সাধারণতঃ যারা উল্টোপাল্টা কথাবার্তা বলে বা অস্বাভাবিক আচরণ করে, তাদেরকে আমরা পাগল বলে থাকি। কিন্তু আপনি জানেন কী সোজাসাপ্টা কথাবার্তা বলা লোকেরাও পাগল হয়? আজ এমন একজন পাগলের কথা বলবো, যার কথাবার্তা ছিল সোজাসাপ্টা এবং আচার আচরণও ছিল স্বাভাবিক। পুরোপুরি পাগল হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তার মানসিক ভারসাম্যের অভাব কেউ বুঝতে পারেনি। তিনি ছিলেন মেডিসিনের একজন নাম করা ডাক্তার। পাবনা মেন্টাল হসপিটালে যাওয়ার আগে এক স্বনামধন্য ক্লিনিকে রীতিমতো চেম্বার নিয়ে বসে তিনি রোগী দেখতেন। শত শত রোগীর প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়েছেন তিনি। সেসব রোগীরা সুস্থও হয়েছে। এক পর্যায়ে এসে ডাক্তার সাহেব নিজেই অসুস্থ হয়ে গেলেন।
কিন্তু ঐ যে কথায় আছে না, গোয়ালা নিজের দই খায়না। এই ডাক্তার সাহেব নিজের অসুখ বিসুখ হলে বরাবর অন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হতেন। একবার তার ইনসমনিয়া (অনিদ্রা রোগ) হলো। ইনসমনিয়ার ওষুধের নাম তার বিলক্ষন জানা আছে। ডজন ডজন রোগীকে তিনি মুড়ি মুড়কির মতো প্রেসক্রাইব করেছেন। কিন্তু নিজের ইনসমনিয়া হওয়ায় তিনি একজন সাইকিয়াট্রিষ্টের কাছে গেলেন।
একজন ডাক্তার আর একজন ডাক্তারের কাছে গেছেন। স্বাভাবিকভাবে জাতভাই হিসাবে তাকে অনেক খাতির যত্ন করা হলো। সাইকিয়াট্রিষ্ট ভদ্রলোক ডাক্তার সাহেবের শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে ইনসমনিয়ার পূর্বাপর তথ্য জানতে চাইলেন। প্রধান প্রশ্ন ছিল, ইনসমনিয়ার আগে ডাক্তার সাহেবের পারিবারিক, সামাজিক বা পেশাগত কোন সমস্যা হয়েছিল কী না?
ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘আমার স্ত্রী আমার ছেলের এক বন্ধুর সাথে পালিয়ে গেছে।’
আঁতকে ওঠার মতো কথা। কিন্তু পেশাগত কারণে সাইকিয়াট্রিষ্টদের নার্ভ শক্ত রাখতে হয়। রোগীর কথাবার্তায় তারা কখনো আঁতকে ওঠেন না। এমন অনেক আঁতকে ওঠার মতো কথা তাদেরকে প্রায়ই শুনতে হয়। তিনি নির্বিকার কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার ছেলে মেয়ে কয়জন?’
‘একটাই ছেলে। মেয়ে নাই।’
‘ছেলে কী করে?’
‘সে মেডিক্যাল কলেজের ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র।’
‘আচ্ছা ডাক্তার সাহেব, কিছু মনে করবেন না। পালিয়ে যাওয়া স্ত্রী কী আপনার দ্বিতীয় পক্ষ?’
‘মাই গড!’ ডাক্তার সাহেব হাত তালি দিয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, ‘আপনি জানলেন কীভাবে?’
‘আমি জানি না। অনুমান করে বলেছি। ছেলেটি কী এই পক্ষের, না প্রথম পক্ষের?’
