Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

তাহমিদুর রহমান

১০ বছর আগে

অভিশাপ

আব্দুর নূর সাহেবের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল দুবছর আগের পহেলা বৈশাখে। শরীরে সৌখিন পাঞ্জাবী ছিল যা আমার স্মৃতিতে মাঝে মাঝেই ভেসে উঠে। তার সাথে আমার কিভাবে পরিচয় হয়েছিল এখন আর তা মনে নেই তবে ধরে নেওয়া যায় সেটা ইন্টারনেটের মাধ্যমেই হবে। কারণ অনেক মানুষের সাথেই ইন্টারনেটে পরিচয় হওয়ার পর বাস্তবে দেখা হয়েছিল আমার। তখন দশ বছরের ছেলে থেকে শুরু করে সত্তর বছরের বুড়ো সবার মাঝেই ফেসবুকের জোয়ার বইছিল। তার সাথে আমার পরিচয় ফেসবুকে হতে পারে কিন্তু আজ আর তা মনে নেই। এর কারণও আছে, তার সাথে আমার যে আত্নীয়তার বন্ধন গড়ে উঠেছিল তারপর আর পরিচয়ের সূত্র মনে রাখার প্রয়োজনবোধ করিনি। আমি তা মনে করার চেষ্টাও করি না তবে তাকে নিয়েই আমার এই গল্প।

 

সময়টা বসন্তের প্রথম মাস ফাল্গুন গিয়ে চৈত্র আসি আসি করছে। প্রখর রৌদ্র তখনও শুরু হয়নি তবে সূর্য মাঝে মাঝেই তার তেজ জানান দিয়ে যাচ্ছে। এরকম দিনের এক সময়ে আব্দুর নূর সাহেব তার দোকানে বসে ছিলেন। গল্পের ভিতরে ঢোকার আগে আব্দুর নূর সাহেবের সম্পর্কে কিছু বলে নেওয়া দরকার। তাকে অদ্ভূত মানুষ বলতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেশির ভাগ মানুষই চাকরির জন্যে পায়ের জুতো ক্ষয় করে ফেলে আর তিনি কিনা সেদিকে না গিয়ে পত্রিকা বিক্রির দোকান খুলে বসলেন। তার আত্নীয় স্বজন প্রায় সবাই হায় হায় করে উঠল, অনেকে তার জন্যে মান ইজ্জত গেল বলে দূরে সরে গেল এবং পরিচয় দেওয়াও বন্ধ করে দিল। এমনকি এই দোষে তাকে তার বাসা থেকে বের করে দেওয়া হল তবু তিনি পত্রিকা বিক্রির দোকানের সাথে জীবন গড়ার মনস্থ করলেন।

 

পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে তিনি বঞ্চিত হলেও তাকে পথে বসতে হয়নি কারণ তার স্ত্রীর কল্যাণে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই তিনি বিয়ে করে ফেলেছিলেন, তার স্ত্রী বিয়েতে দশ ভরি সোনা পেয়েছিল যা সে সময়ের বাজারে অর্ধেক বিক্রি করেও স্বাবলম্বী হয়ে দাঁড়ালেন এবং শান্তিনগরে একটা দু’কামরার বাসা ভাড়া নিয়ে শান্তিতে দিনাতিপাত করতে লাগলেন। হয়ত এরকম সময়েই তার সাথে আমার পরিচয়, পরিচয় থেকে পহেলা বৈশাখের দিন আমাদের প্রথম দেখা এবং তারপর থেকে মাঝে মাঝে ফ্রি পত্রিকা পড়ার লোভে তার দোকানে আড্ডা মারা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছিল।

