জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন।
কালো মেঘে ঢেকে আছে পুরোটা আকাশ। মেঘ জমেছে মনের কোণেও। আকাশের মেঘ কিছু পরেই সরে গেলেও, মনের বিষন্নতার কালো মেঘ এতো সহজেই কি তাঁকে নিষ্কৃতি দেবে?
সবাই চলে গেছে। ছুটি হয়ে গেছে। সেকশনের সবাই যাবার পরেও কিছু কাজ পেন্ডিং থেকে যায়। সেগুলো আগামীকাল করলেও চলে। কিন্তু মোবারক সাহেব কোনো কাজ আগামীকালের জন্য ফেলে রাখেন না। গত পনের বছর ধরে তো এভাবেই কাজ করে আসছেন।
একটু আগে এইচ,আর ডিপার্টমেন্ট থেকে ঘুরে এলেন। ওনাকে ম্যানেজার ডেকেছিলেন। হাতে আর চার মাস সময় আছে। বয়স ৬০ হতে যাচ্ছে এই চার মাস পর। বাধ্যতামূলকভাবে এবার অবসরে যেতেই হচ্ছে।
জানালার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজের সেকশনের দিকে ফিরলেন। এই ষ্টোরটির প্রতিটি যায়গায় রয়েছে তার হাতের ছোঁয়া-হৃদয়ের পরশ। গত পনের বছরে নিজের মেধা দিয়ে এটিকে গড়ে তুলেছেন। ইমপ্লিমেন্ট করেছেন যুগের সাথে তাল রেখে। এগুলোকে ছেড়ে চলে যেতেই হচ্ছে তাহলে! একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে কিছু জমাট বেদনাও যেন বের হয়ে সেকশনের ভিতরের আবহাওয়াকে ভারাক্রান্ত করে তোলে।
এখনো তো কর্মক্ষম রয়েছেন। নিজের দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ওদের একজন অস্ট্রেলিয়ায়, অন্যজন কানাডায় পরিবারসহ ভালোই রয়েছে। বৃদ্ধ বাবা-মাকে কত বলেছে ওদের সাথে চলে যেতে। কিন্তু মোবারক সাহেব স্মিত হেসেছেন শুধু। এতেই মেয়েরা বুঝে গেছে তার নেতিবাচক মনোভাব।
ইচ্ছে করলে অনেক টাকা তিনি অবৈধ ভাবে রোজগার করতে পারতেন। পার্চেজ এর দায়িত্বও তার কাছে। একই সাথে দুটো দিকই সামলে এসেছেন সাফল্যের সাথে। কিন্তু দু'নাম্বারি নিজেও করেন নাই, অন্যদেরও করতে দেন নাই। তাই আজ যাবার বেলায় একেবারে 'শুন্য' হাতে চলে যেতে হচ্ছে। গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে হাসিনা বেগম রয়েছেন ওনার সুখ-দুঃখের সাথী হিসেবে। এই চাকরি থেকে 'অবসর' নেবার পরে কি করবেন? ভাড়া বাসায় থাকেন। দুজনের থাকা-খাওয়ার খরচ আর ঘরভাড়ার টাকাটা তো মাস গেলে দিতেই হবে। বড় মেয়ে প্রথমদিকে টাকা পাঠাতো। বার দু'এক ফিরিয়ে দেবার পরে আর ফোনে একটু কড়া ভাবে নিষেধ করাতে সেগুলো আসাও বন্ধ হয়েছে।
এ দেশ যখন স্বাধীন করার প্রয়োজন হয়েছিল, অন্য যুবকদের মতো তিনিও কোনো কিছু না ভেবেই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। অসহ্য কষ্টকর দীর্ঘ নয়টি মাস প্রচন্ড শারীরিক ও মানসিক কষ্টে জর্জরিত হয়েছেন। তবে অন্য সবার মতো তিনিও কোনো কিছু পাবার আশায় করেননি। চিন্তা ভাবনার এই পর্যায়ে একটু হোঁচট খেলেন। কিছু পাবার আশা না করেই মানে? কিছু পাওয়ার আশা তো ছিলই। মোবারক সাহেবের ছিল স্বাধীন মুক্ত ভূমিতে ইচ্ছেমত