Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

sokal roy

৯ বছর আগে

আজ তবে তাই হোক, জোস্না ছুয়েঁ কলরব হোক বিমূর্ত ক্যানভাসে






♣ বইয়ের নাম:
বিমূর্ত ক্যানভাস
♣ লেখক: বাবুল হোসাইন
ধরণ : কবিতা
♣ প্রকাশনী: প্রতিকথা
♣ প্রকাশকাল: একুশে বইমেলা-২০১৫
_________________________________________________________

এর আগে ওয়েবে, লিটিল ম্যাগ ও ইবুকে কবি বাবুল হোসাইনের গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা ও মুক্তগদ্য পড়বার সুযোগ হয়েছে। অন্যসব কবিতার চেয়ে একটু আলাদা ছাঁচে শব্দের ঢালাই দিয়ে বাক্য নির্মাণ করে কবিতার জন্ম দেন তিনি। যে কারনে খুব সহজেই চিনে নেয়া যায় কবির কবিতার ভাষা। এবার হাতে পেলাম কবির প্রথম প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থ “বিমূর্ত ক্যানভাস” এর পাণ্ডুলিপি। যেখানে রয়েছে ১০৮টি গদ্য কবিতা। খুব বেশী দীর্ঘ নয় কবিতাগুলো যে কারনে, ‘দীর্ঘ ভাবনার স্বল্প রুপ’ কবিতাকে দিয়েছে অনন্য এক অলংকার।

এই কাব্যগ্রন্থে দীর্ঘ কাব্যের ছন্দোময় আসমান থেকে সম্পূর্ণ হাওয়া পাল্টে কাল্পিক শব্দের এক নিজস্ব ভুবন নির্মাণ করেছেন কবি বাবুল হোসাইন। এটি কবির প্রথম প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থ। রচিত প্রতিটি কাব্যেই গদ্যের প্রজাপ্রতি বাক্যের পাখা মেলে হরেক রঙের দৃশ্যাবলী হয়ে কল্পনা তৈরি করেছে। কল্পচিত্র গুলো নাগরিক,সামাজিক, প্রেম ও দর্শনের কথা বলে। কবির নিজস্ব শব্দভাণ্ডার প্রতিটি কবিতাকে দিয়েছে নতুন আবরণ, দিয়েছে উপমার সুবিন্যস্ত শব্দমুখর প্রান্তর।
মানবিক জীবনের বিভিন্ন বিষয়াবলী, বিভিন্ন ভাবে কলমের শাব্দিক স্রোতের অনুকূলে মুদ্রিত হয়ে কবির কবিতায় সৃষ্টি হয়েছে  স্বলিখিত ভাবনা ও নতুন চেতনার সুর। তিনি এমনই সব কল্পচিত্র এঁকেছেন এবং শব্দ বলে প্রেমের নয়ন আঙ্গিনায় লিখেছেন-

“ তোমার চোখের ভিতর অজস্র কবিতা আছে জেনেছি
চোখের তারায় ঝিলিক, ভ্রবলতায় নেচে উঠা ফড়িঙের
ধূসর জনা আর পাপড়িতে টলোমলো কনাজল।”
- এই চোখে আমার মৃত্যু

কবি চোখের ভেতর মৃত যজ্ঞকে দেখেছেন। জ্বরগ্রস্থতায় নিজের প্রাণকে টেনে এসেছেন। কখনও বা চোখে ধারন করেছেন ঈশ্বর দর্শন। চক্ষু হাসপাতাল শিরোনামের কবিতায়, ব্যাক্তিগত কথামালার এক রুপরেখায় নিজের চিন্তাকে ঝুলিয়ে দিয়েছেন তিনি। ক্ষয়রোগে ক্ষয়ে যাওয়া বিবেক যখন নিশ্চুপ পড়ে থাকে, পথে কিংবা দালাল যখন কারো উপার্জনের গায়ে হেলান দিয়ে দুনিয়া দর্শনে মগ্ন। তখন কবি আতঙ্কিত। আর এ জন্যই কবি লিখেছেন “ভালো থাকা নেহাতই আপেক্ষিক”। তিনি নিজস্ব দৃষ্টি থেকে ফুটিয়ে তুলেছেন ভালো থাকা না থাকার আপেক্ষিকতত্ত্ব। “ভালো আছি বললেই ঝনঝন বেজে উঠে কৃস্টাল জোত্স্নার দর্পিত স্মৃতি, কবির অনুভবে জানান দেয় ভালো থাকা নেহাতই আপেক্ষিক কিছু”।

