কালাম আজাদ
সুরেশ সেন। পুরো নাম সুরেশ চন্দ্র সেন। অগ্নিযুগের বিপ্লবী। সশস্ত্র বিপ্লবী। অভিভক্ত বাংলার বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী সহযোদ্ধা। তিনি ছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী স্টুডেন ক্যাডারও। তাঁর কাজ ছিল তরুণ যুবক ও ছাত্রদেরকে বিপ্লবী দলে এনে বিপ্লবীমন্ত্রে দীক্ষিত করা। এমনকি নিজ দলের বিপ্লবীদেরকেও তিনি বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন কলা-কৌশল বিষয়ে পূর্ণেন্দু দস্তিদারের সহযোগী হিসেবে প্রশিক্ষণ দিতেন। স্কুল অধ্যয়নকালেই তিনি মাস্টারদা সূর্য সেনের ‘অনুশীলন’ ও যাত্রিক বিপ্লবী দলে যোগদান করেন।
কলেজে বিএ পড়ার সময় ১৯৩০সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টার দা সূর্যসেনের নেতৃত্বে পরিচালিত ঐতিহাসিক জালালাবাদ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করায় এবং যুব বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পূর্ণেন্দু দস্তিদারকে কলকাতায় গ্রেফতার করার অন্যান্য বিপ্লবী ন্যায় তাকেও খুঁজতে থাকে বৃটিশ পুলিশ। বৃটিশ পুলিশ চোখঁকে ফাঁকি দিয়ে গ্রেফতার এড়াতে কক্সবাজার মহকুমার মহেশখালীতে আত্মগোপন করেন। ১৯৩১ সালে মহেশখালীতে আত্মগোপন থাকা অবস্থায় বৃটিশ পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। দীর্ঘ নয় বছর সময় তাঁকে কাটাতে হয় জেলে।
সুরেশ সেন। একজন বিপ্লবী রাজনীতিবিদ ও সংস্কৃতিকর্মী। স্বদেশ, স্বাধীনতা, মাটি ও মাটি মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার জন্যে ভারত উপমহাদেশের বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে সশস্ত্র বিপ্লববাদী লড়াই-সংগ্রাম সংগঠিত হয় এবং যার ধারাবাহিকতায় ভারত স্বাধীন হয়, তাঁর মূলে যে সকল বিপ্লবীর নাম সর্বজন স্বীকৃত তাঁদের মধ্যে সুরেশ চন্দ্র সেন একজন অন্যতম বিপ্লবী। জন্ম থেকেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মেধা প্রজ্ঞা সততায় আদর্শে এখনো কিংবদন্তী পুরুষ হিসেবে সবার মাঝে বেঁচে আছেন অগ্নিযুগের এই বিপ্লবী পুরুষ।
পরাজয়ের শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার রক্ত সূর্য ছিনিয়ে আনতে সুরেশ চন্দ্র সেন বেশ কয়েকবার সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। একবার বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে অসহযোগ আন্দোলন, ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের রক্তঝরা দিনে তথা ঐতিহাসিক জালালাবাদ যুদ্ধ, ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং কালজয়ী ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে। একজন বিপ্লবী হিসেবে সুরেশ চন্দ্র সেনের জীবনের প্রতিটি সিঁড়ি, অধ্যায় তাৎপর্যপূর্ণ এবং শিক্ষণীয়। সুরেশ চন্দ্র সেন যে একদিন সন্দীপন সাহসী মানুষ হিসেবে পরিচিতি হবেন, তার পরিচয় তিনি ছোটবেলা থেকেই দিয়েছিলেন।
সুরেশ চন্দ্র সেনের জন্ম ১৯০৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। চট্টগ্রাম জেলার পটিয়ার থানার অন্তর্গত বোয়ালখালী (বর্তমানে একটি উপজেলা) থানার সরোয়াতলী গ্রামে। তাঁর বাবা ঈশ্বর চন্দ্র সেন, মাতা বামা দেবী সেন। অঢেল বিত্তবৈভবের অধিকার পিতা ঈশ্বর চন্দ্র সেনের একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি। তাঁর মা বামা দেবী সেন। তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমী নারী। তার উদারতা ও দেশপ্রেম প্রতিটি সন্তানের মাঝে প্রভাব বিস্তার করে। তেমনি প্রভাব পড়েছিল সুরেশ চন্দ্র সেনের উপর। ঘরের একমাত্র সন্তান হিসেবে তার যে ধরনের উষ্ণ স্নেহের অধ্যায় শুরু করার কথা ছিল