(গৃহবধূর বেতন কতো শীর্ষক ইস্যুভিত্তিক মাসিক মৌচাকে ঢিল পত্রিকার জুলাই ২০১১ সংখ্যায় এই লেখাটি প্রকাশিত। ব্লগার বন্ধুরা যারা এটি পড়েননি, তাদের জন্য ব্লগে প্রকাশ করলাম। ধন্যবাদ।)
আমাদের সময় এস এস সি পর্যায়ে এক ধরনের অংক করতে হতো যার নাম ছিল পাটিগণিত। আজকাল আর ছাত্রছাত্রীদের এই অংক করতে হয় না। সম্ভবত এই ডিজিটাল যুগে আদিকালের এই অংকের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। তাই গৃহবধূর বেতন কত হওয়া উচিৎ, তা’ হিসাব করার জন্য আমি বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি, জ্যামিতি ও ক্যালকুলাসের শরণাপন্ন হলাম।
প্রথমে বীজগণিতের কথা বলি। আমার দুটি বীজ অর্থাৎ দুই ছেলেকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, আপনাদের আম্মা তো খাঁটি গৃহবধূ। ঘর সংসারের কাজ ছাড়া আয় উপার্জনের কোন কাজ তিনি করেন না। কিন্তু ঘর সংসারের এসব কাজে তার অনেক পরিশ্রম হয়। তার এই পরিশ্রমের তো একটা পারিশ্রমিক বা বেতন নির্ধারণ করা উচিৎ, তাই না? এখন বীজগণিতের সেট ফাংশান, বহুপদী সমীকরণ, ম্যাট্রিক্স বা এই জাতীয় কোন অংকের সাহায্যে কি এই বেতন নির্ধারণ করা সম্ভব? আপনারা তো পড়ালেখার মধ্যে আছেন। নিশ্চয় আপনারা ভালো বলতে পারবেন। কি বলেন?’
বড় ছেলে বলল, ‘আম্মা কি তোমার সংসারে বুয়ার কাজ করে যে তাকে বেতন দিতে হবে?’ আমি বললাম, ‘না না, তা’ কেন? বুয়া তো আছেই। আমি বলতে চাচ্ছি......’
ছোট ছেলে বলল, ‘আম্মা কি তাহলে আমাদের এই সংসারে চাকরি করছে?’
বললাম, ‘না না, চাকরি করবে কেন? আমি বলতে চাচ্ছি.........’
বড় ছেলে বলল, ‘বেশ, আম্মা এই সংসারে চাকরি করছে না, বুয়ার কাজও করছে না। তাহলে এখানে আম্মার বেতন নির্ধারণের প্রশ্ন আসছে কেন?’
ছেলেদের মা বললেন, ‘রিটায়ারের পর তোমাদের আব্বা বাড়িতে বসে থেকে থেকে এ্যাবনরমাল হয়ে গেছে। কথায় বলে না, অলস মস্তিস্ক.....’ বাঁকিটুকু আমার সম্মান রক্ষার্থে তিনি আর বললেন না।
বীজগণিতে সুবিধা করতে না পেরে আমি ত্রিকোণমিতির আশ্রয় নিলাম। ত্রিকোণমিতি মানে তো ত্রিভুজের পরিমাপ। একদিন রিটায়ার করা আমরা তিন বুড়ো এক জায়গায় বসে গল্প করছিলাম। গৃহবধূর বেতন কত হওয়া উচিৎ এই চিন্তাটা আমার মাথায় সব সময়ই ছিল। তাই ছেলেদের কাছে বলা কথাগুলো পুনরুল্লেখ করে আমি এক বুড়োর কাছে জানতে চাইলাম, ‘আচ্ছা জামান সাহেব, এই বেতন কত হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?’
জামান সাহেব চাকরি জীবনে কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আমার মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ শঙ্কা প্রকাশ করে বললেন, ‘কি সব আবোল তাবোল কথা বলছেন? আমাকে এই উদ্ভট প্রশ্ন করে কোন লাভ আছে? আমার দুই পরিবার। সামান্য যা পেনশন পাই, তা’ দুই স্ত্রীকে ভাগ করে দিলে আমার প্রস্টেট, ডায়াবেটিস আর প্রেশারের ওষুধপত্র খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে গোরস্থানের দিকে রওনা দিতে হবে। যতো সব রাবিশ!’
