রাত ১২ টা। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ফাহিদ এখনও ঘুমায়নি, ঘুম আসছে না তার চোখে। চলে আসে বাইরে। তাদের সেই পুকুর চালায়। পুকুর চালায় মাধবী, হাসনাহেনা, বেলী, রজনীগন্ধা, শিউলী এজাতীয় নানা রকম ফুল। সব ঋতুতেই ফুল পাওয়া যায় এখানে। তাদের বাড়ির চারপাশ দেয়াল ঘেরা, মাঝেই পুকুর। পুকুরের তিন পাশে নানান বৃক্ষ জাতীয় ফুলের গাছ আর ফলের বাগান, অপর পাশে তিনটি চৌচালা ঘর। সবকয়টি ঘর আধাপাকা। নানা-রং, নানা ঢংএ সাজানো, যেন পার্ক। এছাড়া ও রয়েছে বিভিন্ন স্থানে বসার জন্য পার্টিশন। ফাহিদের বাবা সোহেল সাহেব বড় যত্ন করে গড়ে তুলেছে এ বাগান বাড়ি। অনেক জায়গা নিয়ে অবস্থিত এ আকর্ষণীয় বাড়িটা, অনেক সময় ফিল্মের শুটিং করার জন্য চিত্র নায়ক, নায়িকাদের সমাগম হয়ে থাকে এ পরিবেশে। ফুলতুলী গ্রামের নামকরণ অনেকটা এ বাড়ির জন্যই সার্থক। রাত অনেক হয়েছে। তবু এ শীতে বাগানের এক পাশটায় জ্যোৎস্নার আলোতে বসে ফাহিদ ভাবছে তার বাবার কথা। বাবা সোহেল সাহেব বাড়ি এসেছে। তাঁর সাথে ঢাকা যাবে ফাহিদ। সে একজন স্কুল মাস্টার। ঢাকা হাম্মাদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণিত শিক্ষক। বহু সম্পাদকের সাথে পরিচিত তিনি। প্রতিবার সে বাড়িতে এসে ফাহিদের একটি করে কবিতা নিয়ে যায় প্রকাশ করতে। এইতো কিছুদিন আগে প্রকাশ পেয়েছে এই কবিতাটি :
কে আমাকে চিনে চাও নিতে-
তেমনতো নয় মন, ফুটেছে রং তুলিতে।
কেন শুধু খোঁজ তুমি
এ ঠিকানার করে সন্ধান,
কি আশায় মম জয়-
চেলে নির্ভুল অভিযান।
লোভের টানে ললে মোরে
সোনার তরী করে,
সোনার ফসল ফলবে কি আর-
রইবে শূন্য পড়ে॥
‘সোনার তরী’ কবিতায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যা না- পাওয়ার বেদনায় ক্ষত-বিক্ষত। ফাহিদ এই কবিতায় তা নিরর্থক ও অকারণ বলে উল্লেখ করে। ফাহিদ বলতে চায়- ‘তোমরা আমাকে নয়, আমার কর্ম (ফসল) কে গ্রহণ কর’। কারণ আমাকে গ্রহণ করলে আমি আর উৎপাদন করতে পারব না, যা তোমরা চাও। তখন আমি পরাশ্রী হিসেবে গণ্য হব। ব্যাপক তোল-পাল তুলেছে তার এ কবিতা। বিশেষ করে তরুণ ছাত্র সমাজে। অনেকে চিঠি লিখেছে সম্পাদক বরাবর এই লেখকের বই ছাপানোর জন্য। তাইতো সম্পাদক আজিজুল হক ওরফে রানা সাহেব উৎসাহ দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে তার বন্ধু সোহেল সাহেবকে। নানা রকম চিন্তা ভাবনার মধ্যে কেটে গেল ফাহিদের রাত। ভোর হল। পূর্ব দিগনে- লাল আভা দেখাদিতেই দেখা গেল বাইরে অপরা ফুল কুড়াচ্ছে। গেট ঘুরে ফাহিদ এগিয়ে আসল সেখানে।
তুমি নিশ্চয় অপরা?
