Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

তাহমিদুর রহমান

১০ বছর আগে

ইলিশ

আজম ইকবাল সাহেবের বয়স ষাট ছুঁইছুঁই করলেও শরীর স্বাস্থ্য এখনো বেশ শক্ত সামর্থ্যই আছে। বাজারের ব্যাগ যতই ভারী হোক না কেন অনায়াসে রিক্সা ছাড়াই হেঁটে হেঁটে বাজার থেকে বাড়ি ফিরতে পারেন। কিছুদিন আগে চাকরি থেকে রিটায়ার্ড করায় বলতে গেলে বেশিরভাগ সময়ই বাসায় কাটে তার যাকে বলে অখণ্ড অবসর। তার দুই মেয়ে, দুজনেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে বলে বাসায় উনি ও উনার স্ত্রী ছাড়া কেউই থাকে না। বড় মেয়ে-জামাই কানাডায় সেটেলড যার সাথে উনার শেষ দেখা হয়েছে প্রায় বছর তিনেক হয়ে গেল। আর ছোট মেয়ে-জামাইয়ের সাথে তার সদ্ভাব নাই কারণ ছোট মেয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল যা উনি এখনো মন থেকে মেনে নিতে পারেন নাই। ঢাকা শহরে এমন কোন আত্নীয় স্বজনও নেই তার তাই বলতে গেলে উনি ও উনার স্ত্রী প্রায় নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছেন।

আজ সকালবেলা উনার স্ত্রী নিলুফার বেগম যখন গরম চায়ের কাপ টেবিলে রাখলেন তখন আজম সাহেব খুব মনোযোগ দিয়ে পেপার পড়ছিলেন বলে স্ত্রীকে লক্ষ্যই করলেন না। চাকরি করার সময়ে তিনি বাসায় পেপার রাখা বাড়তি খরচ মনে করতেন। এখনও করেন কিন্তু সময় কাটানো দুঃসাধ্য হয়ে যাওয়ায় রাখতে বাধ্য হয়েছেন। তাছাড়া এখন দুই টাকার পেপারের বেশ চল উঠেছে, সংবাদও মোটামুটি ভালই পাওয়া যায়। আজকের পেপারে তিনি যে জিনিসটা খুব মনোযোগ সহকারে পড়ছিলেন তার হেডিংটা এরকম,

“বর্ষার শুরুতেই মাছের দাম পড়তির দিকে”

এমন সময়ে নিলুফার বেগম কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলেন,

“চা দেওয়া হয়েছে।”

আজম সাহেব চমকে উঠে বললেন,

“আস্তে কথা বলতে পারনা? সমস্যা কি তোমার?”

“আমার সমস্যা কি? বাসায় তরি তরকারী যে নেই সেদিকে কি কোন খেয়াল আছে?”

“বিয়ের পঁচিশ বছর পরেও তোমার ডায়লগ চেঞ্জ হল না।”

আজমল সাহেব পেপার গোছাতে গোছাতে বলেন এবং এরপর উনার স্ত্রীর কথার ঝাঁঝ আরো বেড়ে গেল।

“হ্যাঁ আমি খারাপ তো তাহলে বিয়ে করেছিলে কেন? খগেন থাকতে পারনি?”

“তাহলে তো বেঁচেই যেতাম কিন্তু তোমার বাবা চালাকি করে যে তোমাকে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিবে তা কে জানত?”

“মুখ সামলে কথা বলবে বলে দিচ্ছি।”

আজম সাহেবের মুখের স্বাদ তেতো হয়ে আসে। সেই কবে নিলুফারকে তরুণী বউ করে ঘরে আনলেন আর তখন থেকেই তার এই তেজ সহ্য করে আসছেন। পরিবারের ছোট মেয়ে হওয়ায় আহ্লাদ সবসময়ই বেশি থাকে তার এবং এই বুড়ি বয়সে এসেও সেই তরুনী বয়সের মত এখনো ঝগড়া করে চলেছেন।

তিনি চায়ের কাপ নিঃশব্দে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলেন,

“মাছের দাম কমেছে, সেটা জান?”

