Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

একজন আনমনা

১০ বছর আগে

'আলোয় আলোয় আঁধার'

 

 

'আলোয় আলোয় আঁধার'

 

 

বিকেলের হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে দিনটি সন্ধ্যার পথে নেমে পড়ে। কুয়াশার ঘোলাটে চাঁদর আঁধারের রঙে যেন ছাই ঢেলে দেয়। সারাদিনের ক্লান্তির চোখ আরও ঝাপসা হয়ে যায়। অপেক্ষামাণ আড্ডামুখর একটি মুহূর্তের কাছে এমন ক্লান্তির হাজারো বার পরাজয় নিশ্চিত।  

লাল রঙের একটা চাদর-ই শীতের শেষ সম্বল। গেলো তিন বছর ধরেই শীত থেকে আমায় বেশ বাচা বাঁচিয়ে যাচ্ছে। নিউমার্কেটের বাইরে থেকে ৩৫০টাকা দামে কেনা। দাম ভালো ভাবেই উসুল হয়েছে এখন চলছে বোনাস।  যদিও একটা দুটো জায়গায় একটু একটু ছিঁড়ে গেছে। মাসের শেষ, খালি পকেট জানান দিয়ে দিলো এই মুহূর্তে আরেকটা কেনার দরকার নেই। যাচ্ছেই যখন, যাক না আরও কিছুদিন। শীতের পুরনো কাপড়ের কিন্তু দারুণ উম। চাদরটা গায়ে জড়িয়ে আর ব্যাগ টা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম অফিস থেকে। ঘড়িতে সময় সন্ধ্যা সাতটা। দারোয়ান ব্যাটা আজও পাহাড়ায় নেই। নিশ্চয়ই রাস্তার পাশে করিম মিয়ার চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছে। কবে যে ব্যাটার চাকরিটা যায়। বয়স তো কম হয়নি। চাকরি গেলে খাবে কি?

এবছর ভালোই শীত পড়েছে। চারিদিক বেশ কুয়াশাচ্ছন্ন। অফিস শেষে বন্ধুরা ক’জন মিলিয়ে কিছুক্ষন আড্ডা দিয়ে তবেই বাড়ি ফেরা হয়। এই শহরে একা থাকি, ঘরে ফেরার খুব একটা তাড়াও নেই। গন্তব্যের দিকে একপা দু’পা করে হাটা শুরু করলাম। শহরের রাতের অন্ধকার কখনোই উপভোগ করতে পারিনা। চারিদিকে গাড়ি, শপিং মল, বড় বড় এপার্টমেন্ট, অলি-গলিতে দোকান পাট আর মানুষে মানুষে ভরপুর। না আছে নীরবতা না আছে অন্ধকার। শহরের রাতের আকাশে তাঁরা পর্যন্ত দেখা যায়না। শহরবাসীরা কতো দুর্ভাগা সেইটা কেউ বোঝেনা।

শীতের সময়টাতে চায়ের দোকানগুলো থাকে অন্যসময়ের তুলনায় একটু বেশী জমজমাট। সেই সাথে ভাপা আর চিতই পিঠার ছোট ছোট দোকান গুলো। দোকান গুলোর চারিদিকে মানুষের ভিড়। গ্রামের বাড়ির শীতের পিঠা-পুলি, খেজুরের রসের পায়েস কতো আয়োজন করে বানানো। বানাতে বানাতেই সবাই গোল করে বসে একসাথে খাওয়। এইসব কি আর এই শহরে আছে? আসলে, যান্ত্রিক শহরটাতে এর বেশী আর কিই বা পাওয়ার থাকে। এইটুকুই বা কম কিসে? 

বেশ অনেকটা পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম প্রতিদিনের নির্ধারিত গন্তব্যে। আমি আসার আগেই দেখছি আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। চায়ের কাপের উপর গরম ধোঁয়া উঠছে, মাত্র এনে দিয়ে গেছে মনে হয়। নিজের জন্য একটু জায়গা করে বসে পড়লাম। মিতু আর সুমন ভাই এরই মধ্যে বেশ আলাপ জুড়ে দিয়েছে। টুম্পা, চন্দন আর শোভনও পিছিয়ে নেই। এইযে সারাটাদিন খাটা-খাটুনি করে এসেছে, কেউ বসের ঝাড়ি খেয়েছে, কারো চাকরি যায় যায়, কারো প্রোজেক্ট ফেইল হয়েছে কেউ এখনো এটাই জানেনা গত দু’মাসের মতো আগামী দুমাসও বেতন টা পাবে কিনা। অথচ কাউকে দেখে এমন কিছুই মনে হবেনা। গান, কবিতা, আড্ডা আর চায়ের সাথে গরম গরম সিঙ্গারা। বাহ্‌! কি চমৎকার জীবন। আমরা মধ্যবিত্ত গোছের মানুষগুলোর বিলাসিতা কম জীবনবোধ মনেহয় খানিকটা বেশী। আমরা আজকের চায়ের বিল দেবার সময় কালকের হিসেবটাও করে ফেলি। আমাদের জীবন সীমাবদ্ধ অথচ খুব অল্পতেই সুখের। আরেকজনের সুখে নিজের দুঃখ ভুলে সুখী হয়ে যাই। আরেকজনের দুঃখে নিজের সুখ বিলিয়েও সুখী হয়ে যাই। আমাদের জীবনটা বাহির থেকে দেখতে খুব সহজ কিন্তু সহজে কেউই সংজ্ঞায়িত করতে পারবেনা। 

