Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

আমার জীবনের উজ্জ্বল নক্ষত্র, আমার ধ্রবতারা....

আমার জীবনের উজ্জ্বল নক্ষত্র, আমার ধ্রবতারা।

(আমার জীবনের আদর্শ মানুষ, আদর্শ নারী)

নেপলিয়নের সেই বানী “আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটা শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।” যার জন্য এই বাক্যটি স্বার্থক তিনি আজ আর নেই আমাদের মাঝে :(

আমার পথপ্রদর্শক , আমার প্রিয় মানুষ, প্রিয় ব্যক্তিদের একজন, আমার প্রথম শিক্ষক , যিনি ছিলেন মনে প্রানে আধুনিক, একজন প্রগতিশীল মানুষ, একজন মমতাময়ী মা, সমাজ সেবিকা, দানশীল , অতিথী পরায়ন, হাসী-খুশী ও প্রাণবন্ত, যাকে কোন দিন মলিন মুখে দেখিনি, দেখিনি কখনো রাগ করতে। শুধু নারী নয় ,যিনি আমাকে একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় সচেষ্ট ছিলেন । আমার দাদী যিনি গত ৪ঠা জানুয়ারী , ২০১০ সোমবার ১২টায় আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেছেন।

তার প্রচেষ্টা কতখানি স্বার্থক হয়েছে, কতটা মানুষ হতে পেরেছি, কতটা নারী জানি না । কিন্তু আজম্ম তার সেই প্রচেষ্টা স্বার্থক করবার চেষ্টা করেছি এবং করব।

আমার জম্ম আর দশটা মফস্বল শহরের মতই একটি শহরে । আর আমিও হয়ত বেড়ে উঠতাম আর দশটা মেয়ের মতই। কিন্তু তিনি তা কখোনোই চাননি এবং হতেও দেননি।

সেই ছোটবেলা থেকেই তার অনেকগুলো মন্ত্রের একটা ছিল – “তুমি শুধু নারী নও , মানুষও”। 
আমার দাদী , যাকে দাদু বলে সম্বোধন করতাম । যিনি ছিলেন বাহ্যিক ও মানসিক দিক দিয়ে অসম্ভব সুন্দর মানুষ। বুঝতে শেখার আগে থেকেই তিনি আমাকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। সব সময় বলতেন, “সব সময় মনে রেখ তুমি আগে মানুষ, তারপর নারী।”

তোমার নারীত্ব তোমার দুর্বলতা নয় , এটা তোমার শক্তি। তিনি চাইতেন প্রত্যেক নারীর কমনীয়তা , রমনীয়তার পাশাপাশি তার মাঝে থাকবে সাহস , শক্তি, বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব , আত্মসম্মান। ঘরকন্নার পাশাপাশি তিনি উৎসাহ দিতেন দেশ-বিদেশের খোজ -খবর রাখতে যেমন-রাজনীতি, সমাজনীতি বিভিন্ন বিষয়ে।

তার কাছ থেকে সেই ছোটবেলা থেকেই জেনেছিলাম আমার প্রিয় ব্যক্তিদের সাহস , আত্মত্যাগ, উদারতার কথা যেমন- মাদার তেরেসা, নেলসল ম্যান্ডেলা, প্রীতিলতা। আরও জেনেছিলাম মহাত্তা গান্ধী , ইন্দিরা গান্ধী, মারগারেট থেচার , চন্দিকা কুমারাতাঙ্গার কথা। তারই ধারাবাহিকতায় আস্তে আস্তে জেনেছি জাহানারা ইমাম , পান্না কায়সার , সুফিয়া কামাল, ভেলরি টেলর এবং আরও অনেক সাহসী নারীদের জীবন গাথা। যাদের কাছ থেকে পেয়েছি বেচে থাকার অনুপ্রেরনা, জীবন যুদ্ধে লড়াই করার সাহস, মানবতা, মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ , কর্তব্যবোধ।

তিনি নিজেকে কখনই দুর্বল মনে করতেন না। তার ছিল অপরিসীম প্রানশক্তি। নিজে সুন্দর করে বেচে থাকার পাশাপাশি অন্যের বেচে থাকাকেও তিনি আনন্দময় করে তুলতেন। তার প্রিয় কবি ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম । কারন তার আধ্যিত্বকতা ও প্রতিবাদী মনোভাব দুটোই দাদুর পছন্দের ছিল। বিদ্রোহী কবির সেই বিখ্যাত দুটি লাইন “এই পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর অর্ধেক তার নারী অর্ধেক করিয়াছে নর।” বলতেন এই কথাগুলোর জন্যই সারাজীবন তার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকব।

