Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি নবীনচন্দ্র সেন এর ১০৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি


উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি নবীনচন্দ্র সেন। দেশপ্রেমিক কবি হিসেবেই খ্যাত ছিলেন নবীনচন্দ্র সেন। ছাত্রজীবন থেকেই নবীনচন্দ্র কবিতা রচনা শুরু করেন। প্যারীচরণ সরকার সম্পাদিত এডুকেশন গেজেটে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অবকাশরঞ্জিনী’ প্রকাশিত হয় ১৮৭১ সালে। ১৮৭৫ সালে ‘পলাশীর যুদ্ধ’ মহাকাব্য প্রকাশিত হলে নবীনচন্দ্র ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়েন। তিনি ভগবতগীতা ও চন্ডি’র কাব্যানুবাদ করেন। স্বজাতিবোধ ও স্বদেশানুরাগ তাঁর কাব্যের মৌলিক অবদান। আজ এই করিব ১০৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯০৯ সালের আজকের দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কবির মৃত্যুদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

কবি নবীনচন্দ্র সেন ১৮৪৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার অন্তর্গত পশ্চিমগুজরার (নোয়াপাড়া) সুপ্রসিদ্ধ প্রাচীন জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম গোপীমোহন রায় এবং মাতার নাম রাজরাজেশ্বরী। মাত্র পাঁচবছর বয়সে লেখাপড়া শুরু করেন নবীনচন্দ্রস সেন। ১৮৬৩ সালে তিনি চট্টগ্রাম স্কুল (বর্তমানে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল) থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথমশ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতা যান। ১৮৬৫ সালে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ (বর্তমান প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এফএ এবং জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইন্সটিটিউশন (স্কটিশচার্চ কলেজ) থেকে ১৮৬৯ সালে বিএ পাশ করেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হন।

(This ornate chair belonged to poet Nabin Chandra Sen)
নবীনচন্দ্রের প্রথম কবিতা "কোন এক বিধবা কামিনীর প্রতি" প্রকাশিত হয় তৎকালীন অন্যতম খ্যাতনামা পত্রিকা এডুকেশন গেজেট-এ, যখন তিনি এফ.এ (বর্তমান উচ্চ মাধ্যমিক) শ্রেণীর ছাত্র। তাঁর প্রথম বই "অবকাশরঞ্জিনী"র প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয় ১৮৭১ সালে এবং এর দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশিত হয় ২৯ জানুয়ারি, ১৮৭৮ সালে। এটি ছিলো দেশপ্রেম ও আত্মচিন্তামূলক কবিতার সংকলন। কিন্তু তাঁর কবিখ্যাতি পরিপূর্ণতা পায় ১৮৭৫ সালে প্রকাশিত পলাশীর যুদ্ধ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হবার পর। নবীনচন্দ্রের কাব্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কাব্য হচ্ছেঃ ১। পলাশির যুদ্ধ (১৮৭৫), ২। রৈবতক(২রা ফেব্রুয়ারি ১৮৮৭), ৩। কুরুক্ষেত্র( ১৮ই জুলাই ১৮৮৩) ও ৪। প্রভাস(১৮৯৭)
শেষের কাব্য তিনটি একটি বিরাট কাব্যের তিনটি স্বতন্ত্র অংশ। এই কাব্য তিনটিতে কৃষ্ণচরিত্রকে কবি বিচিত্র কল্পণায় নতুনভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। কবির মতে আর্য ও অনার্য সংস্কৃতির সংঘর্ষের ফলে কুরুক্ষেত্রযুদ্ধ হয়েছিল। এবং আর্য অনার্য দুই সম্প্রদায়কে মিলিত করে শ্রীকৃষ্ণ প্রেমরাজ্য স্থাপন করেছিলেন। নবীনচন্দ্রের অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ১। ক্লিওপেট্রা (১৮৭৭), ২। অমিতাভ (১৮৯৫), ৩। রঙ্গমতী (১৫ই জুলাই ১৮৮০) এবং ৪। খৃষ্ট (১৮৯০)। নবীনচন্দ্র কিছু গদ্যরচনাও করেছিলেন। তাঁর আত্মকথা "আমার জীবন" উপন্যাসের মত একটি সুখপাঠ্য গ্রন্থ। আমার জীবন পাঁচ খণ্ডে সামাপ্ত করেণ তিনি। জীবনের নানান ঘটনার মধ্যে তাঁর জীবনের প্রথম অনুরাগের কথাও তিনি পাঠককে শুনিয়েছেন। পুরানো সেই অনুরাগের গল্প আজও পাঠকের নতুনই লাগবে।

