Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

রাজু আহমেদ

৯ বছর আগে

কবে থামবে অভিজিতদের মৃত্যুর মিছিল ?

সন্তান বিদেশে কিংবা নিকট আত্মীয়দের থেকে দূরে থাকলে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তায় থাকতে হয়-এমন ধারণা এদেশের মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী লালন করে আসছে । মানুষের সে ধারণায় সম্ভবত ছেদ দিল লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের অকালে প্রাণহানী । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায় বারবার চাইতেন তার প্রিয় সন্তান প্রিয় পুত্রবধূকে নিয়ে দেশে আসুক এবং নিকটজনদের সাথে কিছুটা সময় কাটিয়ে যাক । সাত বছর আগে আমেরিকায় নাগরিকত্ব গ্রহন করা অভিজিত রায় এবং তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও চাইতেন দেশে এসে নিকট আত্মীয়, বন্ধুমহল ও চেনা-জানা পরিবেশে কিছু সময় কাটিয়ে যেতে । বাংলাদেশ ছেড়ে বহুদূরে বাস করলে কি হবে মনটা যে এ মাটি আর মানুষের সাথেই মিশে যেতে চায় । তবুও বাস্তবতা বড় কঠিন । আমেরিকার ব্যস্তজীবন ছেড়ে হুট করে হাজার মাইল দূরত্বের বাংলাদেশে ছুটে আসা যায়না । অত্যন্ত ব্যস্ত জীবনের সাথে অভিজিৎ-রাফিদা দম্পতির একমাত্র কন্যা তৃষার স্কুলে পড়াশুনার চাপ থাকায় সন্তানকে ছাড়াই তারা বাংলাদেশের টানে পাড়ি জমিয়েছিলেন । ঔরসজাত ও গর্ভের সন্তানকে ছেড়ে আরেক সন্তানের (প্রকাশিত বইয়ের) খোঁজ নিতে বইমেলায় ছুটে এসেছিলেন । দূরদেশে বাস করলেও মাতৃভাষার প্রতি অকৃত্রিম টান, প্রাণের বইমেলার প্রলোভন এবং সন্তানতুল্য প্রকাশিত বইয়ের খোঁজ নিতে ১৫ই ফেব্রুয়ারী সকল বাঁধা উপেক্ষা করে দেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন । অভিজিৎ রায়কে হত্যার হুমকিও তার আগমনে বাঁধা হতে পারেনি । কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ২৬ ফ্রেব্রুয়ারী রাত ৯টার দিকে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির বটতলা এলাকায় অভিজিৎ-রাফিদা সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হন এবং রাত ১০টা ২০ মিনিটে অভিজিৎ মৃত্যুবরণ করেন ।  সন্ত্রাসীদের হামলায় রাফিদা আহমেদ বন্যাও গুরুতর আহত হয়েছেন এবং তিনি এখনও শঙ্কামুক্ত নন ।

 

 

বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের সাবেক শিক্ষক অভিজিৎ রায় চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে উচ্চ শিক্ষা এবং উন্নত জীবনের খোঁজে স্ব-স্ত্রীক আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য নাগরিকত্ব গ্রহন করেন । সেখানে বসে তিনি লেখালেখিতে আত্মমগ্ন হন  । বিজ্ঞান, দর্শন ও বস্তুবাদী লেখার মাধ্যমে তিনি উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেন । অভিজিৎ রায়ের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে অবিশ্বাসের দর্শন, আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে, ভালোবাসা কারে কয়, স্বতন্ত্র ভাবনা : মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি, সমকামিতা : বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান প্রভৃতি । তবে অভিজিৎ রায়ের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্লগার ছিলেন । আমেরিকায় গিয়ে মুক্তমনা নামে একটি ব্লগ তৈরি করেন এবং তাতে নিয়মিত লেখালেখি করে বেশ পরিচিতি পান । সুস্নিগ্ধ ও সুসজ্জিত গদ্য ভাষায় বিজ্ঞান ও সাহিত্যের উপাস্থাপনা ছাড়াও ধর্মীয় উগ্রবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে তার হাত সর্বদা সচল ছিল । প্রখর যুক্তিবোধে স্নাত কুসংস্কারভেদী মুক্তচিন্তাগুলো অভিজিৎ রায়কে সত্যিকারার্থের জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত করতে শুরু করেছিল । তার গদ্য আর চিন্তায়ও ছিল যত্নের সুস্পষ্ট ছাঁপ । কিন্তু ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা মাত্র ৩৭ বছরের তরুণ এই মুক্তিচিন্তককে সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ববাসীর জন্য খুব বেশি অবদান রাখার সুযোগ দিল না ।   