“কোন মাছ?”

“সব ধরনের মাছ।”

“মাছের দাম কমলে কি? এ সংসারে মলা মাছ ঢেলা মাছ ছাড়ে জীবনে কিছু ঢুকেছে?”

“মানে?”

“মানে কি? ইলিশ মাছ খেয়েছি সেই কবে মনে পড়ে না। আর জীবনে খাওয়াও হবে না। এই কবরে পা দিলাম বলে।”

“ফালতু কথা বলবে না। সারাজীবন মেয়েদুটোকে মানুষ করতেই তো জান গেল আমার। তার মধ্যে বড়টা সেই যে গেল তারপর আর বাবা মায়ের খোঁজ নেওয়ার হুশ নেই। আর ছোটটা বেহায়ার মত মানুষের হাত ধরে চলে গেল। মা হয়ে ওদেরকে কি মানুষ করতে পেরেছ?”

আজম সাহেবের এই এক অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। আজকাল তার রাগ উঠলেই মেয়েদের প্রসঙ্গ টেনে আনেন।

“আমি কি মানুষ করেছি মানে? তোমার কোন দায়িত্ব ছিল না? সারাদিনরাত তো বাইরে বাইরে থাকতে, একদিনও মেয়েদের খবর নিয়েছিলে? কি করে? কোথায় যায়? তুমি স্বামী হিসেবে তো আমাকে কোনদিন কিছু দিতে পারলে না বরং বাবা হিসেবেও তুমি ব্যর্থ।”

এবার আজম সাহেব আর সহ্য করতে পারলেন না। সোফার ছোট টেবিলে রাখা ফুলদানি নিয়ে পাশের দেয়ালে জোরে ছুঁড়ে মারলেন এবং প্রচন্ড শব্দে তা ভেংগে পড়ল।

নিলুফার বেগম কপালে হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়লেন আর আজম সাহেব ভেতর থেকে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে যেতে বললেন,

“আজ যদি ইলিশ মাছ না আনি তো আমার নাম আজম ইকবাল না।”

তারপর দরজার পাল্লা দেয়ালের সাথে দড়াম করে ঠুকে দিয়ে বাইরে বের হয়ে শান্তিবোধ করলেন যেন দরজার পাল্লায় দড়াম করে শব্দ করলেই নিলুফার বেগমকে উচিত জবাব দেওয়া হয়েছে। বাইরে কিছুদূর আসার পর ভয় হল তার যদি নিলুফার রাগ করে বাসা বন্ধ করে বোনের বাসায় চলে যায়? বিয়ে হওয়ার পর প্রায়ই ঝগড়া হত তাদের তখন নিলুফার বেগম রাগ করলেই না বলে কোথায় কোথায় চলে যেতেন, এখনো সে স্বভাব যায়নি। আজম সাহেব ভাবলেন, নিলুফার যদি বাসায় তালা লাগিয়ে চলে যায় তবে সারারাত তিনি কোথায় থাকবেন? আরেকবার ভাবলেন যা করেছেন উচিত কাজ করেছেন, চলে গেলে যাবে। দুশ্চিন্তাকে মনে জায়গা না দিয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।   

আজম সাহেব মাছের বাজারে ঢুকে রীতিমত হতাশ হলেন। পত্রপত্রিকায় মিথ্যে খবর হরহামেশাই বের হয় তাই বলে এইরকম ডাহা মিথ্যা। ইলিশ মাছের দাম তো কমেইনি বরং বেড়েছে, বিক্রেতা মুখের উপর আটশ টাকা কেজি চেয়ে বসল। দুঃখিত মনে মাছের বাজার থেকে সবজির বাজারে চলে গেলেন। অবশ্য তার মনে একটাই বাক্য ঘুরতে লাগল-

“নিলুফারকে তাহলে ইলিশ খাওয়ানো গেল না।”

এ কথা ভাবতে ভাবতে বাজারে গিয়ে যেসব সবজি কিনলেন তা নিম্নরূপঃ

 

