Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

ইরাকী বন্দীর আত্মকথা

মার্কিন সেনারা ইরাকে তথাকথিত গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করার কথা বলে প্রায় ৫ বছর ধরে দেশটি দখল করে রেখেছে ৷ শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলে মার্কিন সেনারা এ পর্যন্ত অন্ততঃ এক লক্ষ নিরীহ বেসামরিক ইরাকীকে হত্যা করেছে ৷ নিরীহ বৃদ্ধ, নারী-এমনকি শিশুরাও তাদের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না ৷ সন্ত্রাসী বলে অভিযু্ক্ত করে শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়ে মার্কিন সেনারা ইরাকের ঘরে ঘরে, বিশেষ করে আবু গারিব কারাগারে নিরীহ ইরাকীদের ওপর যেসব নৃশংস, পাশবিক ও অমানবিক অত্যাচার করেছে তাতে বিশ্ব বিবেক স্তম্ভিত হয়ে গেছে ৷ ইরাকে মার্কিন সেনাদের আচরণ আর নির্মম পাশবিকতা যেন সমার্থক হয়ে পড়েছে ৷ মার্কিন সেনাদের ঐ পাশবিক আচরণের খন্ডিত বর্ণনা আপনারা হয়তো বিভিন্ন গণমাধ্যমের কল্যাণে পেয়ে থাকবেন ৷ কিন্তু প্রকৃত চিত্রটি দেখার কৌতূহল নিশ্চয়ই রয়ে গেছে ৷ আর একথা চিন্তা করেই আমরা আপনাদের জন্যে ইরাকী বন্দীর আত্মকথা নামে নতুন ধারাবাহিকের আয়োজন করেছি ৷ গ্রেফতার থেকে শুরু করে নিরীহ এক ইরাকী বন্দী তার বন্দী জীবনের লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা যেভাবে দিয়েছেন, আমরা তা হুবহু আপনাদের মাঝে তুলে ধরার চেষ্টা করবো ৷)

ইরাকী বন্দীর আত্মকথা
( ১ম পর্ব )
মার্কিন পাশবিকতার শিকার এক নিরীহ ইরাকী নাগরিক তার মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছেন, আমি জানতে পেরেছিলাম, দখলদার মার্কিন সেনারা আমার বাড়ীর কাছেই বিভিন্ন বাড়ী ঘরে তল্লাশী চালাচ্ছে, নিরীহ লোকজনকে পাইকারী হারে গ্রেফতার করছে, অনেককে হত্যা করছে ৷ আমার বাড়ীটার অবস্থান একটা সংকীর্ণ গলির মাঝখানে৷ আমি জানতাম এ মহল্লার কেউ কেউ সশস্ত্র এবং তাঁরা আগ্রাসীদের ওপর হামলার জন্যে ওঁত্‍ পেতে আছে৷ এদের একজনকে আমি ভালোভাবেই চিনতাম ৷ সে ছিল আগ্রাসন বিরোধী যোদ্ধা৷ সে নিজেই বলতো, আমি দুজন দখলদার সেনাকে জাহান্নামে পাঠিয়েছি৷ কিন্তু আমি একজন সাধারণ ব্যবসায়ী ৷ আমি মুক্তিযোদ্ধাদের দলে যোগ দিতে অস্বীকার করেছিলাম৷ তাই আশা করছিলাম যে আমেরিকানরা হয়তো আমাকে ধরবে না ৷ আমার সন্তানরা খুবই ছোট হওয়ায় তারা যুদ্ধ করার উপযুক্ত ছিল না ৷ আমার বারো বছর বয়সের এবং ৬ বছর বয়সের সদ্য স্কুলগামী কন্যা আমেরিকানদের জন্যে কোনো সমস্যা সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখতো না৷ আমার তৃতীয় সন্তানের বয়স মাত্র চার বছর ৷ আমার স্ত্রীও ছিল যুবতী ৷ তাই নিজেকে সামলে নেয়ার যথেষ্ট ক্ষমতা তার ছিল না ৷ মার্কিনীরা গণহত্যা শুরু করেছে এটা শুনেই সে ভেঙ্গে পড়বে আমি এ আশঙ্কা করছিলাম ৷ ঐ নিরীহ ইরাকী নাগরিক বলছিলেন, গোলাগুলি শুনেই আমার স্ত্রী ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তো ৷ এমনকি সে অস্ত্র শস্ত্রের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারতো না ৷ একদিন যুবক বয়সী আমাদের এক আত্মীয় তার অতিরিক্ত কিছু অস্ত্র লুকানোর জন্য আমাদের বাসায় আশ্রয় নিলে আমার স্ত্রী ভয়ে কাঁপতে শুরু করে ৷ এমনকি সে ঐ অস্ত্রগুলোর দিকে তাকাতেও চায়নি ৷ তাই, আমি অস্ত্রগুলো আমার বাসায় গোপন করতে দিলাম না ৷ প্রথমতঃ আমার স্ত্রী ভীত সন্ত্রস্ত থাকুক তা আমি চাইনি ৷ দ্বিতীয়তঃ আমি নিজেও এ ধরনের বিপদের মধ্যে জড়াতে চাচ্ছিলাম না ৷ যুবকটি আমাদের ঘরে আশ্রয় নেয়ায় মার্কিন সেনারাও আমাদের বাড়ীতে চলে এলো৷ ঐ নিরীহ ইরাকী নাগরিক বলছিলেন, আমাদের পরিবারের কেউ কখনো মার্কিন সেনাদের দেখেনি ৷ আমরা কখনও ভাবিনি যে আমাদের বাড়ীর ওপর মার্কিন সেনাদের হামলা এতো ধ্বংসাত্মক ও ভয়াবহ হবে ৷ সেই ভয়াল রাতে দখলদার মার্কিন সেনারা লাথি মেরে আমাদের বাড়ীর প্রধান গেইট ভেঙ্গে ফেলে এবং পুরোপুরি যুদ্ধ করার ভঙ্গি নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে ৷ অগ্রবর্তি মার্কিন সেনাদের কভার দেয়ার জন্যে কেউ কেউ মেঝেতে বসে সাবমেশিনগানের গুলি ছুঁড়তে থাকে এবং এরপর তারা তাদের প্রথম গ্রুপের পথ নিরাপদ করার জন্যে হাঁটু গেড়ে বসে গুলি চালাতে থাকে ৷ এরপর ওরা উঠান পেরিয়ে বারান্দায় পৌঁছে ৷ আমি ও আমার স্ত্রী বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরে ঘরের এক কোনে জড়সড় হয়ে থাকলাম যাতে গোলাগুলীতে আহত না হই কিংবা ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো গায়ে এসে না পড়ে৷ কাঁচের টুকরোগুলো এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছিল ৷ গুলি চালানো অব্যাহত রেখে তারা ঠিক যেভাবে প্রধান ফটক বা গেইট