Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

আখতারুজ্জামান সোহাগ

১০ বছর আগে লিখেছেন

ঠিকানার জন্মকথা (প্রতিযোগিতা)

ঠিকানা আমার মেয়ের নাম।

আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করেছিলেন, প্রথম বাক্যটা পড়েই থুতনিটা নিচু হয়েছে, ভ্রু-দু’টো সামান্য দলা হয়ে এখন তাদের প্রায় গলাগলি অবস্থা- বেশ বুঝতে পারছি। আপনাদের বিস্মিত হওয়ার কারণটা আমি জানি। আমার মেয়ের নামটা মোটেও আটপৌরে নয়। বলতে গেলে এখনকার দিনেও নয়। আর আমার মেয়ে যখন জন্মলাভ করেছিল, সেই অনেক বছর আগে, তখনকার দিনে নিন্মমধ্যবিত্ত ঘরে সদ্য পৃখিবীর আলো দেখতে পাওয়া কোন কন্যা-সন্তানের এরকম একটা কাব্যিক নাম কেউ ভাবতে পারে, সেটা বোধ হয় সুপাঠকেরও ‘বিশ্বাস করতে পারার’ সক্ষমতার অগ্নিপরীক্ষা। তবে হ্যাঁ, একটা কথা কিন্তু সত্যি। বিশ্বাসযোগ্যতার মাপকাঠি হাতে করে অভিঘাত আসে না, জন্মায় না প্রতিঘাতও! অবিশ্বাস্য অনেক কিছু ঘটে তাই, এই ভবে, নিত্যদিন।

আমি ঠিকানার মা।

সে সময়কার দিনে সন্তান-জন্মানোর দিনক্ষণ লিখে রাখার চল ছিল না অতটা। সমাজের নিচুতলায় তো এই ‘চল’টা ছিল আরও বেশি অচল। সেই হিসাবে আমার মেয়ের জন্মতারিখটা মনে থাকার কথা নয় কারো। কিন্তু আমাদের মনে আছে। সে কথায় পরে আসছি। সংক্ষেপে আমার কথা, আমার মায়ের কথা বলে নিই তার আগে।

ভারতবর্ষের মতো বিশাল এক সংসারে বউ হয়ে এসেছিলেন আমার মা। বড্ড অভাবের সংসার, নুন আনতে পান্তা ফুরোয় এ রকম অবস্থা। অভাবের সংসার বলেই হয়তো গৃহকর্তার শাসন-বারণের জোয়ার ছিল না অতটা, ছিল না পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। বরং তার বদলে ছিল সদস্যদের নিজস্ব চিন্তা-ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী চলার একগুঁয়েমিতা, ছিল বৃহৎ কর্তৃক ক্ষুদ্র জনের উপর কর্তৃত্ব ফলানোর প্রবণতা। আর দশটা বড় সংসারে যেমনটা হয় আর কি! তাদের মধ্যকার মত আর পথের পার্থক্যটা এতটাই প্রকট ছিল যে সেটা চোখে পড়ত তাকানোর আগেই। এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছিল গ্রামের পাজি মোড়ল। ফলাফল যথারীতি ভাঙন। ঠিক যেন দেশভাগ! হাড়ি আলাদা হলো, একটা সংসার ভেঙে জন্ম নিল কয়েকটা সংসার। ঠিক এরকম একটা সময়ে আমি জন্মালাম। অবশ্য আমি একা নই। আমার জমজ একটা বোনও জন্ম নিয়েছিল সেদিন। এটা ১৯৪৭ সালের কথা।

আমরা দু’বোন বেড়ে উঠছি। একই পৃথিবীর আলোয়, বাতাসে, জলে। পাশাপাশি বেড়ে ওঠা দু’টো চারা গাছের মতো। কিন্তু একই মাটিতে একই প্রজাতির দু’টো গাছ একই সঙ্গে জন্মালেও একটাকে ছাপিয়ে আর একটা মহীরুহ হয়ে উঠতে পারে, এ রকম উদাহরণ জগৎ-সংসারে হরদম রয়েছে। আমাদের ক্ষেত্রেও ঘটল সে রকমটা।