প্রথম অনুরাগঃ নবীনচন্দ্র সেন (ছোটোগল্প)

প্রবেশিকা পরীক্ষা শেষ হইল। ঘাম দিয়া জ্বর ছাড়িল । শেষ দিন যখন পরীক্ষার গৃহ হইতে বাহির হইলাম, বোধ হইল, হৃদয়ে যেন একটু নবীন উৎসাহ, শরীরে যেন একটি নবীন জীবন সঞ্চারিত হইল । বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার কথা যখন মনে করি, তখন আমার একটি দৃশ্য মনে পড়ে । বলিদান । অজ শিশুগুলিকে প্রক্ষালন করিয়া আনিল । পরীক্ষার ফিস দাখিল হইল । ছাগল চিৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগিল, - বালক অনাহার-অনিদ্রায় রাত্রি জাগিয়া চীৎকার করিয়া পড়িতে লাগিল । ছাগলের ললাটে সিন্দুরের ফোঁটা এবং গলায় বিল্বপত্রের মালা অর্পিত হইল, বালকের ‘নমিনেশন রোল’ পহুঁছিল । ছাগল তাহার পর কাঁপিতে কাঁপিতে পরীক্ষাগৃহে দাখিল হইল । তাহার পর উভয়ের বলিদান । তারতম্যের মধ্যে এই - ছাগল তখনই মরে, সকল যন্ত্রণার শেষ হয় । বালক যাবজ্জীবনের জন্য আধমরা হইয়া থাকে, তাহার যন্ত্রণা আরম্ভ হয় মাত্র ।

যাহা হউক বলিয়াছি, প্রবেশিকা শেষ হইল; শরীরে নবীন জীবন, নবীন উৎসাহ প্রবেশ করিল; প্রকৃতি নবীন সৌন্দর্যে হাসিল । হৃদয় হইতে কি পাহাড় নামিয়া গিয়া হৃদয় আনন্দে নৃত্য করিতে লাগিল । নানা আনন্দে আমরা দলে-দলে গিরিশৃঙ্গের উপত্যাকায় এবং নির্ঝরের ধারে বেড়াইতে লাগিলাম । কখনও কখনও প্রশ্নের কাগজ খুলিয়া যে-যে প্রকার উত্তর দিয়াছি সেরূপ নম্বর ধরিতাম, কিন্তু কিছুতেই ‘পাস মার্ক’ কুলাইয়া উঠিত না ।

বিদ্যুৎ আমার কোনো দূর আত্মীয়-কন্যা । তাহার ভ্রাতা আমাদের সঙ্গে পড়িত । দিবারাত্রি আমরা প্রায় এক সঙ্গে পড়িতাম, খেলিতাম; কখনও-কখনও ঝগড়া করিতাম । বিদ্যুৎ তখন ক্ষুদ্র বালিকা - চঞ্চলা, মুখরা, হাস্যময়ী । বিধাতার হস্তের একটি অপরূপ একমেটে প্রতিমা । যখন সে তাহার নাতিদীর্ঘ কুঞ্চিত অলকরাশি দোলাইয়া হাসিতে হাসিতে ছুটিয়া যাইত দেখিতাম, তখন সে শত ত্যক্ত করিয়া গেলেও তাহাকে মারিতে ইচ্ছা করিত না । সেও আমাদিগকে বিরক্ত করাটি একরূপ বিজ্ঞান শাস্ত্র করিয়া তুলিয়াছিল । তাহার ভ্রাতা আমাদের অপেক্ষা ভাগ্যবান । যখন বিদ্যুৎ সপ্তম কি অষ্টম বর্ষীয়া বালিকা, সে একাদশ বা দ্বাদশ বয়সে ভাবি সংসারের যন্ত্রণা হইতে অব্যহতি লাভ করে । তদবধি আমি তাহার গৃহে বড় একটা যাইতাম না; গেলে মনে কি যেন দুঃখ, হৃদয়ে কি যেন একটা অভাব বোধ হইত । চার কি পাঁচ বৎসর চলিয়া গিয়াছে । প্রবেশিকা পরীক্ষার পর একদিন বিদ্যুতের মাতা আমাকে ডাকিলেন । আমি অপরাহ্নে তাঁহার গৃহে উপস্থিত হইলাম । তাঁহার জ্যেষ্ঠা ভগিনীর সঙ্গে কথা বলিতেছি, পাশে ও কে ধীরে ধীরে কোমল পদক্ষেপে আসিয়া বসিল ? বিদ্যুৎ! কি আশ্চর্য পরিবর্তন । যে-বালিকা ছুটিয়া, বাতাসে কুন্তলের কুঞ্চিত অলকাবলি এবং অঞ্চল উড়াইয়া ভিন্ন চলিতে পারিত না, সে আজি ধীরে-ধীরে কোমল পদক্ষেপে - পায়ের নিচে ফুলটি পড়িলেও নামিতে হইত না - এরূপ অলক্ষিত ভাবে আসিয়া বসিল । যাহার হাসি ও কণ্ঠ বাঁশীর মত অনবরত বাজিত, আজি তাহার তরঙ্গায়িত অধরবিপ্লাবী হাসি কোমলার অধরপ্রান্তে বিলীনপ্রায় হইয়া এক অস্ফুট ভাব ও শোভা বিকাশ করিতেছিল । কণ্ঠ নীরব । যে কখনও গলা জড়াইয়া ধরিয়া অংসে উরসে ভিন্ন বসিত না, কি আশ্চর্য, আজি তাহার সঙ্গে চোখে চোখে দেখা হইলে সে চোখ নামাইয়া লইতেছে । আমি অন্য কাহারও সঙ্গে কথা কহিতে , সে তাহার কমলদলায়ত দুই ভাসা চক্ষু আমার মুখের দিকে স্থিরভাবে স্থাপিত করিয়া অতৃপ্ত ভাবে চাহিতেছে । কি দৃষ্টি ! কি অর্থ ! কোনও কথা জিজ্ঞাসা করিলে কলকণ্ঠে কাকলি বর্ষণ না করিয়া থামিত না, সে আজি ঈষৎ হাসিয়া নিরুত্তরে অধোমুখে চাহিতেছে ।

