Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

মোঃ জিয়াউল হক

১০ বছর আগে

আই উইটনেস (যাহা বলিব সত্য বলিব)

(এক)

অনেক ভেবে চিন্তে শেষতক ঠিক করলাম ঢাকাতেই যাবো। কারণ, আমার কর্মহীন বাউন্ডুলে জীবন বাবা ঘৃণার চোখে দেখতে শুরু করেছেন। তিনি খেতে-নিতে উঠতে-বসতে বকাঝকা করতে শুরু করেছেন। অনেক সময় সে বকাঝকা মায়ের উপরেও বর্ষিত হতে দেখা যায়। আমি জানি পৃথিবীর সব বাবারাই যখন সংসারে দারুন আর্থিক অনটনের মুখোমুখি হোন, তখন ঘরে উপযুক্ত ছেলে থাকলে স্বাভাবিক ভাবেই নিজের অজান্তেই তাঁদের একটা আশা-আকাঙ্খা জেগে ওঠে মনে। হয়তো ভাবেন ‘ইশ ছেলেটা যদি কিছু রোজগার করে আনতো তবে এই অভাব আজ দূর হয়ে যেতো।’ যাদের ছেলে নেই তারাও হয়তো দুঃখিত মনে এ কথা  ভাবেন ‘আহা আমার যদি একটি ছেলে থাকতো....?’ আমার বাবাও হয়তো সেরকম করেই ভাবতেন। বাবা যখন, তখন ভাবতেই পারেন তিনি। আমি বাবা হলেও হয়তো এরকমই ভাবতাম। তাই সে জন্য বাবাকে দোষারোপ করার কিছু নেই আমার। কিন্তু আমি তাঁর জন্য কিছুই করতে পারছিলাম না বলে ভাঙ্গা মনোরথ নিয়ে ঢাকায় যাবার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত করি। সেখানে গিয়ে যদি কিছু একটা করতে পারি এই আশায়।
    তবে আমি সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেও কেন যেন যাবার দিন তারিখটা ঠিক করতে পারছিলাম না। আজ যাই কাল যাই করতে করতে দিন যায়, রাত যায় আমার যাওয়া হয়ে ওঠে না। প্রতি দিনই নানা অজুহাত সামনে এসে দাঁড়ায়। ওদিকে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবার পর থেকে যে বন্ধুকেই দেখা পেয়েছি তাকেই বলেছি ‘কদিনের মধ্যেই ঢাকায় যাচ্ছিরে।’ যখন যাওয়া হচ্ছে না তখন সেই বন্ধুদের সাথে দেখ হওয়া মাত্রই শুনতে হচ্ছে ‘কি রে তোর না ঢাকায় যাবার কথা ?’ কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কি ভাবে এতো অজুহাত তৈরি হচ্ছে। একদিন মনে হলো হয়তো আমার সাব-কনসাস মাইন্ড চাচ্ছে না আমি ঢাকায় যাই। সেজন্য আমি নিজের অজান্তেই অজুহাত তৈরি করছি। তাই একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আজই ঢাকায় যাবো।
    ঠিক করলাম রাতের ট্রেনেই রওয়ানা হবো। দিনের বেলায় বাসেও যাওয়া যেতো। কিন্তু বাসে উঠলেই আমার মাথা ঘুরে বমি হয়ে যায়। এ কথা যে শোনে সেই হাসে। এক বন্ধু শুনে বললো, ‘আমি আজীবন চলন্ত বাসেই কাটিয়ে দিতে পারি।’ কিন্তু আমার বেলায় কেন সেটা হয় তা আমার জানা নেই। ইতোপূর্বে এই সমস্যা নিয়ে একজন ডাক্তারের স্মরণাপন্নও হয়েছিলাম। তিনি একটি ট্যাবলেটের নাম লিখে দিয়েছিলেন। যে কোন সময় বাসে ওঠার আগে খেয়ে নিলেই হবে। কিন্তু তাতেও আমার কাজ হয়নি। বাসে উঠে খুব হলে দু’তিন মাইল অতিক্রম করার পরেই অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। তারপর একপর্যায়ে হরহর করে নাড়িভুড়ি পর্যন্ত বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়। তাই যেখানে ট্রেনে যাওয়া যায় না সেখানে আমি সাধারনত যাই না। এ জন্য আমার অনেক জায়গা দেখা হয়ে ্ওঠেনি। ট্রেনে যাওয়া যায় আমি সাধারনত সেদিকেই যেতে আগ্রহী বেশি। আমার এক অত্মীয় একবার আমাকে ঢাকায় নিয়ে গেলেন তার বাসায়। অনেক যতœআত্তি করলেন। তার ইচ্ছা আমাকে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াবেন। কিন্তু আমি বাসে উঠার ভয়ে কোথাও যেতে রাজি হলাম না। তিনি হতাশ হয়ে আমাকে বাসায় রেখে তার কর্মে তিনি যোগ দিলেন। আমি তার বাসার আশপাশ এলাকায় একা একা হেঁটে বেরিয়েছি কয়েকদিন। তবে কিছু কিছু জয়গায় গিয়েছি চড়া দামে সিএনজি ভাড়া করে। বাস, কার এবং মাইক্রোবাস এই তিন যানে উঠলেই আমার বমি হয়।