শারিরীক গঠনে, মগজে, চলনে, বলনে- সবখানেই আমার জমজ বোনটি আমার চেয়ে অনেকটা এগিয়ে গেল। খুব অল্প দিনের মধ্যেই সে হয়ে উঠল আমার চেয়ে অনেক বেশি শাণিত, অনেক বেশি কর্তৃত্ব পরায়ণ, বিশেষ করে আমার উপর। সে যখন শব্দ করে মাকে ডাকতে পারে তখনও আমার শব্দযন্ত্রটি অপ্রস্ফুটিত, আনন্দ-ব্যথা-বেদনা কোন কিছুই আমার কণ্ঠনালীতে শব্দ-কম্পাঙ্কের জন্ম দেয় না। আমার বাবা-মা শব্দ করে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলে, আমাকে ডাকলে আমি শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি তাঁদের দিকে। আমার শূন্যদৃষ্টির তল খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টায় তাঁরা রত থাকেন, এক সময় তাঁদের শব্দময় লম্বাশ্বাস পথ করে নেয়।

এসব অবশ্য আমার জানার কথা নয়। আমি জেনেছি আমার মায়ের কাছ থেকে। পরে অনেকবার তিনি আমাকে বলেছেন সেই সব দিনের কথা।

যাই হোক, এক সময় কারোরই বুঝতে বাকি রইল না যে আমি বাকশক্তিহীনা। কথায় বলে ‘সন্তান না কাঁদলে মা’ও দুধ দেয় না’। কথাটা কি সত্যি? হবে হয়তো! হয়তো এমন হয়েছে কোনদিন আমি বিছানা ভিজিয়েছি, সামান্যতম জানান দিইনি সেটা আকারে ইঙ্গিতেও, মা’ও সাংসারিক কাজে ব্যস্ত ওদিকে, তাই তার উপরই হয়তো পড়ে থাকতে হয়েছে আমাকে লম্বা সময়। হয়তো ক্ষুধায় পেটে জ্বালা করেছে কোন কোন দিন, প্রকাশ করার ক্ষমতা ছিল না আমার, তাই খাবারটাও পেয়েছি দেরীতে। কখনো হয়তো খাবারটাই পাইনি, আমার জমজ বোনটা নিজেরটুকু শেষ করে সাবাড় করেছে আমার অংশটুকুও। বৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনা, গঞ্জনা- এ সব তো মূকদের জন্যই, তাই না!

তখন আমার পাঁচ। আমাকে স্কুলে দেওয়ার কথা ভাবেন নি আমার বাবা-মা। আমার বোনটাকে স্কুলে ভর্তি করা হলো, তার দু’হাত ভরল নতুন বইয়ে। কি সুন্দর মন পাগল করা গন্ধ লুকিয়ে থাকত সেই সব বইয়ের পাতায় পাতায়!

একদিন কৌতূহলবশত একটা বই আমি হাতে তুলে নিয়েছিলাম। বড় বড় অক্ষর ছিল বইটাতে, ছিল রং-বেরঙের ছবি। অজগর, আম, ইঁদুর আর কত কিছুর ছবি যে ছিল বইটাতে! দেখতে পেয়েই সেদিন ছোঁ মেরে বইটা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল আমার বোন। ঠিক তখনই নিজেই নিজের ভিতর খেয়াল করলাম এক অবিশ্বাস্য পরিবর্তন, প্রাণপণে আঁকড়ে ধরলাম আমি বইটা বুকের সাথে। হ্যাঁ, সেই বাংলা বইটা। সেদিন সেটাই ছিল আমার প্রথম প্রতিবাদ, এতদিনের জমানো ক্ষোভের প্রথম বহিঃপ্রকাশ। আমার জ্বলজ্বলে দু’চোখে ছিল বুনো ক্রোধ, না ঠিক বুনো নয়, বরং তা যেন দারুণ অবিচল, আর একই সাথে ভীষণ হৃদ্যতায় উথাল-পাতাল। আমি চেয়েছিলাম বাংলা পড়তে, আমি চেয়েছিলাম বাংলা বলতে, আমি চেয়েছিলাম বাংলার মান। উত্তেজনায় আমার গলা চিরে বেরিয়ে এসেছিল ছোট্ট একটা শব্দ। একটা মাত্র উচ্চারিত শব্দ সেদিন পথ করে দিয়েছিল হাজারটা শব্দের। সমুদ্র-গর্জনের মতো শব্দরাশি এতদিন যারা ছিল সময়ের খাঁচায় বন্দী, সহসাই তারা যেন সোচ্চার হলো স্বাধিকারের সংগ্রামে। ক্ষুদ্র ব্যাসার্ধের একমাত্র ছিদ্রটাই শব্দের অবিরাম বহির্গমনে এক সময় বড় ব্যাসার্ধের বৃত্ত হলো। আমার মুখে বোল ফুটল। আমার বোনটা জেনে গেল, প্রবল বিক্রমে পূবের হাওয়া আসছে। সে বাতাসের পথ ধরেই এলো ১৯৫২।

