Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

এই তো আমার বাবা! # ছোট গল্প

মোবারক স্যারের পুকুরটা বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজের ঠিক দক্ষিণ পাশে। ভার্সিটির ভিতর হবার পরও এর নাম 'মোবারক স্যারের পুকুর' হবার পিছনে কি কারণ থাকতে পারে? একা একা ভাবছিল আরাফাত। পুকুরটির পশ্চিম দিকের পাড়ে চুপচাপ বসে আছে সে। দ্বিতীয় বারের মত ওর মনে এই নামকরণের পিছনের কারণ কি তা জানার ইচ্ছেটা কেন জানি জেগে উঠল। হয়ত মোবারক স্যার দীর্ঘদিন এই পুকুরটি লীজ নিয়ে মাছ চাষ করেছিলেন, তাই বোধ হয় এরুপ নামকরণ। তবে রংপুর পুকুর এর নাম কেন রংপুর হল? এই নামের কোনো শিক্ষক আছেন বা ছিলেন কিনা ভাবতে চেষ্টা করল...

ধুত্তুরি! কি ভাবছে এসব?

আজ মন খারাপের চুড়ান্ত হয়েছে বাসায়। এজন্য স্কুলেও যায়নি। এই স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র আরাফাত। কিন্তু বাসায় সকালে আব্বুর কিছু কথা শুনে ভাল লাগেনি... মনটা সেজন্যই খারাপ। ইদানিং আব্বু কোনো ভাবেই ওর উপর স্যাটিসফাইড নন। জে এস সি পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পাওয়ার পরেও আব্বু বলেছিল, ' আরো ভাল করতে হবে।' আরাফাতের ইচ্ছে ছিল কমার্স নিয়ে পড়ার। কিন্তু আব্বুর ইচ্ছেতে সাইন্স নিতে হল। সবাই আফজাল স্যারের বাসায় ব্যাচে পড়ে। সে ও সেখানে পড়তে চাইলে আব্বু গম্ভীর হয়ে বললেন, ' হুম, পড়ার থেকে আড্ডা হবে বেশী। বাসায় ভালো একজন টিচার রেখে দিবো।' ও যেটা চায় আব্বু সবসময় সেটার বিপরীত করবেন। অথচ ছেলেবেলায় ও যেটা চেয়েছে বিনা শর্তে এক কথায় সেটা করেছে। সেই একই মানুষ কিভাবে ও বড় হবার সাথে সাথে চেঞ্জ হয়ে গেলেন?

মোবাইলের রিং বাজাতে বসা থেকে উঠে পড়ল। শামিমের কল। রিসিভ করল। ও কোথায় জানতে চাইলে আরাফাত জানালো। ও কে স্কুলের পশ্চিম পাশের পেয়ারা বাগানে আসতে বলে লাইন কেটে দিলো শামিম। ধীরে ধীরে সামনে আগাতে থাকে সে। হাঁটে আর ভাবে আজকাল সে নিজেও আব্বু আম্মুর সাথে অশান্ত ব্যবহার করছে। যে কোনো কথাতেই কেমন বিরক্ত হয়... ঝাঁঝিয়ে ওঠে... ঠিক মত কথার উত্তর দিতে ইচ্ছে করেনা। ওর কাছে আজকাল ওনাদেরকে বিরক্ত লাগে। এজন্য আব্বু-আম্মুই দায়ী। একটা গাছের ডালের সাথে হোঁচট খেয়ে থামতে বাধ্য হল। যন্ত্রনায় মাথায় আগুন ধরে গেল। চিন্তার তিক্ততার সাথে পায়ের নখের আঘাতের ফলে সৃষ্ট যন্ত্রনা, আক্ষরিক অর্থেই সকালটাকে আরো খারাপ করে দিল। আপাতত ভাবনা চিন্তাকে বাক্সবন্দী করে অদূরে বসে থাকা শামিম ও রাসেলের দিকে আগালো। দৃঢ় চোয়াল, দৃপ্ত পদক্ষেপ।

কাছে যেতেই সে দেখল শামিম ও শিহাব বসে আছে। আর খোকন সিগ্রেট খালি করে তার ভিতরের তামাক বাইরে ফেলছে। কৌতূহল নিয়ে আরাফাত সব দেখতে লাগল। শেষে শামিমকে জিজ্ঞেস করল,

: কি করছে ও?