আমারও হৃদয়ে কি একটা ভাবের উদয় হইতেছিল, আমি বড় বুঝিতে পারিতেছিলাম না । আমারও সেই মুখখানি বড় দেখিতে ইচ্ছা করিতেছিল, অথচ নয়ন ভরিয়া দেখিতে পারিতেছিলাম বা । কে যেন চোখ ফিরাইয়া দিতেছিল । চোখে চোখে দেখা হইলে কি যেন একটি কোমল কুসুম স্পর্শ-মৃদু-মধুর আঘাত হৃদয়ে পঁহুছিতেছিল । সেখান হইতে যে উঠিতে পারিতেছিল না সেকথা আর বলিতে হইবে না । বসিতে বসিতে সন্ধ্যা, সন্ধ্যার পর কিঞ্চিৎ রাত্রি হইল । অবশেষে উঠিলাম; আত্মহারাবৎ চলিয়া যাইতেছিলাম, অন্ধকারে বারাণ্ডা পার হইয়া বক্ষে কি লাগিল ? আমি এক পা পিছাইলাম. কিন্তু আবার সে কুসুমস্তবকনিভ স্পর্শ হৃদয়ে লাগিল - আহা! কি স্পর্শ! বুঝিলাম, আমার বুকে মাথা রাখিয়াছে বিদ্যুৎ । অজ্ঞাতে আমার দুই ভুজ তাহাকে আরও বুকে টানিয়া ধরিল । আমার সমস্ত শরীরের যন্ত্র কি অমৃতে আপ্লুত হইয়া নিশ্চল হইল । বালিকা আমার করে একটি গোলাপ ফুল দিল । আমি তার ললাটে একটি চুম্বন দিয়া উন্মত্তের ন্যায় ছুটিয়া একেবারে গুরুঠাকুর চন্দ্রকুমারের কাছে উর্ধশ্বাসে উপস্থিত হইলাম । গুরুমহাশয় আমাকে যথাশাস্ত্র বুঝাইয়া দিলেন যে, বিদ্যুতের সঙ্গে আমার বিবাহ হইতে পারিবে না । এতএব সেখানে যাইতে আমাকে নিষেধ করিলেন ।
(সমাপ্ত)


এছাড়াও তিনি ভানুমতী নামে একটি উপন্যাসও রচনা করেছিলেন। তিনি ভগবতগীতা এবং মার্কণ্ডেয়-চণ্ডীরও পদ্যানুবাদ করেছিলেন। নবীনচন্দ্রের কবিত্ব জায়গায় জায়গায় চমৎকার কিন্তু কবি এই চমৎকারিত্ব সব জায়গায় বজায় রাখতে পারেন নি। এই কারণে এবং কাব্য বাঁধুনি না থাকায় নবীনচন্দ্রের কবিত্বের মূল্যায়ন হয়নি।

১৯০৯ সালের আজকের দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। উনিশ শতকের দেশপ্রেমিক এই কবির ১০৫তম মৃত্যুদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


তথ্যসূত্রঃ India Netzone
Nabin Chandra Sen, Bengali Author

০ Likes ৩ Comments ০ Share ৭২৫ Views