Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

কাছের মানুষ

১০ বছর আগে

আমাদের টার্গেট অনেক আগেই বগুড়া পৌছাব !

অসময়ে মুঠোফোনটা হঠাৎ চিৎকার করে কেধে উঠল, রিসিভ করতেই  ওপাশ থেকে  কিছুটা ভেটকি মাছের মত হেসে হাফিজ ভাই বলল  “শুক্রবারে আমার বিয়ে, ভাবিসহ আসবা ! আমাদের টার্গেট সকাল সকাল ঢাকা থেকে রওনা দিব, ঠিক সাড়ে দশটা নাগাদ বগুড়া পৌছাবো !”

আমি আর হাফিজ ভাই একই ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করেছি কোরিয়াতে । আমি মাস্টার্স করে চলে এসেছি আর তিনি এখনও পি,এইচ,ডি করছেন সেখানে, সম্প্রতিদেশে এসেছেন দিল্লি কা লাড্ডু খেতে মানে শুভ বিবাহ করতে । হাফিজ ভাই ‘জীবিত থেকে উজ্জীবিত হতে যাচ্ছে’ ,এটা যতটানা আনন্দের তার চেয়ে বেশী আনন্দের বিয়ের অনুষ্ঠানটা হবে ঢাকার বাইরে বগুড়াতে । একে-তো ঢাকার বাইরে ধুমছে ঘোরাঘোরি করতে পারব তার উপর কোপা ছামছুর মত কোপাইয়া বিয়েতে মুরগির রান টানব অনেক দিন পর । বাঙ্গালীদের নাকি এমনিতেই দেশী মুরগির প্রতি দেশ প্রেমটা একটু বেশীই থাকে ! যেমন, ফুলপেনের বেলায় চাই আমেরিকান ছিরা হেছরাইনা পেন, লেহেঙ্গার বেলায় ভারতীয় সানি লিয়ন ডিজাইনের লেহেঙ্গা, পায়জামার বেলায় চাই পাকিস্তানি কিন্তু একমাত্র মুরগীর বেলাই চাই খাটি দেশী মুরগী রান! দেশী মুরগি চিবিয়ে ভক্ষণ করতে হেভি আরাম, আমি মুরগীর রান চাবাচ্ছি আর মনে মনে মুরগীকে বলছি “কিছু মনে কইরেন না মিস মুরগী  ম্যাডাম, আপনাকে দেশী পাইয়া অনেক দিন পর নির্দয়ের মত চাবাচ্ছি” ব্যাপারটা কল্পনা করতেই খুশীতে মনটা ভরে উঠল । 

*****

ঢাকার বাইরে যাচ্ছি শুনে আমার বউতো আনন্দে আত্তহারা, কারণ বিয়ের পর এই প্রথম আমাদের একসাথে ঢাকার বাইরে যাওয়া হবে । আমি অতি উৎসাহে খাজা ভাইকেও ফোন দিয়ে রাজি করালাম বগুড়ায় যাওয়ার জন্য । খাজা ভাই ও কোরিয়াতে আমাদের সাথে পড়াশুনা শেষ করে দেশে এসেছেন ।অবশ্য আমার আগেই হাফিজ ভাইও তাকে ফোন দিয়েছিল যাওয়ার জন্য । আমাদের আরেক সৈনিক ভোলার পোলা মুসফিক ভাই দেশে তসরিফ এনেছেন কিছুদিন হল অথচ বিয়েতে নাকি থাকতে পারবেন না কারণ তিনি বরিশালে গিয়ে আটকে গেছেন, বেচারার দেশে এসে লাইফটা তামা তামা হয়ে গেছে, গাড়ি-গোরার অভাবে ঢাকায় পদধূলি রাখতে পারছেন না !    

*****

শুক্রবার খুব ভোরে আরামের ঘুম হারাম করে মাঞ্জা মেরে রেডি হচ্ছি সাথে বউকেও তাড়া দিচ্ছি তাড়াতাড়ি রেডি হবার জন্য। এর মাঝেই হাফিজ ভাই এবং খাজা ভাইয়ের সাথে বেশ কয়েক দফা কথা হয়েছে মুঠোফোনে । হাফিজ ভাইয়ের কড়া নির্দেশ, দুনিয়ায় আজ রোজ কেয়ামত হয়ে যাক তবুও সকাল আটটার মধ্যে থাকতে হবে খাজা ভাইয়ের বাসার সামনে, আমাদেরকে সেখান থেকে মাইক্রোতে নেয়া হবে ।  হাফিজ ভাই জীবনের প্রথম বিয়ে করতে যাচ্ছে তাই মনের খুশী চেপে রাখতে পারছে না, পারেতো উড়াল দিয়ে বগুড়া চলে যায় তিন কবুল বলার জন্য । যথারীতি ফোন রাখার সময় বলল “আমাদের টার্গেট সাড়ে দশটা না হলেও এগারটা নাগাদ বগুড়া পৌঁছে  আমরা সকালের নাস্তা করব!”