মানবিক জীবন নদীর ব্যর্থতা যে কখনও কখনও চোখের সামনে অনুরাগ ফুটিয়ে তোলে, আর সেজন্যই কবির কলম থেকে জন্ম নেয় এমন সব শব্দসম্ভার- “এ আঙ্গুল ছোঁবে না মৃত্তিকায় ঘ্রাণ ভুলে যাবে নিবিড় চাষের নিগূঢ় তত্ত্বকথা”। প্রিয়জনের অনুকম্পা কান্নার জন্য হয়ে উঠে দরদভরা “সুরা” পেয়ালা। আবার কখনোবা ব্যর্থতায় বিদ্রোহী হয়ে উঠে, তখন কোরাস তুলে- “এই নষ্ট নগর ছিড়ে ঘরে ফিরবই একদিন একদিন সোনাঝরা আলোয় মুখোমুখি দেখবো জলের ছায়ায় কীর্তিময়ী তোমার কোমল বদনখানা”।
কবিতা নিয়ে কবিতার জাল বুননে শৈল্পিক ভাবনায় অসাধারণ মোহ সৃষ্টি করেছে কবিতা। “বদলে যাওয়া মানুষেরই রুপ” কবিতায় কবি আপন তুলিতে চিত্রিত মানুষ কবিতার কথা।  আস্ত মানুষই যে একটি কবিতা কিংবা এই সব উপমার জন্ম যে মানুষ মাত্র কিংবা পরম মিত্র কবিতা এবং জীবন এ দুটোর অভূতপূর্ব সমন্বয়কে একই সূত্রে গেঁথেছেন। কবিতাই যে প্রতিদিনকার সময়কাল সে কথাটিও উল্লেখ করেছেন।

মানবজীবনের দ্বিতীয় স্বত্ত্ব বা আয়না। যা প্রতিটি মানুষের জীবন কথার অনুপম সঙ্গী, যে গভীর চলমান স্রোত রোজকার সময়গুলো ভাসে, প্রতিদিন অস্ত যায়। কারো রুপ, কারে ঘৃণায় কবি দেখতে পান প্রেমিকার পথের ধারে দাড়িয়ে থাকা ইভটিজারকে। কবির নির্মিত চরিত্র মানসকন্যা, ধুলোগলা বাসে কখনো শুনে নি ক্ষুদাসঙ্গীত! এবং পথকুড়িদের প্রার্থনা। সময় তার যাচ্ছে কেটে কর্পোরেট বেনিয়ার পন্য হতে হতে। সেই মানসকন্যা কবির কবিতায় হয়েছে মিরর সিটির মেয়ে। আবার “দীর্ঘ চুম্বনের দাগ মনে নেই” কবিতায় কবি বলেছেন- “কাউকে বলোনা তোমার গোপন প্রণয়, স্রোতস্বিনী নদীটির নিখোঁজ হবার গল্প হারিয়েছি অপেক্ষায় ডুবে”। কেঁদে উঠে তিনি এভাবেই লিখেছেন কাব্য ভাবে সেইসব দিনলিপি।

