Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

আজ লাল মিয়ার জন্মদিন

 

 

“আমি আমার বিশ্বাসের কথা বলছি৷ আমার সকল চিন্তা, সবটুকু মেধা, সবটুকু শ্রম দিয়ে যা কিছু নির্মাণ করি তা কেবল মানুষের জন্য, জীবনের জন্য, সুন্দর থেকে সুন্দরতম অবস্থায় এগিয়ে যাবার জন্য৷ আমার ছবির মানুষেরা, এরা তো মাটির মানুষ, মাটির সঙ্গে স্ট্রাগল করেই এরা বেঁচে থাকে৷ এদের শরীর যদি শুকনো থাকে, মনটা রোগা হয়, তাহলে এই যে কোটি কোটি টন মানুষের জীবনের প্রয়োজনীয় বস্তুসকল আসে কোত্থেকে? ওদের হাতেই তো এসবের জন্ম৷ শুকনো, শক্তিহীন শরীর হলে মাটির নিচে লাঙলটাই দাব্বে না এক ইঞ্চি৷ আসলে, মূল ব্যাপারটা হচ্ছে এনার্জি, সেটাই তো দরকার৷ ঐ যে কৃষক, ওদের শরীরের অ্যানাটমি আর আমাদের ফিগারের অ্যানাটমি, দুটো দুই রকম৷ ওদের মাসল যদি অতো শক্তিশালী না হয় তাহলে দেশটা দাঁড়িয়ে আছে কার উপর? ওই পেশীর ওপরেই তো আজকের টোটাল সভ্যতা৷”

কথাগুলো ছবিপ্রাণ মানুষ এস এম সুলতানের৷ শেখ মোহাম্মদ সুলতান। 
যিনি এস. এম. সুলতান নামে দেশে এবং বিদেশে সমধিক পরিচিত। 
জন্ম আগস্ট ১০, ১৯২৩ মাছিমদিয়া, নড়াইল। এই গুণী চিত্রশিল্পীর জীবনাবসান ঘটে ৭১ বছর বয়সে অক্টোবর ১০, ১৯৯৪ সালে। তিনি শুধু বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন তাঁকে বিশ্বজুড়ে কাল্পনিক কৃষিসভ্যতার জনক বলা হয় । তাঁর জীবনের মূল সুর-ছন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন, কৃষক এবং কৃষিকাজের মধ্যে। আবহমান বাংলার সেই খেটে খাওয়া কৃষিজীবী মেহনতি মানুষের ইতিহাস-ঐতিহ্য, দ্রোহ-প্রতিবাদ, বিপ্লব-সংগ্রাম এবং বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকার ইতিহাস তাঁর শিল্পকর্মকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। তাঁর চিত্রকর্মে গ্রামীণ জীবনের পরিপূর্ণতা, প্রাণপ্রাচুর্যের পাশাপাশি শ্রেণীর দ্বন্দ্ব এবং গ্রামীণ অর্থনীতির সংগ্রামীরূপ ফুটে উঠেছে শিল্পীর নিজের একান্ত নিজস্ব মহিমায় ও স্বকীয়তায়। তাঁর ছবিগুলোতে বিশ্বসভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে গ্রামের মহিমা উঠে এসেছে এবং কৃষককে এই কেন্দ্রের রূপকার হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তার আরেকটা চমৎকার গুন ছিল তিনি অনবদ্য বাঁশি বাজাতেন। তার জীবনকে কৃষি এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে তিনি শেষ জীবনে তার পরিপূর্ণতা নিয়ে এইভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন- 
“আমি সুখী। আমার কোনো অভাব নেই। সকল দিক দিয়েই আমি প্রশান্তির মধ্যে দিন কাটাই। আমার সব অভাবেরই পরিসমাপ্তি ঘটেছে"।