: স্টিক বানাচ্ছে!

: স্টিক?

: হ্যা, গাঁজা বানাচ্ছি। খাবি?

: ধুর! আমি কি এইসব খাই?

: আরে একদিন খেলে কিস্যু হবে না।

খোকনও শামিমের কথায় সায় দিল। শিহাব আরাফাতকে জিজ্ঞেস করল,

: তুই পুকুর পাড়ে এতোক্ষন একা একা কি করছিলি?

পেয়ারা বাগানের যে যায়গাটায় ওরা এখন বসে আছে সেটা বেশ উচুতে এবং দূর থেকে সহজে না দেখার মত। তবে এখান থেকে পুকুরটা বেশ ভাল দেখা যায়। তাই আরাফাতকে একা একা বসে থাকতে দেখেই শামিম ফোন দিয়েছিল। ও আজকের সকালের মন খারাপের কথা ওদেরকে জানালো। কৈশোরের বয়সটাই এমনি। বন্ধুদের কাছে সব কিছুই অকপটে শেয়ার করে ফেলে। শামিম একটা সিগ্রেট ধরিয়ে আরাফাতকে অফার করল। জীবনের প্রথম সিগ্রেট! নিবে কি নিবে না ভাবতে ভাবতে কিছুদিন আগে ফিরে গেলো সে। জে এস সি পরীক্ষার আগের ঘটনা। সাভারে অ্যাসেড এ মডেল টেস্ট দিতে গিয়েছে। আব্বু মটর সাইকেলে নিয়ে গেলেন। কিন্তু এরপর পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই একটানা রয়ে গেলেন। পরীক্ষা শেষ হবার পর বন্ধুদের সামনেই কোশ্চেন নিয়ে দেখলেন... কি লিখেছে জিজ্ঞেস করলেন। ওর বন্ধুরা মনে মনে যে হাসছে সেটা বেশ বুঝতে পারল। এরপরে আবার বাইকের পিছনে করে নিয়ে এলেন। এভাবে প্রতিটি মডেল টেস্টের দিনেই একই ঘটনা। এসব নিয়ে সে বন্ধুদের কাছে হাসির পাত্র হয়। কিন্তু আব্বুর সেদিকে কোনো বিকার নেই। ... আর একদিন শিহাব এসেছে বাসায়। ওর সামনেই ওর যত বদনাম আব্বু করলেন। সে ঠিকমত পড়ে না... খায় না... ঘুমায় না ইত্যাদি ইত্যাদি। ... আর আব্বু যখনই কোনো কথা বলা শুরু করেন সবসময় অন্যদের সাথে তুলনা করে ওকে সব সময় আরেকজনের মতো হতে বলেন। এটাও আরাফাতের ভীষণ খারাপ লাগে। আর এখন সে বড় হয়েছে... ওকে এখনো আব্বু সেই বাবু মনে করে... ওর নিরাপত্তার কথা বেশী বেশী ভাবে আর ওর ওপর অযৌক্তিক নজরদারি করে। মাঝে মাঝে ওর নিজের ড্রয়ার কেউ যে ঘেটেছে সেটা বুঝতে পারে। তবে সব চেয়ে বড় কথা হল, ওর সকল চাওয়া-পাওয়া কে দমিয়ে তাদের পছন্দকে গুরুত্ব দিতে বলেন। এখন কমার্স বাদ দিয়ে সাইন্স নিতে ওকে বাধ্য করাটাও সেরকম একটি ব্যাপার...

মুহুর্তের ভিতরে এই সব কিছু আরাফাতের মনে এক ঝড় তুলে দেয়... সে শামীমের বাড়িয়ে দেয়া গাঁজা ভর্তি সিগ্রেটিটি প্রচন্ড এক আক্রোশে তাড়িত হয়ে হাতে তুলে নেয়... নিজেকে ধবংস করার এক বুনো ইচ্ছের কাছে এই প্রথম পরাজিত হতে খুব ভালো লাগে ওর! ধীরে ধীরে নেশার অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে থাকে সে... ওর পৃথিবীটা দুলে ওঠে!