ভেঙ্গেছিল, সেই একই পদ্ধতিতে আমাদের কক্ষের দরজাও ভেঙ্গে ফেললো ৷ প্রথমে দুজন মার্কিন সেনা ভেতরে ঢুকলো ৷ এরপর আরো তিনজন তাদের সাথে যোগ দিল ৷ আমি নিশ্চিত যে তারা আমাদের ঠিকই দেখেছিল ৷ এ অবস্থায় মার্কিন সেনাদের একজন একটি বিশেষ সংকেত দিল ৷ সাথে সাথে অন্য সেনারা নির্বিচার গুলি চালাতে শুরু করলো ৷ গুলিতে বাড়ীর দেয়ালগুলোসহ দরজা এবং রান্নাঘরের আসবাবপত্রসহ আরো অনেক কিছু ধ্বংস হয়ে গেল ৷ রেফ্রিজারেটর, ওভেন, টেবিল ও চেয়ারগুলোকে চেনার উপায় রইলো না ৷ সাব মেশিনগান দিয়ে তারা যে কী পরিমান কতো গুলি ছুঁড়েছিল তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে ৷ ওদের গুলিতে দেয়ালের প্রায় সমস্ত প্লাষ্টার ঝরে পড়েছিল৷ মার্কিন সেনাদের পাশবিকতার শিকার ইরাকের ঐ নিরীহ নাগরিক বলছিলেন, এরপর চারদিকেই কবরস্থানের নিস্তব্ধতার মতো হঠাত্‍ এক ভয়ানক নীরবতা নেমে এল ৷ মনে হলো, কেউ যেন যুদ্ধ বিরতির নির্দেশ দিয়েছেন ৷ আমি এবং আমার পরিবার এত নীরব ছিলাম যে, আমরা বোধ হয় তখন নিঃশ্বাসও নেই নি ৷ ঐ ইরাকী নাগরিক আরো বলেছেন, যে মার্কিন সেনাটি গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিল, সে যেন হঠাত্‍ হতভম্ব হয়ে পড়লো ৷ সে এমন একটা ভাব দেখালো যেন সে এইমাত্র আমাদের দেখতে পেয়েছে ৷ সে আমাদের দিকে ছুটে এলো ৷ প্রথমে সাবমেশিনগানের পাইপ দিয়ে এবং পরে রাইফেল দিয়ে আঘাত করে আমাদের কি যেন বললো, বুঝে উঠতে পারলাম না ৷ কয়েকটা তীব্র আঘাত পাওয়ার পর আমরা বুঝতে পারি যে তারা আমাদেরকে হাত উঁচু করে বেরিয়ে আসতে বলছে ৷ আমার স্ত্রী নিজেকে সামলাতে পারায় আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম ৷ কারণ, আমি ভেবেছিলাম ঐ অবস্থায় সে নিশ্চই অজ্ঞান হয়ে পড়বে ৷ সে আমার পিছে পিছে বেডরুম থেকে সন্তানদের নিয়ে বের হল৷ একজন মার্কিন সেনা দরজার পেছনে দাঁড়িয়েছিল ৷ তাদের দুজন বারান্দায় অবস্থান নেয় আর মূল গেইটের কাছে ছিল চারজন মার্কিন সেনা ৷ এরপর ওদের কমান্ডারের নির্দেশে আমার মাথায় মোটা কাপড় বা ক্যানভাসের ব্যাগ পরানো হলো ৷ এভাবে ওরা আমার চোখ বেঁধে ফেললো, এর প্রয়োজন ছিল না যদিও ৷ কারণ আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে তাকিয়ে থাকলেও ওদেরকে চিনতে পারতাম না ৷ কেননা, ওদের সবার মাথায় ছিল হেলমেট, চোখে ছিল কালো চশমা এবং পরনে ছিল খুব পুরু পোশাক আর নিশ্চই বুলেট প্রুফ জ্যাকেটও ছিল৷ ওরা যখন খুব রুক্ষ্ম ও কর্কশ ভঙ্গীতে আমাদের তাড়িয়ে নিচ্ছিল তখনই বুঝতে পেরেছিলাম মার্কিন সেনারা আমাদের বন্দী করতে চাইছে ৷ ঐ নিরীহ ইরাকী নাগরিক আরো বলছিলেন, যখন আমরা উঠানে আসলাম তখন পরিস্থিতি আরো খারাপ হলো ৷ মার্কিন সেনাদের লাথি আর রাইফেলের উপুর্যপরি আঘাত খেতে খেতে আমরা একটু একটু করে এগুচ্ছিলাম ৷ কিন্তু চোখ বাঁধা অবস্থায় একসময় মনোযোগ হারিয়ে ফেললাম ৷ ফলে ওরা যেদিকে যেতে বললো সেদিকে না যাওয়ায় আরো তীব্র লাথি-গুতো ও ধমক খেতে হলো ৷ আমার স্ত্রী শান্তভাবে কাঁদছিল, আমার বড় মেয়েও প্রায় নীরবে কাঁদছিল ৷ কিন্তু আমি স্পষ্টভাবে আমার ছোট্র দুই শিশুর ভয়ার্ত কান্না শুনতে পাচ্ছিলাম ৷ গলির মাঝখান পর্যন্ত যাবার পর আমি আর আমার সন্তানদের কান্না শুনতে পেলাম না ৷ আমি ভাবছিলাম যে তারাও আমার পিছে পিছে আসছে৷ কিন্তু কিছু সময় পার হবার পর বুঝলাম, আমার চার বছরের ছেলেটির কান্নার শব্দ দূর থেকে ভেসে আসছে ৷ আমি যেই একটু থেমে তাদের কন্ঠস্বর শোনার চেষ্টা করলাম, অমনি মার্কিন সেনারা আবার নির্দয়ভাবে আমাকে পেটাতে লাগলো ৷ বাড়ী থেকে বের হবার পর থেকেই দখলদার মার্কিন সেনারা উচ্চ স্বরে কিছু না বলার চেষ্টা করছিল ৷ তবুও তাদের কথা বার্তা শুনে আমি বুঝলাম যে আমরা গলির শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি ৷ ঐ নিরীহ ইরাকী নাগরিক আরো বলছিলেন, আরো কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা ধাতব বেড়া বা সেরকম কিছুতে ধাক্কা খেলাম ৷ স্পর্শ করে বুঝলাম যে আমি একটা সামরিক ট্রাকের পেছনে দাঁড়িয়েছি ৷ দখলদার সেনারা আমাকে ট্রাকের ওপর উঠতে বাধ্য করলো ৷ আমি যখন ঊঠছিলাম তখন ওরা আমাকে নিচু হবার জন্যে ঘাড়ে চাপ দিলো ৷ আর তাতে আমি বুঝলাম ট্রাকের ছাদ রয়েছে এবং আমার মাথা ট্রাকের ছাদে যাতে না লাগে সে জন্যেই হয়তো ওরা আমার ঘাড়ে চাপ দিয়েছে ৷ কিন্তু যখন চারটি শক্তিশালী হাত আমার ঘাড়ে প্রবল চাপ দিল, তখন বুঝলাম যে ওরা আমাকে হাঁটু গেড়ে বসতে বলছে৷ ঐ চারটি হাত আমার হাত দুটিকে পেছনে টেনে ঘুরিয়ে নিল এবং খুব ধারালো তার বা রশি দিয়ে আমার হাত দুটো বেঁধে ফেললো ৷ হঠাত্‍ আমার মাথার পেছনের দিকে একটা প্রচন্ড আঘাত করা হলো ৷ আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লাম ৷ #

