আমার বড় বোন খুলনায় থাকতো, আমার দুলাভাই সেখানে চাকুরী করে। একদিন আমার বড় বোন একাই খুলনাতে যাচ্ছিল। কারণ আমার দুলাভাই তখন খুলনাতেই ছিল। আমাকে আমার বাবা বলল , তোমার আপাকে পার্বতীপুর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আস। আমি তখন কাস এইটে পড়ি। আমার এটাই ছিল জীবনের প্রথম একা একাই ভ্রমণ।
যা হউক, আমার আপুকে পার্বতীপুরে খুলনার ট্রেনে উঠিয়ে দিলাম রাত ৮টায় । আর আমি রাত ১ টার দিকে এক লোকাল ট্রেনে উঠে রওয়ানা হলাম নিজ বাড়ি অভিমুখে । লোকাল ট্রেনতো চলছে তো চলছেই ! ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের হাওয়া শনশন করে গায়ে লাগছিল । বারবার মনে পড়ছিল আপুকে বিদায় জানিয়ে বাড়ি ফিরবার কথা আর স্কুলের অংক স্যারের কথা । আপু চলে গেল অনেক দূরে সেই খুলনায় , বিষন্নতায় মনটা ছটফট করছিল । এদিকে পরদিন সকালে স্কুলে বিএসসি স্যারের অংক করে নিয়ে স্কুল যাওয়া হবেনা তার জন্য বকুনি খেতে হবে ভাবনাগুলো মনটাকে বড় উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল । এমনি করেই রাত ৩ টায় ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে এসে থামলো শিবগঞ্জ স্টেশনে । ট্রেন থেকে দেখি স্টেশনের প্লাটফর্মে একটাও মানুষ নেই। শুধু দুর থেকে দেখা যায় কয়েকটা কুকুর।
এই দেখে আমি ভয়ে কাঁদতে লাগলাম। কিন্তু কে শোনে আমার কথা। কোন মানুষ থাকলেনা আমার কথা শুনবে।
এমন অবস্থায় স্টেশন থেকে যাবার কোন মনমানষিকতাও ছিল না । অথচ রেলস্টেশন থেকে আমাদের বাড়ি মাত্র ২ মিনিটের রাস্তা। আর আমাকে বাড়িতে যেতে হলে এক ভয়ঙ্কর বিশাল বট গাছের নিচ দিয়ে যেতে হবে। আমি শুনেছি ওই গাছে নাকি অনেক ভূত, জ্বিন আছে।
তো আমি নিজে নিজেকে সাহস দিলাম যা বাবু বাড়ী যাও, কোন বিপদ হবেনা।
এই কথা সেই কথা ভাবতে ভাবেত আমি সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম যাই আজকে যা হবার হবে।
আমি বুকে কয়েকটা বড় বড় ফু দিয়ে আশে পাশে তাকিয়ে দেখলাম মানুষতো নেই। এখানে একা একা থাকলে আমার আরো অবস্থা খারাপ হবে।
যত বাধাই আসুক আমাকে যেতে হবেই। আমি তখন রেল লাইন থেকে দুইটি পাথর নিলাম। ভাবলাম পাথর পাথর সংঘর্ষে আগুন বের হয়। আর আগুন দেখলেতো ভূত কাছেই আসবে না।
তাই আমি পাথর দু’টি দু’হাতে নিয়ে আঘাত করতে করতে আস্তে আস্তে হাঁটছিলাম। আমি বট গাছের কাছাকাছি আসতে শুনি। জিকির করার মত আওয়াজ আসছে। কিন্তু বুঝতে পারছিনা কোথা থেকে জিকিরের আওয়াজ আসছে। আমি ভাবলাম আমি মনে হয় ভুল শুনছি। তার পর পরই দেখি বটগাছের উপড়ে ডালপালা নড়ছে একপাশ দিয়ে। আমি ভাবলাম বাতাস হলে গাছের সব পাতাগুলো নড়তো। কিন্তু এটা একপাশ দিয়ে নড়তেছে কেন! আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ভয়ে আমার শরীর থর থর করে কাঁপতে লাগলো। আমি আর হাঁটতে পারছিলাম না। তাও সাহস করে বট গাছের নিচে দেখি এক জায়গায় চার পাঁচ জনের মত হুজুর জিকির করছে। আর কিছু দূরে তাকালাম কতজন হুজুর বসে আছে, মনে হয়খেতে বসেছে।
অন্ধকার রাত ছিল এটি ঠিক মত বুঝা যাচ্ছিলনা। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল আমি যে দৌড় দিয়ে পালিয়ে যাব সেই শক্তিটুকু পাচ্ছিলাম না। আমি দাঁড়িয়ে আছি চুপকরে। হঠাৎ দেখি আমার পিছন থেকে আরো তিন জন হুজুর আসছে, তিন জনের হাতেই ছিল মিষ্টির হাড়ি। আর তারা এত সুন্দর ছিল যে, তাদের চেহেরা আলোয় জ্বল জ্বল করছে। তারা লম্বায় ছিল আনুমানিক ৮ ফুটের মতো। আমি এবার বুঝতে পারলাম এরা হয়তো জ্বিন। এরা আমার কাছাকাছি আসতে আমি ভয়ে ভয়ে সালাম দিতে ওদের মধ্যে একজন আমাকেও সালাম দিল। তারপর আর একজন জিজ্ঞাসা করল “পার্বতীপুর থেকে আসলে বাবু ?”
-আমি বললাম হ্যাঁ।
আমি অবাক হলাম তারা আমার নাম কিভাবে জানলো !
- এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছিস? আমি বললাম ভয় পাচ্ছি তাই আর বাড়ী যেতে পারছিনা।
তাদের মধ্যে একজন বলল
- আজকে তোর কপাল ভালো আজ এই রাতে আমরা কারো তি করিনা।
-আমি বললাম আপনারা কে আমাকে কিভাবে চিনেন ?
-বলল বেশি কথা বলিওনা তাহলে মেরে ওই বট গাছের উপড়ে বেঁধে রাখবো।
তাদের সাথে কথা বলতে বলতে বট গাছ থেকে জিকির করা একজন আমার দিকে আসা শুরু করল। আমি তাকে দেখে আরও ভয় পেলাম। তার চেহারাটা এত বিভৎস্য যে দেখতে ভয়ঙ্কর, তার চোখগুলো বড় বড়, মুখ নাই, নাক নাই। শুধু চোখ গুলো বড় বড়।
আর সে বলতে বলতে আসছিল এই ওকে ধর......... ধর। আমারতো মাথা ভন ভন করে ঘুরছিলো। সাথে সাথে দেখি এই রাস্তার দিকে হেড লাইট জ্বালিয়ে দুইটি ট্রাক খুব দ্রুত এদিকেই আসছে হর্ণ বাজাতে বাজাতে, ট্রাকগুলো আমার কাছাকাছি আসতে না আসতেই সব অদৃশ্য হয়ে গেলো। আর আমি একটুকু না দেরি করে ট্রাকের পিছনে পিছনে দৌড় দিয়ে বাড়িতে ফিরলাম। এই কথাগুলো মনের ভিতরে রেখেছি কাউকে বলিনি। আপনারাও কাউকে বলবেন না কারণ ঐ যে বটগাছটার কথা বলে ছিলাম সেটি আজও আছে। কিন্তু এখন আর জ্বিন- ভূতের কোন আলামত নেই! এখন শুধুই স্মৃতি ।