আরাফাতের আব্বা রেজা সাহেব একটি পোশাক কারখানায় চাকুরী করেন। একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। থাকেন পানধোয়ায়। ভাড়া বাসাতে। আজও অফিসে যাবার পথে ভিসি স্যারের মাঠের পাশে যখন এলেন, দেখলেন স্কুল ড্রেস পড়া তিনজন এক কর্ণারে বসে রয়েছে গোল হয়ে। একটু ভালো করে তাকালেন। না, সেখানে আরাফাত নেই। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তবে ছেলে তিনটি সিগ্রেট খাচ্ছে এটা দেখতে পেয়ে কেন জানি মনটা খারাপ হয়ে গেলো। তার নিজের ছেলে নেই দেখে যে স্বস্তি পেয়েছিলেন, মুহুর্তেই তা উবে গেলো। তার নিজের ছেলে না হোক, স্কুল পর্যায়ের ছেলেরা এভাবে স্কুল চলাকালীন প্রকাশ্যে স্কুল পালিয়ে সিগ্রেট টানবে? হচ্ছেটা কি এদের ভিতর? কেন এই অবক্ষয়?

আজ সকালে ছেলেকে একটু কড়া কথা শুনিয়েছেন। এজন্য তার নিজেরও মনটা খারাপ হয়ে আছে। দুই ছেলেমেয়ের ভিতরে এই ছেলেটিকে একটু বেশী শাসনে রাখছেন আজকাল। কারণ এটাই বেড়ে উঠার সময়। এখনই বিভিন্ন সঙ্গে মিশে বখে যাবার আদর্শ সময়। নিজের চাকুরীস্থল ক্যাম্পাসের বাইরে হওয়াতে ছেলেকে দেখেশুনে রাখার সুযোগটা তার নেই। আর ছোট মেয়ে ক্লাস এইটে পড়ে। তাকে নিয়ে আপাতত কোনো ভাবনা নেই। চিন্তিত মনে মেইন রোডের বাস স্টান্ডে অপেক্ষা করতে থাকেন।

সেদিন কি কারণে জানি রেজা অসময়ে বাসায় চলে এলেন। দুপুরের দিকে।
বাসায় এসে শুনলেন আরাফাত আজ স্কুলেই যায় নি। একটা অদম্য ক্রোধ কয়েক পলক ব্রেইনে ঘুরপাক খেয়ে গেলেও নিজেকে সামলালেন। ছেলের রুমে একবার যাবেন কিনা ভেবেও কি মনে করে গেলেন না। ডাইনিং টেবিলে ছোট মেয়েকে সাথে নিয়ে খেতে চাইলেন। ওদের মাকে বললেন মেয়েকে ডেকে দিতে। সে জানালো বসার ঘরে মেয়ে টিভি দেখছে। রেজা সেখানে গেলেন। মেয়ে বাবাকে দেখে একবার ফিরে তাকালো। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। আবার টিভি দেখতে লাগল। পাশে গিয়ে বসলেন। বললেন,

: কি করছ আম্মু?

: দেখছ না কার্টুন দেখছি।

: ওহ, স্যরি। ... চল আমার সাথে খাবে।

: না, তুমি খেয়ে নাও... আমি পরে খাবো।

: আচ্ছা। - চলে যাচ্ছিলেন এমন সময় মেয়ে আবার তাকে ডাকল,

: আচ্ছা আব্বু, Nick চ্যানেলটা নেই কেন? যেটায় ডোরেমন কার্টুন দেখাত?

: ওটা দেখানো নিষেধ করে দিয়েছে।

: কে নিষেধ করেছে আব্বু?

