Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

মোঃ জিয়াউল হক

১০ বছর আগে

আই উইটনেস (যাহা বলিব সত্য বলিব)

(দুই)
অনেক গুলি লোকের মধ্যে দু’তিন জন লোক যদি হঠাৎ কোন কারণে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তখন অন্য লোকদের মধ্যে দু’চারজনকে স্বাভাবিক ভাবেই এগিয়ে আসতে দেখা যায়। আসতেই পারে। কারণ, এটা মানুষের সামাজিক দায়িত্ব। এই এগিয়ে আসা লোকদের কেউ মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেন কেউ বা হঠাৎ পক্ষ নেওয়ার চেষ্টা করেন। আর কিছু লোক তামাশা দেখেন।
সিটের স্বত্ত্ব নিয়ে যখন আমাদের দু’পক্ষের পাল্টাপাল্টি দাবী তুঙ্গে, তখন একজন মুরব্বী লোক এগিয়ে এলেন মধ্যস্থতা করতে। তিনি আমার পিছনের সিটেই বসেছিলেন। মুরব্বী বললেন, ‘দেখুন তো কারো টিকিট জাল কিনা ?’
সঙ্গে সঙ্গে আমরা নিজ নিজ টিকিটখানা দেখতে লাগলাম এবং আরও ক’জন লোক কৌতুহল নিয়ে ঝুঁকে এসে দেখতে লাগলেন। কিন্তু আমার জানামতে রেলের টিকিট কখনো জাল হয় না বা জাল হয়েছে বলে শুনিনি। টিকিট গুলি নেড়েচেড়ে দেখে ক’জন বললেন, ‘না না টিকিট জাল নয়, তাছাড়া টিকিট জাল হওয়ার কথা কোনদিন শোনা যায়নি।’ এবার কপাল কুঞ্চিত করে মুরব্বী বললেন, ‘তাহলে ব্যাপারটা কি ?’ সাইড থেকে একজন বললেন, ‘ব্যাপারটা কিছুই নয়, ভুয়া সিট নম্বর বসিয়ে দিয়েছে।’
এইবার আমার মনের মধ্যে সন্দেহ ঢুকে গেলো। কারণ, আমি ব্লাক টিকিট কিনেছি। মৃদু গুঞ্জনের মধ্যে ফিস ফিস করে পাশের লোকটিকে আমি বললাম, ‘এই যে ভাই আপনি কি কাউন্টার থেকে টিকিট কিনেছিলেন ?’ লোকটি আস্তে বললেন, ‘না। বাহির থেকে কিনেছি।’ এবার আমি বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম এই ভেবে যে, যারা ব্লাক টিকিট বিক্রি করে তারা সিট নম্বরটি বসিয়ে দিয়ে আমার নিকট থেকে বেশি দাম নিতে পারে। কিন্তু, এই সিটটি এই স্টেশন পর্যন্ত খালি আছে সেটা তারা কিভাবে জানলো ? এই যে আট-দশটি স্টেশন পেরিয়ে এলাম এই দুটি সিটের দাবী নিয়ে তো একবারও কেউ এলো না ? কেউ যদি বলেন আন্দাজ করে সিট নম্বর বসিয়ে দিয়েছে আর তাতেই কাজ হয়েছে, এ কথা মানা যায় না। কারণ, আমরা পাশাপাশি দু’জন লোক সম্পূর্ণ অপরিচিত। নিশ্চয়ই আমরা আলাদা আলাদা ভাবে টিকিট কিনেছি। আর আন্দাজে এক সঙ্গে দু’টি ঢিল কোথাও লাগতে পারে না। তাই আমি নিশ্চিত ভুয়া সিট নম্বরের ব্যবসা তারা একা করছে না। অবশ্যই রেলওয়ের কর্মচারীরা এর সঙ্গে জড়িত আছে। আমি নিজের ভেতরেই নিজের যুক্তিটা চেপে গেলাম। কারণ, এমনও হতে পারে আমার সিটটা অরজিনাল, ঐ লোকটার সিট নম্বরটাই দু’নম্বর।
ইতিমধ্যেই ট্রেন ছুটতে শুরু করেছে। ট্রেনে উঠা লোকদের সিট দখলের প্রতিযোগিতা প্রায় শেষ। দু’চার জন এখনো টিকিট হাতে নিয়ে সিট খুঁজে বেরাচ্ছেন। অনেকেই সিটবিহিন টিকিট নিয়ে সুবিধা মতো দাঁড়িয়ে থাকার জায়গায় খুঁজচ্ছেন। এদিকে টিকিট হাতে আমার সামনে স্ব-স্ত্রীক লোকটি জোর দাবী নিয়ে বলে যাচ্ছেন, ‘আমার অরিজিনাল টিকিট। আমার সিট নম্বরও অরিজিনাল। আপনারা দু’জনেই সিট ছাড়েন।’
