লাইট ঠিকমতো রেডি করেছ তো?
জী ম্যাডাম। আফনে কওনের আগেই রেডি কইরা ফালাইসি।
আর শট গুলো ঠিকমতো রেডি করেছ তো? শট রেডি না থাকলে কিন্তু সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমরা কিন্তু বেশিক্ষণ সময় পাব না। যা করার এই কম সময়ের মধ্যেই করতে হবে। বারে বারে বলছি কোন কিছু যেন বাদ না যায়। আর কোন কিছুতেই যেন ভুল না হয়।
আরে অইব না আফা। আফনে একদম টেনশন নিয়েন না। আফনে খালি মাইয়াডারে ঠিকমতো ম্যানেজ করেন। বাকিডা আমগো উপর ছাইড়া দেন।
গুড। আচ্ছা মবিন তুমি কি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারো না? তোমাকে না কতবার বলেছি আমার সাথে এভাবে বিশ্রী ভাষায় কথা বলবে না।
কি করমু আফা কন? নাড়ির টান। ছাড়বার পারি না।
এই বলে মবিন দাঁতের ফাঁক দিয়ে পানের পিক ফেলল। রুমা প্রায় সময় ভাবে ক্যামেরাম্যান হিসেবে মবিনকে সে বাদ দিয়ে দিবে কিন্তু বাদ দিব দিব করেও তাকে বাদ দেয়া হচ্ছে না। কথা বার্তা বিশ্রী ধরণের হলেও লোকটি কাজ জানে। তার উপর তার সবচেয়ে বড় গুণ হোল যে কোন পরিস্থিতি সে সামলাতে পারে। যেমন ঐদিন পত্রিকার জন্য এক ধর্ষিত হওয়া মেয়ের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিল সে। কিন্তু গ্রামের লোকজন তাদের দেখে এমনভাবে ক্ষেপেছিল যে সেখান থেকে তারা বের হয়ে আসতে পারবে কিনা এই নিয়ে তাদের মধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছিল। কিন্তু সেই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে মবিন অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় গ্রামের লোকজনের সাথে কথা বলে পরিস্থিতি সামলে নিয়েছিল। সেই ধর্ষিত মেয়ের সাক্ষাৎকার আর সেদিন রুমার নেয়া হয় নি কিন্তু নিজের জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারায় বাসায় পৌঁছেই সে তাওবা করেছিল যে জীবনে আর কোনদিন এরকম ইন্টার্ভিউ সে নিতে যাবে না।
আজকের সাক্ষাৎকারটি নেয়ার জন্য রুমা আর মবিন প্রায় ৪ ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছে। সাংবাদিকদের এতো ভিড় এখানে যে তাদের সাথে রুমা কুলিয়ে উঠতে পারছে না। তার উপর দেশের সব নামকরা টিভি চ্যানেল এর সব সাংবাদিক এখানে উপস্থিত আছে। তাদের তুলনায় রুমা কিছুই না। সদ্য সাংবাদিকতার উপর গ্র্যাডুয়েশন শেষ করে সে বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলে জয়েন করেছে। টিভি চ্যানেলটিও অতোটা নামকরা নয়। তারপরও, পেটের দায় সামলানো দিয়ে হোল কথা।
আর কতক্ষণ লাগবে মবিন?
আর বেশিক্ষণ মনে হয় লাগবো না আফা। আমগোরে আগেই যাইতে দিব। আমি ম্যানেজ করসি।
মবিনের কথা শেষ না হতে হতেই সামনে থেকে একজন লোক হাতের ইশারায় রুমাকে ভেতরে যেতে বলল। সাক্ষাৎকার যে ঘরে নেয়া হবে সে ঘরে ঢুকার দরজাটা অনেক ছোট। মবিনের বেশ কষ্ট হোল ক্যামেরা আর অন্যান্য যন্ত্রপাতি বিশেষ করে লাইটইং এর জিনিসপত্র গুলো ঢুকাতে।
ঘরের মাঝখানে ছোট্ট একটা চেয়ার রাখা। তার সামনে একটি বেতের টেবিল। টেবিলটি বেশ পুরানো দেখেই বুঝা যায়। চেয়ারটিতে যবুথবু হয়ে একটি বাচ্চা মেয়ে বসে আছে। মেয়েটির বয়স কতো হবে? বড়জোর ১০ কি ১১ বছর। মেয়েটির চোখে মুখে চাপা বিস্ময়। এই পর্যন্ত বোধয় শ খানেক সাক্ষাৎকার সে ইতিমধ্যে দিয়ে ফেলেছে। রুমা আর মবিন ক্যামেরা রেডি করে পসিশন নিলো। মবিন রেডি বলার সাথে সাথেই রুমা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কথা বলতে শুরু করলো।
কি নাম তোমার আপু?
