Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

শ্রেয়সী দে

১০ বছর আগে

ঈশ্বর-পৃথিবী-ভালবাসা

অনেক দিনের পরে আজ আবার আমার গোপন সমরাস্ত্র হাতে তুলে নিলাম। তবে, এবার পদ্যের কোমলতা ছেড়ে, গদ্যের মধ্যে দিয়েই শুরু হোক ছন্দপতন।

আজকাল, বড় বেশি মাথা চারা দিয়ে উঠেছে যে শব্দটা, তার নাম “বিশ্বায়ন”! বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিবিদ্যার কল্যাণে বিশ্ব আজ মানুষের হাতের মুঠোয়। অথচ, কি অদ্ভুতভাবে এই বিশ্বায়নের মোড়কে মুড়ে মানুষ আজ প্রতিনিয়ত আত্মকেন্দ্রে ঘুরপাক খায়! খবরে খবরে “সেলিব্রিটি”দের অন্দরের খবর পাওয়া যায়, পাশের বাড়ির মৃতপ্রায় মানুষটার খোঁজ পাই না। সোমালিয়া-ইথিওপিয়া দারিদ্রের চরম সীমায় পৌঁছায়। এক মুঠো খাদ্য যেখানে দিবাস্বপ্নের মতো, এক ফোঁটা জলের জন্য সেখানের মানুষগুলো মাসের পর মাস শুষ্ক মরুপথ পায়ে হেঁটে পাড় হয়ে যায়। পথেই জীবন,পথেই মরণ। মা তাই তার ধুকধুক করে বেঁচে থাকা সদ্য-প্রসূত সন্তানটিকে ফেলে দিয়ে যায়, পথের প্রান্তে,মৃত্যুর গ্রাসে! তবু, খাদ্য নেই, বস্ত্র নেই, বাসস্থান নেই, মুক্তি নেই, বন্ধনও নেই। আছে শুধু নিরন্তর এগিয়ে চলার মরণপণ। আছে বিশ্বায়ন।

এদের দায়িত্ব কার? ক্লাসের ভালো ছাত্র হিসেবে খ্যাত আমার এক পরিচিত আমায় উত্তর দিয়েছিল, “এইসব সেন্টিমেন্টাল ডায়লগ মিটিং-মিছিলে ভালো চলে রে, বাস্তব পরিস্থিতিতে নয়। এইসব ‘দায়’ তোর-আমার মতো সাধারণ মানুষের নয়। এসবের জন্য তো দেশের সরকার, এন.জি.ও., স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো রয়েইছে। তাই না?” আমি সেইদিন এর কোন উত্তর দিতে পারিনি। মনে মনে ভেবেছিলাম, কবে কোন এন.জি.ও. দল এই দুস্থ মানুষগুলোর প্রয়োজনের চেয়েও নগন্য কিছু খাদ্য-জল বা ওষুধ নিয়ে সেখানে পৌঁছাবে,তবে হয়তো বরাত-জোড়ে অভুক্ত কয়েকটি প্রাণের এক একদিন ক’রে আরও কিছুদিনের দিন গুজরান হবে। পথের প্রান্তে একটা মৃত মায়ের শরীর পড়ে থাকবে। আর তার পাঁজর সর্বস্ব বুকের ভেতর মুখ দিয়ে একটা ছয়-সাত মাসের জীর্ণ প্রাণ একফোঁটা দুধ পাওয়ার আশায় জীবনের শেষ শক্তিটুকুও ব্যয় করে দেবে। তারপর হয়তো, শুরু হবে শকুনের মহাভোজ। কেউ হয়তো,তার বহুমূল্য ডিজিটাল ক্যামেরায় বন্দী করবে সময়কে। মানুষ দেখবে, কালো কালো জীর্ণ শৈশব, বেঢপ আকৃতির পেট-পাঁজর। ছবি ছড়িয়ে পড়বে ফেসবুকে, টুইটারে। হাজার হাজার ‘লাইক’ পাবে। হয়তো কিছু ‘শেয়ার।’ হয়তো সেই ছবি পুরস্কৃত হবে, এক্সিবিশনে ঠাঁই পাবে শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঝাঁ চকচকে মঞ্চে। হবে বিশ্বায়ন।

