Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

কফিল একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল (প্রতিযোগিতা : ক্যাটেগরি-১)

আসরের আজান একটু আগেই দিয়েছে। মুসল্লীরা একে একে মসজিদে আসছেন। কেউ কেউ অজুখানায় গিয়ে ঢুকছেন। অন্যরা বাসা থেকে ওজু করে আসাতে সরাসরি মসজিদের ভেতরে চলে যাচ্ছেন। এতে অনেক সওয়াব। অজু থাকলে বাসা থেকে আসার পথে প্রতি কদমে কদমে সওয়াব।

সুদৃশ্য মসজিদ। শহরের অভিজাত এলাকার অভিজাত মানুষেরা এখানে নামাজ আদায় করেন। এদের ভেতরে সাধারণ এবং অতি-সাধারণ মানুষজনও আসে। তবে এদের সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল। যদিও ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী আল্লাহর ঘরে মানুষের ভিতর ভেদ ভেদাভেদ নেই। তারপরও এই অতি-সাধারণ মুসল্লিরা আগে এসেও সামনের প্রথম সারিতে বসতে কেন জানি কুন্ঠাবোধ করে। ঐ সারিতে গুলশানের এই এলাকার বাড়িওয়ালারা নিয়মিত বসেন। এদের ভিতরে রাজনীতিবিদ, সরকারি আমলা, অবসরপ্রাপ্ত সচিব কিংবা সেনাবাহিনীর সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা রয়েছেন।
কফিলকেও দেখা যাচ্ছে। একেবারে শেষ সারিতে দরোজার সাথে বসেছে। ওর পেছনে কাঠের সুন্দর জুতোর বাক্স। সেখানে দামী জুতো স্যান্ডেল শোভা পাচ্ছে।

এই জুতো-স্যান্ডেল মালিকের অনুমতি না নিয়েই সে পায়ে দিয়ে চলে যায়। অন্যরা এই কাজটিকে চুরি বললেও কফিল মানতে চায় না। নিজেকে নিয়ে অনেক গর্ব তার। নিজেকে একজন চোর কখনোই ভাবে না সে।
একজন মুক্তিযোদ্ধা কি চোর হতে পারে?
কফিল একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল।
এখন কি নেই তবে?
ওর সার্টিফিকেট যেহেতু নেই, কাগজে-কলমে সে কিভাবে একজন মুক্তিযোদ্ধা হতে পারে?

গত দুই মাস ধরে এভাবে চুরি করাই ষাটোর্ধ কফিলের একমাত্র পেশা। আগে সাধারন মসজিদে এই কাজটি করতো। কিন্তু সেখানে মানুষের পদমর্যাদাও যেমন ছোট, তাদের জুতো-স্যান্ডেল ও সেইরকম কমদামী। সচ্ছলতার সাথে সাথে পোষাক পরিচ্ছদও উঠানামা করে। এরকম মসজিদ থেকে একটি স্যান্ডেল নিয়ে চোরবাজারে সেটি বিক্রী করে পঁচিশ থেকে ত্রিশ টাকার বেশী পাওয়া যায় না। এজন্য অনেক চিন্তা-ভাবনা করে অভিজাত এলাকার মসজিদগুলোকে টার্গেট করেছে কফিল। এখান থেকে পাওয়া স্যান্ডেলের দাম অনেক বেশী পাওয়া যায়।

তবে জুতোর থেকে স্যান্ডেল ই বেশী পছন্দ কফিলের। এই বয়সে জুতো নিতে গেলে সেই অনুযায়ী পোষাক পরতে হয়। কিন্তু সেরকম পোষাক পরবার সামর্থ্য থাকলে কি আর কফিলকে এই চুরির মতো হীন কাজ করতে হয়?