মেয়েটি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, সাদিয়া মেহজাবিন।
কেমন লাগছে তোমার এখন?
ভালো লাগছে।
তুমি এতো ভালো রেজাল্ট করেছ। নিশ্চয়ই তুমি অনেক খুশি।
মেয়েটি কিছু না বলে রুমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল।
আচ্ছা এখন বল তোমার এতো ভালো রেজাল্ট করার পেছনে কে বেশি তোমাকে সাহায্য করেছে? তোমার বাবা মা নাকি তোমার শিক্ষকরা?
আম্মু আমাকে পড়াত।
তার মানে তুমি বলতে চাঁচ্ছ তোমার মা তোমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে।
হুম।
তুমি কি জানো আমাদের দেশে এতো ভালো রেজাল্ট আগে কখনো হয় নি বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায়। তোমার রেজাল্ট এতোই ভালো যে ভবিষ্যতে কেউ তোমার মতো ভালো রেজাল্ট করতে পারবে কিনা এ নিয়েও অনেকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ছে। এ বিষয়ে তোমার কি মতামত?
মেয়েটি ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ রুমার দিকে তাকিয়ে রইলো। সম্ভবত সে তার প্রশ্নটি বুঝতে পারছে না। রুমা যেই না তাকে প্রশ্নটা আবার জিজ্ঞেস করতে যাবে তখনি মেয়েটি বলে উঠলো,
আমার মতো পড়লে সবাই পারবে।
তুমি বলতে চাঁচ্ছ তোমার মতো করে পড়লে সবাই পারবে। আচ্ছা তুমি কিভাবে পড়াশোনা করেছিলে? দিনে কতো ঘণ্টা করে পড়াশোনা করতে?
আম্মু যখন কাজ শেষ করে বাসায় আসতো তখন পরতাম।
বাকি সময়টুকু তুমি কি করতে?
আম্মু বাসার কাজ দেখিয়ে দিয়ে যেত বাসার কাজ করতাম।
তোমার আম্মু কোথায় চাকরি মানে কোথায় কাজ করেন?
এই প্রশ্ন শুনে মেয়েটি মাথা নিচু করে ফেলল। মাথা নিচু করে আসতে আসতে বলল, আম্মু নিলু খালাদের বাসায় কাজ করে।
রুমা মেয়েটির প্রশ্নের জবাবে রীতিমতো ধাক্কা খেল। তাকে এই সাক্ষাৎকারের বিষয়ে কোন তথ্য দেয়া হয় নি অফিস থেকে। আগে থেকে কিছু জানা থাকলে সে বুঝে শুনে এই মেয়েটিকে প্রশ্ন করতো। তাকে শুধু অফিস থেকে শুধু মাত্র একটি ফরমেট দেয়া হয়েছে প্রশ্নের। তাকে সেই ফরমেট অনুযায়ী এই মেয়েটিকে প্রশ্ন করতে হবে। রুমা ভেতরে ভেতরে বেশ চিন্তিত বোধ করতে লাগলো। কারণ পরের প্রশ্নগুলো আগেরটির চেয়ে আরও ভয়াবহ।
আচ্ছা তোমার বাবা কি করে?
জানি না।
তোমার বাবা কিছু করেন না?
মেয়েটি এবারও মাথা নিচু করে বলল, আমার বাবা আমাদের সাথে থাকে না।
রুমার প্রচণ্ড অশ্বস্থি বোধ হতে লাগলো। মেয়েটিকে প্রত্যেকটি প্রশ্ন করে মানসিকভাবে তাকে আঘাত করা হচ্ছে। লজ্জায় মেয়েটি মাথা পর্যন্ত তুলতে পারছে না। রুমার একবার ইচ্ছা হোল সে সাক্ষাৎকার না নিয়ে বের হয়ে আসবে। কিন্তু কি মনে করে সে আবার প্রশ্ন করতে শুরু করলো,
কয় ভাই বোন তোমরা?
২ বোন এক ভাই, আমি সবার বড়।
এই প্রথমবার রুমা মেয়েটিকে মিষ্টি করে হাসতে দেখল। ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় হওয়াতে সে যেন বেশ আনন্দিত।
তোমার বাকি ভাই বোনরা কি করে? পড়াশোনা করে তোমার মতো?
না।
কেন করে না কেন?
আমি বড় হলে তারা পড়াশোনা করবে।
কেন তুমি তাদের পড়াবে?
না। আমি পড়াশোনা করলে সবাই আমাকে অনেক টাকা দিবে। সেই টাকা দিয়ে আমি টিচার রাখবো। সেই টিচার আমার ভাই বোনদের পড়াবে।
আচ্ছা এখন বল তুমি এতো ভালো রেজাল্ট করেছ। তোমাকে নিশ্চয়ই অনেক টিচার পড়িয়েছে। তুমি কাদের কাদের কাছে পড়েছ?