 

কারা অভিজিৎ রায়কে খুন করেছে তা এখনও স্পষ্ট নয় তবে গোয়েন্দাসংস্থা ডিবিসহ দেশের অনেকগুলো আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী খুনীদের শনাক্ত করতে জোর তৎপরতা চালাছে । অভিজিৎ রায় যেদিন খুন হন সেদিন রাতেই ‘আনসার বাংলা-৭’ নামের একটি উগ্রবাদী সংগঠন এ হত্যাকান্ডের দায়ভার স্বীকার করেছে । অভিজিৎ রায়কে খুন করতে পেরে এ সংগঠনটি তাদের ফেসবুক পেইজে উল্লাস করে বার্তা প্রকাশ করে । দেশে আনসার বাংলা-৭ নামের জঙ্গী সংগঠনের ভিত্তি কতটা মজবুত এবং তাদের সাথে কারা জড়িত তা অভিজিৎ হত্যার চারদিন অতিবাহিত হলেও এখনও স্পষ্ট হয়নি । অভিজিৎ রায়কে হত্যার সাথে প্রকৃতভাবে কারা জড়িত তাও স্পষ্ট নয় । বিভিন্ন সময়ে ইমলেইল, ফেসবুক ও ব্লগে অভিজিৎ রায়কে হত্যার হুমকি দেয়া হলেও তিনি দেশের আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তা জানাননি বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবী করা হয়েছে । শাহবাগ থানার মাত্র কয়েক’শ গজ দূরে এবং বইমেলা উপলক্ষ্যে ঐ এলকায় নিরাপত্তা বেষ্টণী জোরদার থাকার পরেও যারা নির্বিঘ্নে তাকে খুন করে পালিয়ে যেতে পারল তাদেরকে হাল্কাভাবে নেয়ার কোন কারণ নাই । খুনীদের নির্ভূল সাফল্যেই বোঝা যায় তারা বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং তারা পেশাদার । অভিজিৎ রায় নিহত হওয়ার পর জাতিসংঘ ও আমেরিকা গভীর উদ্ধেগ প্রকাশ করে তাদের ক্ষোভ জানিয়েছে । বাংলাদেশ সরকারকে আমেরিকার পক্ষ থেকে এফবিআইয়ের মাধ্যমে ঘটনাটির তদন্ত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে ।

 