ঘণ্টা খানেক পর আর ভালো লাগছিলনা। কেন যেন আজ মনটা অস্থির লাগছে, তাই  সবার আগে আড্ডা আসর আমিই ছাড়লাম। সবাইকে বিদায় দিয়ে চাদর টা ঠিকঠাক গায়ে জড়িয়ে হাটতে শুরু করলাম। মুখ হা করে নিঃশ্বাস ফেললেই ধোঁয়া বের হচ্ছে, আজ শীতটা একটু বেশীই পড়েছে। মিনিট পাঁচেক হাটার পর থেমে গেলাম। নিজের হাতে খুব ঠাণ্ডা একটা কিছু অনুভুত হল। একটা ৯-১০ বছরের মেয়ে আমার হাতটা ধরে রেখেছে। মেয়েটা শীতে রীতিমতো কাবু হয়ে গেছে। মিথ্যে বলবোনা- শুরুতে একটু ভয় পেয়েছিলাম বটে। পরে দেখলাম ভয় পাওয়ার মতো কিছুনা।

 মেয়েটার নাম আলো। বাবা নেই। মা মানুষের বাড়িতে কাজ করতো, একটা দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়েছে তাই  এখন সেটাও পারেনা। আলো এখন আঁধার খুঁড়ে খুঁড়ে বেঁচে থাকার জন্য দু’চার পয়সা খুঁজে বেড়াচ্ছে। খেতে পারেনা স্কুলে  যাবার সামর্থ্য কই? বলেছিলাম- ‘আমি যদি তোকে স্কুলে ভর্তি করে দেই পড়বি?’ ‘আমি স্কুলে যেয়ে পড়লে আমার আর আমার মায়ের খাবার যোগাড় করবে কে?’ উত্তর শুনে আর কিছু বলতে পারলাম না। মায়া হল, খুব মায়া হল। এমন অনেক ছেলে মেয়েই রাস্তায় ঘুরে ভিক্ষা করে, অনেকে আবার এদের দিয়ে ব্যবসাও করে, আমি জানি। কিন্তু মেয়েটার চোখের মধ্যে কি যেন কি দেখলাম, বর্ণনা করা যাবেনা। আমি ওকে বিশ্বাস করে ফেললাম। চাওয়া মাত্রই অনেক গুলো টাকা দিয়ে দেবার মতো সামর্থ্য আমি রাখিনা। তাকে স্কুলে ভর্তি  করে তাদের দুজনের খরচ চালানোর সামর্থ্য আমি রাখিনা। আমার ইচ্ছে আর সাধ্য একে অপরের ব্যস্তানুপাতিক। এই  শহরে ৮-১০হাজার টাকার একটা চাকুরী করে মাস শেষে নিজেকেই চলতে হয় টেনে টেনে। অসহায় মানুষ গুলোর মন বড় করেছে ঈশ্বর, এইটা এক রকমের নিষ্ঠুরতা। মনে হচ্ছিলো সময়টা একটা গল্প, যার নাম- ‘একটি আলো অন্ধকারে।’ নিজেকে  আলোর চেয়ে বেশী অসহায় লাগছিলো। ১০টা টাকা আলোর হাতে দিলাম। ১০টাকায় কি হয়? অথচ মেয়েটা দারুণ খুশি।

সব ভুলে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। কয়েক পা এগিয়ে আবার থেমে গেলাম। পথ ঘুরিয়ে আবার আলোর কাছে গেলাম। মেয়েটা একটু অবাক হল। গায়ের লাল চাদরটা খুলে আলোর গায়ে জড়িয়ে দিলাম। আলোর চোখের খুশির চমক দেখে নিজেকে আর অসহায় মনে হলনা।  মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে আর পিছু না ফিরে হাটতে লাগলাম। একটি দীর্ঘ রাতের পর আমার জন্য অপেক্ষামাণ একটি ভোর আর নিয়মতান্ত্রিক সেই যান্ত্রিক জীবন। আমি উপেক্ষা করতে পারিনা। প্রতিদিন চারিদিকে দেখি এমন অসংখ্য আলো। এদের চোখে মুখে আর কাজে কেউ দেখে যন্ত্রণা, কেউ দেখে প্রতারণা, কেউ দেখে ভণ্ডামি, কেউ দেখে মায়া। আর, আমি দেখি- ‘কতো আলোয় আলোয় আঁধার’।  

  

০ Likes ১৪ Comments ০ Share ৫৩৭ Views

Comments (14)

  • - মাসুম বাদল

    বেশ ভালো লেগেছে !!! শুভকামনা ! 

    - নীল সাধু

    নাইস।

    শুভেচ্ছা কালপুরুষ দা।

    ভালো লাগা রইলো।

    - ঘাস ফুল

    গভীর ভালোবাসার কবিতা অনেক ভালো লাগলো কালপুরুষ দা। প্রিয়তমা চলে গেছে না ফেরার দেশে। অথচ তাকে ভুলতে পারে নাই এখনো। তাই তো তাকেই খুঁজে ফিরছে এখানে সেখানে। গ্রেট! 

    Load more comments...