সে আড়ম্বরতা তার জীবনে খুব একটা ঘটেনি। পিতার অঢেল বিত্তবৈভব থাকলেও ঈশ্বর চন্দ্র সেন সুরেশ সেনকে গ্রামের সাধারণ মানুষের ছেলের মতো বড় করেন। জ্ঞান প্রজ্ঞা মানবতা কল্যাণবোধের নীতি নৈতিকতা নিয়ে তার জীবন শুরু হয়েছিল। প্রচন্ড মেধার কারণে তিনি শৈশব থেকে গ্রামের স্কুলের সবার চোখে পড়েন। পিতা-মাতা চাইতেন সুরেশ চন্দ্র সেন যেন বিদ্যান এবং কৃতী মানুষ হিসেবে বড় হয়ে বংশের মুখ উজ্জ্বল হয়। যার জন্য শৈশব থেকেই তাঁর জীবনটা অন্যভাবে শুরু হয়। সে কাকডাকা ভোরে উঠে ধর্মীয় বন্দনা, শরীর চর্চাসহ পাঠাভ্যাস করা ছিল তাঁর নিত্যদিনের কাজ। তারপর স্কুলে যাওয়া এবং ফিরে আসাও ছিল নিয়ম মতো। বিদ্যালয়ের গরিব সহপাঠীদের সাথে বিশেষভাবে তিনি মিশতেন। তাদের দুঃখ-কষ্ট অনুভাব করে নিজেরসহ বাবা মা থেকে বই কলম খাতাসহ কাপড় চোপড় দিয়ে তাদের সহযোগিতা করতেন। নিজের পাঠানো খাবার সবার মাঝে ভাগ করে খেতেন। গ্রামের সাধারণ মানুষের সাথে মিশে তাদের সুখ-দুঃখ অনন্দ-বেদনার সাথে নিজের জীবনকে মিশিয়ে ছিলেন। একজন মানবিক মানুষ হিসেবে তার প্রভাব তার উপর সবসময় পড়েছে।
সুরেশ সেনের পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে, মা বামাদেবী সেন ও বাবা ঈশ্বর চন্দ্র সেনের কাছে। শৈশবে তার শিক্ষা জীবন চট্টগ্রামে শুরু হয়। স্কুল পড়াকালীন সময়ে তিনি রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। দুরন্ত চঞ্চল মেধাবী এই বালক মাস্টার দা সূর্য সেনরে সংস্পর্শে ভারতমাতাকে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্যই মূলত: রাজনীতির সাথে যুক্ত হন ঐ সময় মাস্টারদা সূর্যসেনের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে স্বদেশী আন্দোলনের সাথে তিনি যুক্ত হন। গ্রামে গ্রামে তরুণদের সংগঠিত করে স্বাধীন জন্মভূমির স্বপ্ন দেখার কাজ তাঁরা শুরুকরেন। যেটা এখনো যেকোন দেশের স্বাধীনতা এবং মুক্তির মন্ত্র হিসেবে মানুষকে সবসময় অনুপ্রেরণা যোগায়। ১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের সময় স্কুলে পড়াশুনা করেন। ঠিক ওই সময় মাস্টার দা সূর্য সেন পড়াশুনা জীবনের ইতি ঘটিয়ে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলে মাস্টারী শুরু করেছেন। ওই বছর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ অসহযোগ আন্দোলনের কাজে চট্টগ্রাম আসেন। এ উপলক্ষে এক বিরাট জনসভা হয়। এই জনসভায় চট্টগ্রামের স্কুল-কলেজের ছাত্ররা যোগ দেন। এতে সুরেশ চন্দ্র সেও ছিলেন।
এই জনসভায় বসে চট্টগ্রামের প্রায় সকল দেশপ্রেমিক শিক্ষক, রাজনীতিক, সংগঠক, যারা ব্রিটিশ সরকারের অধিনে চাকুরীরত ছিলেন, তারা চাকুরী ছেড়ে দিয়ে অসযোগ আন্দোলনে যুক্ত হন। এই সময় মাস্টার দা সরকার স্কুলের চাকরী ছেড়ে দেন। ওই বছর অসহযোগ আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামে স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় একটি জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। তখন সূর্যসেন এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এটি উমাতারা স্কুল নামে পরিচিত হয়। এই সময় তিনি মাস্টারদা নামে পরিচিত হতে থাকেন। তিনি ছাত্রদেরকে স্নেহ-ভালোবাসা দিয় জয় করতেন। আর তাই ছাত্ররাও তাঁকে অত্যন্ত ভক্তি--শ্রদ্ধা করত। এক সময় এই স্কুলই তাঁর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ছাত্রদের সামনে তিনি তুলে ধরতেন স্বাধীনতার আহ্বান ‘তোমাদের বিদ্যার্জন, তোমাদের দৈনন্দিন জীবনধারণ, তোমাদের ভাবী জীবনের স্বপ্ন ও চিন্তার মধ্যে সবকিছুর ঊর্ধ্বে মনে একটি কথাকে কি প্রোজ্জ্বল করে রাখতে পারবে থ পরাধীনতার অভিশাপ থেকে, ইংরেজের পরাধীনতার পীড়ন থেকে এই দেশকে মুক্ত করাই তোমাদের ব্রত, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য? (সূর্যসেন স্মুতি: বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রাম স্মৃতিসংস্থা, কলকাতা)।