ওর শিকার পদ্ধতি একেবারে সোজা সাপ্টা। জুতো রাখার বাক্সের পাশেই বসে সে দেখে এখানে কোন জুতোটি রেখে জুতোর মালিক কোথায় গিয়ে বসে। অনেক মুসল্লি ঢুকেই একেবারে দরোজার কাছে জুতো রেখে সামনের সারির দিকে এগিয়ে যায়। এদের ভেতর থেকেই একজনকে সে নির্দিষ্ট করে নেয়। আসরের নামাজের সময়টিকে সে বেছে নিয়েছে। এই সময় নামাজ শেষ হলেও মোনাজাতের পুর্বে সব ইমাম সাহেব ই তাসবীহ পড়ার জন্য কিছুটা সময় নেন। অনেকে চার রাকাত নামাজ শেষ হলে মোনাজাতের অপেক্ষা না করেই উঠে চলে যায়। কত জরুরী কাজ থাকে হয়ত এদের। কফিলও তাদের সাথে মিশে যায়। তবে যাবার সময় পছন্দের স্যান্ডেলটি সাথে নিতে ভুলে না।
কফিলের জীর্ণ স্পঞ্জের স্যান্ডেলটি খোলা আকাশের নিচে মুখব্যদান করে সিঁড়ির গোড়ায় পড়ে থাকে।

আজ বাদামী রঙের একটি স্যান্ডেল টার্গেট করেছে। এর মালিক ভদ্রলোক মধ্য পঞ্চাশের একজন। যথারীতি তিনিও কফিলের পাশে দামী স্যান্ডেলটি রেখে সামনের সারির দিকে এগিয়ে গেলেন। সাদা শুশ্রুমন্ডিত কফিল নামাজ শেষ হবার অপেক্ষায় চোখ বুজে ধ্যানমগ্ন হয়ে রইলো।
এই সময়টায় কফিল কি ভাবে?

ভাবনা চিন্তার কি আর শেষ আছে। মসজিদ আল্লাহর ঘর। এখানে অবস্থানের সময়টুকুতে একমাত্র আল্লাহতায়ালাকে নিয়েই ভাবতে হয়। তবে কফিল নিজে দেখেছে, মসজিদে এলে হয় ঘুম আসে না হয় রাজ্যের কথা মনে পড়ে।
এখন যেমন কফিলের মনে পড়ছে।

ওর স্মৃতি ওকে প্রচন্ড উত্তেজিত করে তোলে। চোখের সামনে ভাসে বিভীষিকাময় নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধ আর আগুন। কানে বাজে গোলাবারুদের বিকট শব্দ আর অসহায় মানুষের আর্ত চিৎকার! কফিল তখন সতের বছরের। যুবকের খাতায় নাম লিখাবে লিখাবে ভাব। পঁচিশে মার্চের অন্ধকার রাতে হায়েনাদের বুলেটে যখন অজস্র জনতার প্রাণ ঢলে পড়ছিল, সে তখন শেরপুরে নিজের বাড়িতে। পরের দিন সবকিছু যখন জানলো, আরো অনেকের সাথে সেই সতের বছরের কফিলও যেন অনুভূতিতে একজন যুবকে পরিণত হল। মাকে বাঁচাতে হবে! দেশ হানাদার মুক্ত করতে হবে। সবার সাথে বর্ডার পার হয়ে ভারতে চলে গেলো। প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এলো। এরপর তো সবই ইতিহাস…

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের অতীত থেকে ফিরে আসে কফিল। ওর পাশে আরো মুসল্লি এসে বসেছে। নামাজের আরো বাকি আছে দেখে আবারো চোখ বুজে সে।
এবারে তেতাল্লিশ বছর আগের সেই ভয়ংকর দিনগুলো থেকে একটু সামনের দিনে ফিরে আসে।

যুদ্ধের পরে নিজের জমিজমা যেটুকু ছিল সেগুলো তে নতুন উদ্যমে সোনা ফলানোর জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। বিয়ে করে সংসারি হয়। এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সুখের সংসারই ছিল তার। সময়ের সাথে সাথে ছেলেমেয়ে বড় হয়। মেয়ের বিয়ে দেয়। ছেলে বাবাকে সাহায্য করে। দিনগুলো ভালই কেটে যাচ্ছিলো। ছেলের বয়স যখন বত্রিশ, হঠাৎ একদিন ভরদুপুরে ক্ষেত থেকে এসে শরীর খারাপ লাগার কথা বলে। কফিলের হাতেই সে মারা যায়। নিজের বার্ধক্যের ঐ বয়সে কফিল যেন অকূলে পড়ে দিশেহারা হয়ে যায়। ছেলের বউ একমাত্র মেয়েকে নিয়ে নিজের বাপের বাড়ি চলে গেলো। পরবর্তীতে সে আবার বিয়ে করে। মরার উপর খাড়ার ঘা বলে একটা প্রবাদ আছে। কফিলের জীবনে সেই কথাটি খুব কঠিনভাবে ফলে যায়। সর্বগ্রাসী নদী ভাঙনের শিকার হয়ে সে স্ত্রীকে নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। ঘর-বাড়ি জায়গা-জমি সব হারিয়ে উপার্জনের মতো শক্তিহীন হয়ে সুদিনের নয়, কেবল বেঁচে থাকার আশায় কফিল সস্ত্রীক শহরে আসে। কিন্তু পঞ্চাশোর্ধ একজন অশিক্ষিত মানুষকে কে কাজ দিবে?
অনেক ঘুরে ফিরে শেষে একটি গার্মেন্টসে টয়লেট ক্লীনারের কাজ পায়!