‘প্রথম পক্ষের। ওর মা ওকে জন্ম দিয়ে মারা গেছে। মেডিক্যাল বোর্ড বসিয়েও তাকে বাঁচাতে পারিনি। ছেলে তার নানা-নানীদের কাছে মানুষ হয়েছে। এই তো মাত্র ছয় সাত বছর আগে আমি দ্বিতীয় বিয়ে করার পর ওকে আমার কাছে নিয়ে এসেছি। সৎ মায়ের সাথে প্রথম দিকে ওর সম্পর্ক ভালোই ছিল, কিন্তু পরের দিকে বনিবনা ছিল না। কিছুদিন থেকে সে হোস্টেলে চলে যাওয়ার কথা বলছিল। আমি এটা ওটা বলে ওকে আটকে রেখেছিলাম। এখন তো সে তার সৎ মা ও বন্ধুকে খুন করার জন্য ধারালো ছুরি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
ডাক্তার সাহেবের এ কথা শুনেও সাধারণ মানুষের আঁতকে ওঠার কথা। কিন্তু সাইকিয়াট্রিষ্ট ভদ্রলোক নির্বিকার। তিনি ডাক্তার সাহেবের পালিয়ে যাওয়া স্ত্রীর বয়সের একটা আন্দাজ পেলেন। মনে মনে হিসাব করে বুঝলেন, ডাক্তার সাহেবের সাথে তার স্ত্রীর বয়সের বড় রকমের ব্যবধান রয়েছে। কারণ ডাক্তার সাহেব কিছুদিন আগে সরকারি চাকরি থেকে রিটায়ার করে ফুলটাইম প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছেন। ইনসমনিয়ার কারণে ডাক্তার সাহেবের পেশাগত কাজে ব্যাঘাত ঘটছে কী না এই প্রশ্নের উত্তরে জানা গেল ব্যাঘাত ঘটছে। সম্প্রতি তিনি একজন উচ্চ রক্তচাপের রোগীকে শিশুদের প্যারাসিটামল সিরাপের প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়েছেন। এমন ভুল ভ্রান্তি আরও হচ্ছে কী না কে জানে? দিনে দিনে তার রোগী ও আয়-উপার্জন কমে যাচ্ছে। তার মেডিক্যাল রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়ে যেতে পারে।
ডাক্তার সাহেব সাইকিয়াট্রিষ্টের কাছে ইনসমনিয়ার চিকিৎসা নিলেন ঠিকই, কিন্তু দু’সপ্তাহ ওষুধপত্র খাওয়ার পর সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাসার ভেতর উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। এই ঘটনার কয়েকদিন আগে পত্রিকায় একটা খবর ছাপা হয়েছিল। শিরোনাম ছিল, “মেডিক্যাল ছাত্রের হাতে বন্ধু ও বন্ধুপত্নী খুন।” ডাক্তার সাহেবের আত্মীয়স্বজন তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বহু চেষ্টা করেও কাপড় পরাতে না পেরে শেষে জোর জবরদস্তি করে কাপড় চোপড় পরিয়ে পাবনা মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করে দিয়ে এলো।
কয়েক মাস পর পাবনা থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে এসে ডাক্তার সাহেব জেলখানায় গেলেন ছেলের সাথে দেখা করতে। জানা গেল, মস্তিষ্ক বিকৃতির কারণে তার ছেলেকে হ্যান্ডকাফ ও ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে কড়া পাহারায় সুরক্ষিত সেলে রাখা হয়েছে। অতি সত্ত্বর তাকে চিকিৎসার জন্য পুলিশি প্রহরায় পাবনার মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হবে। জেল কোডের বিধান অনুযায়ী এই ধরনের আসামীর সাথে কারো দেখা করার কোন সুযোগ নেই।
ডাক্তার সাহেব ছেলের সাথে দেখা করতে না পেরে হতাশ হয়ে ফিরে এলেন। তার প্রথম স্ত্রীর ছোট বোন ও তার স্বামী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, ‘মামুনের কিছু হবেনা দুলাভাই। ওর মামলায় আমরা নাম করা উকিল দিয়েছি। দেখবেন ও ঠিকই খালাস হয়ে বেরিয়ে আসবে।’ ডাক্তার সাহেবের ছোট ভাই বললো, ‘আপনি চিন্তা করবেন না ভাইজান। যত টাকা খরচ করতে হয় আমরা করবো। মামুনকে খালাস করে আনবোই।’
ডাক্তার সাহেব চিৎকার করে বললেন, ‘খালাস হয়ে কী হবে? তোমাদের উকিল কী ওর ব্রেন ভালো করে দিতে পারবে? তোমরা কী জানো না যে মামুন পাগল হয়ে গেছে? জেলখানায় ওকে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে রাখা হয়েছে?’