কলেজে পড়ার প্রথমলগ্নে মাস্টারদা সূর্যসেনসহ বিভিন্ন কৃতী মানুষের সংস্পর্শে তাঁর জীবনের নতুন দুয়ার খুলে যায়। লেখাপড়ার সাথে সাথে মুক্তবুদ্ধির জ্ঞানচর্চা এবং মানবিক মূল্যবোধকে নিজের জীবনের আদর্শ হিসেবে বেছে নিয়ে ছিলেন। ঐ সময় মাস্টারদা সূর্যসেনের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে স্বদেশী আন্দোলনের সাথে তিনি যুক্ত হন। গ্রামে গ্রামে তরুণদের সংগঠিত করে স্বাধীন জন্মভূমির স্বপ্ন দেখার কাজ তাঁরা শুরু করেন। যেটা এখনো যেকোন দেশের স্বাধীনতা এবং মুক্তির মন্ত্র হিসেবে মানুষকে সবসময় অনুপ্রেরণা যোগায়।
১৯২১-২৪ সাল পর্যন্ত অসযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে মাস্টার দা চট্টগ্রামের প্রায় ছাত্রদের কাছে প্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠেছেন। এই অসংখ্য ছাত্রদের মধ্যে আবার হাতে গোনা কয়েকজন তার বিপ্লবী দলের সাথে পরিচিত ছিলেন। এদের মধ্যে সুরেশ সেন ছিলেন অন্যতম। ১৯২৩ সালে তিনি মাস্টার দা’র সংস্পর্শে এসে বিপ্লববাদী দলে যুক্ত হন। দেশের স্বাধীনতার জন্য দৃঢ়চিত্তে শুরু করেন বিপ্লবী দলের কর্মকান্ড। পড়াশুনা আর রাজনীতির অধ্যায়ন ছিল তাঁর ছাত্র জীবনের একমাত্র কাজ। তখন বিপ্লবী দলের সাথে তার গড়ে উঠেছে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। এত অল্পবয়সে তিনি হয়ে উঠেছেন বিপ্লবী দলের অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য এক সদস্য। কিন্তু মজার বিষয় হলো তার আচরণ ও কথাবার্তায় বুঝার কোনো উপায় নেই যে, তিনি বিপ্লবী দলের সদস্য। শুধু বিপ্লবী দলের সদস্যরাই জানতেন।
১৯২৪ সাল। ভারত উপমহাদেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। সর্বত্র সংগঠিত হচ্ছে সশস্ত্র বিপ্লববাদী সংগঠন। চট্টগ্রাম রেলওয়ে ডাকাতি, বঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক ডাকাতি ও বিপ্লববাদীদের সশস্ত্র কার্যকলাপের কারণে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে ব্রিটিশ “বেঙ্গল অর্ডিনান্স” নামে এক জরুরি আইন পাশ করে। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল “রাজনৈতিক কার্জকলাপের জন্য সন্দেহভাজনদের বিনা বিচারে আটক রাখা”। এই আইন পাশ হওয়ার পর ব্রিটিশ সশস্ত্র বিপ্লববাদীদের গ্রেফতার করা শুরু করে।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সূর্য সেন সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করেন। ইংরেজদের সাথে যুদ্ধকালীন সময়ে চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহীরা বৃটিশদের হাত থেকে বীর চট্টলাকে ৪ দিন মুক্ত এবং স্বাধীন করে রাখে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে বিপ্লবী সুরেশ চন্দ্র সেনসহ একদল যুব বিদ্রোহী চট্টগ্রামে বৃটিশ পতাকা (ইউনিয়ন জ্যাক) নামিয়ে সর্বভারতীয় স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার ১৮ এপ্রিল যুববিদ্রোহ বা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনাকে ‘ভারতের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে সাহসিকতাপূর্ণ কাজ’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। “যা ছিল দেড়শত বছরের ইতিহাসের মধ্যে ইংরেজ জন্য খুবই অপমানজনক ঘটনা। ইংরেজ বাহিনী এদেশের মানুষের কাছে প্রথম পরাজয়”।