অনেক শিল্পীই সেখানে নব নব শৈলী, গড়ন এবং মিডিয়া নিয়ে উপস্থিত হচ্ছিলেন। 
কিন্তু এস এম সুলতান সে সময়ও নড়াইলে থেকে যান, অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালে। এর কারণ অবশ্য গ্রামীণ জীবনের প্রতি তাঁর চিরন্তন আকর্ষণ এবং সহমর্মিতা। তাঁর শিল্পকর্মের স্বরূপটিও খুঁজে পাওয়া যায় এই গ্রামীণ জীবনযাত্রার প্রেক্ষাপটে। তাঁর সে সময়কার ছবিগুলোতে গ্রামীণ কৃষকদের দেখা যায় পেশীবহুল এবং বলশালী হিসেবে। এর কারণ হিসেবে তাঁর বক্তব্য হলো: “আমাদের দেশের মানুষ তো অনেক রুগ্ন, কৃষকায়। একেবারে কৃষক যে সেও খুব রোগা, তার গরু দুটো, বলদ দুটো -সেটাও রোগা...। [আমার ছবিতে তাদের বলিষ্ঠ হওয়াটা] মনের ব্যাপার। মন থেকে ওদের যেমনভাবে আমি ভালোবাসি যে আমাদের দেশের কৃষক সম্প্রদায়ইতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়েছিলো। অর্থবিত্ত ওরাই তো যোগান দেয়। ...আর এই যত জমিদার রাজা মজারাজা আমাদের দেশের কম কেউ না। সবাই তো কৃষিনির্ভর একই জাতির ছেলে। আমার অতিকায় ছবিগুলোর কৃষকের অতিকায় অতিকায় দেহটা এই প্রশ্নই জাগায় যে, ওরা কৃশ কেন? ওরা রু্গ্ন কেন- যারা আমাদের অন্ন যোগায়। ফসল ফলায়।”

তাঁর কাছে আধুনিকতার সংজ্ঞা কেমন ছিলো তা বলতে গিয়ে বাংলাপিডিয়ায় তাঁর জীবনীর লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছেন: ”তাঁর কাছে অবয়বধর্মিতাই প্রধান। তিনি আধুনিক, বিমূর্ত শিল্পের চর্চা করেননি; তাঁর আধুনিকতা ছিলো জীবনের শাশ্বত বোধ ও শিকড়ের প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ফর্মের নিরীক্ষাকে গুরুত্ব দেননি, দিয়েছেন মানুষের ভেতরের শক্তির উত্থানকে, ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং ঔপনিবেশিক সংগ্রামের নানা প্রকাশকে তিনি সময়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপন করেছেন। এটাই তাঁর কাছে ছিলো 'আধুনিকতা', অর্থাৎ তিনি ইউরো-কেন্দ্রিক, নগর নির্ভর, যান্ত্রিকতা-আবদ্ধ আধুনিকতার পরিবর্তে অন্বেষণ করেছেন অনেকটা ইউরোপের রেনেসাঁর শিল্পীদের মতো মানবের কর্মবিশ্বকে।“

প্রদর্শনীসমূহঃ

> সিমলা, ভারত (১৯৪৬)
> লাহোর, পাকিস্তান (১৯৪৮)
> করাচী, পাকিস্তান (১৯৪৯)
> যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, শিকাগো ও বোস্টন (১৯৫০)
> বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ঢাকা (১৯৭৬)
> এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী : ফুকুওকা মিউজিয়াম, জাপান (১৯৮১)
> ১৯৮৭ সালে এপ্রিল- মে মাসে গ্যেটে ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে জার্মান কালচারাল ইনস্টিটিউটে দ্বিতীয়বারের মতো একশটিরও বেশি ছবি নিয়ে সুলতানের আরেকটি একক চিত্র প্রদর্শনী হয়। এ প্রদর্শনী পরিদর্শন করে ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা জেভিটস বলেছিলেন, ‘এই উপমহাদেশের গুটিকয় অসামান্য শিল্পীর মাঝে সবচাইতে জমকালো সুলতান। তিনি এশিয়ার কন্ঠস্বর। সুলতানের শক্তির উত্স তাঁর টিকে থাকার ক্ষমতায়। যেসব মানবমূর্তি তিনি রচনা করেছেন, তারা জীবনযুদ্ধে মানুষের টিকে থাকার বার্তাবহ। বাংলাদেশ আর বাংলাদেশিদের টিকে থাকার ক্ষমতা ছাড়া তেমন আর কিছু নেই। তাঁর ছবিতে এ জাতির স্বকীয়তার প্রতীক সনাক্ত করা যায়।’
> গ্যালারি টোন, ঢাকা (১৯৯৪)
> যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে তাঁর ১৭টি একক প্রদর্শনী হয়েছিলো।
> এছাড়াও লন্ডনে পিকাসো মার্টিন ও ডালির সাথে যৌথ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।