হ্যাঁ, আর আপনিতো ফাহিদ ভাই
হ্যাঁ ঠিকই ধরেছো, এত সকালে ফুল দিয়ে কি করবে?
সকালেই তাজাফুল পাওয়া যায়, তাছাড়া আপনি অবশ্যই জানেন শখের তোলা আঁশি টাকা।
তাই বলে এত দূর থেকে?
সে আপনি বুঝবেন না, এবার বলুন আপনি কই থেকে?
হাত দিয়ে অন্য একটা বাড়ি নির্দেশ করল ফাহিদ। অপরাকে দেখে স্বপ্নের কথা মোচড় দিয়ে উঠল ফাহিদের মনে। ফাহিদ যেন উদাসীন হয়ে গেল। সে বলতে লাগল,
জান অপরা, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।
থ্যাঙ্ক ইউ।
অপরা আবার ফুল কুড়াতে শুরু করল। ফাহিদ একটু সরে তার সামনে গিয়ে আবার বলতে লাগল,
ইয়ে মানে, ইতিমধ্যে আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।
একি বলছেন আপনি!
হ্যাঁ অপরা, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তোমাকে প্রথম দেখার পর থেকে...
থাক, থাক আর বলতে হবে না। আপনাকে আমি একজন সহজ সরল লোক ভেবেছিলাম। কিন্তু আজ জানলাম আপনিও সবার মত...
না-অপরা, না, এই বুকে হাত দিয়ে দেখ না সে শুধু তোমাকে চায়। অপরার হাতটা তার বুকের মাঝে নিয়ে দেখাতে যাচ্ছে ফাহিদ। এমন সময় অপরা হাতটা টান দিলে ফাহিদ পড়ে গেল অপরার উপর। লম্পট-বদমায়েশ। আমার ভাইকে বাঁচানোর পিছনে এই খারাপ উদ্দেশ্য তোর। চিৎকার করতে না করতেই উত্তম-মধ্যম হয়েছে একপালা। দৃশ্যটা সবার কাছে কেমন যেন দেখিয়ে ছিল, তাই ইচ্ছে মত প্রহারের পর যে যার কাজে ফিরেছে আবার। আশে-পাশে কেউ নেই। ফাহিদ মাটির বুকে লুটিয়ে আছে। স্বপন এদিক দিয়ে আসতেছিল। পথে ফাহিদকে দেখে নিয়ে যায় বাড়ি। দৌঁড়ে আসে হাযেরা বেগম,
কি হয়েছে আমার ছেলের?
তেমন কিছু বলতে পারব না, তবে পথের মাঝে দেখলাম আবল-তাবল বকছে।
জলদি ডাক্তার নিয়ে আস, যা স্বপন।
চলে যায় স্বপন। বাবা সোহেল সাহেব কাছে এসে বসল। শরীরে হাত দিয়ে বুঝতে পারল সে, প্রচুর মারা হয়েছে তাকে। কিন্তু কি এমন কাজ করছে তার ছেলে যে, যার কারণে মার খেতে হল তাকে। প্রশ্নটা মনের মাঝেই পড়ে রইল তার। বাড়িতে ডাক্তার আসল। গ্রামের নামকরা ডাক্তার সরাফউদ্দিন আলী বললেন,