প্রায় ২৫ বছর বয়সে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল বৃটিশ বিরোধী ঐতিহাসিক জালালাবাদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করার পূর্ব প্রস্তুতি পর্বের সকল কাজের সাথে সুরেশ চন্দ্র সেন যুক্ত ছিলেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করার ব্রিটিশ পুলিশ বিপ্লবীদের গ্রেফতার করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। বিপ্লবী দলের অনেকেই চট্টগ্রামের অনন্ত সিং, গনেশ ঘোষ, আনন্দগুহ, মাখম ঘোষালসহ কয়েক জন বিপ্লবী কলকাতায়, সুরেশ চন্দ্র সেন, জিতেন নন্দীসহ অনেকেই বিপ্লবী রামু, কুতুবদিয়া-মহেশখালী এবং উখিয়া উপজেলায় আত্মগোপন করেন। সশস্ত্র যুদ্ধকে আরো বৃহত্তর পর্যায়ে সংগঠিত করার দায়ে ১৯৩১সালের মধ্যবর্তী সময়ে মহেশখালী আত্মগোপন কালে তিনি বৃটিশদের হাতে বন্দি হন। পরবর্তীতে প্রহসনমূলক বিচারে ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য সুরেশ চন্দ্র সেন একটানা দীর্ঘ নয় বছর কারাভোগ করেন। আলীপুর জেল, বকসাদুয়ারা ক্যাম্প, বহরমপুর জেলসহ ভারতের বিভিন্ন কারাগারে তাঁর কারাজীবন কাটে। জেলে থাকা অবস্থায় রেকর্ড পরিমাণ মার্কস নিয়ে তিনি প্রথম শ্রেণীতে বি.এ এবং ল (আইন) পাশ করেন। জেল থেকে বের হয়ে এসে তিনি আইন পেশা এবং রাজনীতির সাথে ভালোভাবেই যুক্ত হন। মাস্টারদা সূর্যসেনের ফাঁসির পর বিপ্লবীরা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। কমিউনিস্ট পার্টি যে পথে দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে, সেই পথই ঠিক মনে হওয়ায় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে ১৯৪৩ সালের মহামারী বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় কক্সবাজার থেকে তিনি কাজ করেছেন। ইতিহাসে মন্বান্তরের সন হিসেবে পরিচিত এ দুর্ভিক্ষের সময় কমিউনিষ্ট পার্টি সারা দেশব্যাপী লঙ্গরখানা খুলে বুভুক্ষু মানুষকে বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করে। এই দুর্ভিক্ষ থেকে মানুষকে বাঁচাতে চট্টগ্রামের পূর্ণেন্দু দস্তিদারের সাথে পুরো চট্টগ্রাম জেলা জুড়ে বিশেষ করে কক্সবাজারে অমানুষিক পরিশ্রম করে দুর্ভিক্ষ লাঘবে কাজ করেন।
১৯৪৭ এর দেশভাগের সময় সুরেশ চন্দ্র সেনের ত্যাগ এবং অসাধারণ মেধার কারণে তৎকালীন ভারতের কেন্দ্রীয় নীতি নির্ধারকরা তাঁকে ভারতে এসে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিতে অনুরোধ জানান। কিন্তু বাংলাদেশের মাটির টানে সুরেশ চন্দ্র সেন ভারতে যেতে এবং দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি প্রকাশ করে। ’৪৭ এর দেশভাগের পর তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যান। ১৯৪৫ সাল থেকে সুরেশ চন্দ্র সেনের শুরু হয়েছিলো কক্সবাজারে স্থায়ীভাবে বসবাস। কক্সবাজারে বসবাস করলেও তিনি জাতীয় পর্যায়ে কৃষক-শ্রমিকদের অধিকারসহ নানান গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সবসময় সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৪৮ সালে কক্সবাজার বার-এ যোগ দেন। এ সময় কক্সবাজারের সাহিত্য সংস্কৃতি এবং নব্য ঔপনিবেশিক সরকার পাকিস্তানের শাসণ-শোষণের বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রতিটি আন্দোলনে শরীক হন। সুরেশ চন্দ্র সেন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ’৫২সাল থেকে বাঙালি জাতির প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নিয়ে সাধারণ গরীব মানুষের রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যান। ১৯৫২ সালে ঢাকার ছাত্রদের মিছিলের উপর গুলি ও ছাত্র শহীদ হওয়ার প্রতিবাদে সারাদেশে আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে কক্সবাজারেও এর প্রভাব পড়ে। এ সময় প্রতিটি আন্দোলনে শরিক