: সরকার।

: সরকার মানে শেখ হাসিনা? – কি বলবেন এর উত্তরে একটু ভাবলেন রেজা সাহেব।

: সরকারের তথ্য মন্ত্রনালয় এটা দেখে থাকে। সেখান থেকে এই চ্যানেলের এই কার্টুনটি বাচ্চাদেরকে দেখাতে নিষেধ করা হয়েছে।

: কেন? বাচ্চারা দেখলে কি হয়?

: পড়ালেখা বাদ দিয়ে বাচ্চারা এই যে সারাদিন কার্টুন দেখে... ডোরেমন দেখে দেখে হিন্দীতে কথা বলা শিখছে... তারপর নবিতার মত মিথ্যে কথা বলা শিখছে...এগুলো থেকে তাদেরকে সেভ করার জন্যই এটা বন্ধ করা হয়েছে।

: শুধু ডোরেমন কার্টুন বাদ দিলেই কি হিন্দীতে কথা বলা শেখা বন্ধ হবে? এই যে পাশের বাসার রাহেলা আন্টির ছোট দুই মেয়ে ওদের আম্মুর সাথে বসে সিরিয়াল দেখে, সেখানেও তো হিন্দীতে কথা বলে? আর যারা এটা বন্ধ করেছে, তারাও কি সব সময় সত্য কথা বলে? যারা ডোরেমন বন্ধ করেছে তাদের মাথায় কি বুদ্ধি নেই আব্বু... ওদের বাসায় কি ছোট কোনো বাবু নেই?

কি উত্তর দিবেন এই প্রশ্নের রেজা? তিনি ভেবে পানা না।
সন্তানের পছন্দের কাজে বাঁধা দিলে সন্তান বিরক্ত হয়। বাচ্চাদের পছন্দ টিভিতে কার্টুন দেখা। এইতো পুতুলখেলার বয়স... না হয় কার্টুন দেখেই সময়টা পার করছে। এখন সেকেলে পুতুলের যায়গা দখল করেছে বারবি পুতুলের সেট। এগুলো নিয়ে খেলে কিংবা কম্পিউটারে গেম খেলে। এই প্রজন্ম কেমন করে যেন বড় হয়ে উঠছে!

খাবার টেবিলে বসেও রেজা চিন্তায় ডুবে গেলেন। আসলে এখনকার ছেলেমেয়েদের কিছু আচরণ রয়েছে যেগুলো তাদের নিজস্ব কিন্তু ক্ষতিকর। আর এগুলো থেকে বাবা মায়েরা তাদেরকে দূরে রাখতে চাইলেই তাঁরা বিরক্ত হয়ে পড়ে। যেমন তার ছেলের কথাই ধরা যাক। সে চায় একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠতে। আর বাবা হিসেবে তিনি চান সে প্রতিদিন সকালে উঠুক। আরাফাতের পছন্দ ফাস্টফুড। আর তিনি চান ছেলে ঘরের খাবার খাক। আর ওর পছন্দের এসব আচরণ পাল্টাতে গেলেই ছেলের মুখ ভার হয়... সে বিরক্ত হয়। তবে কি নৈতিকতা ও মূল্যবোধ এর শিক্ষাটা সন্তানদেরকে দেয়া যাবে না?

কিছুটা ডিস্টার্বড মন নিয়ে খাওয়া থেকে উঠলেন। আজ অফিস নেই। অফুরন্ত সময়। ছেলের রুমে একবার উঁকি মেরে দেখলেন। কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে... তবে এই অবেলায় এভাবে ঘুমানোটাও তার কাছে ভালো লাগলো না। এখন যদি ডেকে উঠাতে যান, তবে আবার পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যাবে। আর ছোটখাট এইসব ব্যাপার নিয়েই সন্তানেরা আজকাল বাবা-মা’র থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বিষন্ন ভঙ্গীতে স্রাগ করে পিছনে ফিরলেন। ছেলের দিকে আর একবার মায়াভরা দৃষ্টিতে চাইলেন। ঠোঁটের কোণে বিষন্ন হাসিটা এক ঝলক উঁকি মেরেই অদৃশ্য হল। আরাফাত এর কিছুই জানতে পারল না। বাবাদের এমন অনেক কিছুই আছে যা সন্তান কখনো জানতে পারে না।