সবজির নাম                দাম

টমেটো (১ কেজি)            ২২ টাকা

লাল শাক (১ আঁটি)          ৫ টাকা

পটল (১/২ কেজি)           ১২ টাকা

আলু (১ কেজি)             ১০ টাকা

পেঁয়াজ (১ কেজি)            ২০ টাকা

আদা (৫০ গ্রাম)            ৫ টাকা

রসুন (১ পুয়া)             ১২ টাকা

শশা (১/২ কেজি)           ১০ টাকা

বেগুন (১ কেজি)            ২০ টাকা

কাঁচকলা (১ হালি)           ২০ টাকা     

মোট                      ১৩৬ টাকা

 

আজম সাহেব সাধারণত দুই তিনদিনের জন্যে বাজার করেন কারণ বাজারে আসার দরকার হলে কিছুটা সময় তো কাটে কিন্তু চাকরিরত অবস্থায় এক মাসের বাজার এক বারেই করতেন।

সবজি বাজারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ব্যাগ হাতে তিনি হিসাব করে নিলেন। মোট খরচ হয়েছে একশত ছত্রিশ টাকা। হিসাব শেষ করতেই কে যেন পেছন থেকে ঘাড়ে হাত দিল। ঘুরে দাঁড়িয়ে তরফদার সাহেবকে দেখতে পেলেন। প্রতিবেশির সংগা যদি চল্লিশ ঘর মোতাবেক ধরা হয় তবে তরফদার সাহেব অবশ্যই তার একজন প্রতিবেশি। তাকে দেখে একটুও খুশি হলেন না তিনি, তরফদার সাহেব বাচাল টাইপ লোক, সবসময় শুধু বকবক করতে থাকেন।

“কি কিনলেন?” জিজ্ঞেস করে বসেন তরফদার সাহেব।

“এইত একটু আধটু সবজি...”

“দেখি দেখি কি কিনলেন?”

এই বলে তিনি আজম সাহেবের ব্যাগে উঁকি দিয়ে দেখলেন আর তা স্বাভাবিকভাবেই সেটা পছন্দ করলেন না আজম সাহেব।

“কাঁচা কলা কিভাবে খান? আমি তো খেতেই পারি না। পটলটা বাসি মনে হল, কোথা থেকে কিনলেন, নিশ্চিত আপনাকে ঠকিয়েছে।”

আজম সাহেব উত্তর করলেন না। শুনতে লাগলেন চুপ করে, ঝাড়া ত্রিশ মিনিট এই রকম বকবক শুনতে হবে এখন।

“এখন কোথায় যাবেন?” তরফদার সাহেব জিজ্ঞেস করেন।

“দেখি মাছ কেনার ইচ্ছা আছে।” আজম সাহেব উত্তর দিলেন।

“আর বলবেন না এই মাছের জন্যেই তো বাজারে আসলাম। বাইরে মেঘলা আকাশ দেখে এই সময়ে সর্ষে ইলিশ না হোক ইলিশ মাছ ভাজা নাহলে কি চলে? বলুন তো?”

এ কথা শুনে আজম সাহেবের মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল।

“চলুন দরদাম করি গিয়ে।”

“চলেন।”

মাছের দাম শুনে দামে বনিবনা না হওয়ায় দুজনে বাজারের একপাশে এসে দাঁড়াতেই তরফদার সাহেব বললেন,

“ইসরে, এত দাম হলে কি করে কিনি? বলুন তো?”

“হুম।”

আজম সাহেবের মনটা এবার আসলেই খারাপ হল। এতদিন পরেও ইলিশ মাছ কেনার সামর্থ্য তার হল না। ঠিক এ সময়ে কবির সাহেব এসে উপস্থিত হলেন। উনিও তাদের আশে পাশে থাকেন বলে গল্প আড্ডা মাঝে মাঝেই হয়।

“কি দুজনে দাঁড়িয়ে কি করছেন এখানে?”