*****

সকাল আটটা বাজার অনেক আগেই চলে গেলাম খাজা ভাইয়ের ইস্কাটনের বাসায়, তিনি কচ্ছপ গতিতে রেডি হচ্ছেন দেখে আমি কিছুটা তাড়া দিলাম যেন তাড়াতাড়ি রেডি হয় সাথে ভাবিকেও  নিয়ে নেয় । কিন্তু ভাবি নাছর বান্ধা খাজা ভাই আজকে গিয়ে আজই চলে আসবে শুনে তিনি এই ভ্রমণে যেতে নারাজ । অবশেষে ভাবিকে রেখেই খাজা ভাইয়ের বাসা থেকে কিছুটা পেট পুজো করে বের হলাম হাফিজ ভাইয়ের হবু শ্বশুর বাড়ি মানে বগুড়ার উদ্দেশ্যে ।

*****

“আমাদের টার্গেট হল দেরি হলেও অন্তত দুপুরের অনেক আগেই বগুড়ায় পৌর্ছাবো এবং জুম্মার নামাজটা সেখানেই পড়ব ” অতি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল হাফিজ ভাই । আমরা তখনও বুঝতে পারি নাই আমাদের ভাগ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে ! মাইক্রোর সামনের সীটে বসেছে হাফিজ ভাই, পিছনের সীটে আমি এবং আমার বউ তার পিছনে খাজা ভাই সাথে আছে হাফিজ ভাই এর কিছু বন্ধু বান্ধব।  ঢাকার কুড়িল ফ্লাই ওভারের নীচ দিয়ে যাবার সময় ব্রিজের  সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে উৎফুল্ল হাফিজ ভাই বলল “ফ্লাই ওভারটা-তো খুব সুন্দর!” হাফিজ ভাইয়ের মনে সুখ তাই যা দেখে তাই ভাল লাগে চোখে ।  হাফিজ ভাইয়ের কথা শুনে দেশ প্রেমিক খাজা ভাই গর্ব করে জোর গলায় বলে উঠল “দেখছেন হাফিজ ভাই, বলছিলাম নাহ, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে ? খালি বিদেশ বিদেশ করেন, দেখছেন কি সুন্দর ফ্লাই ওভার ! ” এরকম বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি মধুর গল্প গুজব করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের গাড়ি ।

*****

ভ্রমণ করে হেভি আরাম পাচ্ছিলাম কিন্তু কথায় আছে না “সবার কপালে সুখ সয় না!”, আমাদের কপালেও সইলো না ,বিপত্তি ঘটল সাভারে গিয়ে ।  সকাল সাড়ে নয়টার মত বাজে , হঠাত দেখি গাড়ি জ্যামে পরছে ! আমরা ভাবলাম এটা মামুলি জ্যাম, একটু পরেই ছেরে যাবে ! সকাল সাড়ে নয়টা থেকে এগারটার মত বাজে অথচ গাড়ি এক চুলও আগে বাড়ছে না মনে হয় সুপার গ্লুপের আঠার মত লেগে আছে !তখন আর আমাদের বুঝতে বাকি রইল না যে এটা মামুলি কোন জ্যাম না, খাতার-নাক জ্যাম । এমনিতেই গরমের দিন, ভ্যাপসা গরমে শরীরের অবস্থা হালুয়া টাইট হয়ে যাচ্ছে ! এদিকে খাজা ভাই খুবই চিন্তিত কারণ পরদিন সকালে তার ক্লাস নিতে হবে কলেজে , সময়মত বাসায় ফিরতে পারবে কিনা এই ভেবে সে শঙ্কায় আছে । আমি তাকে কিছুটা অভয় দেয়ার চেষ্টা করলাম ।  আশাবাদী হাফিজ ভাই আবারো ঝাঁঝালো ভাসায় বলে উঠল “কোন ব্যাপার না! আমাদের টার্গেট সেখানে গিয়ে জুম্মার নামাজটা না পরতে পারলেও, বিকাল তিনটার মধ্যে নিশ্চয়ই পৌঁছব !”

*****

বিকেল তিনটার মত বাজে, গাড়ি তখন মাত্র টাঙ্গাইলের রাস্তায়।  এখনো ঘাড়ি কচ্ছপ গতিতে এগোচ্ছে , কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর পেলাম সামনে একশ কিলোমিটারের মত জ্যামে পরছে । ঐতিহাসিক এই জ্যামে পরে আমাদের এক এক জনের অবস্থা খুবই করুন। ফেইসবুক মারফত আমাদের এই করুন অবস্থার কথা শুনে সু-দুর কোরিয়া থেকে আমাদের ইউনিভার্সিটির আরেক নওজোয়ান নজরুল ভাই ফোন দিয়ে অত্যন্ত ব্যথিত হৃদয়ে সহ-মর্মিতা জানাচ্ছেন । হাফিজ ভাই হতাশায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে চলেছেন দেশের প্রতি, আশাহত কণ্ঠে বলছেন “এই দেশ আর উন্নত হবে না ! এত জ্যাম কি আর পৃথিবীর কোথাও আছে ?” ঐ দিকে ভোলার পোলা মুসফিক ভাই খোদার কাছে শুকরিয়া আদায় করছেন ফোনে কারণ তিনি না এসে বেচে গেছেন এই স্মরণ কালের শ্রেষ্ঠ জ্যাম থেকে।