দোকানে বসে বসে সকালবেলাতেই চার পাঁচটা পত্রিকার হেডলাইন মুখস্থ করা তার প্রাত্যহিক দিনের কাজ ছিল। লোকজন দোকানের সামনে গেলেই হেডলাইনগুলো মুখে আউড়াতেন, এতে কিছু লোক উৎসাহী হয়ে পত্রিকা কিনে নিয়ে যেত নয়ত মাথা নেড়ে চলে যেত আবার কেউ কেউ ফ্রি পেপার দাঁড়িয়ে পড়ে চলে যেত তবু তিনি বিরক্ত হতেন না। আমিও এরকম ফ্রি পত্রিকা পড়ার লোভে যেতাম বলে মাঝে মাঝে নিজের লজ্জায় লাগত কিন্তু তার কথা শুনে বা উনার সাথে গল্প করে সে লজ্জা বাতাসে উড়িয়ে দিতাম।

 

আব্দুর নূর সাহেবের সম্পর্কে মোটামুটি বলে ফেলেছি, এবার সরাসরি মূল গল্পে যাওয়া যাক।

 

তিনি যেভাবে প্রত্যহ দিন পার করেন ঠিক সেভাবেই সকাল গড়িয়ে দুপুর হতেই টিফিন বক্সে স্ত্রীর দেওয়া খাবার খুলে বসলেন, উনার স্ত্রী তাকে বাইরের খাবার খেতে দিতে একদম রাজি নন। খাওয়া শুরু করতেই কিছু কাক দোকানের সামনে এসে জড়ো হল, নিবিষ্ট মনে তাকেই দেখছিল কাকগুলো। তিনি তেমন একটা আমলে দিলেন না, পাশেই ডাস্টবিনে উচ্ছিষ্ট খাবার ফেলা হয় তাই কাক আসা স্বাভাবিক। অন্যদিন খাবার বাঁচলে পাশে ডাস্টবিনে ফেলে দিতেন যা এই কাকগুলোরই পেটে যায় কিন্তু আজ আর খাবার বাঁচল না, টিভিন বক্স ভাল মত ধুয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলেন।

 

সেদিন বিকেলে আমি তার কাছে গিয়েছিলাম, তাকে দেখে কিছুটা চিন্তিত মনে হওয়ায় জিজ্ঞেস করলাম,

 

-কি ব্যাপার নূর ভাই, কি হয়েছে?

-হ্যাঁ, মামুন ভাই কি খবর?

অন্যদিন তিনি আমাকে দেখলেই উৎফুল্ল হয়ে উঠেন কিন্তু আজ তেমনটা হলেন না। আমি তার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট তবু তিনি আমাকে ভাই ছাড়া সম্বোধন করেন না, আমি শত বলার পরেও তা বলা থেকে তাকে বিরত রাখতে পারিনি।

 

-কি ব্যাপার মন খারাপ নাকি আপনার?

আমি আবার জিজ্ঞেস করি।

-না এই আরকি, ভাবছি।

-কি ভাবছেন?

-এই আমাদের প্রকৃতিকে নিয়ে ভাবছি।

 

আমি কৌতূহলবোধ করলাম। আমি তখন অল্প বিস্তর লেখালেখিও শুরু করেছি এবং আমার লেখালিখির অনেক উপাদানও তার কাছে থেকে পাওয়া। স্বাভাবিকভাবেই গল্পের সন্ধানে চেয়ার টেনে উৎসুখ চোখে বসে পড়লাম।

 

-কি ভাবছেন বলেন, শুনতে চাই?

-না খুব সাধারন। বলার মত কিছু নয়।

-তবুও বলুন আমি শুনব।

-না ভাবছিলাম এই আমাদের জীবন কিসের জন্যে? কাকগুলোর জীবনই বা কিসের জন্যে? এইসব কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।

-কিছু খুঁজে পেয়েছেন?

-নাহ তবে আমাদের জীবন হল বাঁশপাতার মত। সাজাতে জানলে বাঁশি বাজানো যায় আর না জানলে শুকনো বাঁশপাতার মত যা জ্বালানি হিসেবে পুড়িয়ে ফেলি।

-বাহ, বেশ বলেছেন তো।

 

আমি আমার নোট বইটা বের করে তার বলা লাইনটা টুকে নিয়ে রাখলাম। তিনি তাই দেখে হায় হায় করে উঠলেন,

 

-ভাই, আমি সাধারন মানুষ, আপনারা লেখকরা সেই কথা লিখে কি করবেন?