চিন্তা-ভাবনা এই পর্যায়ে আসতেই চোখ খোলে কফিল। নিজের ভেতরের সর্বগ্রাসী এক আগুনে নিজেই উত্তপ্ত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে নিজেরই স্বাধীন করা দেশে সে আজ মানুষের নোংরা পরিষ্কার করায় ব্যস্ত! এ ছাড়া ঐ সময়ে ওর আর কোনো পথও খোলা ছিল না। সম্মানজনক কোনো কাজই সে পাচ্ছিল না। ছোট্ট একটি ছাপরা ঘর ভাড়া নিয়ে সে নিজের বউকে সাথে করে জীবনধারণের জন্য দিনগুলো বড্ড হীনমন্যতায় ভুগতে ভুগতে কাটাচ্ছিল।

এরপর ঐ অফিসের একজন কর্মকর্তার ওর প্রতি সদয় মনোভাব দেখে সে নিজের সকল কাহিনী তাকে খুলে বলে। সে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল এ কথাটি ঐ কর্মকর্তাকে জানায়। ভেবেছিল তিনি বোধহয় এ কথা জেনে অবাক হবেন। কিন্তু যে দেশে স্বাধীনতার পর স্বাধীনতা বিরোধী পক্ষ অনেকগুলো বছর ক্ষমতাসীন দলের লেজুড়বৃত্তি করেছে কিংবা অংশ হয়ে থেকেছে… মহান সংসদের সাংসদ হয়েছে… তাদের গাড়িতে এ দেশের জাতীয় পতাকা শোভা পেয়েছে – সেই দেশে একজন কফিল, যে মুক্তিযোদ্ধা ছিল, সে টয়লেট পরিষ্কার করবে না তো কি করবে? স্বাধীনতা বিরোধীদের আজকের এই সুদিনের জন্যই তো এক দিন তারা যুদ্ধ করেছিল বোধহয়!! এমন মুক্তিযোদ্ধা তো আজকাল পথে ঘাটে রেল স্টেশনে কিংবা ওভার ব্রীজের উপর-নিচে অহরহ দেখা যায়!

সেই কর্মকর্তার পরামর্শে কফিল নিজের জন্য একটি মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট গ্রহন করার চেষ্টা করে। ওর কাছে সেরকম কাগজপত্র কিছুই ছিল না। নদী ভাঙ্গনে ওর বাড়ি চলে যাবার সময় অন্য আরো কিছুর সাথে ঐ সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্রও শেষ হয়ে যায়। তারপরও ওর এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের কাছে গিয়ে সে যে যুদ্ধ করেছিল তার প্রমাণস্বরুপ একটি সার্টিফিকেট নিয়ে আসে। সেখানে সে কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছে, ওর মুক্তি নাম্বার এসব কিছু উল্লেখ ছিল।

এরপর চলে আরো কিছু প্রহসন।
স্বাধীনতার আসল সুবিধাভোগী কিছু মানুষ নামের কুলাঙ্গারকে সে নিজের চোখে বড্ড স্পষ্ট দেখতে পায়। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ওর মাসিক ভাতা পাবার জন্য সে মন্ত্রনালয়ে অনেকদিন ঘুরপাক খায়। সেখানে ঘাটে ঘাটে বসে আছে কিছু টাকার ক্ষাক্কস। এরা রাক্ষসের থেকেও অনেক ভয়ংকর। রাক্ষসেরা তো ক্ষুধা লাগলে কেবল খায়। কিন্তু এই ক্ষাক্কসেরা ক্ষুধা লাগুক আর নাই লাগুক, নিরবচ্ছিন্ন ভাবে খেতেই থাকে। কিন্তু কফিল বেঁকে বসে। সে বলে, ‘ আমি একজন আসল মুক্তিযোদ্ধা, আমি আমার সার্টিফিকেট নেবার জন্য কেন টাকা দেবো?’ যে অন্যায়-অবিচার আর শোষণের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে একদিন যুদ্ধ করেছিল, সেই যুদ্ধের একজন বীর যোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে তাকে অন্যায় ভাবে ঘুষ দিতে হবে? কফিলের এতগুলো বছর যখন এই সার্টিফিকেট লাগেনি, তবে এই বয়সে এসে ওভাবে নেয়ারও আর প্রয়োজন নেই।