    রাতের ট্রেনেই যাবো শুনে মা আমার পরিধানের জামা-কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে শুকোতে দিলেন। বাবার কাছে টাকা ছিল না। তিনি কোথা থেকে যেন চলা-ফেরা এবং খাওয়া খরচের জন্য কিছু টাকা ধার করে এনে আমার হাতে দিলেন। সবকিছু গুছিয়ে রেখে আমি দিনমান বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার জন্য ঘুরে বেরালাম। সেই সাথে ঘনিষ্ঠজন যারা ঢাকায় আছেন তাদের ঠিকানা যোগার করলাম। আর সব বন্ধুকে জানালাম যে আজ আমি সত্যি সত্যি যাচ্ছি। আজ আর মিস হবে না।
    ট্রেনের সময়ের এক ঘন্টা আগে স্টেশনে গিয়ে পৌঁছিলাম। গিয়েই সেখানকার এক স্থানীয় বন্ধু রফিকের সাথে দেখা। তাকেও জানালাম আমি ঢাকায় যাচ্ছি দোয়া করিস। সে বললো, ‘টিকেট নিয়েছিস ?’ আমি বললাম, ‘না।’
    টিকিট নেওয়ার কথা আমি বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম। সর্বনাশ হয়েছে। ঢাকায় যেতে হলে কমপক্ষে তো তিন দিন আগে টিকিট নিয়ে রাখা উচিৎ। না হলে সিট পাওয়া যায় না। আমি তড়িঘড়ি রফিককে সাথে নিয়ে কাউন্টারে গিয়ে একটি ঢাকার টিকিট চাইতেই টিকিট মাস্টার বললেন, ‘সিট হবে না।’
সিট হবে না শুনে খানিকটা হতাশা ঘিরে ধরলো আমাকে। কারণ, এতোটা পথ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জার্নি করা খুবই কষ্টকর হবে। আমার মনে হলো সকালবেলা যখন সিদ্ধান্ত নিলাম তখনি যদি এসে একটা টিকিট নিয়ে যেতাম তখনও বোধ হয় সিট পাওয়ার আশা ছিল। বোকামিই করে ফেলালাম বোধ হয়। কিন্তু এই অসময়ে এসে আর দুঃখ করে কি লাভ। আমি বিনিত ভাবে লোকটিকে বললাম, ‘দেখুন না চেষ্টা করে একটা সিট পাওয়া যায় কি না। যে কোন শ্রেণি হলেই হবে।’
আমি যতটা বিনিত ভাবে তার কাছে বললাম তার চেয়ে অধিক বিনয় দেখিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘থাকলে কি না করি ?’
স্টেশনের পশ্চিম পাশেই রফিকের বাড়ি। ভদ্রলোকের সঙ্গে সম্ভবত রফিকের পরিচয় আছে। এবার রফিক এগিয়ে এসে বললো, ‘আঙ্কেল, এ আমার বন্ধু। পরের স্টেশন থেকেও যদি সিট একটা দেওয়া যায় তবু দিন।’
সিট ছাড়াই অনেকে টিকিট কিনছে। একজনকে একটা টিকিট দিতে দিতে ভদ্রলোক রফিকের দিকে তাকিয়ে ¯িœগ্ধ হেসে বললেন, ‘নেই বাবা নেই। থাকলে কি আমি তোমার কাছে না বলতে পারি ?’
ভদ্রলোক আবার সিট বিহীন টিকিট বিক্রিতে মন দিলেন। রফিক কিছুক্ষণ লোকটার দিকে তাকিয়ে থেকে আমার হাত ধরে টান দিয়ে বললো, ‘চল দেখি কি করা যায়।’
স্টেশন এবং তার আশপাশের হালচাল রফিকেরই ভাল জানবার কথা। তখনো ট্রেন আসবার আধা ঘন্টা বাকি। সে আমাকে নিয়ে গেলো বুক স্টলের কাছে। সেখানে এক মস্তান টাইপের লোক দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকাচ্ছে। আমাকে একপাশে দাঁড়াতে বলে রফিক সেই লোকটির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় কি যেন আলাপ করে আবার আমাকে নিয়ে চললো স্টেশনের ও মাথায়। আমি রোবটের মতো রফিককে অনুসরন করছি। আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কেবল একটি চিন্তা কিভাবে এতটা পথ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাবো।
অবশেষে রফিক আমার দুঃশ্চিন্তার অবসান ঘটালো। স্টেশনের ও মাথায় একটি ছোট্ট পানের দোকানে গিয়ে দোকানিকে বলতেই সে টাকার ইঙ্গিত করলো। রফিকও সেই ইঙ্গিত আমাকে করলো। আমি সঙ্গে সঙ্গে টাকা বের করে দিলাম। টিকিটের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে এক’শ টাকা বেশি রেখে দোকানি একটি সুলভ শ্রেণির টিকিট আমার হাতে ধরিয়ে দিলো। আমি টিকিটটা হাতে নিয়ে বিস্ময়ভরা চোখে দোকানির দিকে তাকিয়ে রফিককে বললাম, ‘ইনিও কি টিকিট মাস্টার ?’