বললাম, ‘আহা, রাগ করছেন কেন? মরতে তো একদিন হবেই। তাই বলে স্ত্রীর ন্যায্য পাওনাটা অস্বীকার করা কি ঠিক হচ্ছে, বলুন?’
আমাদের আরেক সদস্য কুদ্দুস সাহেবের দিকে ইঙ্গিত করে জামান সাহেব বললেন, ‘উনি অডিট অফিসের এ্যাকাউন্টস অফিসার ছিলেন। হিসাব নিকাশে দক্ষ লোক। ওনাকে জিজ্ঞেস করুন, উনি ভাল বলতে পারবেন।’
কুদ্দুস সাহেব বিজয়ীর হাসি হেসে বললেন, ‘আমার স্ত্রী অনেক আগেই ইন্নালিল্লাহ হয়ে গেছেন। সুতরাং তাকে বেতন দেয়ার ঝামেলা থেকে আমি মুক্ত। আমাকে এ হিসাব জিজ্ঞেস করে কোন লাভ নেই।’ হাঁ, ঠিকই তো। যার গৃহে বধূই নেই তাকে গৃহবধূর বেতন কতো জিজ্ঞাসা করে লাভ কি?
আচ্ছা গেল। এবার আমি শরণাপন্ন হলাম জ্যামিতির। এই শাস্ত্রে সরলরেখা, বৃত্ত, স্থানাংক, ভেক্টর ইত্যাদির মতো জটিল বিষয় আছে। তো আমি বেশি জটিলতার মধ্যে না গিয়ে সেরাতুল মোস্তাকিম অর্থাৎ সরলরেখা ধরে এগোনোর চেষ্টা করলাম। পুরুষ মানুষ কাজ করে বেতন পেলে তার স্ত্রী সংসারে কাজ করে বেতন পাবেন না কেন? না পেলে এক্স এক্স এবং এক্স ওয়াই ক্রোমোজোমের সমান্তরাল সরলরেখায় ভারসাম্যের অভাব দেখা দেবে। এমন হলে তো এক্স এবং ওয়াই অক্ষের সমান্তরাল সরলরেখার সমীকরণগুলো এই শাস্ত্র থেকে তুলে দিতে হয়। কিন্তু তা’ তো সম্ভব নয়। কাজেই আমার মনে হল এ ক্ষেত্রে আমার কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেতে পারে আমার প্রাণপ্রিয় চাচাতো শ্যালিকা সুমি (এক্স এক্স) এবং ততোধিক প্রাণপ্রিয় ভায়রাভাই সোহেল (এক্স ওয়াই)–এর কাছ থেকে। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে তারা আমার খুব কাছের মানুষ। আমার হাঁচি হয়েছে শুনলেও তারা কমলা লেবু আর কচি ডাব নিয়ে দেখা করতে চলে আসে। বাড়ি, গাড়ি, ধন-সম্পদে সমৃদ্ধ সুখী দম্পতি।
তত্ত্বগতভাবে আমার শ্যালিকা গৃহবধূ হলেও সে গৃহে খুব একটা থাকে না। শপিং, ক্লাব, পার্টি,চ্যারিটি এসব নিয়েই সে সারাদিন ব্যস্ত থাকে। আর আমার ভায়রা তার ব্যবসার সাথে সাথে হার মোস্ট ওবিডিয়েন্ট হাজব্যান্ড হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। এখানে ফ্রম এক্স ওয়াই টু এক্স এক্স একটা হ্যান্ডসাম রেমুনারেশন মাস শেষে হস্তান্তরিত না হয়েই যায় না। সুতরাং, আমার কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের সঠিক উত্তর এরাই দিতে পারবে।
কিন্তু বাস্তবে ফল হল উল্টো। ভায়রাভাই সোহেল হেসেই বাঁচে না। বলল, ‘ভাইজান, আপনি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন।’
‘না না, ঠাট্টা নয়। তুমি বোঝার চেষ্টা করো। জেন্ডার ইকুয়ালিটি বলে তো একটা কথা আছে।’ আমি যতই বোঝানোর চেষ্টা করি, সোহেলের হাসি ততই বেড়ে যায়। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি চলে এলো।
এদিকে শ্যালিকা সুমি এম এ পাস হলেও তার বুদ্ধি সুদ্ধি কম। আমার কথা শুনে সে ধরে নিল, তাকে তার বাসার কাজের বুয়াদের সঙ্গে আমি তুলনা করছি। সে গম্ভীর হয়ে বলল, ‘দুলাভাই, আপনার এই কথাগুলো যদি শালীর সাথে দুলাভাইয়ের ঠাট্টা মশকরা হয় তো কোন কথা নাই। আর যদি সিরিয়াসলি বলে থাকেন তো আপনার খবর আছে। বুড়ো বয়সে আপনার মতিভ্রম হয়েছে। আমাকে ও মাসে মাসে বেতন দিতে যাবে কেন? আমি কি ওর বাড়ির চাকর? আমার যখন যা টাকা পয়সার দরকার হয় তখন তা’ দিতে ও কখনো কার্পণ্য করে না। মাসে মাসে আমাকে ওর কাছ থেকে বেতন নিতে হবে কেন?’