-নূর ভাই, আপনি নিজেও জানেন না মাঝে মাঝে আপনি কত দামি কথা বলেন।

 

তিনি মাথা নাড়তে লাগলেন, তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। সেদিন আর কিছুক্ষন গল্প করে বিদায় নিলাম।

 

পরেরদিন দুপুরে আবার তিনি খেতে বসতেই আগের দিনের মত কোথা থেকে দশ-বারটা কাক উড়ে এল। একটু আগেও এই জায়গায় একটি কাকও ছিল না তাহলে হঠাৎ করে এতগুলো কাক কথা থেকে আসে? আজও খেতে খেতে সব খাবার শেষ করে ফেললেন, কাকগুলোকে কিছু খেতে দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও দিতে পারলেন না বলে স্ত্রীর উপর কিছুটা মনঃক্ষুন্ন হলেন। আজ বাসায় গিয়ে তাকে বলবেন কিছু বেশি খাবার দিতে, না জানি কত দূর থেকে কাকগুলো উড়ে আসে খাওয়ার জন্যে।

সেদিন নূর সাহেবের দোকানের দিকে যাওয়ার কথা ছিল না কিন্তু একটা কাজ পড়ে যাওয়ায় অগত্যা যেতেই হল এবং ভাবলাম উনার সাথে দেখাও করে আসা যাবে। উনার সাথে দেখা করতে গিয়ে গতকালের চেয়েও তাকে বেশি বিমর্ষ মনে হল। আমি একটা পত্রিকা তুলে চোখ বুলাতে বুলাতে বললাম,

 

-কি ব্যাপার নূর ভাই? মন খারাপ?

-নাহ।

-তাহলে?

-ঢাকা শহরে কি কাকের সংখ্যা বেড়ে গেল?

-কাক? কেন বলুন তো?

-দেখুননা, কোথা থেকে জানি দশ বারটা কাক এখানে এসে বসে থাকে।

-কই?

-এখন নেই, রোজ আমার খাওয়ার সময় আসে।

 

আমি ব্যাপারটা খুব সাধারনভাবে নিলাম। বললাম,

-কি বলেন? আজকাল ঢাকা শহরে আমি তো কাকই দেখতে পাই না।

-হবে হয়ত।

তারপর কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন।

-মনে হয় ওরা খাবার লোভেই আসে।

-খাওয়ার লোভে?

-হ্যাঁ, সামনের ডাস্টবিনে খাওয়া ফেলে দিতাম, ওরা কুড়িয়ে কুড়িয়ে খায়।

-তা বেশ তো, খাওয়া বাঁচলে ডাস্টবিনে ফেলে দিবেন, কাকগুলো এসে খেয়ে যাবে। ঢাকা শহরে কাক এজন্যে বেশি দরকার।

 

কথাটা বলেই আমি হাসার ভংগি করলাম কিন্তু উনি হাসলেন না।

-দুইদিন ধরে ওদের খাওয়ার দিতে পারিনি। রাগ করে হয়ত চলেই যাবে অন্যখানে।

 

নূর সাহেব যে সত্যিকারেই কাকগুলোর জন্যে দুঃখ প্রকাশ করলেন তা বুঝতে আমার একটু সময় লাগল। যখন বুঝলাম তখন বললাম,

 

-আহা মন খারাপ করছেন কেন? কাল বেশি করে খাবার আনবেন তাহলেই তো হল।

-হুম, আপনার ভাবীকে বেশি করে খাবার দিতে বলব। আমি বেশি মোটা হয়ে যাচ্ছি বলে ও খাবার বেশি দিতে চায় না।

আমি উনার কথায় হেসে সেদিনের মত বিদায় নিলাম।

 

এরপর তিনদিন নূর সাহেবের দোকানের দিকে যাওয়া হল না। নানান কাজে ব্যস্ত থাকলাম, রুটি-রুজির কাজসহ ব্যক্তিগত নানান কাজ। তিনদিন পর আবার এক দুপুরবেলায় দোকানে গিয়ে উপস্থিত হয়ে উনাকে দেখেই অবাক হলাম। এমনিতেই উনি পরিপাটি থাকেন কিন্তু তার বিমর্ষ চেহারা আর উশকো-খুশকো চুল দেখে বুঝতে পারলাম নিশ্চয় কোন্ সমস্যায় পড়েছেন্।

 

-কি নূর ভাই? কোন সমস্যা?