ইরাকী বন্দীর আত্মকথা
(২য় পর্ব )
সুপ্রিয় পাঠক, ”ইরাকী বন্দীর আত্মকথা” শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার দ্বিতীয় পর্বে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি ৷ গত পর্বে নির্যাতিত ঐ ইরাকী নাগরিকের বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পেরেছিলাম, দখলদার মার্কিন সেনারা বিনা অপরাধে ইরাকের এই ব্যবসায়ীর বাড়ীতে হানা দিয়ে কীভাবে বাড়ীটিতে নির্বিচার গুলি বর্ষণ করে এবং নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালায় ৷ মার্কিন সেনারা এই নিরীহ ইরাকী নাগরিককে ব্যাপক মারধর করে ৷ এমনকি অস্ত্র তাক করে তার স্ত্রী ও শিশু সন্তানদের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করে ৷ এরপর তারা এ ইরাকী ব্যবসায়ীকে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং তার হাত ও চোখ বেঁধে ট্রাকে তোলে ৷ এক পর্যায়ে মার্কিন সেনারা তার মাথায় প্রবল আঘাত করলে তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়েন ৷ এরপরের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, জ্ঞান ফেরার পর আমি বুঝতে পারছিলাম না ট্রাকটি কোথায় এসেছে ৷ আমরা কি এখনও বাগদাদে আছি, না বাগদাদ ত্যাগ করেছি ? আমার মাথা কালো মোটা কাপড়ে বাঁধা থাকায় আমার জন্যে সব কিছুই অন্ধকার হয়ে পড়ে ৷ আমার হাত দুটো পেছনে ঘোরানো অবস্থায় শক্ত রশি দিয়ে বাঁধা থাকায় সেগুলো বোধ শক্তিহীন হয়ে পড়ে ৷ আমি ঠান্ডা বা গরম কোনোটাই অনুভব করতে পারছিলাম না ৷ আমি অজ্ঞান থাকা অবস্থায়ও আমার হাতগুলো হয়তো আমার শরীরের নীচেই পড়েছিল ৷ অথবা (রশিতে শক্তভাবে বাঁধা থাকায়) হাত দুটোয় রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ৷ যাই হোক, আমি আমার ঘাড়ে তাপ অনুভব করে বুঝতে পারলাম , আরেকটি নতুন দিন শুরু হয়েছে ৷ ওরা যখন আমাকে ট্রাক থেকে নীচে ছুঁড়ে ফেললো, তখন আমি সূর্যের তাপ অনুভব করলাম ৷ এরপর উঠে দাঁড়ালাম ৷ সূর্যের আলো কোন্ দিক থেকে আসছে তাও বুঝতে পারলাম ৷ অনুভব করলাম যে, এখন বেলা দুপুর ৷ বুঝলাম , আমি বারো ঘন্টারও বেশী সময় ধরে অজ্ঞান ছিলাম৷ র্নিযাতিত ঐ ইরাকী নাগরিক আরো বলছিলেন, মার্কিন সেনারা আমার পেন্ট ভেদ করে আমার নিতম্বে ইনজেকশান দিয়েছিল ৷ ইনজেকশানের ব্যথায় আমি ভীষণ অশস্তি বোধ করছিলাম ৷ তবে এ সময় মানুষিক দুর্বলতা এবং আতঙ্কের কথা আমার ব্যথা ও অস্বস্তি ম্লান হয়ে পড়েছিল ৷ যাই হোক, সেই উত্তপ্ত আবহাওয়ায় আধ ঘন্টারও বেশী সময় ধরে অপেক্ষা করার পর, তারা আমাকে একটা করিডোরের মতো স্থানে নিয়ে গেলো এবং এরপর তারা আমাকে একটা সেলে নিয়ে যায় ৷ ঐ সেলে আমি কোনো রকমে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ি ৷ একদিকে প্রচন্ড তৃষ্ণা ,অন্যদিকে টয়লেটে যাবার তাড়া দুটোই আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছিল ৷ কিন্তু কেউই আমার কথা শুনছিল না বা শুনিলেও তারা গুরুত্ব দিচ্ছিল না ৷ দুই তিন ঘন্টা পর আমি এক ব্যক্তিকে অত্যন্ত সাবলীলভাবে আরবী বলতে শুনলাম ৷ এই ব্যক্তি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার অবস্থা ভালো তো? তোমার কি কিছু লাগবে?” উত্তরে আমার কী প্রয়োজন তা তাকে জানালাম ৷ সে আবার প্রশ্ন করলো, “তারা কি তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে?” “তারা কি তোমাকে মারধোর করেনি?” আমি বললাম, আমি ভীষণ তৃষ্ণার্ত, প্রায় ২০ ঘন্টা পর্যন্ত পানি, খেতে পারিনি ৷ এবং আমাকে শিগগিরই টয়লেটে যেতে হবে ৷ আগে আমাকে টয়লেটে যেতে দাও ,তারপর অন্য কথা ৷ এরপর লোকটি কারারক্ষীর কাছে ইংরেজীতে কী যেন বলে হাসলো ৷ তারপর চলে গেলো ৷ রক্ষীরা আমাকে টয়লেটে নিয়ে গেলো ৷ একমাত্র টয়লেটে নিয়েই তারা আমার হাতের বাঁধ খুলে দেয়৷ এরপর দরজা খুলে দিয়ে ওরা চলে গেলো৷ আমার অবশ হয়ে পড়া হাত নাড়াতে খুব কষ্ট হচ্ছিল৷ তবুও আমি মাথায় লাগানো ব্যাগের বাঁধন ঢিলে করে ব্যাগটা খুলে ফেললাম ৷ করিডোরটা বেশ দীর্ঘ ছিল ৷ করিডোরের সিলিংয়ে লাগানো ছিল খুব কম আলোর একটা বাতি ৷ ঐ আলোতে দেখতে পেলাম দুটো টয়লেট এবং হাত মুখ ধোয়ার একটা বেসিন ৷ আমি কি আগে পানি পান করবো, না আগে টয়লেটে যাব তা নিয়ে দ্বিধান্বিত হলাম ৷ শেষ পর্যন্ত দুই ঢোক পানি খেয়ে আমি টয়লেটের দিকে ছুটলাম ৷
টয়লেট সেরে ইরাকী ঐ বন্দী আরো বলছিলেন, আমি আমার হাত ও মুখ ধুয়ে নেই ৷ এরপর আমি অনেক পানি পান করলাম ৷ কী পরিমাণ পানি যে পান করেছিলাম তা আমার মনে নেই ৷ এরপর বিশালদেহী এক রক্ষী এসে ইংরেজীতে কী যেন বললো, আমি হুবহু অর্থ না বুঝলেও তার ইঙ্গিত ও অঙ্গভঙ্গি থেকে বুঝলাম, আবার ঐ অস্বস্তিকর মোটা কাপড়ের ব্যাগটা দিয়ে আমার মাথা ঢেকে রাখতে হবে ৷ সেলে ফিরে যাবার পথে আমি কিছু লোকের কাশি ও হাঁটার শব্দ শুনতে পেলাম ৷ আমি এটাও বুঝতে পারলাম যে, এখানে আরো কারা- প্রকোষ্ঠ রয়েছে এবং কারাবন্দীরা আমাকে দেখেছে অথবা আমার হাঁটার শব্দ তারা শুনতে পেয়েছে ৷ কারারক্ষী আবার আমাকে সেলের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল এবং সেলের ঢেউ টিনের মতো লোহার দরজাটা বন্ধ করে দিলো ৷ আমার হাতগুলো মুক্ত থাকায় হাত ও দাঁত ব্যবহার করে আমি মাথার কালো রংয়ের ব্যাগের যে অংশটা নাকের সামনে ছিল তাতে একটা ছিদ্র করলাম, যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে নিঃশ্বাস নেয়া যায় ৷ যখনই আমি কারা রক্ষীর পায়ের আওয়াজ শুনতাম , তখনই আমি ব্যাগ ঘুরিয়ে নিতাম যাতে ছিদ্রটা মাথার পেছনের চুলের কারণে বোঝা না যায় ৷ এরপর ওরা আমার সেলে একটা গামলা বা পাত্র রাখলো বলে মনে হলো ৷ আমার মনে হলো সেগুলো খাবার ৷ কিন্তু নিশ্চিত হবার জন্যে আমি আমার মাথা ঢেকে রাখা ব্যাগটা আবার খুললাম এবং দেখলাম সেখানে আসলেই খাবার রয়েছে ৷ খাবার দেখে আমার ক্ষিদে যেন অসহনী রকম বেড়ে গেল ৷ ঐ খাদ্য খাবার জন্যে আমি মাথার ব্যাগটা পুরোপুরি খুলে ফেলতে দ্বিধা করতাম না, কিন্তু কারারক্ষীরা আমায় বুঝিয়ে দিলো যে মাথায় ব্যাগ রেখেই অন্ধের মতো খেতে হবে ৷ অর্থাত্‍ মাথার ব্যাগ খোলা নিষিদ্ধ! অবশ্য কিছুক্ষণ পর এক প্রহরী এসে পুরো মাথা ঢেকে রাখা ঐ কালো মোটা কাপড়ের ব্যাগটির সামনের দিক থেকে আমার মুখ বরাবর একটা আধুলি বা পয়সার সমান পরিমান অংশ (ব্যাগ থেকে) কেটে নিল৷এরপর ওরা আমার হাতে খাবারের বাটি দিয়ে কিছু কথা বলে চলে গেল৷ সরাসরি তাদের কথার অর্থ বুঝলাম না ৷ কিন্তু ধরে নিলাম যে, মাথার ব্যাগ না খোলার ব্যাপারে ওরা আমাকে সাবধান করে দিয়েছে ৷
মার্কিন সেনাদের হাতে নির্যাতিত ঐ ইরাকী নাগরিক আরো বলছিলেন, আমি ওই ছিদ্র দিয়ে খাবারের দিকে তাকালাম ৷ মনে হলো খুব মজাদার খাবার৷ কিন্তু খেতে গিয়ে খাবারটা কিছুটা লবনাক্ত মনে হলো ৷ আমি পানি দেয়ার জন্যে কারারক্ষীদের ডেকে পানি খেতে চাই- এমন ইশারা বা অঙ্গভঙ্গি করে তাদের বুঝালাম ৷ কিন্তু কারারক্ষী বা প্রহরীদের কথা শুনে , বিশেষ করে তাদের বিদ্রুপের ভঙ্গি দেখে বুঝলাম ওরা আমাকে পানি পান করতে দেবে না ৷ আমি কিছুক্ষণ আমার পরিবারের কথা ভাবলাম ৷ তাদের ব্যাপারে ভয়ানকভাবে উদ্বিগ্ন ছিলাম ৷ আমাকে একটু পানি দিতে ওদের আবার অনুরোধ করলাম এবং আবার টয়লেটে যেতে চাইলাম ৷ ওরা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলো যে , আমাকে পানি দেয়া হবে না ৷ অবশ্য ওরা আমাকে নোংরা ও দূর্গন্ধময় পট বা পাত্র দিল যাতে আমি প্রাকৃতিক কর্ম সম্পন্ন করতে পারি৷ এরপর মধ্যরাতের নীরব নিস্তব্ধতার মাঝে আমি আমার ঢেকে রাখা মাথার ব্যাগটা খুলে ফেললাম ৷ সুপ্রিয় পাঠক মার্কিন সেনাদের হাতে নির্যাতিত একজন নিরীহ ইরাকীর অভিজ্ঞতার কথা শুনলেন ৷ আগামী পর্বে ঐ ইরাকী বন্দীর ওপর মার্কিন সেনাদের লোমহর্ষক নির্যাতনের আরো কিছু ঘটনা আপনাদের মাঝে তুলে ধরার চেষ্টা করবো ৷ #