মুক্তচিন্তক অভিজিৎ রায় হত্যা উগ্রবাদীদের কর্মকান্ডের একটি ধারাবাহিকতা মাত্র । ২০০৪ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী বইমেলা প্রাঙ্গনে বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক ড. হুমায়ুন আজাদকে আক্রমন করার মাধ্যমে এর সূচনা হয়েছিল । এরপর আর থামেনি । মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে উগ্রপন্থীরা ১৫টি প্রাণ কেড়ে নিয়েছে । উগ্রপন্থীরা মুক্তচিন্তকদেরকে বিভিন্নভাবে ধর্মের ও মানবতার শত্রু আখ্যা দিয়ে হত্যার রাজত্ব কায়েম করার সংগ্রাম চালাচ্ছে । তথাকথিত উগ্রবাদীদের অপব্যাখ্যার বলি হয়েছে, মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী, গোপীবাগের কথিত পীর লূৎফর রহমানসহ ছয় জন, রাজধানীর উত্তরায় জেএমবির দলছুট সদস্য রাশিদুল ইসলাম, পল্লবীতে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার, খুলনার খালিশপুরে বাবা-ছেলে, বুয়েটের ছাত্র আরিফ রায়হান দ্বীপ, সাভারে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সর্বশেষ অভিজিৎ রায় হত্যা-নয়টি ঘটনার আকস্মিকতা এবং ধরণ প্রায় একই রকম । রাষ্ট্র যদি এ ধরণের হত্যাকান্ডের লাঘাম টানতে ব্যর্থ হয় তবে এর শেষ কোথায় গিয়ে থামবে তা একমাত্র স্রষ্টাই ভালো জানেন । বাংলাদেশের মত সম্ভবত বিশ্বে দ্বিতীয় কোন দেশ নাই যেখানে মানুষের মধ্যে পরমত সহিষ্ণুতার এমন অভাব রয়েছে । কোন একজন ধর্মের ‍বিরুদ্ধে কথা বললেই ধর্ম অপবিত্র হয়ে যাবে-ধর্ম কি এতই ঠুনকো । ধর্মের ‍বিরুদ্ধে কিংবা ধর্ম প্রচারকের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললেই তাকে হত্যা করতে হবে এই অধিকার কে দিয়েছে ? পৃথিবীতে যেমন আস্তিকদের থাকার অধিকার আছে তেমনি নাস্তিকদেরও থাকার অধিকার রয়েছে । কেউ যদি ধর্মকে অপব্যাখ্যা করে নাস্তিকদের উচ্ছেদে নিজেকে নিয়োজিত করেন তবে তার মত আহাম্মক ধরাধামে দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ । একজন ধর্মহীনকে কিংবা ধর্মের বিরুদ্ধবাদীকে যদি এভাবে হত্যা করার বৈধতা থাকে তবে জান্নাত-জাহান্নামের ভূমিকা কি হবে ?

 