আত্মীয়স্বজন সবাই চুপ। তারা মামুনের অবস্থার কথা জানে। এখন এই প্রশ্নের উত্তর তারা কী দেবে? ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘তোমরা আমাকে আবার পাগলা গারদে রেখে এসো। সেখানে মামুনের সাথে আমার দেখা হবে।’
‘আপনি তো এখন সুস্থ হয়ে গেছেন। আবার পাগলা গারদে যাবেন কেন? আর ওরা সুস্থ লোককে ভর্তিই বা করবে কেন?’
‘না, না, আমি সুস্থ নই।’ কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডাক্তার সাহেব নিজের কাপড় চোপড় সব খুলে ফেলে আত্মীয়স্বজনের সামনে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে গেলেন। তারপর দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে গ্রিল ধরে ঝাঁকিয়ে পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘এই হারামজাদারা, তোরা কী দেখতে পাচ্ছিস না যে আমি পাগল? আমাকে তোরা পাগলা গারদে দিয়ে আয়। সেখানে মামুন আসবে রে কুত্তার বাচ্চারা, মামুন আসবে।’
বদ্ধ পাগল অবস্থায় ডাক্তার সাহেবকে হাত পা বেঁধে আবার পাগলা গারদে দিয়ে আসা হলো। সেখানে কড়া ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে তাকে অধিকাংশ সময় ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো। কখনো কখনো ঘুমের ওষুধেও কাজ হতো না। বিপজ্জনক রোগীদের জন্য নির্ধারিত লোহার দরজাওয়ালা আলাদা কেবিনে তার হাতে পায়ে লোহার শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। এভাবে মাস খানেক যাওয়ার পর চরম উন্মাদ অবস্থায় তার ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক হলো। মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের সাথে নানারকম শারীরিক জটিলতায় খুব দ্রুত তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। হাসপাতাল থেকে তার আত্মীয়স্বজনকে খবর দেওয়া হলে তারা পরদিন এসে তার লাশ নিয়ে গেল।
ওদিকে নানারকম আইনী জটিলতা এবং জেল কোডের নির্মম বিধি বিধানের গ্যাঁড়াকলে পড়ে জোড়া খুনের আসামী মামুনের মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা বিলম্বিত হতে লাগলো। তার বাবার মৃত্যুর কয়েক মাস পরে আত্মীয়স্বজনদের অক্লান্ত চেষ্টায় অবশেষে একদিন জেল কর্তৃপক্ষ তাকে কড়া পুলিশি প্রহরায় হ্যান্ডকাফ ও ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে পাবনার মানসিক হাসপাতালে স্থানান্তর করলো। বিপজ্জনক রোগীদের জন্য সেই লোহার দরজাওয়ালা নির্ধারিত কেবিনে ঠাঁই হলো তার। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের লোক ছাড়াও স্থানীয় থানার দু’জন করে পুলিশ পালাক্রমে কেবিনের দরজার সামনে বসে তাকে পাহারা দিতে লাগলো। প্রথম প্রথম মামুন খুব শান্ত থাকলেও একদিন সে কেবিনের দেয়ালে নখের আঁচড় কেটে লেখা নিজের নাম দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়লো। সে চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘এখানে আমার নাম লিখেছে কে? এই শয়তানের বাচ্চারা, মুছে দে। আমার নাম মুছে দে এখুনি। আমার কোন নাম নাই, তোরা জানিস না?’ তারপর গলার স্বর খাদে নামিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘জেলার সাহেব, ও জেলার সাহেব, আপনি কী আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? এই নামটা মুছে দিন না, প্লিজ!’
খুন করে ধরা পড়ার পর মামুন প্রথমে নিজের নাম ভাঁড়িয়ে অন্য নাম বলেছিল। পরে একটু একটু করে মানসিক ভারসাম্য হারাতে শুরু করলে জেলখানায় কেউ তার নাম ধরে ডাকলে সে জবাব দিত না। বেশি পীড়াপীড়ি করলে সে বলতো, তার কোন নাম নেই।
রচনাঃ ২৭-০৩-২০১৪
*********************************************************
Comments (24)
ছড়াটা অসাধারণ লাগল
অভিনন্দন--------
ধন্যবাদ! পাঠকের সাথে মিথষ্ক্রিয়াটা আকর্ষনীয় সবসময়।
অনেক ভাল একটা ছড়া। ছড়াবাজকে অনেক শুভেচ্ছা।
আপনার সামনে মেকাপ মাইরা আসে সাহস কত বালিকার