পরিস্থিতি বিশেষ সুবিধার নয় দেখে আমি হাসি হাসি মুখে বললাম, ‘আরে না না, আমি তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিলাম। তুমি তো দেখছি তোমার বোনের মতোই ঠাট্টা তামাশা বোঝো না।’
এরপর আমি ক্যালকুলাসের আশ্রয় নিলাম। গণিতের এই শাস্ত্রে এক্স ও ওয়াই সংশ্লিষ্ট সমীকরণ থেকে ওয়াইকে সরাসরি এক্স-এর মাধ্যমে প্রকাশ করা না গেলে সেটি অব্যক্ত ফাংশনে পরিণত হয়। অর্থাৎ, ডিফারেন্সিয়েশন অফ ইমপ্লিসিট ফাংশন। এ ক্ষেত্রে আমি হতদরিদ্র গৃহবধূদের বেছে নিলাম। স্বামীদের চরিত্র এরাই সবচেয়ে ভাল বোঝে। এই শ্রেণীর গৃহবধূরা প্রতিনিয়ত দারিদ্র্যের কশাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলেও তাদের অব্যক্ত যন্ত্রণা প্রকাশ করতে পারেনা। করলে স্বামীর হাতে চড় থাপড় খেতে হয়। তাই গৃহবধূর বেতন কতো হওয়া উচিৎ তা’ এই শ্রেণীর গৃহবধূরা ভালো বলতে পারবে।
আমার বাড়ি থেকে কিছু দূরে এক বস্তিতে গেলাম। কিন্তু সেখানে খাঁটি গৃহবধূ পাওয়া এক সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। কেননা স্বামী ভ্যান চালায় তো বউ বুয়ার কাজ করে। আবার স্বামী তরিতরকারির ব্যবসা করে তো বউ রাস্তার ধারে বসে রুটি বানিয়ে বিক্রি করে। অনেক খুঁজে দুই একজন মেয়ে মানুষ পাওয়া গেল যারা শুধু স্বামীর রোজগারে খেয়ে না খেয়ে থাকে। তাদের আবার ছেলেমেয়ে অনেক। পোলট্রি শেডের মতো ছেলেমেয়ে ভর্তি ঘর। এই শ্রেণীর এক গৃহবধূকে প্রশ্নটি করতেই তিনি মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, ‘হ্যায় তো বৌ পোলাপানরে খাওনই দিবার পারেনা, আর আমারে দিব বেতন?’ আর একজন মহিলা বলল, ‘চাচার মতলব কি?’