কোথা থেকে কোথায় চলে এলাম! কলম ধরেছিলাম ঠিকানার জন্মকথা লিখব বলে। খেই হারিয়ে বলতে শুরু করে দিলাম নিজের জন্মের কথা, নিজের ছেলেবেলার কথা। যাক গে, মূল কথায় ফিরে আসি।

আঠার বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়। আমার বেড়ে ওঠার গতি ধীর ছিল, দেরীতে কথা ফুটেছিল মুখে, স্কুলে যাওয়াও শুরু করেছিলাম বেশ দেরীতে। মেনেই নিয়েছিলাম আমার জীবনে সব কিছুর এই দেরীতে আসা। তাই বিয়ের পাঁচ বছর পরেও যখন কেউ এলো না আমার কোল জুড়ে তখনও খুব একটা মনোকষ্টে ভুগিনি আমি। বরং আমার কেন জানি সব সময় মনে হতো সে আসবে, আজ কিংবা কাল। কিন্তু আমার শ্বশুরবাড়ীর লোকজন! তার মহাব্যস্ত হয়ে উঠেছিল ভবিষ্যৎ বংশধরের মুখ দেখার জন্য।

মনে আছে খুব গরম পড়েছিল সেবার। মার্চের শেষ ব’লে কৃষ্ণচূড়ায় লাল হয়ে উঠেছিল আমার শ্বশুরবাড়ির সামনেরটা। উঠোনের পশ্চিমপাশে ছিল কয়েকটা বড় আমগাছ। দিনের বেলা, বিশেষ করে দুপরের পর বেলা ঘুরলে, গাছগুলোর নিচে ঘন ছায়া পড়ত। সেদিন ছিল শুক্রবার। আমার স্বামীর অফিস বন্ধ। দুপুরে খাওয়ার পর নাভিশ্বাস উঠে যাওয়া গরমে শোবার ঘরে তিষ্ঠাতে না পেরে হাতপাখাটা নিয়ে গিয়ে দু’জনে বসেছিলাম আমগাছগুলোর নিচে, একটা গরু-গাড়ীর উপর। বাতাসে ভাসছিল অনেক কথা, শোনা যাচ্ছিল তার আগের রাতে পাকিস্তান-সেনাবাহিনী ঢাকায় গণহত্যা চালিয়েছে, শেখ মুজিবর রহমান গ্রেফতার হয়েছেন। আমার স্বামী বললেন এসব। বলার সময় তার চোখ ছলছল করে উঠল। আবার পরক্ষণেই সে দু’টো হয়ে উঠল চৈত্রের রোদে ফেটে চৌচির মাঠ, ছলছল জল বাষ্পীভূত হয়ে মিলিয়ে গেল বাতাসে। আমি তালপাতার পাখা দিয়ে তাকে বাতাস দিচ্ছিলাম। অনেক মানুষের মৃত্যু সংবাদ শুনে কি না জানি না, হঠাৎ আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। গা গুলিয়ে উঠল, আমার পেটের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল সবকিছু। প্রাণপণে চেষ্টা করলাম থামাতে, কিন্তু পারলাম না। হড়হড় করে বমি করে দিলাম একসময়, তবেই যেন কিছুটা স্বস্তি পেলাম। উদ্বিগ্ন মুখে ডাক্তার আনতে ছুটলেন আমার স্বামী। ডাক্তার এসে নাড়ি টিপে বললেন, ‘এ তো ভালো লক্ষণ! ভবিষ্যৎ বংশধর আসছে।’