কবির কবিতায় ভবিষ্যত দেখতে পাই ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছরের পড়ার পর’ কবিতায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম অভিশপ্ত হয়ে তাদেরকে ঘুড়তে দেখা যায়। কবির কলমে মুদ্রিত হয় বীরত্ব এক পতঙ্গ! যার মুক্তি আগুনে। রক্তের শরীরে বীরত্বের মোহে ফুল ফোটাচ্ছে রমণীরা, ভবিষ্যতের বুড়ো নিঃসঙ্গ এক মানুষ। কবি শৈশব নিয়েও লিখেছেন, “আমাদের ভূল শৈশব/ নদীরা ভূলে গেছে প্রাগৈতিহাসিক ঢেউ /কৈশোর মনে রাখে না কেউ” যৎসামান্য ছন্দ সৃষ্টি করেছে এখানে। কবির কলমে শৈশব-ভবিষ্যতের সাথে সাথে ধরা দিয়েছে অতীত। তাই তো তিনি “সোনামুখী দিন” কবিতায় জুড়ে দিয়েছেন, আমাদের মাঝ নদীতে সাতরে যাবার কথা, রোদেলা গগন আর বর্ষা দুপুরের কথা। তিনি  নিজের ভেতরকার বিবেককে সামনে দাড় করিয়ে লিখেছেন- “নষ্ট হয়ে যাচ্ছি। ভিতরে বাহিরে দগদগে অনল”।

কবিতা রচনায় কবির মন গল্পচ্ছলে উড়ে যায় খিলগাঁওয়ের প্রফেসর মঞ্জিলে, ছাদে বসে দুজনে গল্প করার অদম্য ইচ্ছে নিয়ে লিখেছেন এমনি এক কথাকাব্য “এখন আর ছাদের স্বপ্ন” কথাকাব্য তুলে আনেন এমন কিছু কথামালা-

"আমাদের কোন ছাদের স্মৃতি নেই। খিলগাঁওয়ের প্রফেসর মঞ্জিলে একটা ছাদ ছিলো নিষিদ্ধ।
এক টুকরো ছাদ ডানা মেলে উড়ে যেতে পারতো।
তুমি আমি কতদিন ছাদে বসে গল্প করতে চেয়েছি, হারিয়ে যেতে চেয়েছি।"

পাণ্ডুলিপিতে লিপিবদ্ধ অন্য একটি কবিতায় ক্ষেভের চিহ্ন অঙ্কন করে কবি বলেছেন, “প্রেমিকার চোখের দিকে তাকিয়ে ভয়ঙ্কর রক্তপিপাসু হয়ে উঠে মন”। প্রেমিকার দৃষ্টি ও দহন থেকে দূরে সরে যাবার প্রার্থনা এখানে অলঙ্কারের মতো জেগে উঠেছে। আর সেই ক্ষোভ যখন আবেগী হয়ে যায় তখন কলম থেকে বেড়িয়ে আসে- জানালার গরাদ ধরে দাঁড়িয়েছি/ ওপাশে সুর বাঁধা নূপুর/ গরাদের ফাঁকে নূপুরের নিক্কণ/ তোমার পায়ের তালে নাচে এ হৃদয়/ এ হৃদয় হারিয়েছে।
পাণ্ডুলিপিতে অর্ন্তভুক্ত বেশ কিছু কবিতায় রয়েছে সরল স্বীকারোক্তি। মুহুর্তের গায়ে উপমা দিয়ে কবি সৃষ্টি করেছেন “বিমূর্ত ক্যানভাস”। বন্ধুতা নিয়ে জীবনের অনুষঙ্গ মিশিয়ে “বন্ধুতার কোন বয়স” কবিতায় বলেছেন- “কেউ একজন হাত বাড়াচ্ছে ছুঁয়ে দিতে হৃদপি-, কেউ একজন মন বাড়াচ্ছে সারিয়ে দিতে সমস্ত জঞ্জাল”। কবিতায় আরো উঠে এসেছে, কারো প্রতিক্ষিত চোখের তারায় আমাদের যাপনের গান, কারো প্রতিশ্র“তিতে থাকে গোপন নদীর গল্প, ও জোসনার হাত ধরে অন্ধকারে হারাবার গল্প। কবি এই কবিতায় আরো বলেছেন বন্ধুতার কোন বয়স নেই, সময় নেই, সব পেড়িয়ে বন্ধুত্ব চিরদিনই অমলিন।