ইরাকী বন্দীর আত্মকথা
(৩য় পর্ব )
সুপ্রিয় পাঠক, ‘ইরাকী বন্দীর আত্মকথা’ শীর্ষক ধারাবাহিক এ আলোচনায় মার্কিন সেনাদের হাতে নির্যাতিত এক ইরাকীর কারাজীবনের চাঞ্চল্যকর ঘটনাবলী শুনছিলেন তারি নিজস্ব জবানীতে ৷ গত পর্বে আপনারা নির্যাতনের সর্বশেষ বর্ণনায় শুনেছেন যে, বহু অনুরোধের পরও কারারক্ষীরা তাকে একটু পানি খেতে দেয়নি, টয়লেটে যেতে চাইলে তারা দুর্গন্ধময় একটা পাত্র এনে দিয়েছিল ৷ মধ্যরাতের নিস্তব্ধতার মাঝে ইরাকী বন্ধী তার মাথার ব্যাগটা খুলে ফেলেছিল ৷ এরপর যা ঘটলো তা আরো বীভত্সা ৷ মার্কিন সেনাদের হাতে নির্যাতিত ঐ ইরাকী বন্দী বলছিলেন, পরদিন সকাল বেলা আমাকে মাটির নীচের একটি ভয়ানক স্থানে নিয়ে যায়৷ সেখানে তিনটি লোক আমাকে জেরা করে ৷ তাদের মধ্যে দুজন খুব স্বাচ্ছন্দ্যে বা অনর্গলভাবে আরবী ভাষায় কথা বলছিল ৷ কিন্তু ওদের হিব্রু টান থেকে আমি বুঝতে পেরেছি যে, ওরা ইসরাইলি ৷ তারা আরবীতে কি নির্দেশ দিয়েছিল তা আমি খুব সহজেই বুঝতে পেরেছিলাম৷ তাদের তৃতীয় জন ছিল যেমনি শক্তিশালী দেহের অধিকারী, তেমনি কুত্সিঝত এবং হিংস্র ৷ তাকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল যে, সে তাদের অনুগত লোক এবং নির্যাতনের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ইরাকী ঐ বন্দী বললেন, হ্যাঁ, আমার অনুমান ঠিকই হয়েছিল ৷ সে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় দ্বিধাহীনভাবে , বেশ দক্ষতার সাথে আমার ওপর নির্যাতন চালায় ৷ এতো নির্বিকারভাবে সে নির্যাতন চালাচ্ছিল যেন সে ঝাড়ু দেয়া বা কাঠ কাটার মতো কোনো স্বাভাবিক কাজ করছে ৷ লোকটা অনায়াসে আমার পা দুটো তার হাতে তুলে নেয় ৷ এরপর আমাকে উপরে তুলে সেখানে জমিয়ে রাখা যন্ত্রপাতির মধ্যে আমাকে ঝুলিয়ে দেয় ৷ ওপরে ঝোলানোর পর সে নির্দয়ভাবে চাবুক দিয়ে আমার ওপর আঘাত করতে থাকে ৷ ঝোলানো অবস্থায় আমার মাথা ও কাঁধ ছিলো নীচের দিকে এবং পা দুটো ছিল ওপরের দিকে ৷ ব্যথা ও যন্ত্রণায় আমি মারাত্মক কষ্ট পাচ্ছিলাম ৷ মারের চোটে আমি চিত্কাোর করে উঠতাম ৷ ওরা যে আমার কাছ থেকে কি জানতে চাইতো তা আমি জানতাম না ৷ সত্যি বলতে কি ঐ ভয়াবহ অবস্থায় ওরা যে ব্যাপারেই জানতে চাইতো, আমি সে ব্যাপারেই তথ্য দিতে প্রস্তুত ছিলাম৷ কিন্তু ঐ জালেমগুলো আমাকে এমন সব বিষয়ে প্রশ্ন করছিল যেসব বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না ৷ ওরা জিজ্ঞাসা করছিল,”বিস্ফোরকগুলো কোথায়? অস্ত্রগুলো কোথায়? কোন্ কোন্ অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রেখেছিস? বিস্ফোরকগুলোর চাবি বা ডিটোনেটরগুলো কোথায়?
মার্কিন সেনাদের হাতে নির্যাতিত ঐ ইরাকী বন্দী আরো বলছিলেন, কুত্সিনত ঐ ইসরাইলি লোকটা আমার পা দুটোর ওপর এক নাগাড়ে পেটাতে থাকে ৷ আর অন্য দুজন আমার কাঁধে, কাঁধের নীচে এবং নিতম্বে এমন ভীষণভাবে লাথি মেরেছিল যে প্রচন্ড ব্যথায় সর্বাঙ্গ টনটন করছিল দীর্ঘক্ষণ ধরে ওরা আমার ওপর এভাবে নির্যাতন চালিয়েছিল৷ আমার তখন শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল৷ কষ্টের জ্বালায় আমি আর্তনাদ করছিলাম৷ তখন মনে প্রাণে আশা করছিলাম যে ওদের লাথিগুলো আমার শরীরের সবচেয়ে স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে এসে পড়ুক, যাতে মৃত্যু এসে আমার সমস্ত দুঃখ ও বেদনার অবসান ঘটাতে পারে ৷ কিন্তু আমি কি চাইছিলাম তা ঐ বেজন্মা বদমায়েশগুলো বুঝে ফেলে ৷ ওরা তাই এরপর থেকে শুধু আমার হাঁটু ও পায়ে আঘাত করতে থাকে৷ আমার পা’গুলো কিভাবে তখনও টিকেছিল তা ভেবে অবাক হচ্ছিলাম ৷ কোন্ দিক থেকে ওরা লাথি মারছে, তা সনাক্ত করে আমি আমার মাথাকে সেদিকে এগিয়ে দিচ্ছিলাম ৷ কিন্তু পেশাদার এবং অভিজ্ঞ ইসরাইলি নির্যাতনকারীরা এবারও আমার উদ্দেশ্য বুঝে ফেলে! এবার ওরা নির্যাতন বন্ধ করলো এবং আমাকে দৌড় দিতে বাধ্য করলো ৷ ঐ ইরাকী বন্দী বলছিলেন, আমার পা’গুলো অবশ হয়ে পড়েছিল ৷ এতোটা অচেতন যে আমার পায়ে জুতো আছে না কি নেই, খালি পায়ে দৌড়াচ্ছি না স্পঞ্জ আছে তাও বুঝতে পারছিলাম না ৷ এরপর ইসরাইলি নির্যাতকরা আবার আমাকে আমার কারাকক্ষে নিয়ে গেলো ৷ আর কোনো প্রশ্ন করলো না ৷ এবার ওরা আমার মাথা ঢেকে রাখা কালো অভিশপ্ত ব্যাগটা নিয়ে চলে যায় ৷ আমার চোখগুলো অবসন্ন ও ঘোলাটে হয়ে পড়ায় কিছুই ঠিকমত দেখতে পারছিলাম না ৷ আমি চোখগুলোকে বন্ধ করলাম এবং কান্না শুরু করে দুঃখের বোঝা হাল্কা করার চেষ্টা করলাম ৷ কিন্তু কারারক্ষী এমন বিকট চিত্কারর দিয়ে আমাকে ধমক দিলো যে আমি কান্না থামাতে বাধ্য হলাম৷ কিছুক্ষণ পর একজন বেঁটে আমেরিকান সেনা আমার কক্ষে আসলো ৷ তাকে দেখে দয়ালু মনে হলো৷ সে তার দিয়ে বাঁধা আমার হাত দুটোর কাছে এল এবং তারটা কেটে দিল৷ এরপর ঐ মার্কিন সেনা বিদ্রুপের হাঁসি হেঁসে কি যেন বলে চলে গেলো ৷
মার্কিন সেনাদের হাতে নির্যাতিত ঐ ইরাকী বন্দী বলছিলেন, এবার আমার নজর পড়লো নিজের পা দুটোর দিকে ৷ এই প্রথমবারের মতো আমি আমার ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত পা’গুলো দেখলাম৷ পা’গুলো ফুলে যেন ফুটবলে পরিণত হয়েছে৷ প্রথমে আমি ভাবলাম আমার পায়ের পাতার কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই৷ সেখানে কোনো চামড়া, গোশত এমনকি কোনো হাঁড়ও নেই বলে মনে হলো৷ কিন্তু নির্যাতকরা ছিল এতো দক্ষ যে, আমার ক্ষত স্থানগুলো খুব গভীর না হলেও সেগুলো খুবই ফুলে উঠেছিল এবং যন্ত্রণা দিচ্ছিল ৷ আমার মনে হলো, খুব শিগগিরই পায়ের ক্ষতগুলো ভালো হয়ে যাবে ,এটা ভাবতেই আমার মনোবল বেড়ে গেলো৷ কিন্তু এরপরই আমার মধ্যে আবার চরম হতাশাবোধ সৃষ্টি হলো৷ আমি আমার পরিবার ও আমার বন্দীত্বের কারণ এবং এ সংক্রান্ত পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম৷ আমি যতই এ নিয়ে ভাবতে লাগলাম ততই নিজের ও পরিবারের সদস্যদের বন্দীত্বের কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না৷ ফলে আমি মনে মনে আরো ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়ে উঠলাম৷ কিন্তু হায়! এখানে এ নিয়ে আলোচনা করার মতোও কেউ নেই! ঐ ইরাকী বন্দী বলছিলেন, মার্কিন সেনারা যেভাবে আমার পরিবারের সদস্যদের গ্রেফতার করেছে এবং যে ভয়াবহভাবে ইসরাইলি নির্যাতকের মাধ্যমে আমার ওপর নির্যাতন চালিয়েছে তাতে আমার ভয় বেড়ে যায়৷ আমি ভাবতে লাগলাম, ওরা কি চায়? ওরা জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতনের সময় ফালতু বা অর্থহীন প্রশ্ন করছিল এবং আমার উত্তর শোনার জন্যে ওদের মধ্যে কোনো আগ্রহ ছিল না৷ আর এ থেকে আমি বুঝতে পারলাম এসব প্রশ্ন তাদের জন্যে মোটেও জরুরী ছিল না৷ মার্কিন সেনারা যেভাবে আমাকে শারীরিক কষ্ট দিচ্ছিল ঠিক সেভাবেই আমাকে জ্বালাতনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করছিল৷ অর্থাত্‍ এসব বাহ্যিক আচরণের পেছনে মার্কিনীদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল৷ কিন্তু কি সে উদ্দেশ্য? তারা দুই দফায় আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এবং দুই বার আমার ওপর ভয়ানক নির্যাতন চালিয়েছে৷ কিন্তু মার্কিন সেনারা আমার কাছে কি চাচ্ছে তা তখনও আমি বুঝতে পারিনি৷ ওদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমি জানলাম যে, ওরা আমার নাম, পেশা এবং আমার পরিবার সম্পর্কেও সব কিছু জানে৷ এমনকি ওরা আমার এবং আমার আত্মীয় স্বজনদের নৈতিক গুণগুলো সম্পর্কেও অবহিত! কতগুলো গুরুত্বহীন বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্যে ওরা ওদের এতো শ্রম ও সময় নষ্ট করছে দেখে আমি অবাক হলাম৷
মার্কিন সেনাদের হাতে নির্যাতিত ঐ ইরাকী বন্দী বলছিলেন, মার্কিন সেনা ও তাদের ইসরাইলি নির্যাতকরা জানতো আমি ৩৮ বছর বয়স্ক একজন ব্যবসায়ী এবং আমি সুঠাম দেহের অধিকারী একজন সৌখিন ক্রিড়াবিদ৷ একজন বিনয়ী ও সুবিবেচক মানুষ হিসেবেও আমার খ্যাতি রয়েছে৷ আর এ কারণে অনেক মানুষের সাথে আমার যোগাযোগ আছে৷ মার্কিন সেনা ও তাদের ইসরাইলি সহযোগীরা নিশ্চয়ই এটাও জানতো যে রাজনীতিতে আমার কোনো আগ্রহ নেই৷ এমনকি আমি সাদ্দামের শাসনামলে কিংবা ইরাকে মার্কিন সেনাদের হামলার পরও রাজনীতি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কখনো জড়িত হইনি৷ তারা এটাও জানতো আমি একজন সংসারী মানুষ এবং আমি আমার পরিবারের চাহিদা ও স্বপ্নগুলো পূরণের জন্যে জীবন বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত৷ এ কারণে ওরা যখন আমাকে নির্যাতন কক্ষের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন তারা একটি বিশেষ কক্ষের সামনে দিয়ে আমাকে খুব ধীর গতিতে এগুতে দিচ্ছিল, যাতে আমি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের ফরিয়াদ এবং কান্নার শব্দ শুনতে পাই৷ ওদের কান্না ও আহাজারির শব্দ আমাকে এতোটা উদ্বিগ্ন এবং শঙ্কিত করেছিল যে এর তুলনায় অন্য যে কোনো ধরনের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন আমার কাছে তুচ্ছ মনে হয়েছে ৷ ঐ ইরাকী বন্দী আরো বলছিলেন, আমার নির্যাতকরা আমার হাত ও চোখ না বেঁধেই আমার ওপর চাবুকের কষাঘাত করে যাচ্ছিল ৷ ফালতু প্রশ্ন না করার আবেদন জানানো সত্ত্বেও তারা আমাকে অর্থহীন প্রশ্ন করা অব্যাহত রাখে, যদিও তারা নিজেরাই জানতো যে আমার কাছে এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই ৷ একদিন মার্কিন ও ইসরাইলি নির্যাতকরা আমার মাথা ও মুখে বেল্ট দিয়ে আঘাত করছিল ৷ হঠাত্‍ ওদের বেল্ট আমার চোখে আঘাত হানে এবং সেখান থেকে রক্ত ঝরতে থাকে ৷ আমার জামা চোখের পানিতে সিক্ত ও রক্তে রঞ্জিত হলো ৷ কিন্তু আমি এতো শোচনীয় অবস্থায় ছিলাম যে অন্ধত্বের ব্যাপারেও চিন্তিত হইনি ৷ সেদিন সন্ধ্যায়ও যখন আমার চোখ থেকে রক্তপাত বন্ধ হচ্ছিল না তখন আমাকে একটা অস্থায়ী হাসপাতালে নেয়া হয়৷ আমার ডান চোখের আইবল বা অক্ষিগোলক নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সেটা অপসারণের জন্যে তারা হাসপাতালে আমার চিকিত্সাগ শুরু করে এবং আমার ওপর নির্যাতন বন্ধ করে ৷ আমাকে অন্ধ করার অনুশোচনায়, নাকি আমি তাদেরকে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় তারা আমার চিকিত্সাম করেছিল বুঝে উঠতে পারিনি! #
ইরাকী বন্দীর আত্মকথা
( ৪র্থ পর্ব )
সুপ্রিয় পাঠক , ইরাকী বন্দীর আত্মকথা শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার আজকে পর্বে আমরা মার্কিন সেনাদের হাতে নির্যাতিত এক ইরাকী বন্দী , মার্কিন সেনা এবং তাদের ইসরাইলি সহযোগীদের হাতে কিভাবে ইরাকের ভেতরেই পাশবিক কায়দায় ও নৃশংস পন্থায় নির্যাতিত হচ্ছিলেন, তার আরো কিছু লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা আপনাদের জন্যে উপস্থাপন করবো ৷ ইরাকি ঐ বন্দীর আত্মকথা থেকে জানা যায়, তার ওপর নির্যাতনকারী মার্কিন ও ইসরাইলি সেনারা বিভিন্ন তুচ্ছ অজুহাত দেখিয়ে মানসিক ও শারীরিক ভাবে নির্যাতন চালাতো ৷ শারীরিক নির্যাতনের কারণে ঐ ইরাকী বন্দীর পায়ে দুবার অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে ৷ একবার ঐ ইরাকী বন্দীর কাছে একটি টুথপিক আকারের ছোট তার এবং একটা ছোট কাপড়ের টুকরা দেখে মার্কিন ও ইহুদিবাদী সেনারা তাকে এমন অপমানজনকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে, যেন তিনি মার্কিনীদের কোনো কিছু চুরি করেছেন! তারা এ ইরাকী বন্দীকে তথ্য গোপনের জন্যে অভিযুক্ত করে এবং এ অপরাধে তাকে উলঙ্গ করে রাখে৷ উলঙ্গ অবস্থায় তাকে হলের মধ্যে হাঁটতে হয়েছে এ অবস্থায় মার্কিন পুরুষ ও মহিলা কারারক্ষী বা নির্যাতকারীরা তাকে ঠাট্রা বিদ্রুপ করেছে ৷ পরে ঐ ইরাকী বন্দীর কক্ষে আরো অনেক ইরাকী বন্দীকে ঠাসাঠাসি অবস্থায় রাখা হয়, যদিও সেখানে তাদের জন্যে কোনো রকমে বসার স্থান সংগ্রহ করাও ছিল কষ্টকর ৷ এই বন্দীদেরকে বাথরুমে একসাথে গোসল করতে হয় ৷ এমনকি এসব বন্দীদেরকে পরষ্পরের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্যে চাপ দেয়া হয় ৷ বাধ্য হয়ে কোনো কোনো বন্দী, মার্কিন সেনাদের পক্ষ হয়ে গুপ্তচরবৃত্তিতে নিয়োজিত হয় ৷ নতুন ইরাকী বন্দীদের কেউ কেউ ঐ ব্যবসায়ী ইরাকী বন্দীকে জানায় যে, মার্কিন সেনাদের নির্যাতনের কঠোরতা থেকে রক্ষা পাবার জন্যে, তারা মার্কিন সেনা কমান্ডের আওতায় ইরাকের বিভিন্ন স্থানে, এমনকি পাকিস্তান, সৌদি আরব, চেচনিয়া ও আফ্রিকায় দূধর্ষ সন্ত্রাসী অভিযানে অংশ নিতে বাধ্য হয়েছেন ৷ এসব সন্ত্রাসী হামলা ভালোভাবে সম্পন্ন করতে না পারলে তাদেরকে পুণরায় কারাগারে এনে, মার্কিন সেনারা আগের চেয়েও জঘণ্য পন্থায় নির্যাতন চালায় বলে এই কারাবন্দীরা জানিয়েছে ৷ তারা আরো জানায়, তাদের কাছ থেকে সব ধরনের তথ্য জানার জন্যে মার্কিন সেনারা তথাকথিত মিথ্যা নির্ণয় যন্ত্র নামের একটি ভয়ংকর নিপীড়ক যন্ত্র ব্যবহার করে থাকে৷ এমনকি এ জন্যে