এক সময় আমার শরীরের মধ্যে আমার সন্তানের অস্তিত্ব টের পেতে আরম্ভ করলাম। বেশ বুঝতে পারছিলাম সে বড় হচ্ছে, একটু একটু করে। আমাকে তখন আঁচ বাঁচিয়ে চলতে হয় যেন বাইরের রোদ-বৃষ্টি-বায়ু তাকে কক্ষণও ছুঁয়ে না যায়। এদিকে এখানকার বিচ্ছিন্ন মানুষগুলোও তখন একটু একটু করে দলা বাঁধতে থাকে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকিন্দুগুলোই একাট্টা হয়ে গড়ে তুলতে চায় অতল সাগর, ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায় এতদিনের অবিচার-অনাচার-বৈষম্য-শোষণ-বঞ্চনা-গঞ্জনা-তিরস্কারের পাহাড়সম জঞ্জাল।

যুদ্ধ এক সময় সর্বাত্মক রূপ পরিগ্রহ করল, হয়ে উঠল ভয়াবহ রকমের ধ্বংসাত্মক। এমন একটা সময়ে এক রাতে আমার স্বামী আমাকে বললেন, ‘মায়া, আমি যুদ্ধে যাব।’

প্রথমটায় আমি কথা বলতে পারিনি, নিষ্কম্প চোখে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। এক সময় আমার চোখের পাতা কেঁপে উঠল তিরতিরিয়ে, বললাম, ‘আমাকে এই অবস্থায় রেখে যাবেন?’

স্বামী নির্বাক রইলেন। আমি তাকে চিনি পাঁচ বছর ধরে। চিনি বলেই জানি, আমার সস্তা তাঁতের শাড়ীর আঁচল তাকে বেঁধে রাখতে পারবে না। বেঁধে রাখতে ইচ্ছেও হচ্ছিল না কেন কে জানে! তবুও জানতে চাইলাম, ‘কার কাছে রেখে যাবেন আমাদের? কে দেখবে আমাদের?’

‘আল্লাহ দেখবেন।’ স্বামীর কণ্ঠ কাঁপল না একটুও।

মাঝ কার্ত্তিকের এক রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর গম্ভীর মুখে স্বামী আমার পাশে এসে বসলেন। তাকে কিছুটা অন্য রকম লাগছিল সেদিন। যেন নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে করে ক্লান্ত, পরাজিত, কিন্তু দ্বিধাহীন। তিনি কাপড়ের উপর দিয়ে আমার স্ফীত পেটে বার কয়েক হাত বুলালেন, ঠাহর করার চেষ্টা করলেন আমাদের অনাগত সন্তানের অস্তিত্ব। তারপর কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন তার নড়াচড়ার শব্দ। একটু বাদে আমার কপালে চুমু এঁকে বেরিয়ে পড়লেন তিনি, যুদ্ধে যাবেন বলে। বৃদ্ধ বাবা-মাকে কিছুই বলে গেলেন না, পাছে তাঁরা তাকে যেতে না দেন!

এরপর কয়েকদিন বাদে মা’র কাছ থেকে চিঠি পেলাম। হাত চিঠি। কোথা থেকে যেন তিনি শুনেছেন, আমাকে এই অবস্থায় রেখে আমার স্বামী যুদ্ধে গেছেন। জামাতার উপর ক্ষুব্ধ মা তাই লিখেছেন কাল-বিলম্ব না করে বার্তাবাহকের সাথেই যেন আমি তার ওখানে চলে যাই, ওদিকটাতে যুদ্ধের দামামা নেই অতটা, জামাতা না আসা পর্যন্ত যেন ওখানে গিয়ে থাকি। মা’র বাড়িতে গিয়ে থাকতে আমার প্রবৃত্তি হলো না। বার্তাবাহককে ফিরিয়ে দিলাম এই বলে যে যেকোন দিন আমার স্বামী ফিরে আসবেন, আর আমি চাই তিনি ফিরে এসে যেন আমাকে এখানেই দেখতে পান।