অথচ, যখন বিশ্বায়ন হয়নি, দেশে চরম আকাল। তখনও শোনা গেছে, কোন এক গৃহবধূ নিজের ভাগের শেষ অন্নটুকুও দিয়ে দিয়েছেন দ্বারে আগত কোন বৃদ্ধ ভিক্ষুকের ক্ষুধা নিবারণে। প্রশ্ন ওঠেনি, “দায়িত্ব কার?”! পাড়ার একটিমাত্র বেতারযন্ত্রে মানুষ কান পেতে শুনেছে বিশ্বের খবর। একজোট হয়ে পাড়ার মোড়ে মোড়ে স্লোগান তুলেছে, “তোমার নাম, আমার নাম। ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম।” বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের রক্তাত বর্ণনায় সরব হয়েছে ভারতবাসী, রাশিয়াবাসী। কলকাতার রাস্তায় গণতন্ত্রের মুক্তির দাবীতে মানুষ বারেবারে পথে নেমেছে। বিপ্লবের স্রোত ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর দেশে দেশে, শহরের গলিতে গলিতে, গ্রামের ঘরে ঘরে।

যুগে যুগে মানুষ মানুষের জন্য একজোট হয়েছে, সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়,আমরা যাঁদের ঈশ্বর রূপে প্রার্থনা করি, তাঁরা কিন্তু আসলে এক একজন বিপ্লবী। এই নামগুলোর সাথে এঁদের কর্মকে মিলিয়ে দেখুন। হজরত মহম্মদ(স.), শ্রীকৃষ্ণ, যীশু খ্রিস্ট, গৌতম বুদ্ধ। নাম যাই হোক, তাঁর কর্মের বিচারে তিনি এক ও অদ্বিতীয়। যুগে যুগে তিনি পৃথিবীতে এসেছেন, নির্ভীক চিত্তে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যকে বিসর্জন দিয়ে জাতির জাগরণের মহৎ উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগ স্বীকার করেছেন। সত্য-শান্তি-প্রেমের পথ দেখিয়েছেন। এও কি বিপ্লব নয়?

পৃথিবীর কোন ঈশ্বর, কোন ধর্ম বলেনি, নিজেদের মধ্যে মারামারি করো। স্বার্থপরতার লক্ষ্যে নিজেকে নিয়োজিত করো। অন্যকে ঘৃণা করো। পরস্ত্রী-কন্যাকে নিজের ঔরসের প্ররোচনায় পতিতাগৃহে নিক্ষেপ করো। তিনি বলেছেন, “মানুষকে ভালোবাসো। তাকে সম্মান করো। সৎপথে চলো।” তাঁর বিচারে ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে’ দু’পক্ষই অপরাধী। নিজেদের মধ্যে এই যে জাতিভেদ, এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, এই হিংসার বাতাবরণ- এ তো মানুষের সৃষ্টি। এত রক্তের বিনিময়েও জেগে ঘুমিয়ে থাকা কিছু মানুষের জাগরণ আজও সম্ভব হয়নি। এই বিশ্বায়নের যুগেও আমরা দেখি, রিজয়ানুরকে খুন হতে হয়। তার অপরাধ ‘ভিনধর্মী’ প্রিয়াঙ্কাকে ভালোবাসা! টাকার জোড়ে জামিনে ছাড় পেয়ে যায় খুনের দায়ে ধৃত প্রধান ইন্ধনদাতা প্রিয়াঙ্কার প্রভাবশালী বাবা। কোথাও মালালা, কোথাও লাকি আক্তার- আমরা বিস্মিত চোখে খবর পড়ি। তারপর, কেজি দরে কাগজ বেঁচে দিই। এখন ছোট ছোট বাচ্চারা কম্পিউটারে মাফিয়াদের সাথে যুদ্ধে মেতে থাকে অবসর সময়ে। স্কুলের ছাত্র ব্যাগে করে পিস্তল নিয়ে যায়, শিক্ষককে হুমকি দেয়, মারপিট করে। অথচ,যুবসমাজ বিপ্লব থেকে মুখ ফেরায়। প্রশ্ন ওঠায় ‘দায়িত্ব’ নিয়ে। তাদের এত সময় কোথায় প্রতিদিনের ইঁদুর দৌড়ের পর, সন্ধ্যাবেলায় প্রেমিক-প্রেমিকার মাদকতা মাখা বাজারী প্রেম আর রাতের নীল ছবি থেকে মুখ তোলে?