স্ত্রীলোকটি অভিমানি সুরে বলছেন, ‘ও মা এটা কেমন কথা ? দেশে আইন-কানুন নাই বুঝি, একজনের সিটে আরেক জন বসে থাকে।’
আমি কিছুক্ষণ ধরেই চুপচাপ আছি। আমার পাশের লোকটি তার কথার প্রতিবাদ করে বলছেন, ‘কিভাবে বুঝবো আপনার সিট নম্বর অরিজিনাল ? আমরা তো আপনার অনেক আগে টিকিট নিয়ে ট্রেনে উঠেছি। আপনি বললেই তো হবে না।’
আমাদের সামনের সিটে বসা লোক দু’জন বোধ হয় খানিকটা বিরুক্তি বোধ করছেন। একজন বিরুক্তিমাখা মুখে বলেই বসলেন, ‘আপনারা কি শুরু করলেন ভাই ?’ আরেক জন বললেন, ‘আপনারা চার জনেই ট্রেন কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে অভিযোগ করুন। সেটাই বরং ভালো। তবু ঝগড়া-বিবাদ করবেন না দয়া করে।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমারও খারাপ লাগতে শুরু করেছে। ভাবছি সিটটা ছেড়ে দিয়ে অন্য বগিতে গিয়ে বরং দাঁড়িয়ে থাকি। অন্যায় দাবী মেনে নেওয়ার অভিজ্ঞতা আমার ঝোলাতে অনেক জমা আছে। হয়তো কেউ ভাবতে পারেন অন্যায় দাবী মেনে নিয়ে আমি অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়েছি। আসলে অযৌক্তিক তর্ক এবং একপেশে সমর্থন আমি করতে পারি না বিধায়, মনে সীমাহীন ঘৃনা নিয়ে অন্যায় দাবী মেনে নিয়েছি অনেক ক্ষেত্রে। কিন্তু পাশের লোকটির তর্ক করতে কোন বিরুক্তি দেখছি না। ইনি বোধ হয় সহজে ছাড়বার পাত্র না। আমি ছাড়লেও উনি ছাড়বেন না।
এ কথা সত্যি যে, জনবহুলতার তুলনায় আমাদের দেশে ট্রেনের কামরা এবং সিট দুটোই অপ্রতুল। এটা সবচেয়ে বড় সমস্যা। কিন্তু তার চেয়েও বড় সমস্যা এই সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অব্যবস্থাপনা। এই অব্যবস্থাপনার পেছনে আছে আরও বড় বড় সমস্যা। যা লিখলে হয়তো দু’চার খানা বই লেখা হয়ে যাবে। আমি কোন লেখক না। তাই আমার পক্ষে সে সব লেখাও সম্ভব না। নির্দ্বিধায় বলা যায় অনৈতিকতা এবং অব্যবস্থাপনার কারণেই আমাদের প্রতিনিয়ত এরকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এছাড়া জাতিগত ভাবে আমাদের নৈতিক কালচারের অভাবও এর জন্য কম দায়ী নয়।
যাই হোক কিছুক্ষণ পরেই একজন ভুড়িওয়ালা অ্যাটেনটেন্টডেন মনের সুখে পান চিবুতে চিবুতে এলেন। পান চিবুনোর স্টাইল দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি পানে আসক্ত। খুব মজা করে পান চিবুচ্ছেন। লোকটাকে দেখতে কুস্তিগিরের মতো মনে হলো। আসলে নিরীহ টাইপের লোক। তিনি আমাদের বাক বিতন্ডা দেখে বললেন, ‘কি সমস্যা ?’ আমি ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবো ভাবছিলাম কিন্তু তার আগেই সিটের দাবীদার লোকটি চেঁচিয়ে বললেন, ‘দেখুন তো কারবার। এই সিট দুটা আমাদের আর ওনারা দুজন দখল করে বসে আছেন। কিছুতেই সিট ছাড়ছেন না।’