হতেন এবং ছাত্র-শিক্ষকদের উৎসাহিত করতেন। ওই সময় ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায় তথা ১৯৪৮ সালের ৬ জানুয়ারি পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার বিষয় তালিকা হতে বাংলাভাষাকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে পদত্যাগকারী ঢাকা সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজের (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) লেকচারার ফরিদ আহমদ (যিনি মৌলভী ফরিদ আহমদ নামে পরিচিত, ১৯৪৬ সালে ছাত্র ফেড়ারেশনের প্যানেল থেকে নির্বাচিত ডাকসু ভিপি) {০৯/ ০১/ ১৯৪৮, দৈনিক আনন্দ বাজার পত্রিকা} কক্সবাজারে ওকালতি পেশায় থাকার সময় ওনার নেতৃত্বে ভাষা সংগ্রামের প্রতি আন্দ্লোনে শরীক হতেন। ওই সময় খালেদ মোশাররফ (পরবতীতে সেক্টর কমান্ডার, স্বাধীনতা সময়ে সেনাপ্রধান), আয়ুব আলী, আমিরুল কবির চৌধুরী (পরবর্তীতে আপীল বিভাগের বিচারপতি), নুরুল হুদা চৌধুরী, মো. বদরুজ্জামান (ডা. এমবি জামান) আবদুল কাদের, নুরুল আজিম চৌধুরী, সগীর আহমদ, আবুল কাশেম, ছালামত উল্লাহ প্রমুখ ছাত্র নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে এসব আন্দোলন সংঘটিত হতো। আর এসব নেতৃবৃন্দকে উৎসাহিত দিতেন অগ্নিযুগের বিপ্লবী এডভোকেট সুরেশ চন্দ্র সেন।
১৯৫৭ সালের ২৬ জুলাই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হলে তিনি ন্যাপের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক আইন জারি করা হলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ে। কিছু দিন আত্মগোপন থাকেন তিনি। ১৯৬০ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কক্সবাজার মহকুমার প্রতিষ্ঠা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ন্যাপ দু ভাগ হয়ে গেলে তিনি মস্কোপন্থী বলে ইতিহাসখ্যাত কমরেড অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপে যোগ দেন এবং ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন ( এ সময় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে ন্যাপের হয়ে কাজ করতো)। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গণ-অভূত্থানেও অংশ নেন তিনি। “তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব পাকিস্তান মৈত্রী সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁর যথেষ্ট অবদান ছিল। তিনি ১৯৬৫-১৯৭৬ পর্যন্ত পাক-রুশ মৈত্রী ও বাংলাদেশ-রুশ মৈত্রী সমিতির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ’৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে যে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয় তার অন্যতম নেতা ছিলেন। এ সময় তিনি জেলা এবং জাতীয় পর্যায়ে কৃতী সংগঠক হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ’৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দুবার সুরেশ চন্দ্র সেনের বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক নির্দেশনামূলক কার্যক্রমসহ স্বাধীনতার লড়াইয়ে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন। ১৯৭৩ সালে সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টি যোগ দেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কক্সবাজারে কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলন সংঘটিত করেছেন।
’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর হুলিয়া নির্যাতনসহ নানান দমন-পীড়ন তিনি এবং তাঁর পরিবারের উপর নেমে আসে। রুদ্ধশ্বাস কঠোর সামরিক শাসনের মধ্যে তিনি মাথা নত করেননি। মুক্তিযুদ্ধের শাণিত চেতনায় সামরিক শাসন বিরোধী লড়াইসহ নানান গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিপ্লবী সুরেশ সেন অংশগ্রহণ করেন।