তারা বন্দীদেরকে নিদ্রাহীন করে রাখাসহ তাদের ওপর বিভিন্ন ধরনের বিশেষ ইঞ্জেকশানও প্রয়োগ করে৷ মার্কিন সেনারা কথিত মিথ্যা নির্ণয় যন্ত্রের মাধ্যমে ইরাকী বন্দীদের মস্তিষ্কের ওপর বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছে৷ তাদেরকে পরীক্ষাগারের ইঁদুরের মতো ব্যবহার করেছে বলেও অনেক বন্দী সন্দেহ প্রকাশ করেছেন৷ ইরাকী বন্দীরা তাদের পরস্পরের কথাবার্তা থেকে মাঝে মধ্যে জানতে পারে যে, আজ কারাগারের অমুক কক্ষে একজন বন্দী মার্কিন সেনাদের নির্যাতনে নিহত হয়েছে, অথবা মার্কিন সেনাদের নৃশংস নির্যাতনে অমুক বন্দীর সাথে বসবাসকারী এক বন্দীর শিরদাঁড়া ভেঙ্গে গেছে অথবা একজন মার্কিন নির্যাতক তার সহর্কর্মীদের বলছেন যে, ওমুকের লাশ সমাহিত কর৷ মার্কিন সেনাদের হাতে নির্যাতিত ঐ ইরাকী বন্দী জানান, এরপর আমাকে দীর্ঘ দিন ধরে একটি নির্জন সেলে রাখা হয় ৷ এবার তারা এ নির্যাতন কক্ষে আমার চোখ বেঁধে রাখে এবং আমার স্ত্রী ও বড় কন্যাকে সেখানে নিয়ে আসে৷ আমার স্ত্রী ও কন্যা আমাকে কিছু সান্ত্বনাদায়ক কথা বলে৷ আমি সন্ত্রাসী নই- এটা প্রমাণিত হলে মার্কিন সেনারা আমার গোটা পরিবারকে বৃটেনে পাঠাবে -এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলেও তারা জানায় ৷ এরপর মার্কিন সেনারা পুনরায় আমার স্ত্রী ও কন্যাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেয় ৷ তারপর পুণরায় আমার ওপর নির্যাতন শুরু করে৷ এ সময় মার্কিন ও ইসরাইলি নির্যাতনকারীরা আমার ডান হাতের বুড়ো আঙুলের নখের নীচে পিন ঢুকিয়ে দেয়৷ ফলে আমার হাত রক্তাক্ত হয়ে পড়ে৷ নির্যাতনকারীরা রক্ত বন্ধ করার ও কোনো চেষ্টা করেনি, বরং নখ থেকে রক্ত প্রবাহ কমে আসা শুরু হলে, নখের নীচে বিদ্ধ করা পিনটা অত্যন্ত জোর দিয়ে আবার নাড়াচাড়া করতো৷ এতেও তারা সন্তুষ্ট ছিল না ৷ তারা লাইটার জ্বালিয়ে ঐ পিনটাকে গরম করতো ৷ এ সময় আমি যেভাবে আর্তনাদ করতাম, তা খুব দূর থেকেও শোনা যেত৷ ঐ ইরাকী বন্দী বলছিলেন, তারা ঐ পিন সরিয়ে নেয়ার পরও আমার মাথা, কাঁধ, শিরদাঁড়া এবং পায়ে অসহনীয় ব্যথা অনুভব করছিলাম ৷ আমি অনেক পরেও ঐ যন্ত্রণার কারণে কান্না থামাতে পারিনি ৷ মার্কিন ও ইসরাইলি নির্যাতকরা এরপর আমাকে একটি হাসপাতালের মতো স্থানে নিয়ে যায় ৷ সেখানে তারা আমাকে একটি রুমে নিয়ে, বিছানায় শুইয়ে দিয়ে, আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি ইলেকট্রোড স্থাপন করে ৷ সেখানে আমি- তার, মনিটর, মিটার, সূচক প্রভৃতি দেখলাম৷ আমি ভাবলাম ওরা হয়তো বৈদ্যুতিক শক দিয়ে আমাকে মেরে ফেলবে৷ আর তা যদি করে, তাহলে ভালোই হয় বলে আমি মনে মনে ভাবলাম ৷ কারণ, এতে আমি সব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব ৷ কিন্তু না, মার্কিন ও ইসরাইলি নির্যাতকরা বললো- দখলদার মার্কিন কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, আমি তাদের সাথে সহযোগিতা করতে সক্ষম এবং আমি যদি তাদের সাথে সহযোগিতা না করি তাহলে তারা তাদের হাতে বন্দী আমার সন্তানও স্ত্রীর নখের ওপর নির্যাতন করাসহ অন্যান্য নির্যাতন করবে, এমনকি তাদের হত্যাও করবে৷
একথা শোনার পরপরই আমি পুণরায় আমার নখে ব্যথা অনুভব করলাম ৷ এ যন্ত্রটা কেন আমাকে হত্যা করলো না তা ভেবে যন্ত্রটার ওপর অভিশাপ দিলাম ৷ স্ত্রী ও সন্তানদের বিপদের ভয়ে ভীত হয়ে পড়া ইরাকের ঐ বন্দী আরো জানান, আমি মার্কিন ও ইসরাইলি নির্যাতনকারী বা গোয়েন্দাদের সাথে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতার অঙ্গীকার করি৷ ওরা আমার মতো আরো কয়েকজন ইরাকী বন্দীকে জানায় যে আমাদেরকে সন্ত্রাসী দলগুলোতে অনুপ্রবেশের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে এবং আল কায়দার সন্ত্রাসীদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে, অথবা আলকায়দার সমমানের সন্ত্রাসী দল গঠন করে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সন্ত্রাসী অভিযান চালাতে হবে৷ মার্কিন নির্যাতনকারী এবং তাদের ইসরাইলি অনুচররা চাইতো আমরা যেন বলি যে, আমরা গুলি চালানো, বোমা ফাটানো, গুপ্ত হত্যা, গোয়েন্দাবৃত্তি ও মার্কিন বিরোধী গ্রুপগুলোর মধ্যে অনুপ্রবেশ করার মতো কাজ করতে আগ্রহী৷ এ অবস্থায় আমি এসব কাজে অংশ নিতে আগ্রহী বলে মার্কিন নির্যাতক ও তাদের ইসরাইলি সহযোগীদের জানালাম৷ কারণ, আমি ভেবেছিলাম একমাত্র এভাবেই আমি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের রক্ষা করতে পারবো ৷ আমার সাথে থাকা অন্য ইরাকী বন্দীদের মধ্যে মাত্র অল্প কয়েক জন এ ধরনের কাজে অংশ নেয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করে ৷ আসলে তাদের এ আচরণ ছিল তোষামোদ মাত্র ৷
ঐ ইরাকী কারাবন্দী আরো বলছিলেন, মার্কিনীদের পরিচালিত ”নীতি-কথা ও প্রশিক্ষণের ক্লাস” ধীরে ধীরে প্রায় পনেরো জন ইরাকীর ক্লাসে পরিণত হলো ৷ ক্লাসে আমাদেরকে কাগজ কলম দেয়া হতো৷ ইরাকের অন্যান্য কারাগারে মার্কিন সেনাদের হাতে বন্দী হওয়া অনেক ইরাকীও এ ক্লাসে আমার সাথে অংশ নেয় ৷ এ বন্দীদের আনা হয়েছিল তাস ফোরাত, আল রাসাফি, উম্মে ক্বাসদু প্রভৃতি জেলখানা থেকে ৷ ওদের কাছ থেকেই আমি প্রথম বারের মতো জানতে পারি যে, আমি কন্দুর নামক কারাগারের বন্দী৷ আমার সহপাঠি কারাবন্দীরা তালিল, আবু গারিব এবং আসালাহিয়া কারাগার ও বৌগা বন্দী শিবিরের অবস্থাও জানালো৷ ইরাকের এসব কারাগারে বন্দীদের ওপর মার্কিন সেনাদের নৃশংস ও বর্বোরোচিত নির্যাতনের ঘটনা মধ্যযুগের কারাগারগুলোর ঘটনাকেও হার মানায়৷ একজন কারাবন্দী জানান যে, মার্কিন সেনারা তাকে উলঙ্গ করে সারা দিন ধরে তার পিঠে সওয়ার হতো এবং এ অবস্থায় তার গায়ে লাথি মেরে তাকে দ্রুত গতিতে দৌড়াতে বাধ্য করতো৷ একজন মহিলা মার্কিন সেনাও এ কাজে অংশ নিয়েছে বলে ঐ বন্দী জানান৷ অন্য একজন ইরাকী বন্দী জানায়, একজন মার্কিন মহিলা সেনা তার গলায় কুকুরের বেল্ট ও শিকল বেঁধে তাকে টেনে বেড়াতো ৷ ঐ মার্কিন মহিলা সেনাটির হাতের লাঠি দিয়ে তার অথাত্‍ বন্দী ইরাকীর নগ্ন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে আঘাত করতো৷ এতো নিম্ন রুচির মানুষও যে বিশ্বে আছে তা বিশ্বাস করা খুবই কঠিন বলে ঐ বন্দী মন্তব্য করেন ৷ এভাবে মার্কিন সেনাদের মাধ্যমে চরম অপদস্ত, হতাশ ও ব্যক্তিত্বশূন্য হয়ে আমরা অর্থাত্‍ ইরাকী বন্দীরা তাদের একনিষ্ঠ অনুগত দাস বা ভৃত্যে পরিণত হয়েছিলাম ৷