-নাহ।

-মন খারাপ?

-নাহ।

-ভাবীর সাথে ঝগড়া?

-নাহ।

-তাহলে আপনাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন?

-ওরা মনে হয় আমাকে ওদের মত করে নিতে চায়্। আমাকে ওদের দরকার।

-কারা?

-কাকগুলো।

 

আমি লেখক মানুষ, এমনিতেই অনেক উদ্ভট উদ্ভট জিনিস লিখে বেড়াচ্ছি কিন্তু এমন অদ্ভূত কথা শুনে অবাক না হয়ে পারলাম না।

 

-কি বলছেন এসব নূর ভাই? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

-হ্যাঁ ওরা আমাকে পরশু থেকে খেতে দিচ্ছে না।

-মানে?

-মানে আমি তিন দিন ধরে না খেয়ে আছি।

আমি আঁতকে উঠে বললাম,

-আপনি তিনদিন ধরে না খেয়ে আছেন?

-হ্যাঁ ওরা আমাকে খেতে দেয় না। পরশু দুপুরে খেতে বসতেই দুইটা কাক এসে দোকানে ঢুকেছিল, আমি লাঠি দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। তারপর কোথা থেকে আরো দশ-বারটা কাক দোকানের ভিতর উড়ে এল। আমি ভয় পেয়ে খাবার ছুঁড়ে ফেলে দিতেই ওরা তা খেয়ে চলে যায়। এখন প্রতিদিনই এই ঘটনা ঘটছে এবং আমার খাওয়ার রুচি চলে গিয়েছে বলে কিছুই খেতে পারছি না।

 

নূর সাহেব এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন। আমি প্রথমে অবাক হলেও হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললাম,

 

-কি যাতা বলছেন। দুপুরে খাওয়ার সময় তো হয়ে এল, খেতে বসুন। আপনার খাওয়া শেষ না হলে আমি যাব না।

 

নূর সাহেব প্রথমে আশ্চর্য রকমের ব্যবহার করলেন এবং তাকে অনেক বলে কয়ে খাওয়ার জন্যে রাজি করালাম।

 

উনি খেতে বসার আগেই দোকানের এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম, কোথাও কোন কাক নেই দেখে তাকে নিশ্চিন্ত মনে খেতে বসতে বললাম। এরপর যে অদ্ভূত ঘটনা ঘটল তার জন্যে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। একটা, দুইটা করে কোথা থেকে দশ-বারটা কাকা এসে দোকানের ভিতর-বাহিরে ঘিরে ধরল। কাকগুলোকে খুব হিংস্র দেখাচ্ছিল, সুযোগ পেলেই চোখ গেলে দিবে এমনভাবে ঠোঁট দিয়ে কা কা করতে লাগল। আমি ভয়ে পিছিয়ে গেলাম, হঠাৎ এই আকস্মিকতায় বোবা হয়ে গেলাম যেন। নূর ভাই খাবারগুলো কাকগুলোর দিকে ছুঁড়ে ফেলতে যেতেই আমি তার হাত ধরে ফেললাম তারপর একটা লাঠি নিয়ে কাকগুলোর সামনে গিয়ে সমানে ঘুরাতে লাগলাম। এতে কাজ হল, কাকগুলো দূরে গিয়ে কা কা করতে লাগল এবং দূর থেকে আমাদের লক্ষ্য করতে লাগল।

-দেখলেন তো? আমি আগেই বলেছিলাম।

 

আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম এবং কিছুক্ষন পর সামলিয়ে নিয়ে বললাম,

-অ্যারে আপনিই তো এর জন্যে দায়ী। প্রতিদিন খাবার দিয়ে দিয়ে কাকগুলোকে বেয়াড়া বানিয়ে ফেলেছেন।

-না তা নয়।

উনাকে ক্লান্ত ও অসুস্থ দেখাচ্ছে। আমি আবার জোর করে তাকে খেতে বসালাম।

 

-ওরা আমাকে ওদের একজন করে নিতে চাই।

-কি বলেন আবোল তাবোল।

 

আমি এবার কিছুটা বিরক্তবোধ করলাম। তিনি উত্তর দিলেন,

 

-হ্যাঁ আমি জানি। ওদের তাড়িয়ে দেওয়া ঠিক হল না। ওরা ঠিকই এর প্রতিশোধ নিবে।

এবার উনার উপর আমার রাগ হল তারপর মায়া লাগল। আমি অনেক বলে কয়ে দোকান বন্ধ করে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ভাবীকে বিশেষভাবে যত্ন নিতে বলে এলাম।

 

পরেরদিন দুপুরবেলাতেই নূর সাহেবের ফোন পেলাম। হ্যালো বলতেই তিনি উত্তর দিলেন,

 

-ওরা আজ আর আসেনি।

 

আমি খুশি হয়ে বললাম,

-বেশ হয়েছে, একদিনেই শিক্ষা হয়ে গিয়েছে।

 

তিনি কিছু বললেন না, বাই জানিয়ে রেখে দিলেন।

 

পরেরদিন অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে চলে গেলাম। একদিন কাটিয়ে পরের দুপুরে যখন ঢাকায় ফিরছি তখন তিনি আবার ফোন করলেন।

 

-আপনি কেন ওদের তাড়ালেন?

-মানে?

-ওরা আর আসছে না। ওরা ঠিক অভিশাপ দিবে আমাকে।

-আহা এই যুগে কিসব কুসংস্কারের মধ্যে বাস করছেন বুঝি না। আমি তো...

 

কথা শেষ না করতেই খুট করে কেটে দিলেন। বিপ বিপ শব্দ শুনে মোবাইলের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ভাবলাম, লোকটা এত অদ্ভূত বলেই কি আমি তাকে এত পছন্দ করি?

 

ঢাকায় ফিরে অফিসের ব্যস্ততায় চার পাঁচদিন কেটে গেল তবু উনার খোঁজ নিতে পারলাম না। ইন্টারনেটেও উনাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তেমন চিন্তা না করলেও মাথা থেকে ঘটনাটা নামাতে পারছিলাম না।

 

ছাব্বিশে মার্চে অফিস ছুটি থাকলেও একটা বিশেষ কাজ ঘাড়ে চেপে যাওয়ায় ঘুরতে ঘুরতে নূর ভাইয়ের দোকানের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। এত দূর যখন চলে এসেছি ভাবলাম দেখাটা করেই যাই কিন্তু দোকানের সামনে আসতেই দোকান বন্ধ পেয়ে থমকে দাঁড়ালাম। পাশের দোকানে জিজ্ঞেস করতেই বলল, উনার দোকান চার পাঁচ দিন ধরে বন্ধ। মালিবাগে আমার একটা কাজ থাকায় ভাবলাম কাজটা সেরে শান্তিনগরে তাকে দেখতে যাব। আসলে উনাকে দোকানে না পেয়ে আমার মনের মধ্যে সন্দেহ দেখা দিয়েছে, আমি চিন্তিত না হয়ে পারলাম না।

মালিবাগ মোড়ে পৌঁছাতেই একটা জটলার মত দেখলাম। আজকাল জটলা দেখলেই পকেটমার ধরা পড়েছে বলে ধরে নেই তবুও কৌতূহলবশত উঁকি দিলাম, দেখেই আঁতকে উঠলাম, দুজন লোক নূর ভাইকে শক্ত করে ধরে রেখেছে আর একজন লোক তাকে কিল ঘুষি মারছে। আমি দৌড়ে গিয়ে লোকটাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

-কি ব্যাপার উনাকে মারছেন কেন?