আরাফাত ঘুম থেকে সেই বিকেল বেলায় উঠল।

প্রথমে সে কোথায় আছে ঠিক মনে করতে পারল না। ধীরে ধীরে সব মনে পড়ে যেতে লাগল। বিছানা থেকে নেমে বেসিনের সামনে গিয়ে আয়নায় তাকায়। চোখ দু’টো টকটকে লাল হয়ে আছে। ব্রাশ করার সময় পেটের ভিতরে অনেক ক্ষিধের অনুভুতি ওকে গ্রাস করে নিল।

একা একা খেয়ে নিল। খুব তৃপ্তির সাথে খেল আজ। নিত্যদিনের প্রতিটা আইটেম আজ অমৃতের মত লাগল আরাফাতের কাছে।

এরপর আজ আর বাইরে স্কুল ও কলেজের মাঠে যেতে ইচ্ছে করল না। কেমন একটা বোবা অনুভুতিতে আচ্ছন্ন হয়ে বাসার ছাদে উঠে গেলো। সেখানে একেবারে উপরে পানির ট্যাংকির উপরে বসে চারপাশটা দেখল। নীল আকাশে সাদা মেঘের কম্বিনেশন! খুব ভালো লাগল। সাদা পরীর মত মেঘবালিকাদের দেখতে দেখতে আরাফাতের মানসপটে একটি কমনীয় মুখ ভেসে আসতে থাকে... সেই মুখ ওদের সাথে পড়ুয়া একজনের!

মিতার!!

ইদানিং এই মেয়েটিকে দেখলে কেন যেন শরীরের ভিতর উত্তেজনার সৃষ্টি হয়... ওর সামনে গেলে চোখের দিকে আরাফাত তাকাতে পারে না... কিছু বলতে গেলে গলায় কি যেন আটকে যায়... কথা বের হয় না।

আর সারাক্ষণ শুধু ওর কথা চিন্তা হয়... ওর পাশে থাকতে মন চায়!

ওকে ভাবলে নিজের বদ্ধ জগতটাকে আর আবদ্ধ মনে হয় না... মনটা কেন জানি ফুরফুরে হয়ে উঠল... আব্বু-আম্মু... পড়ালেখা... বন্ধু-বান্ধব সব কিছুকে ছাড়িয়ে মনটা কোথায় যেন হারিয়ে যেতে চাইছে!
আজ আরাফাতের কোথাও হারিয়ে যাওয়ায় কোনো বাঁধা নেই।

ইদানিং আব্বুকে কেন জানি অন্যরকম লাগে ওর কাছে। অন্যদের আব্বুদেরকেও তো সে দেখে। তাঁরা কত ভালোবাসেন তাদের সন্তানকে। তবে কি ওর আব্বু ওকে ভালোবাসেন না?
একটু থমকে যায় ভাবনাটা এই পর্যায়ে এসে ডালপালা বিস্তার করতে চাইলে। বাবার শরীরের মৌ মৌ করা একটা ঘ্রাণ সময়ের গভীর টানেল ধরে ওকে সেই একেবারে বুঝতে শিখবার মত সেই সময়ে নিয়ে যায়। সেখান থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় এই মানুষটির ওকে কেন্দ্র করে সকল স্নেহ – ভালোবাসার স্লো-মোশন দৃশ্যপট একটা উন্মুক্ত রাস্তার কিনারে ওকে নিয়ে এসে থমকে যায়। রাস্তার ওপাড়ে এই সময়। পিছনে ফেলে আসা সেই সময়। মাঝখানে কিছু যাপিত সময়। এগুলোকে সাথে নিয়ে একজন রেজা বাবার ভূমিকায় হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু আরাফাতের ভিতরে কেন এই মিশ্র বোধের উন্মেষ? কেন বাবাকে আর আগের মতন লাগে না? কিছু চাওয়া-পাওয়ার অনন্ত লেনদেন এখন বাবা আর আগের মত মেটাতে পারে না বলেই কি বাবাকে ‘অন্য মানুষ’ মনে হয়?
একজন বাবা কিভাবে ‘অন্য মানুষ’ হয়ে যেতে পারে?
সে কি নিজে সার্থপরের মত ভাবছে না?