অন্য অনেক কারাগারেও মার্কিনীদের পরিচালনায় সন্ত্রাস শেখার প্রশিক্ষণ ক্লাস চালু করা হয়েছে বলে আমরা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারি ৷
” আজ হোক কাল হোক, গোটা আমেরিকাই একটি বড় মানসিক হাসপাতালে পরিণত হবে৷ কারণ, মার্কিন সেনারা ইরাক ছাড়া বিশ্বের অন্য যে কোনো স্থানে থাকতে আগ্রহী৷ এমনকি তারা আফগানিস্তানকেও ইরাকের চেয়ে বেশী পছন্দ করে৷ শোয়েবিয়া হাসপাতাল থেকে আসা একজন মার্কিন সেনা জানায়, এই হাসপাতালটির অবস্থা কারাগারের চেয়েও শোচনীয়৷ কারণ, হাসপাতালটির সমস্ত ডাক্তার ও নার্স মানসিকভাবে অসুস্থ৷”
ঐ ইরাকী বন্দী ব্যবসায়ী জানান, একজন ইরাকী বন্দী মার্কিন সেনার এ সংলাপটি শুনে আমাদের কাছে তা উদ্ধৃত করেছিল৷ রেডক্রসের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা, আমেরিকার যোগসাজশে এ শোচনীয় অবস্থার খবর চেপে রেখেছে ব’লে একদল বিস্মিত মার্কিন সেনা অভিমত প্রকাশ করে৷ এরপর ঐ ইরাকী বন্দী ব্যবসায়ী জানান, সন্ত্রাসী কাজের ব্যাপারে মার্কিন সেনা ও তাদের কোনো কোনো ইসরাইলি সহযোগীর কাছ থেকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নেয়ার পর তাকে আফ্রিকায় একটি সন্ত্রাসী মিশনে পাঠানো হয়৷ এ মিশনের সহযোগী হিসেবে তাকে ইয়েমেন ও লোহিত সাগর হয়ে ইরিত্রিয়ায় যেতে হয়েছিল৷ কখনো সামরিক বিমানে চড়ে, কখনো নৌকায় ক’রে জলপথে, কখনো ট্রাকের সহযোগী ড্রাইভার হিসেবে বিভিন্ন দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এ মিশনের মাধ্যমে সম্ভবতঃ কোনো সন্ত্রাসী দলের কাছে মার্কিন অস্ত্র সাহায্য পৌঁছে দেয়া হয়েছিল ৷ ট্রাকটির মূল ড্রাইভার ছিল তারই মতো এক হতভাগ্য ইরাকী বন্দী, ঐ বন্দীর স্ত্রী ও মা মার্কিন সেনাদের হাতেই বন্দী হয়েছিল৷ ইয়েমেনে ফিরে এসে তারা আবার সানা শহর হয়ে বাগদাদে ফিরে আসে৷ এরপর ঐ ইরাকী বন্দী ব্যবসায়ী জানান, মার্কিনীরা তাকে পরবর্তি সন্ত্রাসী মিশনে পাঠানোর জন্যে অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেয়৷ মরুভূমি এলাকায়, মার্কিন,সেনাদের কড়া প্রহরায় এ প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়৷ ক্যামেরাযু্ক্ত রাইফেল, সাব মেশিনগান চালানোর প্রশিক্ষণও এর অন্তর্ভূক্ত ছিল৷ এর আগে একই স্থানে বিস্ফোরণ ঘটানোর পদ্ধতি শিক্ষা দেয়া হয়৷ এই শিক্ষকদের অধিকাংশই ছিলেন ইসরাইলি৷ তারা খুব ভালো আরবী বলতে পারতো৷ তাদের মধ্যে একজন মার্কিন মহিলা লেফটেন্যান্ট, নিজেকে প্রকাশ্যেই ইসরাইলি ব’লে ঘোষণা করতে ভালোবাসতেন৷ ঐ ইরাকী বন্দী ব্যবসায়ী জানান, এরপর আমাদেরকে দ্বিতীয় সন্ত্রাসী মিশনে পাঠানো হয়৷ তিনটি গাড়ী নিয়ে আমরা দুপুর পৌনে একটায় রওনা হই৷ আমাদের তিনটি গাড়ীর মধ্যে সব সময় ত্রিশ মিটার ব্যবধান ছিল৷ আধা ঘন্টা চলার পর একটি প্রবল বিস্ফোরণ ঘটে৷ ৩০ মিটার এগিয়ে থাকা আমাদের সামনের কারটি শুণ্যের ওপর ৫-৬ মিটার উঁচুতে উঠে পড়ে এবং এরপর আরো একটি বিস্ফোরণ ঘটে ঐ কারটির ভেতর থেকেই৷ ফলে কারটি আগুনে পুড়ে দলা পাকানো আবর্জনায় পরিণত হয়৷ আমাদের গাড়ীটি ধীরে চলায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া কারটি থেকে বিশ মিটার দূরে থাকতেই আমরা থামতে সক্ষম হই৷ আমাদের গাড়ীর সহযোগী ড্রাইভার তার অয়ারলেসের মাধ্যমে হেড কোয়ার্টারে সব খবর পাঠাচ্ছিলেন৷ সেখান থেকে নির্দেশ এলো, দ্রুত ঐ এলাকা ত্যাগ কর৷ ধোঁয়া ও আগুনের কুন্ডলী পাশ কাটিয়ে গাড়ীসহ দ্রুত পালাতে গিয়ে আমাদের জীপ গাড়ীর একটি চাকা বিস্ফোরক বসানো একটি গর্তে পড়ে যায়৷ আমি গাড়ী থেকে কয়েক মিটার দূরে ছিটকে পড়ি৷ ঐ ইরাকী বন্দী বলছিলেন, আমাদের গাড়ীটি ২-৩ বার ডিগবাজী খেল৷ তৃতীয় গাড়ীটি আমাদের এ গাড়ীর সাথে ধাক্কা খেয়ে উল্টে গেলো৷ আমি যে গর্তে ছিটকে পড়ি তা ছিল কাদা ও পানিতে ভরা৷ কাঁধে মারাত্মক ব্যথা পেলেও আমি বেঁচে যাই৷ কাদার মধ্যে গলা পর্যন্ত ডুবে থাকায় আমি উঠে পালাতে পারছিলাম না৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই স্থানটি জনাকীর্ণ হয়ে গেলো৷ অনেক কষ্টে কাদা থেকে বের হয়ে আমি জনতার