রফিক বললো, ‘এরাই এখন আসল টিকিট মাস্টার। এর মতো আরও ক’জন আছে। এর পরে যদি কোনদিন ট্রেনে কোথাও যাস সরাসরি এর কাছে এলেই সিট সহ টিকিট পেয়ে যাবি।’
আমার বিস্ময় এখানে শেষ হলেই ভাল হতো কিন্তু তা হলো না। শেষ বিস্ময়ের আগেও আরও যে বিস্ময় আছে তা হয়তো কম বেশি অনেকেরই জানা। যেমন, টিকিট ছাড়া ট্রেনে উঠলেও অসুবিধা হয় না। টিকিট চেকার কিংবা  অ্যাটেনটেনডেন্টদের দশ টাকা দিলেই হয়। তখন যারা টিকিট কিনে ট্রেনে ওঠে তারা বোকার মতো তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবে, ‘আহারে এতগুলো টাকা নষ্ট করলাম !’ সত্যি বলতে কি সে কথা আমারও মনে হয়েছিল। কিন্তু অনেক দূর যাবো বলে সেটা নিয়ে আর দুঃখ করিনি। দুঃখ হলো তখন, যখন সান্তাহার রেল স্টেশনে গিয়ে ট্রেন বদল করে অন্য ট্রেনে উঠে গা ঝাড়া দিয়ে আরাম করে বসলাম। এমন সময় এক ভদ্রলোক তার সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ভাই সিটটা ছাড়–ন।’
আমি প্রথমে ভাবলাম অন্য কাউকে বলছে বোধ হয়। কারণ আমার সিটসহ টিকিট আছে। আমাকে বলার কোন কারণ দেখছি না। তাই অন্য দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার সামনেই লোকটির স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন। সে দিকে তাকালে লোকে খারাপ ভাবতে পারে। কিন্তু কোন রকম ভদ্রতার তোয়াক্কা না করেই লোকটি এবার ধমকের সুরেই বললেন, ‘কি হলো ভাই আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন না ?’
‘আমাকে বলছেন ?’
‘হ্যাঁ। তো কাকে বলবো আর।’
‘কেন আরও তো লোক আছে এখানে তাদেরকেও বলতে পারেন।’
‘আপনাকেই বলছি কারণ সিটটা আমার। এই দেখুন টিকিট।’
লোকটির হাতে থাকা টিকিটটা আমার সামনে বসা লোক দুটিও ঝুঁকে এসে এক নজর দেখলেন। ‘হ্যাঁ তাইতো’ এমন একটা সম্মতি তারাও দিলেন। আমি বিব্রত বোধ করছি মনে মনে। কিন্তু যুক্তি দেখিয়ে বললাম, ‘দেখুন ভাই আমি কিন্তু আরও দশটা স্টেশন আগে বসেছি সিটে এই দেখুন আমার টিকেট।’
ইতোমধ্যে আশপাশের অনেকেই আমাদের দিকে কৌতুহলি হয়ে তাকাতে শুরু করেছেন। আমার সন্দেহ হলো সুন্দরী স্ত্রী সাথে আছে বলেই হয়তো কেউ কেউ লোকটার পক্ষাবলম্বন করার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু আমি টিকিট বের করে সিট নাম্বার দেখাতেই অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ভদ্রলোক এবার আমার পাশের লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এই যে ভাই আপনিও উঠুন। ঐ সিটটাও আমার। এই যে দেখুন টিকিট।’
আমার পাশের লোকটি অনেকক্ষণ ধরেই ঝিমুচ্ছিল। তিনি হঠাৎ আতংকিত চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘মানে ?’
‘মানে কিছু নয় সিটটা আমার। এই যে টিকিট।’
‘টিকিট তো আমারও আছে এই দেখুন।’
এই বলে লোকটি তার টিকিটখানা সামনে মেলে ধরলেন। আমরা চারজন মানুষ মুখোমুখি চারটি টিকিট নিয়ে তাকিয়ে আছি সিট নম্বরের দিকে। আর দাবী করছি ঘাম ঝরানো টাকায় কেনা নিজ নিজ সিটের স্বত্ত্ব। কিন্তু কার সিট নম্বরটি যে আসল আমরা কেউ জানি না।
(চলবে..)

০ Likes ৩ Comments ০ Share ৪৪১ Views

Comments (3)

  • - কামরুন নাহার ইসলাম

    ভালো লাগলো আপনার জীবনধর্মী ভ্রমণ কাহিনী। এমন মানবেতর জীবন অনেক বাঙালি যাপন করছেন প্রবাশে। কিন্তু নিজ দেশে ফিরতে চান না, শুধু বেকার থাকবার ভয়ে। কোন দেশে আমরা বাস করি  

    অনেক শুভেচ্ছা আপনাকে। 

    - রোদেলা

    খুব ভালো লাগলো,মনে হল আপনার সাথেই ঘুরে এলাম মালাক্কা শহর।কিন্তু ছবি কোথায়?