সুবিধা হবেনা বুঝতে পেরে আমি মানে মানে কেটে পড়লাম।
সব অংক ব্যর্থ হওয়ার পর ফিরে যেতে হয় বিলুপ্তপ্রায় সেই আদিকালের পাটিগণিতে। সত্যি মিথ্যা জানি না, শুনেছি ব্রিটিশ আমলে টোল, পাঠশালা বা গুরুগৃহে খেজুরের পাটিতে বসে ছেলেমেয়েরা এই অংক করতো বলে এর নাম হয়েছিল পাটিগণিত। তবে তার আগে গৃহবধূর বেতন কতো হওয়া উচিৎ সে বিষয়ে আমার নিজের কিছু কথা বলে নিই। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, মাস শেষে স্ত্রীর হাতে কিছু টাকা তুলে দেয়া উচিৎ। চাকরিজীবী স্বামীর সাপ্তাহিক ও অন্য ছুটি ছাটা আছে, বুড়ো হলে অবসর নেয়ার সুযোগ আছে। ব্যবসায়ী স্বামীরও কর্ম অবকাশ আছে। কিন্তু গৃহবধূর এমন কোন ছুটি ছাটা, কর্ম অবকাশ বা অবসর নেয়ার সুযোগ নাই। মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত গৃহকর্ম থেকে তার রেহাই নাই। অসুস্থতাজনিত কর্মবিরতিই একমাত্র যতি চিহ্ন, যখন সে রোগ যন্ত্রণায় কাতরায়। যে ক্ষেত্রে প্রতি মাসে স্ত্রীকে দেয়ার মতো স্বামীর আর্থিক সামর্থ্য থাকেনা, সে ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে তা’ দেয়া উচিৎ। এবং সব ক্ষেত্রেই স্ত্রীর কষ্ট লাঘবের জন্য ঘর সংসারের কাজে স্বামীরও অংশগ্রহণ করা উচিৎ। স্ত্রী যদি একদিন মশারী টানায় তো পরদিন স্বামীর তা’ টানানো উচিৎ। স্ত্রী ব্যস্ত থাকলে বাচ্চার গোসল খাওয়ানোর কাজগুলো স্বামী করে দিতে পারে। ছুটির দিনে আসবাবপত্র মোছামুছি, বাথরুমের টাইলস পরিস্কার করা, বাগানে পানি দেয়া, বিছানা-বালিশ রোদে দেয়া এই কাজগুলো করে স্বামী তার স্ত্রীকে খানিকটা রিলিফ দিতে পারে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে ঘর সংসারের কাজকর্ম এভাবেই ভাগ করে করা হয়। এ লেখাটি তৈরি করার আগে লেখার বিষয়বস্তু সম্পর্কে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি কি তা’ সংক্ষিপ্ত পরিসরে জানার চেষ্টা করেছি। ফল প্রায় সব ক্ষেত্রেই নেতিবাচক। আমাদের পরিবার ও সমাজব্যবস্থা এখনো মধ্যযুগীয় চিন্তা চেতনায় আচ্ছন্ন। সবচেয়ে যেটা দুঃখজনক ব্যাপার, সেটা হল নারীরাও এ ব্যাপারে সচেতন নন।
সমাজের এই বাস্তবতাকে মাথায় রেখে আমি মনে করি, যে সব স্বামীর আর্থিক সামর্থ্য আছে তাদের উচিৎ স্ত্রীদের অবদানের যথাযথ মুল্যায়ন করে প্রতি মাসেই তাদের হাতে সম্মানজনক অংকের কিছু টাকা তুলে দেওয়া, যা হয়তো বিপদের সময় তার ও তার সন্তানদেরই কাজে লাগবে। কারণ নারীরা সাধারণত পুরুষদের তুলনায় বেশি সঞ্চয়ী মনোভাবাপন্ন।
আর যাদের সে সামর্থ্য নাই(জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে অধিকাংশ স্বামীই সংসারের প্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খান), তাদের উচিৎ আদিকালের সেই পাটিগণিতের সরল অংক অনুসরণ করে গৃহবধূর বেতন নির্ধারণ করাঃ-
(স্ত্রীর গৃহকর্মের যথাযথ স্বীকৃতি)+(গৃহকর্মে নিজেরও অংশগ্রহন)+(ভালোবাসা, বিশ্বাস ও সম্মানবোধ) –(ইনফিরিওরিটি ও সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স)=গৃহবধুর বেতন।
Comments (17)
শব্দ গুলো একসাথে হয়ে গেল কেন! পড়া যাচ্ছে না। এটা কি কারিগরী ত্রুটি?
এবার পড়া যাচ্ছে মনেঅয়।
আমারে এরকম একদিন হইছিল। এটা ব্লগের সমস্যা না।
এটা ব্লগের সমস্যা।
ভাই মনে হয় প্রতিযোগিতা পছন্দ করেন না।
না ভাই পছন্দ করিনা।