জসীমউদ্দীনের কবি, প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক, কথাসাহিত্যিক পরিচয় ছাপিয়ে গীতিকার পরিচয়টিও কম গৌরবের নয়। জসীমউদ্দীনের গানে আছে লোকজীবনের রূপায়ণ ও লোকদর্শনের প্রকাশ। সেখানেই লালনের সঙ্গে জসীমউদ্দীনের মিল খোঁজা যেতে পারে। লালনের গানের ভক্ত ছিলেন জসীমউদ্দীন। লালনকে অনুভব করেছেন পল্লীকবির কোমল হৃদয় নিয়ে। জসীমের গানে লালনের গানের পরোক্ষ প্রভাবকে অস্বীকার করার উপায় নেই। জসীমের স্মৃতিকথায় রচনায় ব্যক্তি লালনকেও গুরুত্ব পেতে দেখি।
গান গাওয়ার অপরাধে জসীমভক্ত হাজেরা বিবি এবং তাঁর স্বামীকে যখন গ্রামবাসীরা একঘরে করে রেখেছিলো, তখন তাঁরা এসেছিলেন কবি জসীমউদ্দীনের কাছে দেখা করতে। তাঁরা ‘ছোটগাঙের ওপারে হিন্দুপাড়ার কাছে একখানা কুঁড়েঘর তুলিয়া এই গ্রাম হইতে চলিয়া’ যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন কবির কাছে। তখন কবি তাঁদের সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘আজ যদি তোমরা আমাদের এই গ্রামকে ছাড়িয়া যাও তবে এই অন্যায়কে স্বীকার করিয়া লওয়া হইবে। হাজেরা! তুমিই ত গানে বল, রসুলউল্লাকে লোকে প্রথম একঘরে করিয়াছিল। লালন ফকির, সাল্লাল ফকির, এঁরাও সমাজের হাতে বহু লাঞ্ছনা পাইয়াছেন। হাজেরা তুমিই ত গানে বলো, ‘লোকের মন্দ, পুষ্পচন্দ অলঙ্কার পইরাছি গায়’। আজ লোকের মন্দ পুষ্পচন্দনের মতো তোমাদের গায় অলঙ্কার হইয়া থাক।’’ লালনের প্রতি লাঞ্ছনার কথা উল্লেখ করে তিনি হাজেরা বিবিকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। লালনকে এখানে তিনি আদর্শ মেনেছেন।
আমরা বেশ কয়েকটি গান বিশ্লেষণ করে দুজনের চেতনাগত ও আদর্শগত সাম্য বিবেচনা করতে পারি। আমরা জানি, ‘তরী’ প্রতীকটি লোকগানে খুব প্রিয় অনুষঙ্গ। বিশাল সংসারসমুদ্রে সামনে প্রবল ঢেউ, সেখানে একমাত্র কাণ্ডারী মুরশিদকে স্মরণ করে জীবনতরী ভাসানোর কথা বলা হয়েছে। তরীকে জীবনের প্রতীকরূপে প্রতিস্থাপন করে লালন লিখেছেন:
সামনে তরঙ্গ ভারি
মুরশিদ বিনে নাই কাণ্ডারী
লালন বলে ভাসাও তরী
যা করেন সাঁই কৃপাতে॥
আর একই প্রতীকে কবি জসীমউদ্দীন বলেছেন নদীর ছলছল কলকল জলের কথা। নদীতে ঢলের আশংকা থেকে মুক্ত থাকার কথা বলা হয়েছে। মৃত্যুর হাত ধরে সর্বনাশা এই তরী বাইতে মাঝিকে সাহস দিয়েছেন। এই উপলব্ধি ধরা পড়েছে সুর ও বাণীতে। জসীম লিখেছেন:
সর্বনাশা এই তরী, মৃত্যুরে হাতে ধরি,
আমার এ ভাঙ্গা নাও বাইওরে।
আবার দুরন্ত তরঙ্গে তরী ডোবার কথা বলে কোথায় পথ ভোলে বলে মুরশিদের কাছে আত্মবিলাপ করেছেন লালন। তিনি দেখেছেন চারিদিকে শূন্য, ঘুর্ণিত পাকের জলে তরী দেখা যাচ্ছে না তারই বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে ভিন্ন ব্যঞ্জনায়:
কোথায় এনে আমায় পথ ভুলালে
দুরন্ত তরঙ্গে তরীখানি ডুবালে॥
তরী নাহি দেখি আর
চারিদিকে শূন্যকার
প্রাণ বুঝি যায় এবার
ঘুর্ণিত পাকের জলে॥
কোথায় রইলে মাতাপিতা
কে করে স্নেমমতা
আমার মুর্শিদ রইল কোথা
দয়া কর বন্ধু সকলে॥
জসীমউদ্দীন বলেছেন, সাবধানে তরী চালাতে বলা হয়েছে মাঝিকে। তরী যে ভাঙা সেই কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে নদীকে বেসামাল করা হয়েছে। আকাশ যেন নেমে এসেছে ঢেউয়ের কাছে। কী অসাধারণ চিত্রকল্প সৃষ্টি হয়েছে জসীমের গানেও। উপরে আসমান নীচে দরিয়া, তার কূল কিনারা দেখা যাচ্ছে না, কূলের জন্য কবি কেন্দে আকুল হচ্ছেন, অকূল দরিয়ায় কবির তরী ভাসানোর কথা বলেছেন:
তুমি সাবধানে চালাইও মাঝি আমার ভাঙা তরীরে।
ঢেউয়ের উপর ঢেউ ছুটেছে ঢেউয়ে করি ভর,
গগন নামিয়া নাচে সেই না ঢেউয়ের পররে।
আসমান চাইয়া দইরার পানে দইরা আসমান পানে,
লক্ষ বছর পার হইল কেউ না কারে জানেরে।
উপরে আসমান নীচে দইরা কারো নাইরে কূল,
এ ওর কূলের লাইগা কান্দিয়া আকুলরে।
আমি দেশ হারা কূল হারা হইয়া পরবাসে,
অকূল দরিয়ায় আমার ভাঙা তরী ভাসেরে।
তরীর প্রসঙ্গ এলে মাঝিও এসে যায় সংলগ্নভাবে। তরী থাকলে মাঝিও থাকে। খুব কাছাকছি হলেও প্রতীকের ভিন্নতায় তরী হতে পারে অবলম্বন আর মাঝি হতে পারে নিয়ামক। লালন লিখেছেন:
অকুল পাড় দেখে মোদের লাগরে ভয়
অকুল পাড় দেখে মোদের লাগরে ভয়
মাঝি বেটা বড় ঠেঁটা
হাল ছেড়ে দিয়ে বগল বাজায়॥
লালনের ‘মাঝি বেটা’ আর জসীমের মাঝি হলেন ‘রঙিলা নায়ের মাঝি’। মেঘের পিঞ্জিরায় পুরে বিজলী পাখিরে পোষার কথা বলেছেন। জসীমের গানের ভাষায় তারই কাব্যিক প্রকাশ:
তুমি কবে খুলিয়া নাও
আমি যেন জানি রে রঙিলা নার মাঝি!
ও রঙিলা নার মাঝি!
মেঘের পিঞ্জিরায় পুরে পুষলাম বিজলী পাখিরে
পুষলাম বিজলী পাখি,
আমি আর কতকাল রাখব অনল অঞ্চলেতে ঢাকি।
বাতাস প্রতীকেও দুজনে রচনা করেছেন অনেক গান। লালন লিখেছেন সাধুর বাতাসে বনের সাধারণ কাঠও সুগন্ধি কাঠ হয়ে যায়। বাতাস এখানে স্পর্শ ও কৃপা অর্থে ব্যবহৃত। তিনি বলেছেন:
সাধুর বাতাসেরে মন
বনের কাষ্ঠ হয়রে চন্দন
লালন বলে মন, খোঁজ কি আর ধন
সাধুর সঙ্গে রঙ্গে দেশ কররে॥
বাতাসের একই অর্থে অর্থাৎ স্পর্শ অর্থে ব্যবহার করে কবি জসীমউদ্দীনও গান লিখেছেন। ললিতা সখিকে উদ্দেশ্য করে কবি জানতে চেয়েছেন, লিলুয়া বাতাসে কেন প্রাণ জুড়ায় না। অর্থাৎ সখির স্পর্শ দিয়ে প্রণয়াস্পদের প্রাণ জুড়ানোর কথা বলা হয়েছে। গানের ভাষায়:
ও সখি ললিতে,
পারবা না বলিতে
কেন লিলুয়া বাতাসে প্রাণ
জুড়ন না যায়।
লালনের ‘সাধুর বাতাস’-ই জসীমের ‘লিলুয়া বাতাস’ হয়ে ধরা দেয়। সংগীতে প্রতীকে-রূপকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাজুয্য আবিষ্কার করা যায়। চেতনাগত ও আদর্শগত সাম্যের কারণেই এই মিল এই প্রভাব আমাদের সংগীতের ধারাকেই পুষ্ট করেছে।
লেখক: তপন বাগচী
Comments (13)
আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু জাফর ইকবাল স্যারকে খুব কাছ থেকে দেখেছে। ওদের মুখে শুনেছি তিনি নাকি পাথরেও সোনা ফলাতে জানেন। আমাদের দেশের সব বিশ্ব বিদ্যালয় গুলো যদি এমন একজন করে দায়িত্ববান শিক্ষকের হাতে পরত।
লেখাটি শেয়ার করবার জন্য ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনি যা বলেছেন সবই সত্য
জাফর ইকবাল স্যার ও তার টিমের জন্য।
নিঃসন্দেহে এটা একটা বিরাট ঘটনা হবে বাংলাদেশের জন্য, যদি সফল ভাবে ড্রোন আবিষ্কার করতে পারে শাবির গবেষক দল। তাদের জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা রইলো। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ পৌঁছে যাক উন্নত বিশ্বের কাতারে। এই প্রত্যাশা করছি। ধন্যবাদ কালের পুতুল।
ধন্যবাদ ঘাসফুল