অতিক্ষুদ্র্ একজন লেখক ও ব্লগার হিসেবে অভিজিৎ রায়ের হত্যা মেনে নিতে পারছি না । একজন লেখক তার স্বতন্ত্রমত প্রকাশ করার স্বাধীনতা ও স্থান না পেলে সেটা সত্যিই লজ্জার । বর্বরতার যুগ কাটিয়ে আমরা সেই কবে সভ্যতার আলোতে প্রবেশ করেছি অথচ এখনও বর্বতার মূখোশ ‍তুলে রাখতে পারিনি । যত মানুষ তত মত থাকবেই । ভিন্ন মতের সাথে দ্বন্দ্ব থাকতেই পারে কিন্তু তার সমাধান হওয়া উচিত বুদ্ধি প্রসূত যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে । একমাত্র যুক্তিবোধই মানুষকে পশু থেকে পৃথক করেছে । বুলেট কিংবা চাকু, গোলা কিংবা বোমা কি কোনকালেই স্থায়ী কোন সমাধান এনেছে ? মানবাজাতিকে শান্তির ছোঁয়া দিতে পেরেছে ? সহজ কথায় পারেনি কিংবা পারবেও না কোনদিন । তবুও মানুষ যে কোন বিবেকে উল্টোপথে সমাধান করতে চায় কে জানে ? যারা অভিজিৎ রায় এবং রাফিদা আহমেদের উপর কাপুরুষোচিত আক্রমন চালিয়ে একজনকে হত্যাও অন্যজনকে মৃত্যুর দ্বারে পাঠালেন তাদেরকে এবং এ জাতীয় লোকদের মনোভাব সমর্থনকারীদের জিজ্ঞাসা করি, অভিজিৎ এবং তার দর্শনকে বাংলাদেশে এবং বিশ্বের কতজন মানুষ জানত ? নিশ্চয়ই সে হিসাব কোনভাবেই ১৬ লাখের ওপরে যেত না । কিন্তু তাকে হত্যা করার পর ফল কি হল ? বাংলাদেশের ১৬ কোটিসহ বিশ্বের শত কোটি মানুষ জেনে গেল অভিজিৎ হত্যার কারণ । বিশ্বের এমন কোন প্রভাবশালী মিডিয়া নাই যেখানে অভিজিৎ রায় হত্যার সংবাদটি প্রধান্য পায়নি । বিশ্ববাসী জেনেছে মুক্তবুদ্ধি চর্চার কারণে তাকে প্রাণ দিতে হল । সহজাতভাবেই এখন অভিজিতের প্রতি সদয় হয়ে হাজার হাজার মানুষ তার মতের অনুসারী হবে এবং তা চর্চা করবে । এদের অনুসারী চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়তেই থাকবে । এর দায়ভার কে নেবে ? হত্যার মাধ্যমে উগ্রপন্থীরা মুক্তচিন্তকদের কয়জনকে দমন করতে পারবে ? কতজনকে হত্যা করার মত শক্তি ও সামর্থ্য তাদের রয়েছে ? মানুষ হত্যার মাধ্যমে কোন সমস্যার সমাধান হয়না কিংবা ও অতীতেও হয়নি । ইসলাম বিরোধীদের যদি হত্যা করা বৈধ হত তবে ইসলাম ধর্মের প্রচারক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে যখন জিব্রাঈল ফেরেশতা তায়েফ বাসীকে ধ্বংসের বার্তা নিয়ে এসেছিলেন তখন তিনি রাজি হয়ে যেতেন অথচ তিনি তায়েফবাসীকে নিয়েই আগামীর ইসলামের ঝান্ডা ওড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং তিনি সফলও হয়েছিলেন । মানবতার মুক্তির দুত হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বাণীর অপব্যাখ্যা করে যারা মানুষ হত্যার বৈধতা দিল তাদেরকে যে কোন মূল্যে কঠোর শাস্তি দিতে হবে ।

 

দেশে প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে । তবে অভিজিৎ রায়ের প্রাণহানী গোটা দেশবাসীকে মারাত্মকভাবে ব্যথিত করছে । সূদুঢ় আমেরিকা থেকে যিনি মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি টান অনুভব করে সবকিছু ফেলে ছুটে এসেছিলেন তাকে আমরা এই প্রতিদান দিলাম ? ধিক্কার ! এমন বিবেবকে যারা এ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত এবং এর বৈধতাদানের জন্য সচেষ্ট । শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীকে আরও কর্মতৎপর হওয়ার অনুরোধ রইল । অপরাধীদের দমনে সরকারকেও আরও কঠোর ও দায়িত্বশীল হতে হবে । অভিজিৎ রায় হত্যার জন্য আমরা সবাই সামগ্রিকভাবে দায়ী । আমাদের সম্মিলিত নিরবতা, সুযোগ-সুবিধা, খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার লালসার বিনিময়ে ধীরে ধীরে ধর্মান্ধদেরকে শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছি এবং তার ফলও বেশ ভালোভাবে ভোগ করছি । আরও কত ভোগ করতে হবে তা কে জানে ? সন্তান হারিয়ে একজন বাকরুদ্ধ অসহায় পিতাকে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করতে হয়-এরপরেও আমরা শান্তির রাজ্যে আছে বলে দাবি করব ? ‘আবার তোরা মানুষ হ’ বিখ্যাত এ উক্তিটি বোধহয় আমাদের জন্যই যথার্থ । আমাদের ব্যর্থতাকে ক্ষমা করো প্রিয় অভিজিৎ ।

 

রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।

 

০ Likes ১ Comments ০ Share ৩০৪ Views