অ্যাটেনটেন্টডেন বললেন, ‘দেখি টিকিট গুলা।’ বলেই তিনি লোকটির হাত থেকে টিকিট দু’টি নিয়ে দেখতে লাগলেন। ওনার বোধ হয় চোখের পাওয়ারের সমস্যা। দেখতে গিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে পকেট থেকে চশমাটা বের করে পড়লেন। তারপর বললেন, ‘আচ্ছা।’ এবার আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এবার দেখি আপনাদের টিকিট।’ আমরা দু’জনেই টিকিট এগিয়ে দিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ ধরে উল্টে-পাল্টে টিকিট দেখে আমাদের হাতে ফিরিয়ে দিতে দিতে অ্যাটেনটেন্টডেন লোকটি খুবই সহজ ভাবে বললেন, ‘সব ঠিক আছে। আপনারা গন্ডগোল না করে ভাগাভাগি করে বসেন।’ বলেই তিনি সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। সিটের দাবীদার লোকটি এবার হতাশ হয়ে বলতে লাগলেন, ‘এটা কোন বিচার হলো ? দুইজনের সিটে চারজন বসা যায় ?’ বলেই লোকটি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আশপাশের যাত্রীদের মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন সম্ভবত তার প্রশ্নের উত্তরের আশায়। তিনি বোধ হয় আশা করেছিলেন অ্যাটেনটেন্টডেন সিট দুটি তাকেই দখল করিয়ে দিবেন। কিন্তু অন্য যাত্রীদের আর কেউই এ বিষয়ে আগ্রহ দেখালেন না।
এক্সপ্রেস ট্রেনের সুলভ শেণির সিট গুলিতে কষ্ট করে খুব হলে তিন জন বসা যায়। আমি দেখলাম আমরা যদি ভাগাভাগি করে বসি তিন জন বসা যাবে কিন্তু মহিলাটির সঙ্গে কিভাবে ভাগাভাগি করবো বুঝতে পারছি না। লোকটিকে যদি বসতে দিই মহিলাকে দাঁড়িয়েই থাকতে হয়। নতুবা আমাদের দু’জনের একজনকে সিট ছাড়তে হবে। ব্যাপারটি নিয়ে আমার খুব অস্বস্তি বোধ হতে লাগলো। এক পর্যায়ে হঠাৎ আমি উঠে দাঁড়িয়ে উপরের র‌্যাক থেকে ব্যাগটা নিতে নিতে বললাম, ‘ভাই আপনি আপনার স্ত্রীকে নিয়ে বসুন আমি চললাম।’ সিটের দাবীদার ভদ্রলোক এবং তার স্ত্রী খানিকটা অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি এত সহজে সিটের দাবী ছেড়ে চলে যাবো তা হয়তো তারা ভাবতেই পারেননি। আমিও একবার তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বিরস মুখে হাঁটা দিলাম। আশপাশের ক’জন যাত্রীও আমার দিকে দ্বিধাশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
জীবনে সব সময়ই সব কিছু পেতে হবে এমন কোন কথা নেই। আমি ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে দরজার মুখে এসে দাঁড়ালাম। তীব্র বাতাসের ঝাঁপটা এসে লাগছে গায়ে। বাহিরে নিশুতি রাতের ঘন অন্ধকার চিরে ট্রেন ছুটে চলেছে তার আপন গতিতে। আমাদের ছোট-খাটো দেনা-পাওনার হিসাব-নিকাশের পঙ্কিলতায় তার গতি বিঘ্নিত হবার কথা নয়।
(ট্রেন যাত্রার গল্প এখানেই শেষ)
(চলবে...)

০ Likes ২ Comments ০ Share ৪০৪ Views

Comments (2)

  • - তাহমিদুর রহমান

    প্রথম লাইনটা কি অন্যভাবে প্রকাশ করা যায়?

    • - সুমন আহমেদ

      মতামতের জন্য ধন্যবাদ। আমি এভাবেই প্রকাশ করতে চেয়েছি। ভাল থাকুন।

    - মাসুম বাদল

    কবিতা তুই কথা কইস না, চোখ তুইলা তাকাইস না
    তার চাইয়া ভাল সুরার পাত্রে আকন্ঠ ডুইবা,
    মাতাল হইয়া যা!
    পানশালায় নাচনেওয়ালীর ঘুঙুরের শব্দে বাড়লে নেশা;

    বড় জোড় শিশ্নে গা ভাসা! 

     

     

    কিছুই যদি না পারি ভাই

    এসো দল বেঁধে অভিমানি হই ... 

    • - সুমন আহমেদ

      অফুরাণ শুভেচ্ছা ...

    - নীল সাধু

    খারাপ না ভালো হইসে কবিতা

    • - সুমন আহমেদ

      জেনে ভাল লাগলো। শুভেচ্ছা।

    Load more comments...