মধ্যে মিশে গেলাম৷ আমি ছাড়া আমাদের অভিযানের অন্য সব সহযোগী মারা যায়৷ আমার স্বদেশবাসীদের বলতে শুনলাম, এম্বুলেন্স ডাকো,…এরা ইরাকী নয়,এরা ইসরাইলি… ১১০ মিলিমিটার কামান… হাঁসপাতাল… কেউ বেঁচে নেই.., টেলিফোন…প্রভৃতি শব্দ৷ ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় আমি বৃষ্টির মধ্যে মূল সড়ক ছেড়ে একটা সংকীর্ণ পথ ধ’রে পালিয়ে যেতে থাকি৷ একটা বাগানে সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত লুকিয়ে থাকার পর, হাঁটতে হাঁটতে দজলা নদীর কাছে পৌঁছি৷ নদীর পানিতে নিজেকে ধুয়ে মুছে বিশ্রাম নেই৷ এরপর বাগদাদে ফিরতে চাইলাম৷ কিন্ত সেখানে তো আমার পরিবার আর বেঁচে নেই৷ তাই রওনা দিলাম আল কুতের দিকে৷ কিন্তু তার আগে ক্ষুধা ও ক্লান্তি মোচনের জন্যে আর একটা খেজুর বাগানে বিশ্রাম নিলাম৷ ঐ ইরাকী বন্দী বলছিলেন, বাগানের খেজুর খেয়ে ভাবলাম, কারাগারের নরক যন্ত্রণা থেকে তো মুক্তি পেলাম৷ কিন্তু এ আমি কি করলাম! আমার সহযোগী কারাবন্দীরা এখনওকি এভাবেই স্বদেশের অনেক মানুষকে হত্যা করছে? আবার ভাবতে লাগলাম আমার স্ত্রী ও সন্তানরা কি জীবীত? হে আল্লাহ! তুমি কতো নমরুদ, ফেরাউন, আলেঙ্ান্ডার, নীরো, নেপোলিয়ন ও হিটলারের মত আগ্রাসীকে ধ্বংস করেছ৷ ধ্বংস করেছো সেভিয়েত আগ্রাসীদেরকে যারা এক সময় পৃথিবীর অর্ধেক মানুষকে সাম্যের নামে শোষন করেছে৷ তারা মুখে বলতো সাম্যের কথা৷ কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের সম্পদ লুণ্ঠন৷ তাহলে হে আল্লাহ! তুমি কখন মার্কিন অপরাধী আগ্রাসীগুলোকে এদেশ থেকে বিতাড়িত করবে? এই মার্কিন আগ্রাসীরা পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে এবং এখন মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদেরকে টার্গেট করেছে৷ জার্মান নাত্সীাদের সাথে মার্কিন সেনাদের কি কোনো পার্থক্য আছে? আমি এখন যখন এ কথাগুলো লিখছি আপনারা হয়তো বলবেন আমার নাম- ধাম বা পরিচয় কি? আমি শুধু এটাই বলবো যে, আমি মধ্যবয়সী একজন ইরাকী, অর্থনীতিতে এম.এ পাশ করেছি৷ সাদ্দাম সরকারের আমলে সরকারী চাকরী পাইনি ব’লে ব্যবসা শুরু করেছিলাম৷ আমার ছিল সুগৃহীনি ও সুন্দর তিন সন্তানের সাজানো সুখের সংসার৷ তারা সবাই নিহত হয়েছে৷ তাদের সাথে সাথে বলতে গেলে আমিও ধ্বংস হয়ে গেছি৷ মার্কিন সেনারা আমার নখ উপড়ে নিয়েছে, এবং আমাকে অন্ধ করে ফেলেছে৷ ওদের চাবুক আমার শরীরে যন্ত্রণাদায়ক ঘা সৃষ্টি করেছে এবং ওদের অত্যাচারের কারণে আমি খোঁড়া হয়ে গেছি৷ ঐ ইরাকী বন্দী আরো বলছিলেন, কিছু দিন আগেও আমি বাগদাদে গিয়েছিলাম৷ কিন্তু আমি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের কবরও খুঁজে পাইনি৷ যখন নিশ্চিত হলাম যে তারা মারা গেছে, তখন কুয়েতে এসে এক জাহাজের ক্রু হিসেবে চাকরী নিলাম৷ পৃথিবীতে আমার কেউ নেই৷ নেই স্ত্রী ৷ নেই সন্তান৷ আমার আত্মীয়রাও নিহত হয়েছে৷ দুঃখ আর বেদনা ছাড়া আমার এখন কি-ই বা আছে? এক সময় আমি একটা পাখীকেও খাঁচায় বন্দী রাখার বেদনা সহ্য করতে পারতাম না৷ এখন আমি খুব সহজেই মার্কিন আগ্রাসীদের হত্যা করতে পারবো অথবা তাদের ডুবিয়ে দিতে মোটেই বিচলিত হবো না৷ মার্কিন আগ্রাসীদের বিরুদ্ধে যে সীমাহীন ঘৃণা ও জিঘাংসা আমার মনে জন্ম নিয়েছে তা আমাকে এরপর কোন কাজ করতে বাধ্য করবে তা আমি জানি না৷ # - See more at: http://pechablog.com/matinur/4169/#sthash.FK5QxXSV.dpuf
০ Likes ০ Comments ০ Share ৪৯৩ Views

Comments (0)

  • - সৌরভ শাওন

    ভালো লেগেছে। বোঝাই যাচ্ছে চাঁদ আপনাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছে। রাঘব চ্যাটার্জি'র "চাঁদ কেন আসেনা আমার ঘরে" শুনেছেন কি? শুনে দেখবেন। ভালো লাগবে।

    ভালো থাকুন। শুভকামনা রইলো।

     

    • - রাশেদ আহমেদ শাওন

      শুনব অবশ্যই। ধন্যবাদ। 

       

    - বাংলার পাই বাপা

    খুব ভালো লাগলো। ভাল থাকুন।

    • - রাশেদ আহমেদ শাওন

      ধন্যবাদ

    - আলমগীর সরকার লিটন

    বা সুন্দর লাগল কবিতা

    অভিনন্দন---

    • - রাশেদ আহমেদ শাওন

      ধন্যবাদ