আমার স্বামী চলে যাওয়ার দিন-বিশেক বাদে একদিন মুখে দাড়ির জঙ্গল আর মাথায় অপরিপাটি লম্বাচুলের একজন লোক এলো আমাদের বাড়িতে। আমার বৃদ্ধ শ্বশুরের সাথে তিনি অনেকক্ষণ কথা বললেন। তারপর আমার সাথে দেখা করে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে গেলেন। ছোট্ট একটা চিঠি। শুরুতে কোন সম্বোধন নেই, সমাপ্তিতেও নেই কোন বিদায় সম্ভাষণ। দেখে চিনতে পারলাম, এটা আমার স্বামীরই হাতের লেখা। ‘সীমান্তের ওপারে গিয়েছিলাম ট্রেনিং নিতে। ফিরেছি। আমি ভালো আছি। আমাকে নিয়ে ভেবো না।’

আমার মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর কি সরল চিন্তা-ধারণা! আমি ভাবতে না চাইলেই বোধ হয় ভাবনারা আসবে না আর আমাকে ভাবাতে!

এদিকে আমার সন্তান বড় হচ্ছে, আমারই জঠরে। এখন সে অনেকটাই বড়। ইদানীং নতুন করে একটা উপসর্গ যোগ হয়েছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে আমার। শ্বাশুড়ি বললেন বিশ্রাম নিতে। আরও কিছু পরামর্শ দিলেন। রক্ষক্ষরণ হচ্ছে এ মাটির বুকেও। প্রতিদিন তাজা মানুষ মরছে পাকিস্তান-সেনাবাহিনীর হাতে, পাখির মতো। একদিন শোনা গেল পাশের গ্রামে পাক-আর্মি ঢুকে মুক্তিবাহিনীতে যারা যোগ দিয়েছে তাদের পরিবার-পরিজনকে গুলি করে মেরেছে, ধরে নিয়ে গেছে তাদের মা-বোনদের। বাদ যায়নি গর্ভবতী মহিলারাও। শান্তিকমিটির লোকরা তাদেরকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করছে, মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি-ঘর-দোর চিনিয়ে দিচ্ছে।

আমার শ্বশুর এ সংবাদ শুনে পাথরের মূর্তি হয়ে বসে রইলেন। তাঁর ছানি পড়া চোখ দিয়ে অঝোরে ঝরতে লাগল অশ্রুধারা। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন গ্রাম ছাড়বেন। সেদিন শেষরাতে আমরা গরু-গাড়িতে চেপে বসলাম। গন্তব্য শ্বশুরের দূর সম্পর্কের মামাবাড়ি। প্রত্যন্ত গ্রাম বলে সেখানে যুদ্ধ এখনও যুদ্ধের আকার ধারণ করেনি, এ রকমটাই সংবাদ পাওয়া গেল। তাছাড়া সেখানে কেউ জানে না আমার স্বামী মুক্তিবাহিনীতে নাম লিখিয়েছে, পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়ছে দিন-রাত জীবন বাজি রেখে।

সেই শীতের রাতে গরু-গাড়ীতে চলতে চলতে আমার কেবলই মনে হচ্ছিল আর কখনো দেখা হবে না আমার স্বামীর সাথে, আমার অনাগত সন্তানও কোনদিন দেখবে না তার জন্মদাতার মুখ, আর কখনো ফেরা হবে না আমার স্বামীর বাস্তুভিটায়। মনে হচ্ছিল যেকোন সময় আমরা ধরা পড়ে যাব শত্রুবাহিনীর হাতে, বেঘোরে প্রাণ হারাব, আমাদের লাশ ছিঁড়ে-খুঁড়ে খাবে শিয়াল-শকুনেরা। মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমত, পথিমধ্যে আমাদের কোন সমস্যা হয়নি, আমরা গন্তব্যে পৌঁছেছিলাম ঊষার আলো ফোটার কিছুক্ষণ পরে।

অভাগা যেদিকে চায়, সেদিকে সাগর শুকায়। আমরা যেদিন আমাদের নতুন আবাসস্থলে গেলাম, তার সপ্তাহখানেক বাদে এক রাতে গ্রামে পাকবাহিনী ঢুকল।