উপরমহল থেকে নিয়ম তৈরি হয়, ভাগাভাগি হয়। এটা আমার, ওটা তোমার। তোমার ভাগের লোক এই ভাগে সামিল হতে এলে, পরিণাম মৃত্যু। এখন শিল্পী তার গানের ভাষায় বলে দেন, “আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি......” এখানেও সেই আত্মকেন্দ্রিকতা! একটা সময় ধারণা ছিল, শিক্ষা-সংস্কৃতি মানুষের আত্মচেতনার বিকাশ ঘটায়। এই কি তবে ‘নব-জাগরণের’ সংস্কৃতির ভাষা? এখন ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে, নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় জনস্বত্ত্বাকে, দিনেদুপুরে আলেয়ার বাস্তবতায় উবে যায় মানুষ, ধর্ষিতা হয় সমাজ। অবশ্য, অপরাধ করলে বিবেকের কাছে নত হওয়ার আগে, অপরাধবোধ থেকে মুক্তির পথ তো আছেই। আইন ভাঙলে যেমন জরিমানা দিলেই, সব বেআইন আইন হয়ে যায়। ঠিক তেমনি ভাবে, ব্রাহ্মণ-মৌলবি-পাদ্রীরা উপযাচক হয়ে মানুষকে আত্মগ্লানি থেকে মুক্তির উপায় বাতলে দেন ‘সামান্য’ অর্থের বিনিময়ে। কেউ বলছেন, কৃষ্ণনাম জপ করো। কেউ বলছেন, প্রভুর সামনে নিজেকে ‘কনফেস’ করো। এই পাপমোচক বাণীর এমনই ক্ষমতা যে মানুষের সাধ্যি নেই, সে ইহজনমে এত পাপ করে! আমার কলম আর ভাষা খুঁজে পায় না। বিশ্বকবি প্রশ্ন তুলেছিলেন, 

“যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, 
নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, 
তুমি কি বেসেছ ভাল?”

ভালবাসা। মনে হয়, পৃথিবীর গভীরতম শব্দ। ঈশ্বর, মা, বাবা, স্বামী, স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়, বন্ধু- প্রতিটা ক্ষেত্রে এর রূপ অন্য। এক সার্বজনীন বোধ, যার অনুভূতি ব্যক্তিকেন্দ্রিক। মানুষকে ভালবাসতে না জানলে, ঈশ্বরকে ভালবাসা যায় না, নিজের জন্মভূমিকে ভালবাসা যায় না। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, মানুষকে ভালবাসতে গেলে গলা তুলে চিৎকার দিয়ে, জানান দিয়ে তা হয় না। ভালবাসা বোধটা নিতান্তই আন্তরিক। যেখানে অন্তরে অন্তরে জানাজানি হয় তাঁর উপস্থিতি। তবু,তাঁকে আরও কাছে পাওয়ার এক অদম্য আকাঙ্ক্ষায় আমি তাঁকে রাত জেগে কঠোর সাধনায় খুঁজি। কখনও গীতায়। কখনও পবিত্র কোরান শরীফের পাতায় পাতায়। কখনও মা-বাবার পদতলে। কখনও দেশমাতৃকার মুক্তির ছলে। কখনও আমার প্রিয়তমের বুকে মাথা রেখে। ভালবাসার এই আত্মনিবেদন তাঁর নিজস্বতায়। কারণ, আমি জানি, তুমি আছো। তুমি আছো। তুমি আছো। আমার বিশ্বাসে, নিঃশ্বাসে, আমার অন্তরের অন্তঃপুরে, সাকার-নিরাকার রূপে তুমি আছো। আমার আত্মস্বত্ত্বার নূর হয়ে তুমি আমার মধ্যেই আছো। তুমি আমার আদি, তুমিই আগামী। তুমি আমার ঈশ্বর, আমার পরম ব্রহ্ম, আমার পথ প্রদর্শক, আমার অন্তরতম, আমার জন্মদাতা, আমার পরিণতি, আমার ভালবাসা। তোমাকেই পেতে আমি নিয়ম করে, নিয়ম ভেঙে আমার সিজদায় তোমাকে খুঁজি, আসলে নিজেকেই খুঁজি। আমাদের বিশ্বায়ন হয়।