আমার দাদা ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ করেছেন। দাদু একাই তার আট ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছেন। সহায় সম্পত্তি শুধু রক্ষাই করেননি সেটাকে সমৃদ্ধও করেছেন দাদুর যদিও নিজের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না কিন্তু তিনি খুব গোড়া ধার্মিক ছিলেন না। তার মাঝে আমি কখনই কোন কুসংস্কার দেখিনি। যার প্রতিফলন আমাদের মাঝেও ছড়িয়েছেন। তিনি তার নিজ সন্তান, পরবর্তীতে আমাদের ভাই-বোনদেরকে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষায়ও অনুপ্রানিত করেছেন। তার উৎসাহে আমি ক্লাস ফাইভে পড়ার সময়েই কোরআন তেলওয়াত করতে শিখি।

তিনি তার সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন মানসিকতায় ও চলাফেরা ও পোশাক আশাকে। আমাদের জুবুথুবু হয়ে চলাফেরা পছন্দ করতেন না। বলতেন যাই পড় না কেন সেটা যেন ফিটফাট, রুচিসম্পন্ন , আধুনিক ও একইসাথে মার্জিত ও শালীন হয়। দাদু খুব ম্যাচিং করে পড়তেন। ছোটবেলা থেকেই আমার জন্য নিজে ম্যাচিং করে কাপড় জুতো, গয়না কিনে আনতেন। যার জন্য আমি নিজে এখন খুব ম্যাচিং করে সব কিছু পড়ার অভ্যেস।

বাল্যবিবাহ তার একদম পছন্দ ছিল না, বলতেন আগে লেখাপড়া, তারপর ক্যারিয়ার, তারপর বিয়ে। যার ফলশ্র“তিতে আমার ঢাকায় এসে পড়াশুনা, চাকরী ইত্যাদি। মনে আছে ঢাকায় এসে যখন ভর্তি হলাম দু’মাস একটানা ক্লাস করার পরই ক্লাস বন্ধ হয়ে গেল ছাত্র রাজনীতি সংক্রান্ত ঝামেলায়। বাসায় ফোন করলাম আমাকে এসে নিয়ে যাবার জন্য । ফোনটা দাদুই রিসিভ করেছিলেন। আমি বললাম আব্বাকে পাঠাও আমাকে নেওয়ার জন্য । বললেন তুমি তো মানুষ হবার জন্য উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে গেছ তাই না , তাহলে মেয়ে মানুষের মত আচরন করছ কেন? তুমি যদি সারাজীবন দুর্বল অবলা নারী হয়ে থাকতে যাও তাহলে তোমার বাবাকে পাঠাব। আর যদি একজন আত্মসম্মান জ্ঞান সম্পন্ন একজন মানুষ হতে চাও তাহলে একা আস। দাদুর কথা শুনে সেই একা ঢাকা থেকে বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দেই। তারপর আর কোন দিন কেউ আমাকে নিতে আসেনি। আমি একা একাই সব জায়গায় চলাফেরা করি নির্ভয়ে।

আমার ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, বাড়ী ভর্তি মেহমান, সব সময় লোকজন লেগেই থাকত , কত দূর দূরান্ত থেকে পরিচিত-অপরিচিতরা আসতেন, কেউ বেড়াতে , কেউ সাহায্য চাইতে , কখনোই তিনি কাউকেই ফিরিয়ে দিতেন না।

আমি অবাক হয়ে দেখলাম যে আমি লিখতে গেলে এক লাইন লিখে চুপ মেরে বসে থাকি সে আমি অকাতরে কেবল লিখেই যাচ্ছি। আমার কথা অফুরন্ত কিন্তু আমার আবেগ অতৃপ্ত, অনেক লিখেও মনে হচ্ছে আমি আরো অনেক কিছুই বুঝাতে চেয়েছি কিন্তু কিছু ভাষা প্রকাশ করতে পারিনি। ঝড়ের ছবি যেমন অনেক রঙ থেকে মানুষ ঝড় বুঝে নেয় কিন্তু কেবল শিল্পি বুঝেন সে ঝড়ের উদ্দ্যোম তার বুকে বাজে। দাদুকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আমার সেই রকম কোন ছবি আকার মতই উপলব্ধি হচ্ছে ।

দাদু মানুষ হও বলতে তুমি কি বোঝাতে আমি কতটা তা ছুঁতে পেরেছি জানিনা কিন্তু মানুষ বলে কাউকে দেখার সৌভাগ্য আমাকে অন্য দশ জন থেকে আলাদা করে কারন আমি তোমাকে দেখেছি।

০ Likes ০ Comments ০ Share ৫৯৮ Views