পাণ্ডুলিপিতে যুক্ত শত কবিতার ভীড়ে কবি জীবন ঘটিত ও নাগরিক ব্যঞ্জনা মিশ্রিত কিছু কবিতার জন্মও দিয়েছেন যেমন- “কৃষকপিতা” কবিতায়, উঠে এসেছে কৃষকের অন্ধকার জীবনের কথা। “আমাকে ক্ষমা করো না কিশোরী বোন” কবিতায় অভয় নগরের মালো পাড়ার ধর্ষিতা কিশোরীর আর্তনাদ। “কর্পোরেট সকাল” কবিতায় শ্রান্ত পথিকের হাহাকার। “ভুল মানুষের জন্য অপেক্ষা” কবিতায় অপেক্ষার আপেক্ষিকতা। “সলিলোকি” কবিতায় দেশ সভ্যতার কথা।

কবির রচিত গদ্যকাব্যে শব্দরূপের মোহাচ্ছন্নতা কাল্পনিক চোখ থেকে দেখতে পারি আক্ষেপ ও অবসাদের চিত্রকল্প। যেখানে তিনি লিখেছেন, “সে আমাকে দেখেছিলো এসে, দেখেছিলো কিনা চৈত্রের ভোরে, ঘোরে? আমি তাকে ডাকিনি/ কোন নাম-বেনামি রোদের জলে ভেসে গেছে শেষে, সে ছিলো আমার শৈশব তাড়িত নদী, বালিকা বধুর কাখে রিনিঝিনি বাড়িতো নূপুর/ অবশেষে শূন্যতা এসে, ঘুঙুরের ডাকে মিলিয়ে গেছে।”
ঘুমশূণ্যের খাতায় কবি লিখেছেন- “আমার ঘর নেই” নামক কবিতা। কবির চোখে ঘুম আসে না, রাতভর শূন্য খাতায় ভাসে ধর্ষকের উদ্বাহু শিশ্ন। তিনি ঘুমুতে পারেন না, অশান্ত দেশ কেড়ে নিয়েছে ঘুম।

পাণ্ডুলিপি আলোচনা শেষ করছি কাব্যগ্রন্থের শেষ দিককার কবিতার কথা দিয়ে, “নীড়ে ফেরা পাখির কল্পচিত্রের রূপকতা দিয়ে লেখা হয়েছে- “ঘরে ফেরা হে পাখি; বুকে গেথে রেখো কিছু সবুজ জমিন কিছু কোমল হাওয়া”। আবার তিনি এটাও বলেছেন, সঙ্গিনীর মায়াবী চোখের দিকে তাকিয়ে ছিন্ন চিন্তা ভূলে যেতে। পান্ডুলিপির সর্বশেষ কবিতা “আজ তবে তাই হোক”। এখানে কবি প্রেম ও বিরহের সুর দিয়ে লিখেছেন-
"আজ তবে তাই হোক, জ্যোস্না ছুঁয়ে কলরব হোক, ফুল ছুঁয়ে পাঁপড়ি বৃষ্টি,
উজানের ঢেউ এনে সমতলে জোয়ার তুলি, আজ তবে তাই হোক।"

“বিমূর্ত ক্যানভাস” কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপিতে কল্পচিত্র আর শব্দ ব্যবহার যে অভূতপূর্ব  মিশ্রণে যে স্বকীয়তা কবির কলম থেকে বেড়িয়ে এসেছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। কবির পাণ্ডুলিপিতে অর্ন্তভুক্ত শেষ কবিতার মতো বলতে চাই আজ তবে তাই হোক, আসুক শব্দবান কল্পিত মনমন্দিরে। কবি ও কবিতার জয় হোক। সেই সাথে পাঠকের হাতে নির্মাল্য হয়ে উঠে আসুক কবি বাবুল হোসাইনের “বিমূর্ত ক্যানভাস”।




♣ বই আলোচনা ♣ প্রতিযোগীতা ৩য় ক্যাটাগরী
১ Likes ২ Comments ০ Share ৯৭৫ Views