এই শাব্দিক বিশ্বায়ন না হলেও আমার কিছু আসে যায় না। কারণ, ‘পৃথিবী’ শব্দটা খুব ছোট হয়ে যায়, তোমাকে পাওয়া হলে। ভালবাসার বিশালত্বকে পাওয়া হলে। জেগে ওঠে আমার বিবেকবোধ, আমার মনুষ্যত্ব, আত্মচেতনা। আমি উপলব্ধি করি, ভালবাসাই একমাত্র মিলনের পথ। তবু,সাধ মেটে না। আরও আরও ভালবেসে যেতে, আরও আরও প্রেমে ডুবে যেতে মন চায়। তাই বোধ হয়, বেঁচে থাকার এত তীব্র ইচ্ছা।

তারপর, একদিন মেয়াদ ফুরায়। অনেক অপূর্ণতা থাকে। অনেক কিছু বলার থাকে। বলা শেষ হয় না। থেমে যেতে হয়। এই আনন্দধামের সব দুঃখবোধ আর সামাজিকতা ছিঁড়ে সেইদিনও এক অন্যরকম ছন্দপতন হয়। যেভাবে সৃষ্টির আদিতে কোন ভেদাভেদ থাকে না, অন্তেও তাই। এ যেন, শূন্য থেকে শুরু করে শূন্যেই মিশে যাওয়া। প্রবহমান সময়। তবু, এখনও সময় আছে। প্রয়োজন শুধু পাশাপাশি থাকা। লক্ষ্য সাম্যবাদ। সোমালিয়া-ইথিওপিয়া-ভারত-বাংলাদেশ কিংবা হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ হয়ে নয়। শুধুমাত্র একজন মানুষ হয়ে, মানুষের পাশে থাকার সরল অঙ্গীকার। বিভাজন শুরু হলেই জটিলতা বাড়ে। বিভাজিতেরও বিভাজন হয়। দেশ-জাতি-লিঙ্গ-ধর্ম-কর্ম-বর্ণ...... এর বুঝি আর শেষ নেই। অথচ, ঈশ্বর তো মানুষের জন্য একটাই পৃথিবী তৈরি করেছেন। ভালো থাকার জন্য এক ও অভিন্ন ভালবাসার পথ দেখিয়েছেন। তবে, আমরা এক হতে পারিনা কেন? ‘দায়িত্ব’ না হয় সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই নেয়া যাক।

এই সুযোগে বলে দিই, আমি কিন্তু বিশ্বায়নের বিরোধী নই। তবে, নতুন মোড়কের চটকদারীতে ভুলে পচা খাবার কিনলে, নিজেকেই কিন্তু ঠকতে হবে। আর বিশ্বায়নের কল্যাণে, এই লেখা দেশ-কাল-সময়ের কাঁটাতার পেরিয়ে যদি একজন বাঙালীকেও, মানুষকে হিসেবে তার ‘দায়িত্ব’বোধ সম্পর্কে সজাগ করে তোলে, তবে সেটুকুই হবে এই লেখার স্বার্থকতা।।

০ Likes ১২ Comments ০ Share ৬৭৭ Views

Comments (12)

  • - লুৎফুর রহমান পাশা

    সুন্দর কবিতা

    • - একজন আরমান

      ধন্যবাদ পাশা ভাই।

      ভালো থাকুন। 

    - সনাতন পাঠক

    শুভেচ্ছা

    কবিতা ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ।

    • - একজন আরমান

      ধন্যবাদ রোদ ছায়া। :)

      ভালো থাকুন। 

    - ইখতামিন

    হয়তো তারাও কোন এক সময় ভেঙ্গে যাবে

    হয়তো এই আশাদের কখনও রাত্রি পোহাবে না

    • - একজন আরমান

      ধন্যবাদ ইখতামিন ভাই। আপনাকে এখানে দেখে ভালো লাগছে। :)

      ভালো থাকুন। 

    Load more comments...