পরবর্তীতে সেই কর্মকর্তার প্রশ্নের জবাবে কফিল জানিয়েছিল, ‘ আমি কোনো মুক্তিযোদ্ধাই না। আমি কোনো যুদ্ধ করিনি। এ দেশে কখনোই কোনো যুদ্ধ হয়নি।‘ আসলে কফিলের যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার আটত্রিশ বছর পর। এরকম যুদ্ধ এ দেশের হাজার হাজার মানুষ করে চলেছে। খেয়ে পরে একটু বেঁচে থাকার যুদ্ধ!

যে দেশে দফায় দফায় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হালনাগাদ হয়, সে দেশে একজন কফিল- একজন টয়লেট ক্লীনার, যে নিজের নীতিতে অটল থেকে ঘুষ না দিয়ে নিজের সার্টিফিকেট পেতে চায়! কি দুঃসাহস ওর? কতটা অসম্ভব ওর এই চাওয়া!!

এভাবে সাতটি বছর ঐ ফ্যাক্টরীতে ক্লীনারের কাজ করেছে কফিল। এরপর ওর বয়স ষাট হয়ে যাওয়াতে চাকুরি থেকে অবসর নিতে হয় ওকে। সব মিলিয়ে বারো হাজার টাকার মতো পেয়েছিল সে চলে আসার সময়ে।
জীবনের সামনে অনিশ্চিত দিনগুলো। হাতে বারো হাজার টাকা। কিন্তু শহরে ভাড়া বাসায় থেকে চাকুরীহীন সময় কাটালে ঐ পরিমান টাকায় আর ক’দিন চলে? কাজ খোঁজে আর জমা টাকা ভাঙ্গে। একদিন সব টাকা শেষ হয়। কিন্তু কাজ আর কোথায়ও পায় না। শরীরে শক্তিও নাই যে কামলা খাটবে কিংবা রিক্সা চালানোর মত পরিশ্রমের কাজ করবে।

একদিন ভিক্ষা করার জন্য এক ওভারব্রীজের নিচে সিঁড়ির গোড়ায় বসে যায়। কিন্তু সেখানে ও যে চলে টাকার খেলা। দখলের মেলা। ভিক্ষাবৃত্তি এখন যদিও আয়ের একটি সহজ পথ, কিন্তু এখানেও রয়েছে প্রভাবশালীদের কালো হাত। এদেরকেও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তাই সে ভিক্ষা ও করতে পারে না। ওকে পুরনো দখলদার ভিক্ষুকেরা দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়।

প্রচন্ড ক্ষুধায় কষ্টে লজ্জায় অপমানে হয়ত কফিল একা হলে মরেই যেতো। কিন্তু ওর এতোদিনের সুখ দুঃখের সাথী বউও যে সাথে রয়েছে। তাই জীবনের দিনগুলো পার করতে কফিল নিজেকে ভুলে যায়।
একজন কফিল কোনো সময়ে যে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল- একথা বিস্মৃত হয়।
আপনি কি বাঙালি?
আপনি কি মুক্তিযোদ্ধা?
আপনি কি রাজাকার আলবদর?
আপনি কি পাকিস্তানী বর্বরতার শিকার?
এসব প্রশ্নের আজ আর কোনো দামই নাই। আপনার কি টাকা আছে? আপনার কি সঠিক রাজনৈতিক যোগাযোগ আছে? আপনি কি ক্ষমতাসীন দলের লেজুড়বৃত্তি করতে ইচ্ছুক? এই প্রশ্নগুলোর হা-বোধক উত্তর হলে আপনি একজন মানুষ বলে গন্য হতে পারবেন এ সমাজে। নচেৎ আপনি কবে কোনকালে কি ছিলেন, সেগুলো ধুয়ে পানি খাওয়া ছাড়া আর কোনো কাজে আসবে না।