*****

বিকেল চারটা বাজে ক্ষুধায় এক এক জনের পেট চো চো করছে । আর এদিকে পাকস্থলীও খালি করা দরকার কিন্তু গাড়িতে জ্যামে বসে আছি  ! অবশেষে উপায় না দেখে, আমি বউকে নিয়ে মহা সড়কের আশে পাশের গ্রামে গিয়ে আরামসে পাকস্থলী খালি করে এলাম । ঐদিকে একের পর এক ফোন আসছে হাফিজ ভাইয়ের হবু শ্বশুর বাড়ি থেকে, হাফিজ ভাইকে দেখে আমার মায়া লাগছে ,  বেচারা শোকে ঘাড়ির সামনের সীটে এতিমের মত বসে আছে, মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোচ্ছে না । দুপুরে বর যাত্রী নিয়ে বিয়ে বাড়িতে মুরগী টানার বদলে গাড়িতেই অর্ডার দিয়ে খেয়ে নিলাম । আমি আর খাজা ভাই, হাফিজ ভাইকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছি, হাফিজ ভাই আমাদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আবারও হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠল “যমুনা সেতু আর বেশী দূরে নেই , আমাদের টার্গেট সন্ধ্যা সাতটা বাজে বগুড়া পৌছাবো!”

*****

বিপদ যখন আসে তখন সব দিক দিয়েই আসে, আমাদের মাইক্রোটাও নষ্ট হয়ে গেল আর কিছুদূর যাবার পর । ড্রাইবার সাহেব করুন কণ্ঠে জানাল গাড়ি ঢাকায় নিয়ে ঠিক করতে হবে , আমরা যেন আরেকটা গাড়ির ব্যবস্থা করি। একে-তো গাড়ি নষ্ট তার উপর আসছে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি । অবশেষে আরেকটা মাইক্রো নিয়ে রওনা দিলাম গন্তব্যে । দেখতে দেখতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছে কিন্তু এখনও বগুড়া যাবতো দুরের কথা যমুনা সেতুর দারে কাছেও পৌছাতে পেলাম না ।  এক এক জনের মুখ শুঁকিয়ে আমচুর হয়ে গেছে, ইতিহাস করা এই ভ্রমণে কারো মুখ থেকেই কোন শব্দ বেরুচ্ছে না ! এর মধ্যেই নতুন আরেক মসিবত, আমাদের গাড়ির গ্যাস খতম হয়ে গেছে । যাইহোক গ্যাস নিয়ে আবারো নব উদ্যমে রওনা দিলাম । “ইনশাল্লাহ , আমাদের টার্গেট রাত বারটা বাজে আশা করি বগুড়ায় পৌছাব” বলে আবারো ঘোষণা দিল আশাবাদী হাফিজ ভাই ।

*****

দেখতে দেখতে রাত বারটা বেজে গেল কিন্তু এখনো যমুনা সেতু পার হতে পারলাম না । আমার বউ জীবনে এমন জ্যাম দেখে নাই, বেচারা নেতিয়ে পরেছে আমার উপর । কথায় আছে না অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর , এবার হাফিজ ভাইয়ের অবস্থা হয়েছে তাই , বেচারা আহত হৃদয়ে চুপ করে বসে আছে , মুখ দিয়ে কোন কথা বেরচ্ছে না।  খাজা ভাই আর আমি তাকে আবারো সাহস যোগানোর চেষ্টা করলাম , আমি বললাম “ডোন্ট ওয়ারি, বিয়ে আজ হবেই হবে ! ” প্রচণ্ড আশাবাদী হাফিজ ভাই এবার কিছুটা নিরাস কণ্ঠে বলল “আর বিয়ে, বগুড়া যেতে পারি কিনা কে জানে !!”

*****

ঘড়িতে তখন রাত একটার মত বাজে , সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে যমুনা সেতুটা পার হলাম। যমুনা সেতু পার হয়ে হাফিজ ভাই যেন নতুন জীবন ফিরে পেয়েছেন , পুরো রাস্তা ফকফকা! গাড়িতে সবাই ক্লান্ত হয়ে চিত হয়ে শুয়ে আছে আর ঐ দিকে হাফিজ ভাই খুশীতে একের পর এক, এদিক-সেদিক ফোন করা শুরু করে দিয়েছেন । আমি ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমের রাজ্যে ডুবে গেলাম, আর মনে মনে বিড়বিড় করে বললাম “আমাদের টার্গেট অনেক আগেই বগুড়া পৌছাব !” কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিলাম টেরই পাইনি, ঘুম থেকে উঠে দেখি রাত তিনটার মত বাজে, গাড়ি মাত্র হাফিজ ভাইয়ের হবু শ্বশুর বাড়ি এসে থামল ।  (শেষ)

   

  //

১ Likes ৬ Comments ০ Share ৫৭৭ Views