“আপনি কোথা থেকে আসলেন?” তরফদার সাহেব উত্তর দিলেন।

“কোথা থেকে আবার, বাসা থেকে, আজ ইলিশ মাছ না হলে চলে নাকি?”

তরফদার সাহেব এবং আজম সাহেব দুজনেই দুজনার দিকে তাকালেন। এবার আজম সাহেব বললেন,

“আমরাও একই উদ্দেশ্যে এসেছিলাম এবং দাম শুনে এখানে দাঁড়িয়ে আছি।”

“কত দাম?”

“আটশ টাকা কেজি।”

“বলেন কি? আমি তো কালকেই শুনলাম পাঁচশ টাকা কেজি।”

এরপর তিনজনের মধ্যে ইলিশ মাছ নিয়ে কিছুক্ষন হাহাকার চলল তারপর এই সেই অতীত নিয়ে গল্প চলল। কিছুক্ষন পরে কবির সাহেবই একটা আইডিয়া বের করলেন। ঠিক করলেন তিনজন একসাথে ইলিশ মাছ কিনে ভাগ করে নিবেন। তরফদার সাহেব আইডিয়াটা শুনে প্রায় চিৎকার করে উঠে বললেন,

“ইউরেকা, দশের লাঠি একের বোঝা।”

বেলা বারটার দিকে আনন্দিত হৃষ্ট মনে বাজার করে আজম সাহেব বাড়ির পথে রওনা দিলেন। শেষ পর্যন্ত ইলিশ মাছ কেনা হয়েছে ভাগে চার পিস পেয়েছেন। তিনি বলে কয়ে পেটি নিয়ছেন দুটো, পেট ভর্তি ডিম, নিলুফার বেগম ইলিশ মাছের ডিম খুব পছন্দ করেন। আর পেয়েছেন একটা গাদার দিকের পিস আর লেজ। উনার লেজ বিশেষ পছন্দ। ভার্সিটি পড়ার সময় তার এই লেজ প্রীতির কারণে বন্ধুমহলে “ল্যাজা” নামে পরিচিত ছিলেন।

রিকশা না নিয়েই রওনা দিয়েছিলেন তিনি এবং বাসা থেকে একটু দূরে রিকশার সাথে ধাক্কা খেলেন। ফুটপাতের পাশেই রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন ফলে ড্রেনের কাছে মুখ থুবড়ে পড়লেন। বাজারের ব্যাগ থেকে ইলিশ মাছের প্যাকেটটা সোজা গিয়ে পড়ল ড্রেনের পচা পানিতে এবং পিছে পিছে কিছু আলু-পটল। তিনি শুয়ে শুয়েই ড্রেনের দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তিনি শুয়েই রইলেন, তাকিয়ে রইলেন ড্রেনের দিকে, একবার ভাবলেন হাত দিয়ে ড্রেন থেকে প্যাকেটটা তুলে নেন, কিছুটা রুচিতে বাঁধে তার এবং আশেপাশে মানুষ এসে তাকে দাঁড় করালো এবং রিক্সাওয়ালাটাকে দুচারটা থাপ্পর মেরে বসল। তিনি বাজারের ব্যাগ হতে হাঁটতে লাগলেন আবার। তার চোখ জলে ভরে গিয়েছে, বুকের কাছে কি যেন অসহ্যভাবে বেঁধে রয়েছে এমনকি পায়ে যেন কেউ ভারী বস্তু বেঁধে দিয়েছে। নিলুফারকে আজও ইলিশ মাছ খাওয়াতে পারলেন না তিনি। আজ প্রতিদিনের মত আবারও দুপুরে তরকারী হবে শুধু সবজীর ঘন্ট। 

০ Likes ১৩ Comments ০ Share ৪৫৮ Views

Comments (13)

  • - রোদেলা

    পাশের বাড়ীর মেয়ে মেয়ে লাগছে।

    - হাছান উদ্দিন রোকন

    ছি ছি এইকি কাণ্ড । 

    - নীল সাধু

    তাই নাকি?
    হায়রে সানি লিওন