-শালায় পতাকা ছিঁড়ছে, কালকেই নতুন সিলায় আনছিলাম, সেই উত্তর বাড্ডা হতে তারে ফলো করতে করতে ধরছি। শালারে এবার মজাটা দেখাবো...

এবার উত্তর দিলেন নূর সাহেব,

-ছিঁড়েছি বেশ করেছি। শালা, বাঞ্চত, গাদ্দার, দেশকে বিক্রি করে আবার পতাকা টাঙ্গাস? শালা, আমি তোর পাছায় বাঁশ ঢুকাব, বাঞ্চত। বাঁশ চিনিস? বাঁশ?

 

আমি হতবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই নূর ভাইকে আমি চিনি না। তার ঠোঁট কেটে গেছে, মুখের লালার সাথে রক্ত পড়ছে। এদিকে লোকটা আবার মারতে উদ্যত হলেই তাকে অনেক অনুরোধ করে ছাড়িয়ে নিয়ে আসলাম তাকে। আমার হাত ধরে কিছুদূর আসার পরেই জিজ্ঞেস করলেন,

-তুই শালা আবার কেরে?

-নূর ভাই আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি মামুন।

এবার তিনি ছড়া কাটতে লাগলেন,

-চুপ শালা

 তুই ভালা

 কি করিস

 মুতা হাগা...

 

আমি যথেষ্ট আবেগ প্রবণ মানুষ হওয়ায় বর্তমান পরিস্থিতি আমাকে কাহিল করে ফেলেছে। প্রায় কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বললাম,

-নূর ভাই আপনার কি হয়েছে?

 

তিনি আমার কথা শুনতে পেলেন কিনা বুঝলাম না। আমার হাত ছাড়িয়ে রাস্তায় গিয়ে একটা প্রাইভেট গাড়ি থামিয়ে ফেলেছেন ইতিমধ্যে। গাড়ির সামনে রাখা পতাকা তুলে উচ্চস্বরে বলতে শুরু করেছেন।

 

-ওই হারামীর বাচ্চা, খানকী মাগী, গাড়িতে কইর‍্যা পতাকা নিয়া ঘুরিস, তোগো লজ্জা করে না রাজাকারের বাচ্চা, শূউর।

 

এবার গাড়ির দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে টানাটানা শুরু করে দিলেন,

 

-বাইর হ শালা, রাজাকার শূউরের বাচ্চা।

 

দরজা না খুলতে পেরে সেখানে একটা লাথি মারলেন তারপর ইঞ্জিনের উপর চড়তে লাগলেন। এসময় কোথা থেকে কিছু পুলিশ চলে এল, তাকে টেনে হিঁচড়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। নূর ভাইয়ের সেকি গগনবিদারী চিৎকার, বুলেটের মত আমার কানে এসে বিঁধছিল।

এই দৃশ্য আমার সহ্য হল না, আমি মুখে হাত চাপা দিলাম এবং একটু পরেই রাস্তার পাশেই বমি করে বসলাম। সেদিন কিভাবে বাসায় ফিরেছিলাম জানিনা। একবার উনার স্ত্রীর খবর নেওয়া দরকার ছিল তাও নিতে পারিনি। নিজেকেই যেন অপরাধী মনে হতে লাগল। অসুস্থ হয়ে দুইদিন বিছানায় শুয়ে কাটালাম।

 

দুইদিন পর অফিসের সামনে আসতেই দেখি আবার একটা জটলা এবং সেখানে পাশের দোকানের টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে নূর ভাই ভাষন দেওয়ার মত চিৎকার করছেন। তার হাতে একটা দা থাকায় কেউ সাহস করে থামাতে পারছে না, এমনকি পুলিশও ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে তার ভাষন শুনছে। তার কথা যা শুনতে পেলাম তা এইরকম,