তেমন কিছু হয়নি। হয়তো জ্বর, বিষ-ব্যথা হতে পারে। আমি ঔষধ দিয়ে যাচ্ছি, ওকে রেস্টে রাখবেন। আর হ্যা, কোন সমস্যা হলে খবর দিবেন। আমি তাহলে আসি সোহেল সাহেব। হাত নেড়ে বিদায় জানাল সোহেল সাহেব। ডাক্তার চলে যাওয়া মাত্র সোহেল সাহেব ফাহিদকে জিজ্ঞাসা করতে থাকে ‘তোকে কে মেরেছে? কেন মেরেছে’? ফাহিদ হা-করে তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে। হাযেরা বেগম কাঁদছে আর বলছে ‘কি হয়েছে তোর’? কেনইবা ওরা এভাবে মারল তোকে? স্বপন তার মা-বাবাকে আসে- করে সরিয়ে নিয়ে বলল, আপনারা কোন চিন্তা করবেন না। আমি জিজ্ঞাসা করে পরে সব আপনাদের বলব। তার কথামত সরে পরে তাঁরা।
পরদিন সকাল বেলা, আবার এসেছে স্বপন। স্বপন দিনে দিনে অনেক গভীরে চলে যাচ্ছে ফাহিদের। ফাহিদও সহজ ভাবে মেনে নিয়েছে। স্বপন ছাড়া আর কেউ তেমন তার সাথে মিশে না। আজ অনেকটা সুস্থ্য ফাহিদ। স্বপন কাছে আসলে ফাহিদ বলল, চল দোস্ত, পুকুর চালায় গিয়ে বসি। এতক্ষণে ওখানে মিষ্টি রোদ এসেছে নিশ্চয়।
দোস্ত যখন বলেছিস তখন আর কি করার। তবে একটা শর্ত আছে, তোকে যে একটা সত্য কথা বলতে হবে।
সেতো তুই বিশ্বাস করবি না।
কেন?
কেন আবার কি? কিছু কিছু কথা আছে ডিসট্রাস্টফূলি। আমার কথাও সেই রকম।
তবুতো বল শুনি।
তার আগে তোকেও কথা দিতে হবে, ‘মা-বাবাকে বলা যাবে না’। মা-বাবা আমাকে প্রচুর ভালোবাসে, এরকম কথা শুনলে তাদের মাথা হেঁট হয়ে যাবে।
ঠিক আছে, বলা না গেলে বলব না।
বিস্তরিত খুলে বলে ফাহিদ। স্বপ্ন থেকে শুরু করে গতকালের ঘটনা পর্যন্ত যাবতীয় সব কথা শুনে বিস্মিত হয়ে যায় স্বপন। ফাহিদের মত ছেলে এমন করতে পারে তা ভাবতে পারেনি স্বপন। সত্যি অবিশ্বাস্য কান্ড। তবু মেনে নিতে হল তাকে কারণ এটাই বাস-ব। ফাহিদ স্বপনের দিকে তাকিয়ে আছে।
স্বপন বলতে শুরু করল,
যে তোকে ভালোবাসে না, তার জন্য আবার কি?
নারে স্বপন, না। ওকে আমার কেন যেন ভালোলাগে।
ও যদি তোকে পছন্দ না করে, ও যদি তোকে কষ্ট দিতে পারে। তবে তুই কেন পারবি না? গাছের সাথে সংযুক্তহীন পাতা যেমন শুধু আবর্জনা হিসেবে গণ্য হয়, ঠিক তেমনি একতরফা প্রেম সমাজের জন্য আবর্জনা। সমাজে অশান্তি
আসে, সৃষ্টি হয় বিশৃঙ্খলা। মানুষ এসব ঘৃণা করে।
কিন্তু আমি কি ওকে ভুলতে পারব?