সুরেশ চন্দ্র সেন তাঁর সারাজীবনের রাজনীতিতে কোনদিন আপোষ করেননি। নীতি আদর্শকে সামনে রেখে তিনি সবসময় রাজনীতি করতেন। সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং পেশাগত জীবনে তিনি অতুলনীয় সততা এবং সাহস দেখিয়ে দেশবাসীর ভালোবাসা অর্জন করেন। কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নানান কৃতি-প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল দেখার মতো। রাজনীতির বাইরে দেশের শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে তিনি জড়িত থেকে প্রগতিশীল চিন্তার আলোর ধারাকে সবার মধ্যে ছড়িয়েছেন। যেটা এখনো সবার মধ্যে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্য মন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়, কমরেড মোজাফফর আহমদ, মজলুম জননেতা মৌলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কমরেড মণি সিংহ, তাজউদ্দিন আহমদ, কমরেড জ্যোতিবসু, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, মৌলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশসহ দেশ-বিদেশের কৃতী রাজনীতিবিদদের সাথে তাঁর ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঙ্গণের কৃতী মানুষেরা সুরেশ চন্দ্র সেনকে ভালোবাসতো এবং কক্সবাজারের দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ তাঁকে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা করতো। বিপ্লবী দেশপ্রেমের সারাজীবন পরীক্ষা দিয়ে ১৯৮১ সালের ১ মে স্ত্রী অর্চনা সেন, পুত্র বিশ্বজিত সেনসহ অংশ গুনগ্রাহী রেখে লোকান্তরিত হন। তাঁর স্ত্রী অর্চনা সেন ৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ পরলোক গমন করেন। দুই পুত্র কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক কমিশনার সত্যজিত সেন বাচ্চু (৬৬-৭১ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্র ইউনিয়ন নেতা, সাংবাদিক গবেষক বিশ্বজিত সেন, দুই কন্যা শিক্ষিকা দেবী সেন ও গোপা সেন পরিবার পরিজন নিয়ে কক্সবাজারের স্থায়ীভাবে বসবাস করছে।
(এ নিবন্ধটি কালাম আজাদ এর স্বাধীনতাসংগ্রামে কক্সবাজার নামক গবেষণা কর্ম থেকে সংকলিত)
তথ্যসূত্র
১। পূর্ণেন্দু দস্তিদা, স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম:, প্রকাশকাল ১৩৭৪ বাংলা, প্রকাশক: বই ঘর, চট্টগ্রাম।২।
২। সুধাংশু দাশগুপ্ত, স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা. ১৯৯০ সাল, কলকাতা।
৩। মালিক সোবহান, কক্সবাজার চরিত কোষ, জুলাই ২০০৭, কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমী।
৪। বিচারপতি আমিরুল কবির চৌধুরী, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কক্সবাজার. ২১ ফেব্র“য়ারি ২০১১, দৈনিক ইনানী।
৫। প্রফেসর মোশতাক আহমদ, দেশের মুক্তিসংগ্রামের অগ্নিযুগের বিপ্লবী এডভোকেট সুরেশ সেন, বিজয়, ২০১২, জেলা প্রশাসন।
৬। কালাম আজাদ, মুক্তিযুদ্ধে কক্সবাজার: জানা-অজানা তথ্য, বিজয়, ২০১২, জেলা প্রশাসন, কক্সবাজার।
Comments (1)
আর আমার...
শিউরে ওঠা শরীরের মননে গেঁথে থাকা স্মৃতি
আঘাতে চূর্ণ প্রতিটি মুহুর্ত
কষ্টের অনুকাব্য আর শূন্যতার হিংস্রতা...
তুমি অনুভব করবে না।।
কারণ তোমার যত অশ্রূ
আমার হাত চিঁড়ে তা কখনোই মাটি স্পর্শ করবে না।।
----------khub shundor
ধন্যবাদ আপনাকে... বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা রইল ...
তোমাকে আসতেই হবে একথা বলিনি আমি।।
প্রথম লাইনেই বাজিমাত করে দিলেন। বাকিটা বোনাস। শুভেচ্ছা জানবেন কবি।
ধন্যবাদ আপনাকে ... শুভেচ্ছা নিবেন...