জীবনের প্রথম জুতো জোড়া সে চুরি করেছিল মাগরিবের নামাজের সময়ে। খুবই পরিচিত এক মসজিদে। সেই গুলো পায়ে দিয়ে কফিল যখন এক নতুন জীবনের দিকে পা পা আগাচ্ছিল, এক এক কদমে কি একজন মুক্তিযোদ্ধার পদস্খলন হচ্ছিল না?
কফিল কি টের পাচ্ছিল?
কফিল কি ওর হৃদয়ের রক্তক্ষরণ অনুভব করছিল?
ওর চেতনায় কি এ কথা ভাসছিল, সে একজন মুক্তিযোদ্ধা? বা ছিল?
কিন্তু কফিল এখন আর মুক্তিযোদ্ধা নাই। কারণ তার সার্টিফিকেট নাই।
পতনের কি সেই শুরু ছিল?
কফিলের পতন কি আরো আগে থেকে হয়নি? স্বাধীনতার পরবর্তী সরকারগুলো কি এই পতনের জন্য দায়ী ছিল না? আজ তারা কি এর দায়ভার নেবে?

মুয়াজ্জিনের একামতের শব্দে একজন জুতো চোর কফিল দাঁড়িয়ে যায়। অন্য মুসল্লিদের পাশে একজন ঘৃন্য মানুষ যে একসময় সোনার মানুষ ছিল, নামাজের জন্য অপেক্ষা করে। আসলে সে অপেক্ষা করে নামাজ শেষ হবার। ঘৃন্য একটি কাজ চুপিসারে সমাধা করবার।

নামাজ শেষ হলে কফিল ওর টার্গেট করা স্যান্ডেল জোড়া হাতে নেয়। অতি স্বাভাবিক ভাবে বের হয়ে মসজিদের বারান্দা পর্যন্ত চলে আসে। সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রেখেই স্যান্ডেল জোড়া নামিয়ে রেখে সেখানে পা ঢোকাতে গিয়েও আর পারে না। পেছন থেকে একটি বলিষ্ঠ হাত ওর ঘাড় ধরে ফেলে। ওকে জোর করে টেনে বারান্দার উপরে তোলা হয়। কফিলের ভাগ্য আজ খারাপ ছিল। যে ভদ্রলোকের স্যান্ডেল সে টার্গেট করেছিল তিনি একা আসেননি এখানে। তার সাথে আরো দুজন ছিলো। যুবক বয়সী এরা। কফিলের পাশেই তারাও বসে ছিল। তাই নামাজ শেষ হতে মোনাজাত শেষ না করেই কফিল যখন ওদের মুরব্বির স্যান্ডেল জোড়া হাতে নিয়ে বের হতে যাচ্ছে, হাতেনাতে আজ তারা ওকে ধরে ফেলে।