এটা তোর আবেগের কথা ফাহিদ। একতরফা ভালোবাসা আসলে কোন ভালোবাসাই না। আমি তোকে আগেই বলে রাখছি, এতে কিন' তোকে কাঁদতে হবে। ভালোবাসা যেমন হাসাতে পারে তেমনি কাঁদাতেও পারে।
সে দেখা যাবে। বলেই ওঠে দাঁড়াল দু’জন। ফাহিদের রুমের দিকে পা বাড়াল তারা। কিন্তু না, তা আর কই হল। তার আগে ফাহিদের কাঁধে হাত রাখল সোহেল সাহেব। চমকে উঠল ফাহিদ, সোহেল সাহেব বলতে লাগল,
বাবা, আমি তাহলে যাই, আবার এসে তোমাকে নিয়ে যাব।
না-বাবা আমি যাব।
চলে যায় পুকুরে গোসল করতে। চট-জলদি তৈরি হয়ে যায় ফাহিদ। এই ফাঁকে ঘটনাটা জিজ্ঞাসা করে সোহেল সাহেব। স্বপন জানায় সড়কের পাশে বৈদ্যুতিক তারের সক্ খেয়েছিল। লোকজন তাকে লাঠি দিয়ে সক্ বিচ্যুতি করেছে। লজ্জায় কথাটা বলতে পারছে না সে। হাযেরা বেগমও শুনে নেয় কথাটা। হাজার দুঃশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেয়ে যায় তাঁরা দু’জন। কিছুক্ষণের মধ্যে বাবার সাথে রওয়ানা হয়ে যায় ফাহিদ। পাড়াতুলী গ্রামের সেই রাজ পথের দিকে হাঁটছে তারা। মাধ্যমিক স্কুল এর নিকট থেকে বাস যোগে ঢাকা যাবে তাঁরা। পিছন থেকে ফাহিদ বার বার তাকাচ্ছে সর্দার বাড়ির পুকুরের দিকে।
পুকুরের পাশেই তালগাছ। পুরনো ইতিহাসের সাক্ষী। এখনো লোকমুখে প্রবাদ আছে সেই নবু ডাকাতের। ডাকাতদের মধ্যে সে ছিল সর্দার। তার আস্তানা ছিল এই বাড়িটা, যা এখন স্পষ্ট নয়। তার ছিল একটি মাত্র মেয়ে। সেও আবার জন্মখোড়া। মেয়েটির বয়স আনুমানিক ষোল-সতের। মেয়েটির বিয়ে দিতে সে এ স্থানে এসেছিল বলে অনেকের ধারণা। টাকা পয়সার কমতি না থাকলেও ঐ এক ডাকাত শব্দটা, আর সেই সাথে যোগ হয় মেয়ে জন্মখোড়া। এমন কথা শুনে কেউ কি সহজে গ্রহণ করবে মেয়েকে? এসব চিন্তা থেকেই তার এ স্থানান্তর। তবু যদি ফায়দা হতো। মেয়েটি সারা দিনরাত নিজ বাস ভবনেই থাকত। আশে পাশের কারো সাথে তাদের সেরকম কোন লিংক ছিল না। নবু ডাকাতকে ডাকাত বললে হয়তো তার মানের একটু কমতি পরে কারণ সে ডাকাতি করত ভিনদেশে। এ পরম সত্যটা গ্রামবাসি যেদিন জেনেছিল, তারপর আর তার সন্ধান মেলেনি। কোথায় যে উদাও হয়েছে তা খোদা মালুম। অল্প কিছু দিনেই যে বাড়িটা সুন্দর করে সাজিয়ে ছিল নবু ডাকাত, সেই ফযিলতে তৈরি এই পুকুর। যা এখন সর্দার বাড়ির পুকুর নামে পরিচিত। সেই সর্দার বাড়ির পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছে ফাহিদ। মাঝে মাঝে অপরাদের বাড়ির আঙ্গিনায়। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। শূন্য বাড়ি। এদিকে অনেক দূর এগিয়ে গেছে সোহেল সাহেব। দৌড়ে গিয়ে নিরাশ মনে আবার হাঁটতে লাগল বাবার সাথে ॥
(পূর্ব নামঃ এ ড্রাই ট্রি , প্রকাশকালঃ২১শে বইমেলা-২০১০ইং )
Comments (3)
অসাধারণ।
অসংখ্য ধন্যবাদ
ভালো লাগলো।
অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া