বিচরণ করার অনুভূতি লাভের আশা। কেউ কেউ নিজের যৌবনের ধর্মের ডাক শুনে নিজেকে শান্ত করাতে গিয়েছিল। কেউ বা বাধ্য হয়েছিল... বাঁচার জন্য অনেকেই যুদ্ধে গেলো। কিন্তু ফিরে এসে সবাই কিন্তু হৃদয়ের ভিন্ন ভিন্ন তাড়নায় নয় মাসের নিজ নিজ আত্মত্যাগের বদলা ঠিকই নিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। যে যেভাবে পারে। এ সময়েও মোবারক সাহেব নির্লিপ্ত রইলেন। কারো কাছ থেকেই কিছুই চাইলেন না। সামান্য একটি কাগজ যা তাদের নয় মাসের আত্মত্যাগের মূল্যায়ন স্বরূপ দেয়া হয়েছিল, সেটিও নিলেন না। একটি ফুলকে বাঁচাতে যুদ্ধ করেছেন, তাই বলে কি ফুলের সৌরভ পেতে তাকে ঐ কাগজের লেবেল গায়ে জড়িয়ে রাখতে হবে? দেশ মাতৃকার বুকে পরম মমতায় আশ্রয় নিয়ে, এ দেশের আলো-বাতাস উপভোগ করতেই মাকে বিপদমুক্ত করেছেন। এটি ছিল দায়িত্ব ও কর্তব্য। কিন্তু সে জন্য একটি সার্টিফিকেট নেয়া নিজের মাকে বিক্রী করে সুবিধাভোগের সামিল নয় কি?
এজন্যই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনো ধরণের সার্টিফিকেটের ব্যাপারে কোনো আগ্রহই ছিল না তার। আজ সরকার বদলের সাথে সাথে এই সার্টিফিকেটের রমরমা বাণিজ্য দেখে বড্ড দুঃখ হয় তার। একটি চেতনা কিভাবে সামান্য একটি সার্টিফিকেটকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে!
সেকশনের মেইন ডোর বন্ধ করে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে যেতে যেতে ভাবলেন, তিনি কি ভুল করলেন? এখন একটি সার্টিফিকেট থাকলে কি এরকম চিন্তা করতে হতো? সরকার এখন তৃতীয় প্রজন্ম পর্যন্ত এই সুবিধা বিস্তৃত করেছে। দফায় দফায় ভাতা বাড়িয়ে এখন সেটি বেশ একটি ভালো অবস্থানে এসেছে।
নিজের এ ধরণের চিন্তায় নিজের কাছে লজ্জা পেলেন। এ কি ভাবছেন? তাহলে অন্যদের সাথে তার পার্থক্য রইলো কোথায়? আবার ভাবেন, অন্যদের মত 'উপরি আয়ের' দিকে না গিয়ে সৎ থাকাটাও কি সঠিক ছিল? সিকিউরিটিদের সালামের জবাব দিতে গিয়ে ভাবনা একটু ছিন্ন হলো। উত্তর দিতে গিয়ে নিজের উত্তরও পেয়ে গেলেন। আল্লাহপাক তো রয়েছেনই। তাকে এখনো কর্মক্ষম এবং সুস্থ রেখেছেন। আল্লাহর দুনিয়ায় একটা না একটা কাজ পাবেনই ইনশা আল্লাহ।
বিশাল কারখানার মেইন গেইট দিয়ে একজন মোবারক সাহেব বের হয়ে এলেন। মুখে হাসি আর অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস। হাতে আর চার মাস সময় আছে, এরপর অবসরে যাবেন- এমন ষাট বছর ছুঁই ছুঁই একজন মানুষ আর পেছনে ফিরলেন না। সোজা রাস্তাটি একদম সামনে চলে গেছে। জীবনও ঐ দিকে। একেবারে সরল পথ। এ পথে চলতেও হবে একদম সহজ ভাবে। জীবনের সরল পথেই জীবনকে নিয়ে যাওয়া উচিত। তিনিও সেদিকে পা বাড়ালেন।।
Comments (33)
ভালো লাগল।
ধন্যবাদ রাইহান আপু ! কিপ ইন টাচ!
ভোট রইল। ২ নং ক্যাটাগরিতে ফেসবুক গল্পটি পড়ার অনুরোধ রইল।