আমাকে আম্মু পড়াত।
তার মানে তুমি কোন টিচারের কাছে পড় নি?
না। মেয়েটি আফসোসের সুরে বলল, টিচাররা অনেক টাকা নেয় তো তাই পড়তে পারি নি।
রুমা আবারো কষ্ট পেল। আজ কালকার ছেলে মেয়েদের প্রত্যেকটি বিষয়ের জন্য একজন করে টিচার রাখা হয়। তারপরও অনেক সময় দেখা যায় তাদের রেজাল্ট ভালো হচ্ছে না। আর এই মেয়ে কিনা নিজে নিজে পড়ে এতটুকু এসেছে।
তোমাকে আজ বিকেলে একটি কোচিং সেন্টার থেকে সংবর্ধনা দেয়া হবে। সেটা কি তুমি জানো?
মেয়েটি আবারো একটু অবাক হয়ে রুমার দিকে তাকাল। রুমা বুঝতে পারলো সে আসলে সংবর্ধনা কথাটি ঠিক বুঝতে পারছে না। তাই সে আবারো জিজ্ঞেস করলো,
তোমাকে যে আজকে সেখান থেকে পুরস্কার দেয়া হবে তুমি কি তা জানো?
হ্যাঁ জানি। আম্মুকে এসে তারা বলে গেছে।
তুমি কি সেখানে পড়তে?
পরীক্ষার আগে পড়েছিলাম।
কতদিন পড়েছিলে?
১ মাস।
আচ্ছা, কোচিং সেন্টারটি তো এখান থেকে অনেক দূরে। তোমার বাসা থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার। এতো দূরে গিয়ে পড়তে কেন? তোমার বাসার কাছেই তো অনেক ভালো ভালো কোচিং সেন্টার আছে। তারা কি অনেক ভালো কেয়ার নিতো তোমার?
মেয়েটি এবারো মাথা নিচু করে বলল, আমার বাসার কাছের কোচিং সেন্টারগুলা অনেক টাকা নিতো। সেটাতে কম টাকা নিতো তো তাই পড়তাম।
বল কি? তোমার বাসা থেকে তো সেটা অনেক দূরে। যাওয়া আসা করতে কিভাবে?
হেঁটে যেতাম।
হেঁটে যেতে মানে? এতো দূরে হেঁটে যেতে?
মেয়েটি অস্পষ্টভাবে বলল, ভাড়ার টাকা থাকতো নাতো। তাই হেঁটে যেতাম।
তোমার সাথে কেউ যেত? তোমার কোন বন্ধু ছিল সেখানে? আসা যাওয়া নিশ্চয়ই একা করতে না।
আমি একা একাই যেতাম। আমার সাথে কেউ থাকতো না।
কেন?
সবার কাছে টাকা থাকতো তো। তারা রিক্সা করে যেত। কেউ হেঁটে যেত না। রিক্সায় করে গেলে অনেকে আমার সাথে আসতো। আমি হেঁটে আসতাম তো। সেখানে হাঁটার মতো কেউ ছিল না। হেঁটে আসতে গেলে কাউকে পাওয়া যেত না।
রুমা চায়ের দোকানে বসে আছে। চা তৈরি হচ্ছে। তার পাশেই মবিন অস্থির অবস্থায় বসে আছে। রুমা তাকে বলেছে কোন কথা এখন না বলতে। কিন্তু মবিন বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারলো না।
এডা কি করলেন আফা। ইন্টার্ভিউ শেষ না কইরাই বাইর হইয়া আইসা পরলেন।
মবিন তোমাকে না বলেছি চুপ থাকতে।
আমি চুপ থাকুম কেমনে আফা কন? বসেরে কি জবাব দেমু। আফনে কইলে আমি আবার শট রেডি করি। আরেকবার চেষ্টা কইরা দেহেন।
শট রেডি করতে হবে না। আমি এই মেয়ের সাক্ষাৎকার আর নিব না। আর যেটুকু করেছি সেটাও চ্যানেলে জমা দেব না।
এডা কি কন আফা? কেন নিবেন না আর ইন্টার্ভিউ?
রুমা অন্যমনস্ক হয়ে মবিনকে জবাব দিল, সব প্রশ্নের উত্তর থাকে না মবিন।
পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ কষ্ট সহ্য করার অমানুষিক ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। সাদিয়া নামের এই মেয়েটি সেই অনেক মানুষগুলোর মধ্যে একজন।
-------------------
Comments (2)
বাহ সুন্দর
অনেক ধন্যবাদ @আলমগীর সরকার লিটন ভাই। ভাল থাকবেন...