খুব ঠাণ্ডা পড়ছিল সে ক’দিন। ছোট্ট গ্রামটিতে তাই রাত নেমে আসত সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই। শুয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল বলে সে রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর পা টান করে বসেছিলাম চৌকির উপর। বরই গাছের পাতা চুইয়ে শিশিরের ফোঁটা পড়ছিল টিনের চালের উপর, টুপটাপ শব্দ হচ্ছিল একটু বাদে বাদে। দূর থেকে পটকা-টটকা ফোটার আওয়াজও আসছিল বোধ হয়। অন্ধকারে বসে কান পেতে শুনছিলাম সেসব শব্দ। হঠাৎ সে সব শব্দকে ছাপিয়ে শুনতে পেলাম দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ। ক্রমেই তার তীব্রতা বাড়তে লাগল। সেই সাথে শুনতে পেলাম শ্বাশুড়ির চাপা গলা, ‘বৌমা। বৌমা।’

অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল বুক, অতি সন্তর্পণে চৌকি থেকে নেমে দরজা খুললাম। এক দঙ্গল শীতল বাতাস ঢুকে পড়ল ঘরে, সেই সাথে বাতাসের গতিতে ঘরে ঢুকলেন শ্বাশুড়ি, ‘খুব বিপদ, বৌমা। খুব বিপদ। গ্রামে মিলিটারি ঢুকছে। শিগগির আমার সাথে আসো।’

শ্বাশুড়ি আমাকে টানতে টানতে নিয়ে চললেন বাড়ির পিছনের দিকটায়। আগের দিন দেখেছিলাম ঘন বাঁশবাগান রয়েছে ওদিকটায়, তার আরও পিছনে কবরখানা। ভারী পেটে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল ভীষণ। বাঁশবাগানের ভিতর দিয়ে কবরখানার দিকে অনেকটা পথ চললাম শ্বাশুড়ির সাথে, অনেকটা ভুতগ্রস্তের মতো, তারপর একটা জায়গায় পৌঁছে থামলাম। দেখতে পেলাম বাড়ির সকলেই সেখানে, আধশোয়া হয়ে রয়েছে মাটির উপর। আশেপাশের অন্যান্য বাড়ির কিছু লোকজনও বোধ হয় এখানে আশ্রয় নিয়েছে, লুকিয়ে রয়েছে প্রাণের ভয়ে। শরীরের ভার নিতে পারছিলাম না, তাই বসে পড়লাম ধপাস করে। শ্বাশুড়ি বসলেন আমার পাশে।

কিছুক্ষণবাদে বাড়ির ওদিক থেকে ভেসে আসতে লাগল অনেক মানুষের কণ্ঠস্বর, ভারী বুটের গমগম করে হেঁটে যাওয়ার শব্দ। আমরা মাথা নিচু করে শুয়ে রইলাম মরার মতো। একটা সময় বোঝা গেল মানুষগুলো আমাদের ঘরের ভিতরে ঢুকেছে। কাঁচের কোন একটা জিনিস ভাঙার শব্দ শুনলাম। গুলির শব্দ ভেসে এলো অন্য কোন দিক থেকে। কয়েকটা টর্চলাইট থেকে ধেয়ে আসল চকচকে আলো বাঁশবাগানের এই দিকটাতে, আমাদের মাথার উপর দিয়ে পথ করে নিল কবরখানার দিকে। একটু বাদে মাথা উঁচু করে তাকাতেই আগুনের শিখা উঠতে দেখা গেল। বোঝা গেল আমাদের বসতঘরে আগুন ধরিয়ে দিযেছে ওরা। গোয়ালঘরের ওদিক থেকে আতঙ্কিত গরুর ডাক ভেসে আসছে। সে শব্দ বাতাসে ছড়াচ্ছে ভীতি, ছড়াচ্ছে বিষণ্নতা। তবে কি ওরা গোয়ালঘরেও আগুন দিয়েছে? অবুঝ, অবলা প্রাণীরও কি নিস্তার নেই এই সব নরপশুদের হাত থেকে!