একটা দমবদ্ধ অনুভূতিতে আরাফাত খাবি খেতে থাকে। উপরের আকাশটিকে যথেষ্ট খোলা মনে হয় না এই মুহুর্তে ওর কাছে। গাছের পাতাগুলো একটুও নড়ছে না। বাতাস কেন জানি গম্ভীর হয়ে কোথায় লুকিয়ে আছে। অথচ একটু আগে কত সুন্দর একটা অনুভূতি নিয়ে ফুরফুরে বাতাসে ভালোলাগাগুলোকে সাথে নিয়ে কল্পনায় ভেসে যাচ্ছিল।
বাবার কথা ভাবতেই এখন কেন এমন হয়?

বন্ধুরা ওকে বলে,’তোর আব্বু অনেক কিপটা রে। উনি যে পোষ্টে চাকরি করেন, তাতে অনেক ধান্ধা। কিন্তু সেভাবে তোদেরকে বুঝতে দেন না আরকি।‘ মুহুর্তে একটা ক্রোধ নিজের ভিতর থেকে বের হয়ে কিছুক্ষণ বাবাকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খায়। এরপর সাথের বন্ধুদের উপর দিয়ে যাবার চেষ্টা করেও কেন জানি যায় না। আবার নিজের উৎপত্তিস্থলেই ফিরে আসে।
ওরা যে বন্ধু! এ এক অন্যরকম সম্পর্ক। আরাফাত নামের এক কিশোরের মনে একজন রেজার চাইতে একজন শামিম কি একজন শিহাব অনেক বড় হয়ে ওঠে। মুহুর্তগুলোর ভারসাম্যহীন দোদুল্যমনতায় একজন বাবা সাময়িক ভাবে পরাজিত হয়ে যান। কিন্তু আসলেই কি পরাজিত হয়?
মনে হয় না। কারণ যে ক্রোধের উৎস নিজের বাবার অক্ষমতা, সেটি বাবাকে ঘিরে কিছুক্ষণ ঘুরপাক খেলেও শেষাবধি  নিজের কাছেই ফিরে আসে। বাবার প্রতি বোধের অগম্য ভালোবাসাই এর আসল কারণ।

ছাদের পানির ট্যাংকির উপর থেকে নীচে তাকায় একবার। তারপর আকাশের দিকে। ওর অবস্থান থেকে নীচের দিকটা কত স্পষ্ট দেখা যায়। অতি সহজেই দেখে সে। আর আকাশের পানে চেয়ে কিছুই দেখতে পায় না। নিঃসীম নীলাকাশে অনন্ত মহাশূন্য যে বিশালতাকে ধারণ করে আছে, নিজের ক্ষুদ্র উপলব্ধি দিয়ে সে তার কতটুকুই বা দেখতে সক্ষম?
চকিতে একটা বোধ আরাফাতকে তাড়িত করে বেড়ায়।
সে যেখানে বসে আছে, এই পানির ট্যাংকি যা নীচের থেকে একটু উপরে। তবে এখান থেকে সে এই দূরত্বটুকু কাছে বিধায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ওর চাহিদা মত বাবার অনেক কিছু দিতে না পারার অপুর্ণতাটুকু হল এই নীচের দৃষ্টির ক্ষেত্রটি। অতি সহজে চোখে পড়ে। দেখা যায়। উপলব্ধিতে নাড়া দেয়। আর বাবার হৃদয় যা ওর জন্য এক ভালোবাসাময় অনন্ত আকাশ হয়ে সীমাহীন উচ্চতায় স্বমহিমায় ভাস্বর! সেটা ওর চোখে পড়ে না।

সব কিছু তাহলে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি!