মুহুর্তে অনেক মানুষের ভীড় জমে যায়।
একজন জুতো চোর ধরা পরেছে গুঞ্জনে ওকে ঘিরে অনেক মুসল্লি চলে আসে। এর ভেতরে যুবক কয়েকজন কফিলকে টেনে হিচড়ে মারধোর শুরু করে। কফিল কোনো বাঁধাই দেয় না। হঠাৎ জীবন ওর কাছে বড্ড ফালতু কিছু মনে হয়। মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হল কাউকে মারতে দেখলে আরো বেশী করে ঝাপিয়ে পড়া। আর যদি জানা যায় সে চোর তবে তো কথাই নাই। কয়েকজন মুরব্বী গোছের মুসল্লি অবশ্য না মারতে বললেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। অবশেষে যার স্যান্ডেল চুরির দায়ে কফিলকে মাটিতে ফেলে রক্তাক্ত করা হচ্ছিল, তিনি এলেন। সবাই ওনাকে দেখে কেমন সমীহ ভরা দৃষ্টিতে সরে যায়গা করে দিলো। তিনি সদ্য বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া একজন সচিব। সব শুনে কাছে এসে কফিলকে ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করেন। তার সোনালী ফ্রেমের দামী চশমার গ্লাস পাঞ্জাবির খুটে পরিষ্কার করে একজন ‘চোর’কে দেখতে কাছে এগিয়ে আসেন। কফিলের সাদা দাঁড়ি রক্তে রঞ্জিত। একটা চোখ ফুলে গেছে। সেই অবস্থায় কফিলও ওনাকে দেখার চেষ্টা করে। এবং এক চোখ নিয়েও কফিল তাকে দেখে চিনে ফেলে। টয়লেট ক্লীনারের চাকুরি করাকালীন এই লোকের ছবি সে পেপারে দেখেছে। অফিসের স্যারেরা ওনাকে নিয়েও অনেক আলোচনা করেছিলো। এই সচিব পর্যায়ের মানুষটি নিজের বয়স জালিয়াতি করে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিতে চেয়েছিলেন। শেষে মিডিয়ায় অনেক আলোচনা সমালোচনার দ্বারা বিষয়টি ফাঁস হয়ে যায়। নিজের পদমর্যাদা সব কিছু হারাতে হয়েছিল ওনাকে। ব্যাপারটা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট সংক্রান্ত হওয়াতে কফিলের বেশ আগ্রহ ছিল এই ঘটনাটিতে। সে ঐ মানুষটিকে দেখতে চেয়েছিল। এজন্যই আজ কফিল তাকে পুর্বপরিচয় না থাকলেও আলোচনার জের ধরে আগে ছবি দেখাতে এখন চিনতে পারে।

সাবেক সচিব এসে রাগান্বিত স্বরে বললেন,’ এই বয়সে মসজিদ থেকে জুতো চুরি! ব্যাটা পাকা হারামি। কাজ করে খেতে পারিস না? অ্যাই, ওকে আরো কয়েক ঘা লাগা।‘ যুবকেরা ক্রোধান্বিত হয়ে মারতে উদ্যত হলে, নিচে পড়ে থাকা অবস্থায়ই কফিল হেসে উঠে। ধীরে ধীরে ওর হাসি অট্টহাসিতে পরিণত হয়। একজন চোর যেন তেতাল্লিশ বছর আগের সেই মুক্তিযোদ্ধায় পরিণত হয়। হাসি থামিয়ে সে সাবেক সচিবের চোখে চোখ রেখে বলে,

’ তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।‘

এই কবিতাটি ওর সুদিনের সময়ে মেয়ে স্কুলে পড়াকালীন কফিলকে অনেকবার আবৃত্তি করে শুনিয়েছে। কবিতার এই লাইনটি কফিলের বড্ড ভালো লেগেছিল। সে আজ তা কাজে লাগালো।

এরপর কফিল ওর মুখের ভেতর থেকে রক্ত মেশানো থুথু সজোরে সাবেক সচিবের মুখ লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করে। দামী পাঞ্জাবীসহ লোকটির মুখের একাংশ রক্ত ও কফে একাকার হয়ে যায়। এই ঘটনা দেখে উত্তেজিত যুবকেরা একযোগে সবাই কফিলের ওপর ঝাঁপিয়ে পরে। একের পর এক আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকা কফিল অনুভূতিতে কোনো কষ্টই পায় না। সে চোর থেকে আবার একজন মুক্তিযোদ্ধায় পরিণত হয়। ওর মনে হয় সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। আর একজন মুক্তিযোদ্ধা আজীবনই মুক্তিযোদ্ধা। এজন্য তার কোনো কাগজের সার্টিফিকেট লাগে না।

একজন কফিলের নিক্ষিপ্ত ঐ ঘৃণার থুথু কি এ দেশের গলদ সিস্টেমের বেড়াজালে বন্দী রাষ্ট্রযন্ত্রের ততোধিক ঘৃণিত কিছু মুখোশধারী নেতৃত্বের ওপরে পড়ে নাই?
কিন্তু এতে কি তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া হবে? না কখনো হয়ে এসেছে?

কাগজের মুক্তিযোদ্ধারা মাস গেলে তৃতীয় প্রজন্ম পর্যন্ত ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা পেতে থাকবে। আর কফিলের মত দেশের সূর্যসন্তানেরা মাটিতে চোর হিসেবে গড়াগড়ি খেতে খেতে ক্ষতবিক্ষত হবে।
কিন্তু কেউ কি জানবে কখনো, কফিল একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল??

(শেষ)
৩৫ Likes ৩৫ Comments ০ Share ৪৪৮ Views