“এই যে এই দশ তলা বিল্ডিংটা দেখতে পাচ্ছেন এইটা হল এক বেজন্মার বাচ্চার, এই শালা ছিল ফকির, হ্যার বাপ ছিল ফকির, তাইলে কি দাড়াল, এই শালা ফকিরের বাচ্চা। তাইলে এই শালার এত সম্পত্তি হইল কি কইরা, শালা এমপি হইয়া শ্বশুড়ের সম্পত্তি পাইছে, শালার আজকে কল্লা নামায় দিব, আইতে দে শালারে।”

 

আমি আজ আর নূর ভাইয়ের কাছে গেলাম না। চুপচাপ তার কথাগুলো শুনে মনে মনে ভাবলাম, নিজেকে এবার মুক্ত করতে হবে। নিরবে অফিসের ভিতরে গিয়ে রিজাইন লেটার লিখে বের হয়ে এলাম।

 

 

পরিশিষ্ট

নূর ভাইয়ের দোকানটা আমি আবার চালু করেছি। কাকগুলো ফিরে এসেছে, প্রতিদিন দুপুরে তাদের খাবার খেতে দিয়ে নিজে খেতে বসি। লেখালেখিও পুরোদমে চলছে, দুই জায়গা থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে আমাদের বেশ চলে যায়। আমাদের বলতে আমি, আমার স্ত্রী এবং নূর ভাইয়ের স্ত্রী। আমার বাসার পাশেই তাকে একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া করে দিয়েছি। মাঝে মাঝে আমার কাছে নূর ভাইয়ের খবর নিতে আসেন। কারণ আজকাল আমি সময় পেলেই নূর ভাইয়ের সাথে ঘুরে বেড়ায়। কখনো মালিবাগ মোড়ে, কখনো মগবাজার আবার কখনো শাহবাগ। তবে উনাকে বেশিরভাগ সময়ে রমনা উদ্যানে দেখা যায়। তিনি আমাকে চিনতে পারেন না, অনেক সময়ই গালি দিয়ে বসেন তবুও আমি উনার পিছনে পিছনে ঘুরি, উনার কান্ডকারখানা দেখি। অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে এখন তিনি ভাল আছেন, আমি ভাবীকে তাই বলেছি। তবুও তিনি কিছুক্ষন আমার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদেন। আমি প্রথম প্রথম উনাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতাম, এখন আর দেই না। নূর ভাইকে সবাই পাগল বললেও আমি বলতে পারি না। কাকগুলোর অভিশাপে তিনি পাগল হয়েছেন কিনা জানি না তবে পাগল হয়ে যদি সঠিক কাজ করা যায় তবে প্রত্যেক মানুষের পাগল হওয়াই উচিত।

০ Likes ১০ Comments ০ Share ৭৬৯ Views

Comments (10)

  • - ঘাস ফুল

    '৯৭ এর ঢাকাকে অসাধারণ বললে, তারও আগে এটাকে কী বলবেন রোদেলা? তবে এটা ঠিক, তখনকার জীবন যাত্রা এখনকার ঢাকার চাইতে অনেক ভালো ছিল। আমার মতে জীবনের স্বাদ নিতে হলে গ্রামে চলে যাওয়া উচিৎ। শহুরে জীবন বড় নিষ্ঠুর, একঘেয়েমিতে ভরা আর দয়া মায়াহিন। ভালো লাগলো কবিতা রোদেলা। 

    • - রোদেলা

      তার আগের ঢাকাকে নিয়ে লিখতে হোলেতো আরো আগে জন্মানো লাগতো।যাই হোক,কবিতা ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশী হলাম।

    - শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

    ভাল লাগল। ধন্যবাদ

    • - রোদেলা

      অনেক শুভেচ্ছা

    - মাসুম বাদল

    এমনই কাল্পনিক এই চলা
    বেসামাল এই বেঁচে থাকা; 

     

    কবিতা ভালো লেগেছে। শুভকামনা !!!