটু বোঁচা? ঝলমলে চুলগুলো আজ কি একটু কম ঝিকিমিকি করছে? আয়নার দিকে তাকিয়ে আমি মুখ ভেংচাই,ট্যারা চোখে তাকাই, ভ্রু কুঁচকাই, দাঁতমুখ খিঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। এটা হচ্ছে আয়নাকে কষ্ট দেওয়া। তারপর চোখমুখ স্বাভাবিক করে আবার আয়নার দিকে তাকিয়ে একটা ভুবনজয়ী হাসি ছুড়ে মারি। এটা হচ্ছে আয়নাকে সুখ দেওয়া। এসব আমার সকলাবেলার আয়না আয়না খেলা। খেলা শেষে নিজেকে গুছিয়ে, ছোটখাটো খুঁতগুলোকে মেরামত করে, ক্লিপের নিচে ঝলমলে চুলগুলোকে ধামাচাপা দিয়ে, চোখের নিচের কালি সযত্নে চাপা দিয়ে রাস্তায় বের হই।

 

নীল অপরাজিতার মনের অলিগলিগুলো খুঁজে ফিরে এর উৎসমূলগুলো বের করা হতে পারে নেহায়েত এক ঝক্কির কাজ। শুরু থেকেই প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসীরূপে হাজির হয় গল্পের নীল অপরাজিতা। অবশ্য শেষ দিকে এই আত্মবিশ্বাসে এসে চিড় ধরে, বলা ভালো, রাজিব হাসানের একাগ্রতায় আর হার না মানার মানসিকতা তাকে শেষপর্যন্ত স্থিরপথে আসার রাস্তা দেখাতে বাধ্য করে, মুহূর্তে মুহূর্তে ভেঙ্গেচুড়ে আবারো শীতলীকরনের প্রক্রিয়ায় জমাটবাঁধার চেষ্টা করে নীল। বলে নেয়া ভালো অপরাজিতা আর রাজিব হাসানের মেলবন্ধনের পুরো প্রক্রিয়াটিকে লেখক একসূত্রে দারুনভাবে গেঁথেছেন ‘ফেসবুক’ নামক বর্তমান সময়ের গুরুত্বপূর্ণ টুলসটিকে ব্যবহার করে।

 

পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হচ্ছে, ছেলদের ঘোল খাওয়া। রাজিবকে যখন বললাম, আমি বেশিদিন নেই, তখন রাজিব বেশ ভচকে গেল। এরপরতো সুনামির মতো মেসেজ পাঠানো শুরু করছে। চলে যাচ্ছেন মানে? কোথায় যাচ্ছেন? বিদেশে? নাকি অন্য কোনো সমস্যা? আচ্ছা আপনার কোনো অসুখ বিসুখ নেইতো? চলে যাওয়া মানে কি? কোনো ভয়ংকর কিছু? হি হি হি। ছেলেটা ভালোই ঘোল খাচ্ছে। আহা রাজিব, খাও, খাও, আরও ঘোল খাও। আরেক গ্লাস ঘোল বানিয়ে দেব?

 

বইয়ের প্রথমাংশের বার্তা আদান প্রদানের সময়টুকুতে লেখক রাজিব কিংবা অপরাজিতা দুজনকেই তাদের নিজ নিজ সাম্রাজ্যের বিস্তার অটুট রেখে প্রতিপক্ষকে ঘোল খাওয়ানোতে ব্যস্ত রেখেছেন। এ ঘোল খাওয়ানোর প্রতিযোগীতায় অপরাজিতা তার স্বভাবগুণে জীবনের গল্প খুঁজে বেড়ানো রাজিবের তুলনায় কিছুটা এগিয়ে থাকে। তবে শেষাংশে সেই উত্তেজনা হ্রাস হয়ে দুজনেই পরস্পরের কাছাকাছি আসার সুযোগে ব্যস্ত হয়। লেখক আশ্চর্য দক্ষতায় আমাদের চারপাশের ঘটনাপুঞ্জ থেকে বাস্তবতার নিরিখে আমাদের নিয়ে তার আবেগের নৌকায় ভেসেছেন, কখনো সে আবেগ বাঁধ ভেঙ্গেছে,কখনো ভাঙ্গেনি, শুধুমাত্র গতিপথ বদলিয়েছে, স্তব্ধ করেছে কয়েকটি মুহুর্তের জন্য, ফিরে ফিরে নজর বুলাতে বাধ্য করেছে আমাদের সঙ্গী সারথিদের উপর:

 

আমি কেঁপে উঠলাম। নিজেকে শক্ত রাখব ভেবেছিলাম। শক্ত থাকা এতো সহজ হলো না। তবু প্রাণপণ নিজের সঙ্গে লড়াই করতে করতে আমি পাঁচটি শব্দ কোনোক্রমে উচ্চারণ করলাম। আমি ভীষন ভাঙ্গা গলায় বললাম, মিতু। আমি আলাদা থাকতে চাই। আমার মাথায় হাত বুলাচ্ছিল মিতু। সেই হাত আচমকা থেমে গেল। মিতু কোনো কথাই বলল না। আমিই ভেঙ্গে পড়লাম। আমি হু-হু করে কাঁদতে লাগলাম। মিতুর বুকে মাথা রেখে। মিতু পাথর হয়ে সেই কান্না শুনল। একটা কথাও বলল না, একটি শব্দও না।

 

স্বাভাবিকভাবে পাঠকমাত্রই বিমোহিত হয়ে নিজকে মেলাবে ঘটনার ঘণঘটায়, একজন রাজিব কিংবা একজন অপরাজিতার অবয়বে, নানান অনুষঙ্গে, নানারকমের ঘটনাপ্রবাহে কেউ কেউ অপেক্ষায় থাকবে কারো কারো ফেরার প্রতীক্ষায়। গল্পের অবয়বে অপরাজিতার স্বামী একজন শুভ হয়তো অনেক ধীর, স্থির, ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করে শেষ সময় পর্যন্ত অপরাজিতার জাহাজ নোঙরের অপেক্ষায়, ঠিক তেমনিভাবে একজন মিতুও হয়তো অপেক্ষা করে থাকে শেষ সময় পর্যন্ত একজন রাজিব হাসানের মুহূর্তের ভুল ভেঙ্গে ফেরার প্রতীক্ষায়। আশার কথা হলো এই, ভিন্ন পথে চলে যাওয়া দুটি নৌকো আবারো ভেসে চলে তার পুরোনো গন্তব্যের অভিমুখে:

 

রাজিব জানো, আমি এখন হাওয়ায় ভাসছি। হাওয়ায় আজকাল কত কিছু ভাসে। হাওয়ায় ওড়ে গাছের পাতা। হাওয়ায় ওড়ে পাখি। হাওয়ায় ওড়ে কতিপয় পতঙ্গ। আর কিছু ঠিকমতো হাওয়ায় উড়ুক বা না উড়ুক, প্রার্থণা কোরো, এই প্লেনটা যেন ঠিকমতো ওড়ে, নিরাপদে তার গন্তব্যে পৌছে। ভালো থেকো রাজিব। ভালো থেকো। আমাদের কাগজের নৌকাটিকে তুমিও দেখে রেখো। এটা আমাদের নৌকো। হোকনা কাগজের, তবুও নৌকো তো!

 

...................................

এক নজরেঃ 

বইঃ কাগজের নৌকা

লেখকঃ আশীফ এন্তাজ রবি

ধরনঃ গল্পগ্রন্থ

প্রচ্ছদঃ সব্যসাচী হাজরা

প্রকাশকঃ প্রকাশক

প্রথম প্রকাশঃ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

মোট পৃষ্ঠাঃ ৯৪

মূল্যঃ ১৮০.০০ টাকা

আইএসবিএনঃ ৯৭৮-৯৮4-৩৩-৭৭৭৩-৯

...................................

 

পুনশ্চ: লেখক গল্পের শুরুতেই কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বলে রেখেছেন “এই গল্পের মূল চরিত্র একজন লেখক। আমি নিজেও টুকটাক লেখালেখি করি। কাজেই কেউ যদি ধরে নেন, এটা আমার গল্প,তাহলে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়া ছাড়া অন্য উপায় থাকবেনা” সুপ্রিয় পাঠক, আসুননা চলে আসুন, কাগজের নৌকোয় ভেসে গিয়ে জেনে, শুনে, বুঝে, সজ্ঞাণেলেখকের নিজের গল্প মনে করে লেখককে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও মাথায় হাত দিয়ে বসিয়ে রাখি।

 

 

.....................

১৯শে আশ্বিন, ১৪২০

মতিঝিল, ঢাকা।

০ Likes ১১ Comments ০ Share ১১৬২ Views