পুরস্কার ও স্বীকৃতিঃ

> তিনি ১৯৮০'র দশকে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের কাছ থেকে পান শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার।
> তিনি ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কে, ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন৷
> ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে আন্তর্জাতিক জুরী কমিটির অন্যতম সদস্য মনোনীত হোন।
> কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৮২ সালে তাঁকে এশিয়ার ব্যক্তিত্ব হিসেবে ঘোষণা করে।
> বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত একুশে পদক (১৯৮৬)
> বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৩)

এস এম সুলতানের বিশেষত্বঃ 

সুলতানের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়, নিজ দেশ ও জাতি নিয়ে এক হিমালয়সম গর্ব, সাধারণ মানুষকে নিয়ে তাঁর দুর্নিবার অহংকার, ভালবাসা, মমত্ববোধ, পাশাপাশি সমাজের
অন্যায়ের প্রতি প্রচন্ড প্রতিবাদ, ক্ষোভ, আন্দোলন তাঁর তুলির পরশে বিশাল বিশাল ক্যানভাসে জীবন্ত রুপায়িত হয়েছে। বিষয়বস্তুতে গ্রামবাংলার খেটে খাওয়া মানুষ, শ্রমিক, কৃষাণ, এদেশের কাদাজলের সাথে যাদের আত্মিক সম্পর্ক, যাদের রুটি-রুজির উৎপত্তি স্থল সেই মাঠ, প্রান্তর, সবুজ ধানক্ষেত, যেখানে জমি কর্ষণরত চাষী, রাখালেরা বাঁশীর সুরে মগ্ন, জেলে মাছ ধরায় ব্যস্ত, গৃহস্থালীর কাজে রত পল্লীবালা, মাছকোটা, ধানভোনায় ব্যস্ত সুখী পরিবারের চিত্র। কুঁড়েঘর, উঠোন, খড়ের পালা, কলাগাছের সারি, অলস দুপুরে গৃহিনীরা গল্পে রত। গোধূলী বেলায় দূরে কোথাও মেঠোপথে ধূলো উড়িয়ে পল্লী-বধূর নায়ওর যাওয়ার দৃশ্য। সারি সারি তাল, নারকেল গাছ, বনজঙ্গল, নদীতে পালতোলা নৌকা, মাঝির ভাটিয়ালী সুর, জাল দিয়ে মাছ ধরা, গুনটানায় ব্যস্ত মাল্লা, নদীর ঘাটে কলসীতে জল আনতে গ্রাম্য বধূর সলাজ চাহনী।

আজ আগস্ট ১০, ২০১৪ 
আজ তাঁর ৯১ তম জন্মবার্ষিকী, গভীর শ্রদ্ধাভরে এই শিল্পীকে স্মরণ করছি। 
তাঁর প্রকৃতিপ্রেম এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার জয় হোক তাঁর শিল্পকর্ম এবং জীবনবোধের চর্চায়।

তথ্যসূত্রঃ
১) এস এম সুলতান ডট কম
২) উইকিপিডিয়া
৩) নড়াইলের সরকারী ওয়েবসাইট

০ Likes ২ Comments ০ Share ৬৫৪ Views

Comments (2)

  • - রোদেলা

    আমি চিৎকার করে কাঁদতে গিয়েও কাঁদতে পারি না.।

    • - Shagor Adnan Ovi

      emoticons