শ্বাশুড়ি আমার হাত চেপে ধরলেন, আমিও আঁকড়ে ধরলাম তার হাতখানি। আমার শ্বশুর হামাগুড়ি দিয়ে রয়েছে একটু দূরে, তার একটু পাশে তাঁর মামা-মামী, অন্যান্য পরিজন। সবাই নিঃশ্বাস নিতেও যেন ভুলে গেছে।

সহসা কিছু মানুষকে এগিয়ে আসতে দেখলাম আমাদের দিকে, পড়ে থাকা শুকনো বাঁশপাতা মাড়িয়ে। আলো ছিল না তাদের হাতে, শোনা যাচ্ছিল কথা বলছে তারা নিজেদের মধ্যে, খুব চাপা গলায়। কাছাকাছি এসে এক সংগে হঠাৎ টর্চ জ্বালাল তারা, আলোর বন্যায় ভেসে গেল জমাট অন্ধকার। আলো-আঁধারির মাঝে দেখতে পেলাম জনা-দশেক উর্দি পরা পাক-আর্মি হাতে অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে রয়েছে থমথমে মুখে। তাদের সাথে রয়েছে দু’তিনজন মানুষ, যাদের সাজ-পোশাক দেখেই বোঝা যায় তারা এখানকার স্থানীয় অধিবাসী।

একজন আর্মি এগিয়ে এলো আমার দিকে, খুব কাছ থেকে টর্চ লাইটের আলো ফেলল আমার মুখের উপর। তারপর আমার চুলের মুঠি ধরে হ্যাচকা টানে টেনে তুলল। আমি স্পষ্ট টের পেলাম আমার পেটের ভিতর আমার অনাগত সন্তান মুষ্টিবদ্ধ হাতে প্রতিবাদ করে উঠল, প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল পরাধীনতার শিকল ভেঙে বেরিয়ে আসার, লক্ষ লক্ষ মুক্তি পিয়াসী মানুষের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে গিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে চাইল সে হানাদার বাহিনীর বুলেটের সামনে।

তাজা রক্ত রাঙাল আমার শাড়ীর খোল। তারপর ঝর্ণার মতো নামতে লাগল। নামতেই লাগল। নিদ্রাহীন, ক্লান্তিহীন। পাহাড়ের চরাই-উৎরাই ডিঙিয়ে নামছে তা নামছেই। একটুবাদে প্রবাহিত হতে লাগল ঢালু জমিন বেয়ে। এ যেন রক্তগঙ্গা! এক সময় সঙ্গম হলো তার সাগরের সাথে। অশ্রু দিয়ে গড়া সাগর রক্তলাল হয়ে উঠতে লাগল গাঢ় রক্তের ব্যাপনে। এক সময় সে সাগরের বুক চিরে পূব আকাশে উঠল নবীন সূর্য। সেও রক্ত লাল!

আমাদের ‘ঠিকানা’র জন্ম হলো। সারা রাত ঝড়-বৃষ্টির সাথে যুদ্ধ করে সকালের সোনা-রোদে যেভাবে কাকভেজা কাক পালক শুকায় সেভাবে ডানা মেলে ধরল একটা তিলা ঘুঘু, নারকেলের পাতার প’রে, পরম নির্ভার হয়ে। সেই সুখদৃশ্যটুকু চোখে লেগে রইল। তখনও ক্ষণে ক্ষণে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল পিছনে পড়ে থাকা নয়-নয়টি মাস।

-------------------

২রা মার্চ, ২০১৪ - ১০ই মার্চ, ২০১৪

Likes ৩৮ Comments
০ Share

Comments (38)

  • - রোদের ছায়া

    মনের ভুলে না আমি মনের আনন্দেই মন্তব্য করতে ভালবাসি দাদা কিন্তু মন্তব্য খরার বিষয়টা আমিও খেয়াল করেছি । ভালো লাগলো আপনার এই ব্লগ জাগানিয়া ছড়া । 

    - শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

    ধন্যবাদ বোন রোদের ছায়া। শুভেছ্চা রইল।

    - রুদ্র আমিন

    চমৎকার হয়েছে ভাই।

    • - শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

      ধন্যবাদ ভাই আমিনুল। শুভেচ্ছা রইল।

    Load more comments...