আব্বুর জন্য মনটা কেমন পুড়ে। হৃদয়ের কোথায় যেন জ্বলে যায়!
মিতা নামের যে কিশোরিটিকে ভাবলে মনের ভিতরে ওর জ্বালা ধরা অনুভূতি এনে দেয়, তার থেকে বাবার জন্য ওর এখনকার এই অনুভূতি আরো তীব্র...ওর সমগ্র সত্ত্বাকে বিবশ করে দেয়া অন্য একধরণের ভালবাসার সন্ধান পেয়ে এই কিশোরটি মুহুর্তে নিজের ভিতরে ফিরে আসে। সেই ছেলেবেলার আরাফাতে পরিণত হয়। বাবাকে কাছে না পেলে... বাবার শরীরের আদর আর সুঘ্রাণে মাতাল হতে না পারলে যার কিছুই ভালো লাগে না!

বুক ধুক ধুক অনুভূতি নিয়ে আরাফাত আব্বুর রুমের দরোজায় দাঁড়ায়। আব্বু বিছানায় শুয়ে আছেন। একটা বই পড়ছেন। রিডিং গ্লাসের নীচের চোখ দুটিতে আজ কত মায়া জড়ানো সে দেখতে পেল। এতদিন এই মায়া কোথায় ছিল?
কে যেন ওকে বলে,’মায়া সব সময়েই ছিল। তোমার দেখার চোখ সাময়িক বন্ধ ছিল।‘

ধীরে ধীরে আব্বুর পাশে গিয়ে বসে। রেজা ঘাড় ফিরিয়ে ওকে দেখেন। বইটি পাশে রেখে ছেলের দিকে তাকান। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আরাফাত ডাকে-
‘বাবা!’
একটা নতুন সম্বোধন!
রেজা অবাক হন। ঘোর লাগা এক নতুন দৃষ্টি নিয়ে ছেলেকে দেখেন। ছেলে হাসিমুখে আব্বু থেকে বাবায় পরিণত হওয়া সেই চিরপরিচিত ওর হৃদায়াকাশের অনন্ত নক্ষত্রবীথিতে মিশে থাকা একজন রেজার দিকে গভীর উপলব্ধিতে চেয়ে থাকে।
ওর মনের ভিতরের ‘আমার আব্বু এমন কেন’ সেই অনুভূতি ইতোমধ্যে কখন যেন নেই হয়ে গেছে। সেখানে বিরাজ করছে ‘ এই তো আমার বাবা!’

এভাবেই একজন বাবার পুনর্জনম হল।
সব বাবারা সময়ের ঘ্রাণে উদ্বেলিত অসময়কে যেকোনো সময়েই অতিক্রম করে একজন 'বাবায়' পরিণত হয়ে থাকেন। একজন বাবা কখনোই হারেন না। অন্তত নিজের সন্তানের কাছে।
পরম তৃপ্তিতে আরাফাত বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। রেজা অনেকদিন পরে প্রশান্তিতে চোখ বোজেন। দরোজায় দাঁড়িয়ে কণা এই দৃশ্যটি দেখে। ওর চোখের সামনেটা কেন জানি ঝাপসা হয়ে আসে।।

[ এই সিরিয়াল গল্পটির আর মাত্র একটি পর্ব রয়েছে। রেজা-কণার পরিবারের শেষ সদস্য পিম্পির জবানীতে ঐ গল্পটিতে এক টিন-এজ মেয়ের নিজের পরিবারের কাছের সম্পর্কধারী মানুষগুলোর সাথে অনুভূতির বেড়াজালে অনুভূতিগুলো কিভাবে জড়িয়ে থাকে জানার চেষ্টা করব। আশাকরি পাঠক সাথেই থাকবেন। ধন্যবাদ। ]
৭ Likes ১৬ Comments ০ Share ৪৬১ Views

Comments (16)

  • - আলমগীর সরকার লিটন

    সত্যই মানুষ ঘুরছে

    শুভ কামনা ----------

    • - পিয়ালী দত্ত

      অসংখ্য ধন্যবাদ

    - রুদ্র আমিন

    ঠিক বলেছেন আপু।

    • - পিয়ালী দত্ত

      অসংখ্য ধন্যবাদ

    - বিন আরফান.

    valo laglo. chalye jan 

    Load more comments...